Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • শারমিন (পূর্বকথা)

    শারমিন (পূর্বকথা)

    শারমিনের যখন বিয়ে হয় তখন কতই বা ওর বয়স! টিনএজ ও পেরোতে পারেনি। হঠাৎ করেই বিয়ে হয়ে গেল। তমাল এফআরসিএস করতে বিলেতে যাবে। এমন সুপাত্র বাবা হাতছাড়া করতে চাইলেন না। মাসের শেষ বিষুদবারে বিয়ের একটা ভাল দিন দেখে পাকা কথা দিয়ে দিলেন। পন হিসেবে মাত্র দুই! লাখ টাকা। এমন পাত্রের জন্য এটা কিছুই না। আর শারমিনটাও কেমন! কোন প্রতিবাদ নাই। দিব্যি রাজি হয়ে গেল!

    আমরা সারারাত খেটে কলাপাতা, নারিকেল পাতা আর বাশের চাটাই দিয়ে বিয়ে বাড়ির তোরন সাজিয়ে ফেললাম। গেটের কাছে গুঁজে দিলাম একগুচ্ছ লাল গোলাপ। সেটা অবশ্য মমিনুদ্দীদের বাড়ি থেকে চুরি করা। সে আর এক কাহিনী।

    গেটের ছবিটা তুলে রেখেছিলাম। এতদিনেও স্মৃতিটা রয়ে গেছে!

    চলবে…

  • পড়ন্ত বিকেল (শেষ পর্ব-৬)

    চমকে পিছনে ফিরে তাকালো নদী। তখন পড়ন্ত বিকেল। নদী দেখলো, ছেলেটি দাঁড়িয়ে আছে তার পিছনে। ছেলেটির গায়ে ঠিক এই রঙের একটি শার্ট ছিলো। জিন্সের প‍্যান্ট। ছেলেটি কোন ভূমিকা না করেই সরাসরি বললো, নদী আমি তোমাকে ভালোবাসি। নদী যেন কিছুই বুঝতে পারছেনা। নদী বলে উঠেছিলো কি বলছেন? আমি তোমাকে ভালোবাসি। নদীর হাতটা ধরে বলেছিলো, আমি প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে নদী। বিশ্বাস করো, কিভাবে কি হলো, কখন থেকে হলো আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিনা এবং তোমাকেও বুঝাতে পারবোনা। নদীর মনে হচ্ছে সে পড়ে যাবে। এই প্রথম কোন ছেলের কাছ থেকে ভালোবাসি শব্দটা সে শুনছে। মাএ কিছু সময়ের জন‍্য সে স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলো। পর মুহূর্তেই এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে বাসায় এসে নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ বসেছিলো সে। পরদিন বিকেলে ছেলেটি তার জানালা দিয়ে একটি সাদা খাম নদীর পড়ার টেবিলে ফেলে গিয়েছিলো সবার অগোচরে। নদী অন‍্যঘর থেকে এসে টেবিলে বসতেই খামটি চোখে পড়েছিলো। খামটির উপরে শুধু লেখা ছিলো নদী। নদী খামটি খুলতেই কিছু লাল গোলাপের পাপড়ি আর নীল রঙের একটি চিঠি পেয়েছিলো। চিঠিতে লেখা ছিলো, ভালোবাসি ভালোবাসি। পূরো পাতাটা জুড়েই। শেষে লেখা ছিলো, প্লিজ উওর দিও। সেদিন নদী সারারাত জেগেছিলো আর মাঝে মাঝেই টিঠিটা পড়ছিলো। কিন্তু কি লিখবে সে? পরদিনও ছেলেটি দুপুরে সরাসরি তাদের আঙ্গিনাতে এসেছিলো। মাকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে বলেছিলো, আমি কি একটু আচার খেতে পারি? উঠোনে এতো আচার দেখে খুব লোভ হলো। মা বলেছিলো, তুমি দেলোয়ার ভাবীর ছেলে না? মাথা ঝাঁকিয়েছিলো। মা বলছিলো, এসো বাবা, ঘরে বসে খাও। ছেলেটি বলেছিলো, একটা বাটিতে দেন, বাসায় নিয়ে যাবো। মা বলেছিলো, ঠিক আছে। আমি বাটি আনছি। নদী সবই শুনছিলো এবং জানালা দিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ ছেলেটি একটি চিঠি জানালা দিয়ে নদীর টেবিলে রেখে বললো, আজই জবাব টা দিবে কিন্তু। আমি তোমার জবাবের অপেক্ষায় আছি। সন্ধ্যায় হাঁটতে আসবে তো? নইলে এখুনি কিছু বলো প্লিজ। নদী তাড়াতাড়ি বলেছিলো, প্লিজ যান এখান থেকে। মা দেখবে। তাছাড়া আপনাদের বারান্দায় আপনার বাবাকে দেখছি। যান। ছেলেটি বেশ সাহসের সাথে বলেছিলো, বেশতো দেখুক বাবা। ভালোবাসি তোমাকে এবং তোমাকেই বিয়ে করবো। নদী বলেছিলো, আমি জবাব দিবো কিন্তু এখন দয়া করে যান এখান থেকে। মা বাটি ভর্তি করে আচার দিয়েছিলো। কিন্ত পরদিন সকালেই ছেলেটির বাবা নদীদের বাসায় এসে নদীর বাবাকে যা ইচ্ছে তাই শুনিয়েছিলেন। মেয়েকে লেলিয়ে দিয়েছেন আমার ছেলের পিছনে। চিঠি চালাচালি করাচ্ছেন, আচার খাওয়ানোর নাম করে বাসায় পযর্ন্ত নিয়ে এসেছেন। এমন আরো অনেক নিন্মমানের কথা বলছিলেন ভদ্রলোক, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে। নদী বাবা কিছুই বুঝতে না পেরে হতভম্ব হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাঁকিয়েছিলেন। নদী পাশের ঘর থেকে এসে তখন বলে উঠেছিলো, আপনার ছেলেই আমাকে চিঠি দিয়েছে। আমি কিছুই করিনি। তাকেই জিজ্ঞেস করুন। ছেলের বাবা বললো, সে একটু আগেই ঢাকা চলে গিয়েছে। এতোটুকু মেয়ে, এতো সাহস তোমার? আমার ছেলে কদিন পরেই বিদেশে যাবে। কি ভেবেছিলে? একবার পটাতে পারলেই হলো। ব‍্যাস। একেবারে রাজরানী। নদীর মা হাতজোড় করে বলেছিলো, আমি বিশ্বাস করি আমার মেয়ে এমন কাজ করতেই পারে না। তাছাড়া কাল আপনার ছেলেই এসে আচার চেয়েছিলো। নদীতো তার ঘরে ছিলো। থামুন থামুন। আপনাদের মতো লোকদের আমার জানা আছে। চোরের মার বড় গলা। মা কেঁদে দিয়ে বলেছিলো, দয়া করে আপনি যান ভাই। আশেপাশের বাসার লোকেরা শুনবে। চলে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক, তবে এটাও বলেছিলেন, তারা কোনদিনও নদীকে ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করবে না, নদী দেখতে যতোই সুন্দর হোক না কেন। মা কেঁদে বলেছিলো, তোর মতো মেয়েকে পেটে ধরেছিলাম আমি? ছি। আজ থেকে কোথাও যেতে পারবিনা আমাদের অনুমতি ছাড়া। সাতদিনের ভিতরে দেয়াল উঠেছিলো পূরো সরকারি জায়গাটায়। আশেপাশের লোকেরা চেঁচামেচি করলেও কাজ হয়নি। বলা হয়েছিলো, সরকারি রাস্তা কেবল সরকারি লোকজনেরাই ব‍্যবহার করতে পারবে। কদিনপর বেলা নদীদের বাসার পিছন দিয়ে এসে একটা চিঠি চুপ করে নদীর হাতে দিয়েছিলো। তাতে ছেলেটির ঠিকানা লেখা ছিলো এবং টেলিফোন নাম্বার ছিলো। আরো লেখা ছিলো, ছেলেটি নদীকেই আজীবন ভালোবাসবে। শুধু নদীর উওরের অপেক্ষায় আছে সে। নদী যেন বেলাদের বাসা থেকে ফোন করে তাকে। তার হাতে সময় খুব কম। সে বিদেশে যাবার আগে একবার শুধু নদীর উওরটা জানতে চায়। পরিবারের বিপক্ষে যেতে হলে তাই যাবে সে। নদী যেন উওর দেয়। নাহ্। নদী উওর দেয়নি এবং ফোনও করেনি। নদীর বাবা, নদীকে বলেছিলেন, তোর জন‍্য জীবনে আজ প্রথম অপমানিত হলাম আমি। ছি ছি ছি। বাবার ছি ছি শব্দটি এবং ছেলেটির বাবার নিন্মমানের কথাগুলো, মায়ের কান্না, সব, সব তীরের মতো নদীর মনে বসে গিয়েছিলো। আগের দুটো চিঠিই সে ছিঁড়ে ফেলেছিলো। একেবারেই মন থেকে মুছে ফেলেছিলো ছেলেটিকে। বেলাকে বলেছিলো, ছেলেটির চিঠি বেলা যেন আর তাকে না দেয়। বেলার কাছে চিঠি এসেছিলো, একটার পর একটা। বেলাই তাকে দিতে আসতো চিঠি আসলেই। কিন্তু প্রতিবারই নদী বেলাকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং চিঠিও নেয়নি। অবশেষে নদীই, বেলাকে বলেছিলো, জানিয়ে দিস তাকে, আমার জবাব না। বেলা বলেছিলো, ঠিক আছে, তাহলে আমিই জানিয়ে দিবো চিঠি লিখে, আর যেন তোকে চিঠি না দেয় এবং তোর উওরটাও। এদিকে বাবা, দাদাকে এবং দুলাভাইকে বলেছিলো, নদীর জন‍্য ছেলে দেখতে। যেভাবেই হোক পাএ পেতে হবে। নদী বারবার অনুরোধ করেছে বাবাকে। কারণ তার ইচ্ছে পড়াশুনা শেষ করে চাকুরী করবে। কিন্তু বাবাকে মানাতে পারেনি নদী। কাউকেই মানাতে পারেনি। পরীক্ষার পর দাদা সরাসরি মোস্তাককে নিয়ে তাদের বাসায় এসেছিলো। সাথে আপা, দুলাভাইও ছিলেন। মায়ের নীল রঙের তাঁতের শাড়ি পড়িয়ে নদীকে সামনে নিয়ে এসেছিলো। মোস্তাক দাদার অফিসেই চাকুরী করতো। নদীকে দেখেই মোস্তাক সম্মতি দিয়ে দিয়েছিলো বিয়ের। নদীদের বাসার কেউ নদীর মতামতও জিজ্ঞেস করেনি। দাদার বিয়ের জায়গায় পরীক্ষার দুইমাস পর নদীর বিয়ে হয়ে গেলো মোস্তাকের সাথে। বিয়ের পর নদীর একটাই অনুরোধ ছিলো মোস্তাকের কাছে, সে পড়াশুনা করতে চায়। চাকুরী করতে চায়। বাঁধ সেধেছিলেন, তার শাশুড়ি। কিন্তু মোস্তাক কথা দিয়েছিলো নদীকে। তাই ঢাকা এসেই নদীকে ভারসিটিতে ভর্তি করে দিয়েছিলো। মোস্তাক অনেক করেছে নদীর জন‍্য। নদী আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে মোস্তাকের কাছে এজন‍্য। কজন স্বামী কথা রাখে? নদী অর্নাস পাশ করেই চাকুরী পেয়ে গিয়েছিলো। তার একবছর পর খোকা এসেছিলো তাদের ঘরে। নদী কোনদিনও মোস্তাককে এই কথা বলেনি। কারণ বলার মতো কিছু কি ছিলো? তখন নদীর পৃথিবীটা জুড়ে শুধুই মোস্তাক, খোকা, চাকরি, এবং সংসার। এতোবছরেও একটিবারের জন‍্যও নদী অতীতের কথা মনে করেনি এবং মনে করার মতো সময়ও তার ছিলো না। নদী দুচোখ বন্ধ করে ছেলেটির মুখটা মনে করার চেষ্টা করলো। ফর্সা, লম্বাটে, মাথাভর্তি ঝাকড়া চুল, গায়ে কালচে খয়েরী রঙের শার্ট কিন্তু কিছুতেই মুখটা মনের আয়নায় ভাসছে না। নদী পাগলের মতো চেষ্টা করছে মুখটা ভাসাতে। আসছে না, আসছে না, মনের আয়নাতে। বয়সের সাথে সাথে ছেলেটির মুখটাও ঝাপসা হয়ে গেছে। নদী প্রবলভাবে চেষ্টা করছে কিন্তু বারবার ব‍্যর্থ হচ্ছে। ভালোবাসি, প্রচন্ড ভালোবাসি শব্দটা নদীর কানে বাজছে। নদী তখন আর নদীর ভিতরে নেই। সে তখন কিশোরী নদী হয়ে গেছে। এই পড়ন্ত বয়সেও একটা অন‍্যরকম ভালোলাগায় নদীর সমস্ত শরীরটা যেন শিহরিত হয়ে উঠছে বারবার । কতক্ষণ চলে গেছে নদী জানে না। হঠাৎ মিতালির ডাকে নদী চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো, পড়ন্ত বিকেলর শেষ আলোটুকু বারান্দায় পড়েছে। সন্ধ‍্যা হবে একটু পরেই। মিতালি মাকে ঝাঁকুনি দিয়ে বললো, মা কি হয়েছে তোমার? তোমার সমস্ত মুখ, এমন লাল হয়ে গেছে কেন? তুমি ঠিক আছো তো? নদী তাড়াতাড়ি হাতের সুয়েটারের সূতাটা বাক্সে ছূঁড়ে ফেলে দিয়ে বললো, কি হবে আমার? কিছু নাতো। মিতালি বললো, বাবা তোমাকে ডেকে অস্থির হচ্ছে, চা খাবে। নদী তাড়াতাড়ি বেডরুমে এসে মোস্তাকের দিকে তাকিয়ে জীবনে এই প্রথমবারের মতো কঠিন গলায় বললো, চেঁচিয়ে সারা পাড়া জানান দিচ্ছো কেন? একটা বেলাকি আলোর হাতের চা খেতে পারো না? মিতালিকে বললেও তো পারতে? সবকাজে আমাকেই কেন দরকার। আমার নিজের জন‍্য একটু সময়ও কি আমি পাবো না কোনদিনও? এযেন এক অন‍্য নদী। মোস্তাক মুগ্ধ চোখে নদীকে দেখে ফিসফিস করে বললো, বাহ্, রাগলে তো তোমায় বেশ লাগে। আগে কখনোই তুমি রাগ করোনি। গালগুলোতে যেন রক্ত জমে গেছে। এখন থেকে মাঝে মাঝেই এভাবে রেগে যেও। অপূর্ব লাগছে, এই বয়সেও আজ তোমাকে। নদী বললো, তাই করবো এখন থেকে। ছেলেমেয়ে, সংসার, তুমি, আর ভাববো না এতোকিছু। আর বিয়ের এতো বছর পর তোমার মনে হলো, আমি সুন্দর? আগে চোখে পড়েনি? মোস্তাকের চোখে তখনও মুগ্ধতার ঘোর। এতোবছর পর নদীকে যেন নতুন করে দেখছে এইরূপে। এতো সুন্দর নদী? একটু কাছে আসবে নদী, বিড়বিড় করে বললো মোস্তাক। যওোসব বাজে কথা বলতে তোমার জুড়ি নেই। এই বলে নদী তাড়াতাড়ি কিচেনে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ছি ছি। আজ এতো বছর পর তার কি ভীমরতি ধরেছে? কিসব আবোলতাবোল চিন্তা করছিলো সে? সে কি ধরা পড়ে গেছে মিতালি অথবা মোস্তাকের কাছে? তাড়াতাড়ি গ‍্যাসের চূলোয় নদী চায়ের পানি বসিয়ে দিলো। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখলো, আকাশটা আজ যেন সেই পড়ন্ত বিকেলের মতো একই রঙে সেজেছে। চারপাশে সন্ধ‍্যা নামছে। ভালো লাগছে দেখতে আকাশটাকে। ভালো লাগছে ছেলেটির কথা মনে করতে। চা হয়ে গেছে। যাক। গ‍্যাস বন্ধ করলো নদী। সে আজ অন‍্য নদী। একটুখানি সময় আজ নদী তার জন‍্য রাখতে চায়, সব দায়িত্ব ভূলে। কিন্তু কেন? সেইরাতে নীল রঙের চিঠিটা শান্ত নদীকে কি খরশ্রোতা নদীতে পরিণত করেনি? সারাটারাত কেন সে চিঠিটা পড়ছিলো একটু পর পর? তারমানে সেও কি ভালোবেসেছিলো ছেলেটিকে? প্রশ্নগুলো নদী নিজেই নিজেকে করলো। উওরটাও শুধু নদীই জানে। আযানের সুমধুর ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হচ্ছে। নদী এক ঝটকায় যেন বাস্তবে চলে আসলো। নামাজ পড়তে হবে, ধীর গতিতে নদী হেঁটে যাচ্ছে। নদীর চোখে জল।

    (সমাপ্ত)

    সাবিহা খান, লন্ডন

  • পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-৫)

    সন্ধ্যায় মোস্তাক অফিস থেকে এসে চা না খেয়েই প্রতিদিনের মতো বাসার সামনের খোলা মাঠটায় হেঁটে আসলো। আজ সকালে হাঁটা হয়নি। কারণ নদী ডাকেনি। নদী নামাজ পড়েই সকালে ব‍্যস্ত ছিলো রান্নাঘরে। কথা ছিলো ইমন আসবে। দুপুর পর্যন্ত একগাদা খাবার রান্না করেছে সে। ইমন দুপুরে খেয়েই চলে গিয়েছিলো। তাই রান্নার চিন্তায় একদমই ভূলে গিয়েছিলো ডাকতে। এটা নদীর অন‍্যায়ই হয়েছে, মনে মনে নিজেকেই অপরাধী ভাবছিলো। বেচারা আজকের নামাজটাও পড়তে পারেনি। হেঁটে এসে ফ্রেস হলে চা দিলো নদী কিছু হালকা নাস্তার সাথে। নাস্তা খেতে খেতেই মিতালি বাবাকে বললো, দেখো না বাবা, মা, আমার মেয়েকে একটা সুয়েটার বানিয়ে দিচ্ছে না। মোস্তাক বললো, তোর মা ইচ্ছে করলেই পারে। গতবছর একগাদা নানা রঙের সুয়েটারের সূতো এনে দিয়েছি। তাছাড়া আগেরও অনেক সূতো আছে তো মনে হয়। আর কিনে দিবো না। আজকাল হাতের তৈরী সুয়েটার পড়তে ভালো লাগে না। বউমা ঠিকই বলেছিলো। নদী বুঝতে পারলো, এসব সব সকালের রাগ। নদী পরিবেশটা বদলে দেবার জন‍্য হেসে বললো, বেশ তো এখন থেকে আমেরিকা আর কানাডার তৈরী সুয়েটার পড়ো। তারপর মিতালির দিকে তাকিয়ে বললো, আছে সূতো। কিন্তু ডিজাইনটা তো বলে দে। মিতালি বললো, মা তুমি আমাকে একটা বড় ফ্রক বানিয়ে দিয়েছিলে অনেক রঙ মিশিয়ে, মনে আছে? ঠিক তেমনি একটা মুচকানকেও বানিয়ে দাও। নদী বললো, অনেক সময়ের ব‍্যাপার রে। আমি ভাবছিলাম দুটো রঙ মিশিয়ে কিছু একটা বানিয়ে দিবো। মোস্তাক নাতনিকে কোলে নিয়ে কিছুটা বিরক্তির স্বরেই বললো, এইটুকু বাচ্চার একটা ফ্রক, কতোইবা সময় লাগবে তোমার? নদী বললো, সময় লাগবে কারণ মিতালির ডিজাইনটা বেশ কঠিন ছিলো। তাছাড়া একটু বড় করে বানিয়ে দিলে বেশ কিছুদিন পড়তে পারবে। মিতালি নদীর দিকে তাকিয়ে পায়েস খেতে খেতে বললো, কোন প্রয়োজন নেই মা। ছোট করেই বানিয়ে দিও। মোস্তাকের কোল থেকে নাতনিকে কোলে নিয়ে নদী বললো, ঠিক আছে, বানিয়ে দিবো। মনে মনে ভাবলো, অফিসের ঝামেলাটা নেই এখন। বিকেলে তো বসেই থাকি। তাছাড়া অনেক রাত পর্যন্তও যদি বুনি তাহলে ঠিকই হয়ে যাবে। মুখে বললো, তবে আজ আর হাত দিবো না। কাল দিনের আলোতে দেখবো কোন রঙটার সাথে কোন রঙটা যায়। নদী বললো, আজ কিছু আচার করবো মিতালির জন‍্য। মিতালিকে দিয়ে দিবো সাথে। মিতালি বললো, আচার বানাও। খেয়ে যাবো কিন্তু সাথে আমি একটা আচারের বোতলও নিবো না কিন্তু। তোর তো আমার হাতের আচার খুব পছন্দ রে। তাই ভাবছিলাম, নদীকে থামিয়ে দিয়ে মিতালি বললো, মা ফ্রকটাই বানিয়ে দাও। স্মৃতি থাকবে আমার মেয়ের। নদী আচার বানাতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লো। আচার বানাতে বানাতে নদী ভাবলো, শুধুই স্মৃতির জন‍্য সুয়েটার বুনবে? ভালো। তাও মিতুটা তার স্মৃতি তো রাখতে চাচ্ছে। খোকাতো হয়তো তাও রাখবে না। রাতে ঘুমানোর সময় ঘড়িটা এ‍্যালার্ম দিয়ে রাখলো। আজ মোস্তাক বেশ রেগেছে নদীর উপর। কারণ নদীর সাথে মোস্তাক প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া একটি কথাও বলেনি, যা অন‍্যদিন বলে।। নদী ভাবলো, এই দীর্ঘ সংসারজীবনে আজই প্রথম সকালে ডাকতে একদমই ভুলে গেছি আর তাতেই এতো অভিমান? মোস্তাকের গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে ভাবলো নদী, মিতালি ঠিকই বলেছে, বড্ড ভূলো মনের হয়ে গেছে নদী। বয়স হয়ে গেছে তার।পরদিন দুপুরের পর সুয়েটারের সূতোর বাক্সটা নিয়ে নদী তার প্রিয় পিছনের বারান্দায় বসলো। অনেক রঙের সূতো। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। বেশিরভাগ কোন রঙটা দিবে? শেষমেশ গোলাপী রঙটাই বেছে নিলো নদী। কিন্তু তার ভিতরে কোন কোন রঙ থাকবে? একটা করে সূতো নিয়ে গোলাপী রঙের সাথে ধরছে। নীল রঙটা বেশ ফুটছে। কিছু হলুদ এবং লাল রঙও নিলো। কিন্তু অনেক রঙ দিয়ে মিতালির ফ্রকটা বানিয়েছিলো সে। তাই আরো কিছু রঙ দরকার। সবুজ রঙটা? হঠাৎ একটা রঙের সূতো নিয়ে নদী যেন খানিকটা চমকে উঠলো। এই রঙটা কোথায়, কোথায় দেখেছে সে? ঠিক খয়েরীও নয়, একটু কালচে খয়েরী রঙ…….

    নদী যেন নিজের অজান্তেই ফিরে গেলো ঠিক চল্লিশ বছর আগে। তাদের বাসার সামনাসামনি সরকারি অনেক বাসা ছিলো। নদী তখন সবে কলেজের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুদিন পরেই পরীক্ষা। কলেজ বন্ধ দিয়ে দিয়েছে। বাসাতেই পড়ছে সবাই। নদীও সারাদিন পড়াতেই ব‍্যস্ত থাকে। রেজাল্ট ভালো না হলে ভারসিটিতে ভর্তি হতে পারবে না। গতকাল ঘর থেকেই বের হয়নি সে। যদিও সে প্রতিদিনই হাঁটে। সেদিনও সন্ধ‍্যার আগে নদী হাঁটছে তাদের বাসার সামনের সরকারি কোয়াটারের চিকন রাস্তাটায় আর সারাদিন যা পড়েছে তা যেন আপন মনেই পুনরায় ঝালাই করছে মাথায়। বাসায় ফেরার সময় হঠাৎ নদী দেখলো ঝাকড়া চুলের একটি ছেলে তাদের বাসার ঠিক সামনের বাসার বারান্দায় বসে গিটার বাজাচ্ছে। কখনো দেখেনি নদী এই ছেলেটিকে। ইংরেজি গানের সুর তুলছে। নদীর প্রিয় গান। প্রায়ই সে এই গানটি শুনে। নদী সহসাই নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ছেলেটি হেসে নদীর দিকে তাকিয়ে বললো, ঠিক বাজাচ্ছি তো? নদী কিছুটা থমকে গিয়ে বলেছিলো, হ‍্যাঁ। একদম ঠিক। ছেলেটি তাকে আরো অবাক করে দিয়ে বললো, প্রায়ই এই গানটি তোমাদের বাসায় বাজে। সরি তুমি বলে ফেললাম। নদী তাড়াতাড়ি বললো, ঠিক আছে। কে শুনে? আবার প্রশ্ন। নদী আপনমনেই বলেছিলো, আমিই শুনি। হুম, আমি দেখি প্রতিদিনই তুমি জানালার পাশে টেবিলে পড়ছো। এতো কি পড়ো? আমার পরীক্ষা যে সামনে। ওহ্ সরি। আমি জানতাম না। আগে কোনদিন দেখিনি কেন তোমাকে? আবার প্রশ্ন। আমাদের বাসা তো এখানেই ছিলো নদী অবাক হয়ে বলেছিলো। তাহলে হয়তো লক্ষ‍্য করিনি। অবশ‍্য আমি এখানে থাকি না। ঢাকায় থাকি। ভারসিটির পরীক্ষা শেষ, তাই ঘুড়তে এসেছি বাবা মায়ের কাছে। দশদিন হলো আমি দেখছি, প্রতিদিন সন্ধ‍্যার আগে তুমি আপন মনেই হাঁটো একা একা এই রাস্তাটায়। মনে হয় এদিকে প্রাচীর তুলে বন্ধ করে দিবে। সব ফাইনাল হয়ে গেছে শুনলাম। নদীর কোন মাথা ব‍্যাথা নেই। তুললে তুলুক প্রাচীর। যদিও সরকারি কোয়াটারের ভিতর দিয়ে যে রাস্তা সেটাই তারা বেশিরভাগ ব‍্যবহার করে। এর কারণ খুব সহজেই মেইন রোডে চলে যাওয়া যায় অল্প সময়ে। তবে নদী চলে যেতো তাদের বাসার পেছনের রাস্তা দিয়ে। পাড়ার সব মেয়েদের সাথে দল বেঁধে কলেজে যায়। কোন প্রাচীর না থাকাতে সরকারি কোয়াটারের সব বাসাগুলি দেখে তারা এবং কোয়াটারের একটি মেয়ের সাথে নদীর বেশ ঘনিষ্ঠতাও আছে। কারণ নদীর সাথেই পড়ে সে। বেলা। নদীর বেশ খারাপ লাগলো কথাটা শুনে। শহরের বড়চাইতে বড় শাড়ির দোকানটা নদীদের। কোয়াটারের সব মহিলারা দল বেঁধে তাদের দোকানে যায় শাড়ি কিনতে এবং তাদের বাসায়ও আসে। মায়ের সাথে বেশ আড্ডা হয় তাদের। নদী আর কথা বাড়ালো না, চলে এসেছিলো ওখান থেকে। কিন্তু এরপর থেকে সে পড়তে বসলে সামনে তাকালেই দেখতো ছেলেটি বেতের চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের বাসার দিকে। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতো সে। নদী জানালার পর্দাটা টেনে দিতো। কিন্তু মা এসেই আবার পর্দা সরিয়ে দিয়ে বলতেন, দিনেরবেলা অন্ধকার করে রেখেছিস কেন ঘরটাকে। নদী কিছুই বলতে পারতো না। বড়ভাইয়া সবে চাকুরীতে ঢুকেছে। সেও ঢাকাতেই থাকে। নদী পরীক্ষা শেষ করেই ঢাকা যাবে বেড়াতে বড়বোনের বাসায়। দুলাভাই ব‍্যাংকে চাকুরী করেন। দুইবোন মিলে দাদার বিয়ের বাজার করবে। দাদার জন‍্য মেয়েও ঠিক করা হয়ে গেছে। নদীর পরীক্ষার কিছুদিন পরেই বিয়ে। নদী দুদিন বাসা থেকে বের হলো না। দুদিন পর নদী গিয়েছিলো কোয়াটারের বেলাদের বাসায়। বেলার সাথে বেশ কিছুক্ষণ পড়াশুনা নিয়েই কথা হলো। বেলাও পরীক্ষা দিবে তার সাথে। অংকে ভিষণ কাঁচা। কিছু অংকও সে বুঝিয়ে দিলো বেলাকে। তারপর বাসার দিকে আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে শুনলো, এই শুনো। শুনছো?

    চলবে…

    সাবিহা খান, লন্ডন

  • পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-৪)

    মিতালি চারদিন পর এসেছে মিরপুর থেকে। এসেই প্রতিদিনই কারো না কারো বাসায় যাচ্ছিলো। আজ কোথাও যাবে না মিতালি। আসার পর থেকে মার সাথে বসে কথা বলাই হচ্ছিলো না। আলো খুব মজা করে কাঁচা আমের ভর্তা করে দিয়েছে মিতালিকে। মিতালি আম ভর্তা খেতে খেতে বললো, মা ফ্ল‍্যাটটা খুব সুন্দর করে সাজিয়েছো তুমি। বাবা তো ভিষণ অগোছালো। নদী রান্নাঘরে রান্না বসিয়ে দিয়েছে। মাংসটা ভুনতে ভুনতে বললো, আর সাজানো এই বয়সে। হ‍্যাঁরে মিতু, খোকা ছবি তোর কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে আমেরিকা থেকে? মিতালি বললো, মা তুমি আজকাল খুব ভুলো মনের হয়ে গেছো। তোমাকে বলেছিলাম না, ভাইয়ারা আসবে কানাডা? নদীর মাংস ভুনানো শেষ তাই মাংসে পানি দিয়ে এককাপ চা নিয়ে রান্নাঘরের সাথে লাগোয়া প্রাইভেট সিটিংরুমে বসে বললো, হ‍্যাঁ বলেছিলি তো। কিন্তু কবে আসলো খোকা, কিচ্ছুতো জানাসনি। মিতালি হাতটা ধূয়ে মার কাছে বসে বললো, ইচ্ছে করেই বলিনি। তোমার আদরের বউমা কানাডা আমার বাসায় এসেই নাক সিঁটকে বলেকি, ওমা এতো ছোট বাসায় তোমরা থাকো কি করে? আমিও সাথে সাথে বলে দিয়েছি, বাসাটা আসলেই খুব ছোট কিন্তু আমাদের জন‍্য ঠিক আছে, তোমার সমস্যা হলে হোটেলে গিয়ে থাকতে পারো। ভাইয়া তখন বেশ রেগে গিয়েছিলো ভাবীর উপর। অথচ জানো মা, আমাদের বেডরুমটাই ভাইয়াদের ছেড়ে দিয়ে আমরা পাশের ছোট রুমটাতেই ছিলাম। ভাইয়া এসেই আমার কাছে ছবিটা দিয়ে বললো, মাকে দিস এবং এও বলেছিলো, তোর ভাবীকে আবার দেখাসনে কিন্তু। তারপর একটু বলেছিলো, মা বানিয়েছিলো দেশে যখন গেলাম কিন্তু দিপ্তীকে তো তুই জানিস। আর মাও আছে… আমরা পড়েছি ছোটবেলায় সেটা আলাদা কিন্তু এখন আমাদের বাচ্চাদেরও সুয়েটার বানিয়ে দিতে হবে কেন? তখন বাবাকে ফোন করে বাকীটা জেনে নিয়েছিলাম। তুমি তো কিছুই বলবে না। সেটা আমি জানতাম। ফ্রেমে বাঁধিয়েই নিয়ে এসেছিলো ছবিটা। ছবিতে দেখোনি, পার্কে গিয়ে ছবিটা তুলেছে চুপিচুপি। তোমার ছেলে একদম বউয়ের গোলাম। কানাডা এসে ভাবিকে নিয়ে শুধু ঘুড়াঘুড়ি করেছে। একদন্ড সময়ও আমাকে বা ইমনকে দেয়নি। পাঁচদিন ছিলো। একদিন শুধু রাতে খাবারের সময় বলেছিলো, তোমরা নাকি এই বয়স ফ্ল‍্যাট কিনে ভূল করেছো। আরো বললো, ভাড়া বাসাতেই থাকতো মা বাবা। কি প্রয়োজন ছিলো ফ্ল‍্যাট কেনার? আমি আমেরিকাতে বাড়ি কিনছি। বরং টাকাটা পেলে কিছুটা এগিয়ে যেতাম। আমি বলেছি, বাবা মার প্রয়োজন না একটা ফ্ল‍্যাটের? আজীবন তো ভাড়া বাসাতেই কাটালো। যখনই একটা জায়গা ঠিক করলো অমনি তুই বায়না ধরলি আমেরিকা যাবি। জায়গাটা তো তোর কারণেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো। তাই এখন ছোট্ট একটা ফ্ল‍্যাট কিনেছে। তাছাড়া তোর কাছে তো কোন টাকাও চাইনি রে ভাইয়া। উল্টো আমাকে বলেকি, তাই বলে ছেলেমেয়েদের সাথে পরমর্শ করবে না? একটাবার বলেওনি ফ্ল‍্যাটের ব‍্যপারে, মা বাবা আমাকে জানিস? পূরোই স্বার্থপর একটা ছেলে ভাইয়া। আমিও বলে দিয়েছি, ভাইয়া, মা বাবা অনেক করেছেন আমাদের জন‍্য। এখন শেষ বয়সে তাদের আর যন্ত্রণা দিসনা। ফ্ল‍্যাটের কথাটা ভাইয়া ভাবীর সামনেই তুলেছিলো। ভাবীর মুখটা দেখার মতো ছিলো। কারণ বসে বসে তোমার গাধা ছেলের সাথে তাল মিলাচ্ছিলো যে। ওহ্ আমার জন‍্য এই সেটটা এনেছিলো। দাঁড়াও দেখাচ্ছি। নদী চা খাওয়া শেষ করে রান্নাঘরে মাংসটা দেখে আসলো। আর একটু পানিটা কমবে। অফিস থেকে কদিনের ছুটি পাওনা ছিলো নদীর। তাই মেয়ের জন‍্য রেখে দিয়েছিলো নদী। মিতালি এসে বললো, দেখো তোমার সোনার ছেলে কি দিয়েছে বোনকে। নদী দেখলো, একটা লকেট লাগানো পাতলা চেইন। মিতালি বললো, ইমনকে একটা ঘড়ি দিয়েছে, কিপটা কোথাকার। নদী বললো, থাক। তুই তো এমনিতেও গহনা পছন্দ করিস না। মিতালি বললো, মা, তুমি আসলে আমার চাইতেও ভাইয়াকেই বেশি ভালোবাসো। ছেলের কোন দোষই তোমার চোখে ধরা পড়ে না। যাও, ঘেমে একাকার হয়ে গেছো। গোসল করে আসো। নদী বললো, এইতো যাচ্ছি। মাংসের হাঁড়ির ঢাকনাটা খুলে দেখলো তারপর বন্ধ করে দিলো গ‍্যাস। মিতালিকে বললো, ইমন আসবে না আজ? মিতালি বললো, নাহ্ মনে হয়। আমি তবুও ফোন করছি, এই বলে মিতালি মোবাইল নিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। নদী একা একা বললো, আহা, আমাদের সময় এসব মোবাইল ছিলো না। কতোদিন মার কথা মনে পড়েছে কিন্তু ফোনও করতে পারতাম না। মা বেঁচে থাকতে মায়ের বাসায় একটা ফোনও ছিলো না। দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে কাজের মেয়েকে টেবিলে ভাত দিতে বলে তাড়াতাড়ি গোসল করতে গেলো নদী। ইমন যদি রাতে আসে? মনটা খচখচ করছে, একটু মাছের কোপ্তা আছে ডিপে, রান্নাটা করতে হবে বিকেলে। গোসল করে নামাজ পড়ে নদী এসে দেখলো, ঝাকড়া চুলের বারবী ডলটা ঘুম থেকে উঠে গেছে। নদী কট থেকে কোলে নিয়ে নাতনিকে আদর করে মিতালিকে ডাকলো। মিতালি এসে বললো, ইমন আজ আসবে না। বন্ধুদের সাথে রাতে ওর পার্টি আছে। ওমা, তুমি উঠে গেছো গুলগুলি? মেয়েকে বললো, নান্নীর কোলে থাকো, আমি তোমার খাবার আনছি। একটু পর বোতলে তৈরী করা খাবার নিয়ে আসলো। নদী বললো, সেকি রে এসব তোরা কি খাওয়াস বলতো? সব সবজি দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া একটু করে। মিতালি চামুচ দিয়ে খাবার মেয়ের মুখে তুলে দিতে দিতে বললো, মা এতো কষ্ট করতে পারবো না এখন। আপাতত যে কয়টা এনেছি শেষ হোক তারপর তো নিজের হাতেই বানাবো। তাছাড়া তেমন একটা খেতেও চায় না এসব। মেয়েকে খাবার খাইয়ে আলোর কাছে দিয়ে নদীকে মেয়ে বললো, মা, আমি আমার মেয়েকে খাবার খাইয়েছি এবার তুমি তোমার মেয়েকে খাবার খাইয়ে দাও। নদী হাসতে হাসতে বললো, তুই কবি বড় হবি রে মিতুসোনা। খাবার প্লেটে নিয়ে আগের মতো সব মিশিয়ে মেয়ের মুখে ভাত তুলে দিচ্ছে নদী আর মিতালি বান্ধবীদের সাথে টেলিফোনে কথা বলছে আর খাচ্ছে। কি চমৎকার সেই দৃশ্য। নদীর চোখে পানি আসছে, কারণ বারবার খোকার মুখটা ভেসে উঠছে। খোকাকেও তো এভাবেই খাইয়ে দিয়েছে নদী।

    চলবে…

    সাবিহা খান, লন্ডন

  • পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-৩)

    শেষ পযর্ন্ত নদী এবং মোস্তাক মেনে নিয়েছিলো খোকার বিয়েটা। ঠিকই তো বলেছে খোকা। আবেগ দিয়ে তো জীবন চলে না। শুধু বিয়েটা দেশে নিতে অনুরোধ করেছিলো দিপ্তীর বাবা মাকে। উনারা কথা দিয়েছিলেন তাই হবে। কিন্তু কবে আসবে, কিভাবে কি হবে কিছুই বলেননি। হঠাৎ করেই খোকা ফোন করে বলেছিলো, মা, বাবাকে বলো আমরা আসছি সামনের মাসে। বিয়েটা শুধু তোমাদের জন‍্যই দেশে নিতে হচ্ছে। খোকার কন্ঠে ছিলো একরাশ বিরক্ত। নদী চমকে গিয়ে বলেছিলো, কি বলছিস খোকা? এমাসের আছে মাএ একুশদিন? এতো অল্প সময়ে কিভাবে কি হবে? খোকা বলেছিলো, কাউকেই দাওয়াত করতে হবে না। কারণ আমরা আমেরিকাতেই বিয়ের জন‍্য পার্টি দিবো। দিপ্তীর আপনজনেরা তো এখানেই থাকে। তাই কিছুই করতে হবে না। শুধু বিয়েটা তোমাদের সামনে হবে। আর আমি কিন্তু টাকা পয়সা কিছুই দিতে পারবো না। এমনিতেই ওদের যাওয়া আসার টিকেট কাটতে হচ্ছে আমাকেই। আমরা মাএ চারজন আসবো। দিপ্তীর বাবা মা, দিপ্তী আর আমি। তারপরও নদী আর মোস্তাক দুজনেই, শুধুই নিকট আত্মীয় এবং দু চারজন বন্ধুদের নিয়েই ছোট্ট একটা সেন্টারে বিয়ের ব‍্যবস্থা করেছিলো। মিতালি আর নীলু আপা লেগে গিয়েছিলো বিয়ের মার্কেট করতে। নদী তার নিজের গহনা থেকেই একসেট গহনা রেখেছিলো দিপ্তীর জন‍্য। কিন্তু খোকা গহনা দেখে পছন্দ করেনি বরং বলেছে, এগুলো তো তোমার আমলের গহনা। ছি ছি মা, তুমি আজো মর্ডান হতে পারলে না। তখন বাধ‍্য হয়েই মিতালির বিয়ের জন‍্য রাখা টাকা থেকেই নতুন একসেট গহনা খোকাকে নিয়েই কিনেছিলো নদী, দিপ্তীর জন‍্য। মাএ পনের দিনের জন‍্য এসেছিলেো দিপ্তীরা। নতুন বউকে বুঝার আগেই চলে গিয়েছিলো সবাই। মিতালি গাল ফুলিয়ে বলেছিলো, এটা কোন বিয়ে হলো? না হলো আনন্দ, না হলো ভাবীকে জানা। কি বিয়ে করলো ভাইয়া? ভাইয়ার সাথে একদমই মানাইনি ভাবীকে। তাছাড়া ভাবী যেন কেমন। নদী বলেছিলো, বউমা ছোটবেলা থেকেই আমেরিকাতেই বড় হয়েছে। একটু তো তফাৎ থাকবেই ব‍্যবহারে। মিতালি বলেছিলো, মেট্রিক পাশ করে গিয়েছে দেশ থেকে, এতো ছোটবেলাতেও যাইনি। তোমার কাছে পরের মেয়ে আজীবন ছোটই থাকবে কেবল আমিই বুড়ি হয়ে গেছি। গাল ফুলিয়েছিলো মিতালি। নদী হেসে মেয়েকে বুকে চেপে ধরে বলেছিলো, তুই আমাদের মিতুসোনা যে। দেড়বছর পর মিতালিরও বিয়ে হয়ে গেলো। আগে থেকেই ছেলেপক্ষের সাথে কথা পাকাপাকি করেই রেখেছিলো। মেয়ের বিয়েতে নদী মন ভরে মজা করতে পেরেছে। আত্মীয়স্বজন, কলিগ এবং বন্ধুবান্ধব সবাইকে নিয়ে মিতালির বিয়েতে আনন্দ করেছিলো নদী। বিয়ের সময় নিজের গহনাগুলো দিতে সংকোচবোধ করেছিলো নদী। মিতালিকে বলেছিলো, এগুলো বদলে নতুন কিছু কিনে আনি চল মিতু। কিন্তু মিতালিই বলেছিলো, কখনোই না। ভালোই হয়েছে। তোমার স্মৃতিমাখা গহনাগুলো, আজ থেকে আমার কাছেই থাকবে। এমন সুন্দর ডিজাইন আজকাল দেখাই যায় না। নদীর চোখটা আনন্দশ্রুতে ভরে গিয়েছিলো। বিয়ের পর মিতালি কিছুদিন তাদের কাছেই ছিলো। খোকা বিয়েতে আসেনি। বারবার বলা সত্ত্বেও খোকা কোন না সমস্যা দেখিয়েছে। তখন তো তারা দাদা দিদাও হয়ে গিয়েছিলো। তাই নাতিনকে এক নজর সামনাসামনি দেখার জন‍্যও তারা অস্থির ছিলো। কিন্তু খোকা আসতে রাজীই হয়নি। বউমাকে আসতে বলাতে, দিপ্তী কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বলেছিলো, এখন তারা আসতে পারবেনা, বেবী ছোট, বরং মিতালির জন‍্য তারা কিছু টাকা দিতে চায়। মোস্তাক নেয়নি খোকার টাকা। বরং হাসিমুখেই বলেছিলো, টাকা লাগবে না খোকা। তোর মা আর আমি ব‍্যবস্থা করেছি। খোকা বলেছিলো, বেশতো, বিয়ের টাকা নাইবা নিলে, মিতালির কিছু গহনার জন‍্য…. খোকাকে থামিয়ে দিয়ে মোস্তাক বলেছিলো, এখনো তো বেঁচে আছি রে খোকা। লাগলে অবশ্যই চাইবো। ভবিষ্যতে মিতালির সাথে দেখা হলে বরং কিছু কিনে দিস। পাশাপাশি দেশেই তো থাকবি। খোকা বেশ আনন্দের সাথে বলেছিলো, হ‍্যাঁ, তোমাদের বউমাও বেশ খুশী কারণ কানাডা এখনো আমাদের যাওয়া হয়ে উঠেনি। মিতালি কানাডা চলে যাবার দুইবছর পর তারা তাদের এই ছোট্ট ফ্ল‍্যাটটি কিনেছিলেন। জায়গাটা অনেক আগেই হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিলো টাকার অভাবে। ফ্ল‍্যাট কেনার সময়ও মোস্তাক তার গ্রামের সব জমিগুলোও বিক্রি করে দিয়েছিলো এবং ব‍্যবসা থেকে আসা সব টাকাও ফ্ল‍্যাটের পিছনেই লাগিয়েছিলো। শুধু গ্রামের বাড়িটাই পড়ে আছে এখনো। ফ্ল‍্যাট কেনার পর মোস্তাক হেসে বলেছিলো, কি গো, তোমার বাড়ির শখ পূরণ হলো তো? আমার দায়িত্ব কিন্তু শেষ, এখন আবার হঠাৎ ছেলেমেয়েদের কথায় বিদেশে বসবাস করতে বায়না ধরবে নাতো? নদী বলেছিলো, কখনোই না। দেখো, পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে কি চমৎকার দৃশ্য চোখে পড়ে। নদীদের পেছনের বারান্দায় দাঁড়ালে দৃষ্টিটা বহুদূর যায় কারণ পেছনের পরপর পাঁচটি বাড়ি এখনো বহুতল হয়নি। বাড়িগুলো বেশ গাছ গাছালি দিয়ে ভরা। মনটা খুব ভালো হয়ে যায়, নদী যখন পেছনের বারান্দাটায় যায়। খুব ভোরে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শুনেই নদীর ঘুম ভাঙ্গে। ফজরের নামাজ পড়ে, নদী আর মোস্তাক এখানে বসেই চা খায়। নদী খুব সাদামাটা করে ঘর সাজিয়েছে কিন্তু কলিগরা বাসায় এসেই হৈচৈ করে বলেছিলো, আপা, এওো সুন্দর করে আপনি বাড়িটাকে সাজিয়েছেন যে, এখানে আসলেই মনটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। নদী হেসে বলেছে, আমি মানুষটাই সাদামাটা তাই আমার মতো সাদামাটা করেই সাজালাম। কিন্তু যেই এসেছে সেই প্রশংসা করেছে নদীর রুচির। খোকা এসেও বলেছিলো, দেখো, আমার মায়ের রুচি দেখো। মা বাসার প্রতিটা কোণা তুমি একদম বাঙালি ভাবেই রাখার চেষ্টা করেছো। কিন্তু মা, আমি ভাবছিলাম, তোমাদের আমেরিকায় নিয়ে যাবো। মোস্তাক বললো, এই বয়সে আর টানিস না আমাদের। দেশেই বরং সবার সাথে আমাদের ভালো দিন কাটছে। তাছাড়া এখনো তো চাকুরিটা আছে। নদীও বললো, আমারও বেশ লাগে অফিসের সবার সাথে। তাছাড়া তোর মামা, খালা, চাচারা সবার সাথেই দেখা হচ্ছে যখন তখন। ভেবেছিলাম তোরা বাইরে থাকলে খুব সমস্যা হবে আমাদের কিন্তু কোন সমস‍্যাই হচ্ছে না। বউমা ইংরেজিতে বাড়ির দাম জিজ্ঞেস করেছিলো। দাম শুনার পর বললো, এওো দাম? বাব্বা। এ বাড়ি বিক্রি করে বরং আমেরিকাতে আর কিছু টাকা লাগালেই আমাদের বাড়িটা কিনতে পারি। মোস্তাক বলেছিলো, আমরা মারা যাবার পর খোকা আর মিতুই তো এই বাড়ির মালিক হবে। তখন না হয়, তোমরা যা ভালো বুঝো, তাই করো। দিপ্তীর মুখটা কালো হয়ে গিয়েছিলো। মুখটা কালো করেই বলেছিলো, আপনারা আমেরিকা কিংবা কানাডা গেলে দেশে আসার আর প্রয়োজন পড়তো না আমাদের। তাছাড়া ঐসব দেশে বৃদ্ধদের জন‍্য কতোকিছুর সুবিধা আছে। বৃদ্ধদের জন‍্য আধুনিক বৃদ্ধাশ্রমও আছে। আপনাদের ভালোর জন‍্যই বলছিলাম কথাটা। দিপ্তীর কথার সাথে খোকাও সায় মিলাচ্ছিলো আর বৃদ্ধদের কি কি সুবিধা দেয় তাও বলছিলো খুব উৎসাহের সাথে। কিন্তু নদী আর কথা বাড়াতে দেয়নি দিপ্তী এবং খোকাকে। খোকাকে আড়ালে ডেকে কঠিন গলায় বলেছিলো, আমরা এখানেই থাকবো যতোদিন বেঁচে আছি। তাছাড়া উন্নত দেশের বৃদ্ধাশ্রমে যাবার কোন শখও আমাদের নেই। তাই দিপ্তীকে বলিস, আর যেন এই বিষয়ে কোন কথা না বলে কারণ তুই তোর বাবাকে তো চিনিস। এককথার মানুষ সে। এখনো তোদের জন‍্য হ্নদয়ে যে ভালোবাসার স্থানটা আছে তাতে আর আঘাত করিস না। খোকা বলেছিলো, বৃদ্ধাশ্রমে তোমাদের দিবো কেন? এটা ওখানকার সুযোগ সুবিধার কথা দিপ্তী তোমাদের বলছিলো। তাছাড়া বিদেশে যারা কাজ করে অনেসময় নিজেদের সুবিধার জন‍্যই…। এরপর খোকাও আর কথা বাড়াইনি এ ব‍্যাপারে। তবে বুঝা গেলো সেও খুব একটা খুশী নয় তাদের সিদ্ধান্তে। মিতালিও বাসাটা দেখে বাচ্চাদের মতো খুশী হয়েছে। কারণ মিতালি মায়ের বাড়ির বানানোর শখটা প্রায় ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে। যদিও বাড়ি হয়নি, তাতে কি। একটা ফ্লাট তো কিনেছে বাবা মা। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নদী উঠে দাঁড়ালো পেছনের বারান্দার চেয়ার থেকে। গাছ লাগিয়েছে নদী। তার শখের বারান্দা বাগান। কাজের মেয়েকে বললো, আলো পানি আনতো, গাছে পানি দেই। বেশ গাছ লাগিয়েছে নদী। এই নিয়েই নদীর সময় কেটে যায় এখন অফিস থেকে আসার পর। ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। তাই অফিস থেকে ফেরার পর রান্না শেষেও যেন সময় আর কাটতে চায় না। ফলের গাছ, সবজি, ফুলের গাছ সব আছে। বেশ বড়ই পেছনের বারান্দাটা। সামনের বারান্দায় শুধু ফুলের গাছ লাগিয়েছে নদী। হঠাৎ মনে পড়লো, সর্বনাশ ছয়টা বেজে গেছে অথচ মোস্তাককে চা দেয়া হয়নি। মোস্তাক খুব সময় মেনে চলা লোক। একদিনের জন‍্যও অফিসে তার দেরী হয়নি। খাবারও প্রতিদিন একই সময়ে খাবে। সকালে হাঁটতেও যাবে ঘড়ি ধরেই। রাতে ঘুমাবেও একই সময়ে। নদী তাড়াতাড়ি কিচেনে এসে চায়ের পানি তুলে দিলো গ‍্যাসের চূলোয়।

    চলবে…

    সাবিহা খান, লন্ডন

  • পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-২)

    নদী তাড়াতাড়ি বললো, কি করেছে তোর ভাবী? বউমা তো অত্যন্ত লক্ষী মেয়ে। মিতালি মুখ বাঁকিয়ে বললো, কতো লক্ষী বউমা তোমার, তা আমি জানি মা। তুমি সবসময়ই আমার কাছে অনেক কিছু লুকাও। ভাইয়াই আমাকে একটু বলেছে আর বাকীটা আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি। ওহ্ ভূলেই গেছি একটু অপেক্ষা করো। মিতালি পাঁচমিনিট পরেই একটা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি নদীকে দিয়ে বললো, এই দেখো তোমার দাদা ভাইয়াকে। নদী ছবিটা দেখতে দেখতে ছবির গায়ে হাত বুলিয়ে বললো, খোকা এই সুয়েটার নিয়ে গিয়েছিলো? মিতালি বললো, মা আমি যাচ্ছি। ফিরে এসে সব বলবো। মিতালি চলে গেলো তার শশুরবাড়ি। মেয়ে যাবার পর নদী নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। ছবিটা বুকে চেপে ঢুকরে কেঁদে উঠলো। মোস্তাক নদীর মাথায় হাত রেখে বললেন, আর কত কাঁদবে তুমি? খোকারা যাবার পর থেকেই তো মাঝে মাঝে কাঁদছো আর সুয়েটারটা খুঁজছো। আমিই খোকাকে সুয়েটারটা তোমাকে না জানিয়ে দিয়েছিলাম। নদী কাঁদতে কাঁদতে বললো, এতোদিন ধরে খুঁজছি, বলোনি কেন? মোস্তাক নদীকে বললো, দাও, আমার দাদুর ছবিটা দাও, বেডরুমের দেওয়ালে লাগিয়ে দেই। সাদা রংঙের সুয়েটারের গলায় নীল রঙটা বড্ড ফুটেছে। কি সুন্দরই না লাগছে দাদু ভাইয়াকে। ছেলেটা দেখতে একদম খোকার মতোই হয়েছে। মনে হচ্ছে ছোটবেলার খোকা। খোকারা বছর খানেক আগে দেশে এসেছিলো। মাসখানেক ছিলো। তখনই নদী এই সুয়েটার বানিয়ে খুব উৎসাহের সাথে দিপ্তীর হাতে দিয়ে বলেছিলো, বউমা দাদুভাইয়া পড়িয়ে দেখো তো মাপটা ঠিক আছে কিনা। খোকাও ঐ ঘরেই ছিলো। সুয়েটারটা হাতে নিয়ে নদীর স্মার্ট বউমা বললো, ছি, এটা কেন বানিয়েছেন আপনি? কতোগুলো সুয়েটার আছে আমার ছেলের, তা জানেন? যেমন নরম তেমনি সুন্দর। এটা কোন সুয়েটার হলো? খোকা বলে উঠেছিলো, আহ্, কি বলছো দিপ্তী? মার হাতের সুয়েটার পড়েই আমরা বড় হয়েছি। এমনকি আমেরিকা যাবার সময়ও মার বানানো সুয়েটারগুলোই নিয়ে গেছি। তুমি তো সবই জানো। দিপ্তী বেশ ঝাঁঝালো গলায় বললো, দেখো, ওসব পুরানো দিনের কথা বাদ দাও। আমার ছেলের কথা আলাদা। আমি এই সুয়েটার পড়িয়ে আমার ছেলেকে বাইরে বের করতে পারবো না। মা, আপনি বরং এটা, দেশেই কাউকে দিয়ে দিয়েন। এই বলে দিপ্তী সুয়েটারটা ঢিল দিয়ে বিছানায় ফেলে বারান্দায় চলে গিয়েছিলো। খোকা তাড়াতাড়ি বললো, মা আমি পড়াবো কিন্তু নদী সুয়েটারটা হাতে নিয়ে বললো, বউমা ঠিকই বলেছে। থাক। এটা বরং আমি অন‍্য কাউকে দিয়ে দিবো। সুয়েটারটা হাতে নিয়ে নদী সোজা নিজের ঘরে এসে কাঁদছিলো। মোস্তাক সবই শুনেছিলো। কারণ তাদের বাসাটা এতো বড় নয় যে কথা শুনা যায় না। মোস্তাক নদীর হাত থেকে সুয়েটার নিয়ে বললো, তোমার পাগলামী কবে যাবে নদী? এখন বাচ্চারা বড় হয়েছে। তাদের সংসার তাদের মতো করে করতে দাও। নদী শুধুই কাঁদছিলো। কি করিনি নদী আর মোস্তাক এই দুই ছেলেমেয়ের জন‍্য। দুজনেই চাকুরি করেছে। নদী প্রতিটা পয়সা জমিয়ে রেখেছিলো একটি জায়গা কিনবে এবং সেখানেই বানাবে তার সপ্নের বাড়ি। নিজে কোনদিনও একটা দামী শাড়ি কিনেনি। কলিগরা সবসময়ই বলতেন, তাঁত আর জর্জেট ছাড়া অন‍্য কোন শাড়িই কি আপনার পছন্দ না আপা? নদী হেসে বলতো, যে পছন্দ করার সেতো তাঁতের শাড়িতেই পছন্দ করেছিলো। মোস্তাক খারাপ চাকুরি করতো না। মাঝে মাঝে কাতান বা জামদানি শাড়ি নিজে থেকেই কিনে আনলেই নদী মৃদু হেসে বলতো, কেন টাকাটা খরচ করলে খামোখা। অবসরে যাওয়ার আগে একটা জায়গা অন্তত কিনতে হবে তো। মোস্তাক হেসে বলতো, হবে হবে। অতোকিছু ভেবো না তো। ছোট একটা ব‍্যবসাও তো করছি বন্ধুর সাথে। তুমি তো সবই জানো। ওখান থেকেই হয়ে যাবে। খোকা ইউনিভার্সিটির পড়াশুনা শেষ করেই বায়না ধরেছিলো, আমেরিকাতে যাবে উচ্চতর ডিগ্রির জন‍্য। নদী বেশ আপওি করেছিলো এবং এটাও বলেছিলো খোকার রেজাল্ট ভালো। তাই আপাতত দেশেই ভালো চাকুরি পেয়ে যাবে। কিছুদিন পরে না হয় আমেরিকা যাবে। কারণ কিছু টাকা জমেয়েছি, মিতালির বিয়ে,ও তিনকাঠার একটা জায়গাও পছন্দ করেছি। নীলু আপাও কিনছে ওখানে। মনে নেই তোমার? কিন্তু নদীর আপওি ঠিকেনি কারণ মোস্তাকই উৎসাহ দিয়েছে খোকাকে যাবার জন‍্য এবং নদীকে এটাও বলেছে, দেখো দেখো একদিন আমার ছেলে আমেরিকা থেকে ডলার পাঠাবে এবং সেই ডলার দিয়েই তুমি তোমার সখের বাড়িটি বানিও, বলেই হা হা করে হেসেছিলো মোস্তাক। নদী তার চাকুরীর জমানো টাকা থেকে ডলার দিয়েছে খোকাকে, পূরো একটা বছর। তারপর অবশ‍্য খোকারও একটা চাকরি হয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু একটি টাকাও খোকা কোনদিন পাঠাইনি। নদী খোকাকে একদিন কতো বেতন পাচ্ছে এটা জিজ্ঞেস করাতে খোকা একটু অন‍্যরকম গলায় বলেছিলো, মা এটা বিদেশ। এখানে আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ কি আছে? তোমার কিংবা বাবার সব আত্মীয়স্বজন তো বসে আছে টাকার বস্তা নিয়ে আমার জন‍্য। নদীও ছেলের উপর অভিমান করে মোস্তাককে বলেছিলো, ছেলে কতো বেতন পাচ্ছে তা জানার অধিকারটুকুও কি আমরা হারিয়ে ফেলেছি? কিন্তু মোস্তাক এ ব‍্যপারে ছেলেকে কোনদিন কিছুই বলেনি। বরং নদীকে বলেছে, ঠিকই তো বলেছে খোকা, বিদেশের বাড়িতে হঠাৎ টাকার প্রয়োজন পড়লে কে দিবে টাকা খোকাকে? খোকা আমেরিকাতে যাবার বছর দেড়েক পর দিপ্তীর কথা বলেছিলো মাকে ফোনে। অথচ নীলু আপার মেয়েটাকে নদীর খুব পছন্দ ছিলো। খোকাকে তা বলার পর পরই খোকা নদীকে বলেছিলো, মা আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করবো ভাবছি তাই এখানে বসবাসরত মেয়েকে বিয়ে করলে আমার জন‍্যই তা ভালো। মেয়ে যদিও অতো সুন্দর নয় কিন্তু জীবন তো কোন আবেগ দিয়ে চলে না। একটু তো বুঝার চেষ্টা করো মা। নদী বললো, মিতালির জন‍্য কানাডাতে থাকে ছেলে, পরিবারও শিক্ষিত, ভালো একটা প্রস্তাব এসেছে রে। তাই ভাবছিলাম আগে মিতালির বিয়েটা দিয়ে তারপর তোর বিয়েটা হলে ভালো হতো। খোকা কিছুটা বিরক্তি ভরা কন্ঠে নদীকে বললো, মা আমার পড়াশুনা শেষ। একটা চাকুরী পেয়েছি কিন্তু চাকুরী চলে গেলেই আমাকে এদেশে থাকতে দিবে না। তাই ওসব বলো না তো। তাছাড়া মিতালির বিয়েটা এক্ষুনি দেবার প্রয়োজনটা কি? ও তো এখনো ভারসিটিই পেরুইনি। নদী বললো, তোর বাবার বন্ধুর বড় ভাই এর ছেলে। পরিচিত। ঠিক আছে, কিন্তু তোরা দুজনেই বাইরে থাকলে আমরা বুড়োবুড়ি কিভাবে দেশে একা একা থাকবো রে খোকা?

    খোকা আর কিছু না বলে ঠাস করে ফোনটা নামিয়ে রেখে দিয়েছিলো। নদী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লো। সেই খোকা, যে বাইরে থেকে এসেই বায়না ধরতো, মা তাড়াতাড়ি খেতে দাও। ভাত দিলে আবারও বায়না ধরতো তুমি মেখে খাইয়ে দাও মা। সারাদিন অফিস, অফিস থেকে বাসায় এসে রান্না, বাচ্চাদের পড়াশুনা সব, সব সামলাতো নদী। রাত একটা দেড়টার আগে কোনদিনও ঘুমাতে পারিনি সে। মাঝে মাঝে মনে হতো চাকরিটা ছেড়ে দিবে কিন্তু মোস্তাকের আয়ে কিভাবে সব হবে তা ভেবে ভেবে আর চাকুরী ছাড়াই হয়নি। জীবনটা এভাবেই কেটে গেছে নদীর অথচ এখন কিনা…

    চলবে…

    সাবিহা খান, লন্ডন

  • পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-১)

    নদী আজ ভারি ব‍্যস্ত। কানাডা থেকে মেয়ে, মেয়ের জামাই আর একবছর বয়সী নাতনি এসেছে। পাঁচবছর পর মেয়েটাকে দেখছে নদী। বিয়ের পর সেই যে কানাডা গেলো তারপর এই প্রথম তার মেয়ে বাংলাদেশে আসলো। নাতনিটাকে দেখে নদীর মনটা ভরে গেলো। কি সুন্দরই না হয়েছে মেয়েটা। মায়ের গায়ের রংটাই পেয়েছে। অবশ‍্য নদী নিজেও খুব সুন্দর। এখনো নদীকে দেখলে বুঝাই যায় না যে সে শাশুড়ি হয়েছে এবং নান্নী দিদাও হয়েছে। নদীর মেয়ের জামাই অত্যন্ত সুদর্শন। সেইসাথে লেখাপড়া আর পরিবারের সুন্দর শিক্ষা, সব মিলিয়ে অসাধারণ একটি মেয়ের জামাই পেয়েছে নদী।

    খাবার টেবিলে খেতে বসেই মেয়ে চিৎকার করে বললো, মা তুমি এওো কিছু রান্না করেছো। আরে আমার প্রিয় খাবার, গরুর মাংসের কালা ভুনাও আছে দেখছি। ইস্ কতোদিন পর খাচ্ছি। মেয়ের জামাই ইমন বললো, মা আপনার মেয়ে আমাকে কিছুই রান্না করে খাওয়ায় না। অথচ আপনি পুরো টেবিলটাই খাবার দিয়ে ভরে ফেলেছেন। নদী একটু লজ্জিত হয়ে বললো, আমিও সংসারজীবনের প্রথমটায় কিছুই পারতাম না বাবা, কিন্তু একসময় নিজে থেকেই শিখতে শুরু করলাম। মেয়ে মিতালি বললো, দেখ মা, কিভাবে রান্না শিখবো? প্রথমেই ডিগ্রীটা শেষ করলাম এবং তারপরেই মেয়ে আসলো সংসারে। ইমন তাড়াতাড়ি বললো, আরে আরে আমি কি মার সাথে একটু মজাও করতে পারবো না তোমাকে নিয়ে।

    মিতালি বললো, একমাস থাকবো দেশে, সব রান্না শিখে তবেই প্লেনে উঠবো। ইমন একটু মুচকি হেসে খেতে খেতে বললো, যাক বাবা.. বাঁচলাম। এখন থেকে আর দোকান থেকে খাবার কিনে আনতে হবে না। নদী বললো, তোমাকে আর একটু মাংস দেই ইমন। ইমন বললো, মা আমাকে বরং রুইমাছের দোপেঁয়াজাটা দিন। অনেকদিন পর মাছ খাচ্ছি তাও আবার দেশি মাছ। নদী বললো, কেন? শুনেছি তোমাদের ওখানে সবই পাওয়া যায়। ইমন বললো, সব পাওয়া যায় কিন্তু দেশি মাছ একদম খাওয়াই হয় না। রেষ্টুরেন্টে আমরা মাঝে মাঝেই খেয়ে আসি কিন্তু আপনার হাতের রান্নার স্বাদটাই আলাদা। নদী হেসে বললো, তোমরা কি কালই মিরপুরে যাবে? মিতালি বললো, মা, আমরা একটু পরেই যাচ্ছি মিরপুরে। মিরপুরে মিতালির শশুরবাড়ি। মিতালির বাবা নাতনিকে কোলে নিয়ে বারান্দায় ছিলো। বারান্দা থেকেই বললো, তাই ভালো। আগে বিয়াইন সাহেবার সাথে থেকে এসো।

    খাবার পর মিতালি একটা সুটকেস দেখিয়ে বললো, মা এই সুটকেসটা থাকলো। আমি দুদিন পরেই আসবো। সবার গিফট আছে এই সুটকেসে। তোমাকে নিয়ে সবার সাথে দেখা করতে যাবো। নদী বললো, এতো গিফটের কি প্রয়োজন ছিলো? তোর শশুরবাড়ির জন‍্য..

    মিতালি নদীকে থামিয়ে দিয়ে বললো, মা, আমি তোমার মেয়ে। অন্তত এই জিনিসটা আমি ভালোভাবেই জানি। ও বাড়ির সবার জন‍্যই আমি আর ইমন মিলে গিফট কিনেছি। আমাদের নিজেদের কাপড় খুব কম এনেছি। কারণ দেশ থেকে ইচ্ছেমতো কাপড় কিনে নিয়ে যাবো। মিতালি আরো বললো, মা, তুমি আমার মেয়ের জন‍্য একটা সুয়েটার বুনে দিবে কিন্তু। নদী যেন একটু চমকে গিয়ে বললো, কি যে বলিস না, ওসব দেশে কতো সুন্দর সুয়েটার পাওয়া যায়। কি নরম, তেমনি সুন্দর ডিজাইন। মিতালি নদীর হাতদুটো ধরে বললো, প্লিজ মা, আমি চাই আমার মেয়ে তার নান্নীর হাতের সুয়েটার পড়বে। ছোটবেলাতে আমি আর ভাইয়া তোমার বুনে দেয়া সুয়েটার পড়েই বড় হয়েছি। কি সুন্দর ডিজাইন তুমি জানো। নদী একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললো, ওসব দিনতো কবেই চলে গিয়েছে রে মা, আর তোদের কথা আলাদা। তাছাড়া এখন এই বয়সে ভূলেও গেছি রে। মিতালি ঠোঁট ফুলিয়ে বললো, মা তুমি সুয়েটার না বানালে আমিও মিরপুর থেকে আসবো না। ওখান থেকেই চলে যাবো। আমি জানি, কেন তুমি সুয়েটার না বানানোর কথা বলছো।

    কারণ ভাবী…

    সাবিহা খান
    চলবে…