Blog

  • আলো-ছায়া: অশেষ কবিতা!

    আলো-ছায়া: অশেষ কবিতা!

    কেন নস্টালজিয়া?
    নিস্তব্ধতা?
    সূর্যাস্ত, কবিতা ও প্রেমের রঙ হারিয়ে যাওয়া?

    কেন নিস্তব্ধতা নামে গোধূলির ছায়ায়?
    কেন সূর্যাস্ত ঢেকে দেয় রঙিন আকাশ?
    কেন শব্দহীন স্রোতে বাজে অনুরণন?
    কেন হারায় প্রেমের রঙ কোথাও?
    কেন খোঁজে হৃদয় তোমায় আলো-ছায়ায়?

    নস্টালজিয়া, প্রেমের স্মৃতি, নিস্তব্ধতা
    সব মিলেই জীবন? – অশেষ কবিতা!

    ©আলম – ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ইং, ৯টা ৪১মি.

  • গ্রহণের লাল চাঁদ

    গ্রহণের লাল চাঁদ

  • সহোদরা – পর্ব১

    সহোদরা – পর্ব১

    অনেক বছর আগের ঘটনা; আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। পরের দিন ক্যালকুলাস পরীক্ষা, অ্যাডভানস ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনগুলো মাথায় ঢুকছিল না। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম। তার উপর লেগেছে খিদা। রান্নাঘরে গিয়ে এক প্যাকেট চানাচুর খুঁজে পেলাম। চানাচুর চিবাতে চিবাতে রুমে ফিরে আমার পড়ায় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করছি, তখন হঠাৎ শুনলাম, ‘বড়ভাই কী কর?’

    তাকিয়ে দেখলাম ‘ইতি’, আমার ছোটবোন। ইতির বয়স তখনও পাঁচ বছর হয়নি। বয়সে সে আমাদের ভাইবোনদের সবার ছোটো। আমি সবার বড়ো, আর আমার ছোটো তিন বোন। আমার বোনদের নাম প্রীতি, গীতি এবং ইতি; কী সুন্দর সব কাব্যিক নাম! কিন্তু আমার নামে কাব্যের কোনও ছিটেফোঁটা নেই; আমার নাম ‘আবুল খায়ের’, ডাক নাম খায়ের। সারা জীবন স্কুলের ছেলেরা ‘আবুইল্যা’ ‘আবুইল্যা’ বলে টিটকারি করত। এই জন্য বাবার উপর খুব মেজাজ খারাপ হতো আমার। কেন যে আমাকে এই রকম একটা নাম দিয়েছিলেন! একবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন আমার এই নাম রাখা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আরে, চক-বাজার জামে মসজিদের ইমাম সাহেব এই নাম রাখছে, তোর নামের অর্থ হচ্ছে যে সবার মঙ্গল করে; খুবই সুন্দর নাম।’ মনে মনে বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি আইসা আমার স্কুলের পোলাপানগো এইটা বুঝান, কেমন খেত খেত একটা নাম রাখছেন!’

    ইতিকে বললাম, ‘পড়াশুনা করছি, তুই কী কিছু বলবি?’

    ‘হ্যাঁ, বড়ভাই, আমার মহা-বিপদ, সাংঘাতিক বিপদ।’

    হেসে দিয়ে বললাম, ‘তোর আবার কী মহা-বিপদ?’

    ইতি আমার কাছে এসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আমার মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘তোমার দাড়িগুলা দেখতে ভালো হয় নাই বড়ভাই; দেখতে কেমন ঝাড়ুর মতো লাগে।’

    ‘ঝাড়ুর মতো লাগে! কী বলিস!’

    ‘হ্যাঁ, নিলুফা খালার ঝাড়ুর মতো লাগে তোমার দাড়ি।’

    নিলুফা খালা সকাল-বিকাল আমার মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করেন। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় ইতি দেখেছে হয়ত। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তুই এইটা বলতে আসছিস?’

    ‘না বড়ভাই।’

    একটু বলে রাখি, আমার অন্য দুবোন আমাকে ভাইয়া ডাকে, কিন্তু ইতি কেন যেন আমাকে ডাকে ‘বড়ভাই’। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কিরে, আমি তো তোর একমাত্র ভাই, আমাকে ভাইয়া ডাকলেই তো হয়।’ ইতি উত্তর দিয়েছিল, ‘কিন্তু তুমি তো সবার বড়ো, এই জন্য তুমি বড়ভাই।’

    ইতিকে বললাম, ‘ঠিক আছে, কী বলবি বল।’

    ‘বড়ভাই তুমি কী খাও?’

    ‘চানাচুর খাচ্ছি, খিদা লাগছে।’

    ‘আমাকে একটু দিবা?’

    ‘তোরে না মা একটু আগে খাওয়াইছে। তোর কি এখন আবার খিদা লাগছে?’

    ইতি আমার মুখের দিকে তাকাল, ‘না খিদা লাগে নাই। দাঁড়াও, আমি আসতেছি’, বলে সে দৌড়ে চলে গেল। ফিরল এক মিনিট পর; হাতে একটা পুতুল।

    ‘কিরে কী নিয়া আসলি?’

    ‘এইটা আমার বার্বি’, পুতুলটাকে দেখিয়ে ইতি বলল, ‘দেখো ওর মুখটা কী শুকনা! ওর অনেক খিদা লাগছে, ও চানাচুর খাইতে খুব পছন্দ করে। ওরে একটু দিবা?’

    বুঝতে পারলাম তার উদ্দেশ্যটা কী। চানাচুরের প্যাকেটটা হাতে দিয়ে বললাম, ‘নে ধর, তুই খা। আমার আর খাইতে হবে না। এখন যা এখান থেকে, কাল আমার ক্লাস-টেস্ট। পড়তে হবে।’

    ‘কিন্তু বড়ভাই, আমার যে মহা-বিপদ। জীবন-মরণ সমস্যা।’

    আবারও হাসি আসলো পিচ্চি মেয়ের মুখের জীবন-মরণ সমস্যার কথা শুনে। বললাম, ‘ঠিক আছে, বলবি তো কী সেই সমস্যা।’

    ‘আমার পাঁচশ টাকা লাগবে।’

    ‘পাঁচশ টাকার মহা-বিপদ। কী করবি পাঁচশ টাকা দিয়ে।’

    ‘আমি প্রেম করব; এই জন্য পাঁচশ টাকা লাগবে।’

    বোকা হয়ে গেলাম, বলে কী পিচ্চি! কৌতূহলও হলো, ‘প্রেম করবি? কার সাথে? কীভাবে?’

    ‘ওই যে ছোটাপা যেভাবে প্রেম করে।’

    ‘কী! গীতি প্রেম করে নাকি? কীভাবে প্রেম করে?’

    ‘ওই যে, যখন ফোন পিং-পিং করে তখন দৌড় দিয়া গিয়া ফোন ধরে, আর ফোনে কথা বলার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢাইকা রাখে।’

    ‘তাতে কি হইছে? বন্ধুদের সাথেও তো কথা বলতে পারে।’

    ‘না আমি জানি, প্রেম করে; নিলুফা খালা বলছে। ছোটাপা বালিশে শুয়ে, দুই পা খাটের রেলিং-এ তুলে একবার ফোনটা এই কানে নেয় আবার ওই কানে নেয়। আর আমি কাছে গেলে ছোটাপা খালি বলে – ভাগ, ভাগ এখান থেকে। আমাকে খালি ভাগায়া দেয়। আমার জীবনটা একদম শেষ করে ফেলছে, একদম তামা তামা করে ফেলছে।’

    কষ্ট করে হাসি চেপে রাখলাম। বুঝলাম এই নিলুফা খালাই হচ্ছে সব নষ্টের মূল।

    বললাম, ‘ঠিক আছে প্রেম করবি, কিন্তু পাঁচশ টাকা দিয়ে কী করবি?’

    ‘পাঁচশ টাকা দিয়ে একটা মোবাইল কিনব, তারপর ওইটা দিয়ে প্রেম করব।’

    এতক্ষণে বুঝতে পারলাম বিষয়টা; পাঁচশ টাকা দিয়ে যে মোবাইল কেনা যায় না, সেটা তার জানার কথা নয়। আর এও বুঝতে পারলাম ইতির এই সমস্যা সমাধান না করলে আমার আর ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস করা হবে না।

    ইতিকে বললাম, ‘শোন, এক কাজ করি, চল আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। ঘুরতে ঘুরতে আলোচনা করা যাবে কীভাবে তোর সমস্যাটার সমাধান করা যায়। যাবি? কী বলিস?’

    ‘ঠিক আছে বড়ভাই’, ইতি সম্মতি দিলো ঘাড় নেড়ে।

    বললাম, ‘দেখ ড্রাইভার কাকু কোথায় আছে, আজ আমরা গাড়ি দিয়ে ঘুরব।’

    ছুটির দিন, রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর ইতিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে কিছু খাবি? এখনো খিদা লাগে নাই?’

    ‘হ্যাঁ বড়ভাই, বার্গার খাব। বার্গার খেয়ে শেষ করে তারপর আইসক্রিম খাব।’

    ‘ঠিক আছে’, ড্রাইভার কাকু বললাম, ‘কাকু একটা ফার্স্ট-ফুডের দোকানে চলনে তো।’

    দোকানে বসে ভাই বোন দুজনে দুইটা বার্গার অর্ডার করলাম। বার্গার অর্ধেকটা খেয়ে ইতি বলল, ‘সে আর খাবে না, পেট ভরে গেছে।’

    ‘পেট ভরে গেছে! তাহলে আইসক্রিম খাবি কী করে?’

    ‘না না বড়ভাই, আইসক্রিমের জন্য পেটের পাশে একটু জায়গা খালি আছে।’

    আমি মুখ টিপে হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে, কোনটা খাবি? চকলেট, না ভ্যানিলা, না কি স্ট্রবেরি?’

    ‘চকলেট’, ইতি বলল।

    ইতি খুব মজা করে চকলেট আইসক্রিম খাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘আইসক্রিম কেমন?’

    ‘মিষ্টি মিষ্টি, খুব মজা।’

    ‘কিন্তু আইসক্রিম খেয়ে তো আমার সব পাঁচশ টাকা শেষ হয়ে গেছে। এখন তোর জীবন-মরণ সমস্যার কী হবে?’

    ইতি গম্ভীর মুখে আইসক্রিম খেতে খেতে বলল, ‘প্রেম করার দরকার নেই। আইসক্রিম খাওয়াই ভালো।’

    ‘একদম ঠিক বলেছিস। এরপর থেকে যখনই তোর প্রেম করতে ইচ্ছা করবে, তখনই আমরা আইসক্রিম খাব। ঠিক আছে?’

    ইতি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

    ফেরার পথে গাড়িতে ইতি বার্বি কোলে নিয়ে আমার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও নড়াচড়া না করে সোজা হয়ে বসে রইলাম যাতে ওর ঘুম না ভাঙে। বাসায় এসে ঘুমন্ত ইতিকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে খেয়াল করলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। আগামী কাল আমার পরীক্ষা; এতক্ষণে আমার অ্যাডভানস ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস শেখার বারোটা বেজে গেছে। তবে আমি অবাক হলাম পরের দিন; পরীক্ষা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম, পরীক্ষা তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ হয়েছিল।

    এতদিনের পুরনো এই কথাগুলো আজ দুপুরে মনে পড়লো ইতির ঘরে যাওয়ার পর। ইতি এখন বড়ো হয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছে কদিন আগে। মনে হলো আজ বাসায় কিছু একটা হচ্ছে, কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। বউকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাসায় কী হচ্ছে বলত? কোনো অনুষ্ঠান? আমি তো কিছু জানি না।’

    বউ মুচকি হেসে বলল, ‘ইতির ঘরে যাও, নিজেই দেখে আস, কী কেরামতি চলতেছে।’

    চলবে…

    ২২ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রি., আটলান্টা, জর্জিয়া

  • সাদা পিরিচ -পর্ব৪

    সাদা পিরিচ -পর্ব৪

  • পদচিহ্ন

    পদচিহ্ন

  • বিড়ালের পায়ের মতো নিঃশব্দ

    বিড়ালের পায়ের মতো নিঃশব্দ

  • ঝুম ঝুম ঝুম…

  • আমরা অপেক্ষা করি

    আমরা অপেক্ষা করি

  • অস্ফুট চিঠি

  • একজন পাঠিকার চোখে

    পর্ব ১: অদেখা পাঠিকা

    রুমীর বয়স ষাট পেরিয়েছে অনেকদিন। চোখে চশমা, চুলে রূপোর রেখা। কিন্তু কলমে আজও ঝরে প্রেমের বৃষ্টি, সময়কে হার মানিয়ে। তিনি কোনো নামজাদা কবি নন, তবে ফেসবুকের এক কোণায় তার কবিতা ঠিক ঠিক পৌঁছে যায় কিছু মনচঞ্চল পাঠকের হৃদয়ে।

    প্রতিদিন সন্ধ্যা ছুঁতে না ছুঁতেই তিনি পোস্ট করেন নতুন কবিতা, নতুন কথামালা। তার টাইমলাইনে কোনো কোলাহল নেই—শুধু একান্ত কিছু পাঠক, যারা নীরবে পড়ে, অনুভব করে, আবার হারিয়ে যায়।

    তবে একজন আছে—নাম তার রিমা। বয়স মাত্র বাইশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, সাহিত্যপ্রেমী, একটু ভাবুক। বন্ধুদের ফটোবোমায় ঘেরা ফিডের মাঝে সে প্রতিদিন খুঁজে নেয় রুমীর পোস্ট। কোনোদিন লাইক করে না, কোনো মন্তব্য রাখে না। শুধু চুপচাপ পড়ে যায়। যেন লাইনগুলোর মাঝে লুকোনো থাকে তার নিজস্ব কোনো ব্যথা কিংবা বাসনা।

    রুমী জানেন না, কোথায় থাকেন রিমা, কী করেন, বা আদৌ কেউ আছে কিনা এমন করে তাকে পড়ছে। তিনি কেবল লেখেন। লিখতে থাকেন।

    কিন্তু একদিন কিছু বদলে গেল।

    রাত দশটার কবিতা পোস্ট করার মিনিট দশেক পরেই একটা অচেনা ইনবক্সে নটিফিকেশন।

    “আপনার লেখাগুলো… আমার পৃথিবী বদলে দিয়েছে। আমি জানি না আপনি কী ভাববেন, কিন্তু আমি আপনাকে ভালবাসি।”
    — রিমা

    রুমীর বুকের ভিতর কেমন যেন ধাক্কা লাগলো। এই বয়সে এসে এমন অনুভূতির সঙ্গে তার পরিচয় নেই। না তিনি আশা করেছিলেন এমন কিছু, না প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু রিমার বার্তায় ছিল একধরনের নৈঃশব্দ্যের স্পর্শ—যেটা শুধু একজন প্রকৃত পাঠকই দিতে পারে।

    তিনি উত্তর দিলেন না। শুধু ফোনটা রেখে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তবু চোখের পাতা কিছুতেই নামলো না।

    পর্ব ২: আড়ালের আলো

    রাতটা ঘুমের ছিল না। রুমীর চোখে লেগে ছিল একটুখানি অচেনা উজ্জ্বলতা। বয়স ছাপিয়ে প্রেম শব্দটা তার কানে যেভাবে বাজলো, তা অনেক পুরনো সঙ্গীতের মতো—ভুলে গিয়েও মন চেনে।

    সকালবেলা তিনি বার্তাটা আবার পড়লেন। এবার ধীরে, শব্দে শব্দে।
    রিমা নামের মেয়েটি কোনো ছলনা করে লেখেনি, সেটি তার চোখ বুঝে বললো। ইনবক্সে দেখা গেল, সে আরও কয়েকটি কবিতায় “সিন” করেছে, কিন্তু কখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।

    রুমী উত্তর লিখলেন না। শুধু কবিতার একটা খসড়া খুলে বসলেন।

    যে চেয়ে থাকে দূর থেকে
    সে হয়তো সবচেয়ে গভীর ভালোবাসে।
    তার চোখে থাকে ভয়—
    যদি তোমার চোখে পড়ে ফেলে,
    যদি তার নিঃশব্দ প্রেম ফিসফিসিয়ে ওঠে
    তুমি কি পালিয়ে যাবে?

    পোস্ট করলেন না। শুধু নিজের কাছে রেখে দিলেন।

    বিকেল নাগাদ আরেকটি বার্তা এলো।

    আপনি যদি ভুল বুঝেন, আমি মাফ চাই।
    আমি জানি, আপনি অনেক বড়, অনেক দূরের।
    কিন্তু আমি তো কোথাও বলার সাহস পাইনি।
    এতদিন ধরে চুপ করে ছিলাম, শুধু আপনাকেই পড়তাম।

    রুমী এবার শুধু ছোট্ট একটা জবাব দিলেন—

    ভালোবাসা কোনো অপরাধ নয়।

    তারপর আর কিছু না। তিনি উঠলেন, বারান্দায় দাঁড়ালেন। সামনের গাছে কোকিল ডাকছে, কিন্তু তার বুকের ভিতর বাজছে অন্য সুর।

    রিমা তখন অন্যপাশে, একটা ক্লাসরুমে। ফোনের পর্দায় রুমীর উত্তর দেখে হাত কাঁপছে তার। সে জানে না এরপর কী হবে। কিন্তু এটুকু বোঝে—এই মানুষটার শব্দই তার জীবনের শব্দ হয়ে গেছে।

    পর্ব ৩: মুখোমুখি

    রুমীর মনে প্রশ্নের জট। এই বয়সে এসে ভালোবাসা শব্দটা শুধু কবিতার উপাদান হয়ে ছিল এতকাল। বাস্তবের রঙে তার এমন আঁচ লাগে, ভাবেননি কখনও। সন্ধ্যার দিকে তিনি হঠাৎ একটি সাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন।

    রিমা, আমি উত্তর দিতে জানি না। তবু যদি কখনো মনে করো, তোমার এই নীরব পাঠিকা সত্তাকে আমি চা খাইয়ে ধন্য করতে পারি—তাহলে বলো।

    পাঠিয়ে দিলেন। আর ভাবলেন—হোক যেটা হবার।

    দুই মিনিট… পাঁচ মিনিট… কুড়ি মিনিট…
    তারপর রিমার উত্তর এলো।

    কাল বিকেল, শাহবাগ পাবলিক লাইব্রেরির সামনে। আমি আসব। আপনি যদি না আসেন, আমি বুঝে নেব—আপনি কবিতা হয়েই থাকতে চান, কবি হয়ে নয়।

    রুমী বুঝে উঠতে পারছিলেন না। শুধু বুকটা যেন অনেকটা হালকা লাগল।

    পরদিন বিকেল।
    রুমী পরেছিলেন একদম সাদা পাঞ্জাবি, চোখে চশমা, হাতে তার সবসময়কার চামড়ার ফোল্ডার। লাইব্রেরির সামনে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, তিনি যেন অনেক ছোট, অনেক তরুণ।

    হঠাৎ একটা মৃদু গলা—

    আপনি কি রুমী কবি?

    রুমী মুখ ঘুরিয়ে তাকালেন। সামনে এক তরুণী—চোখে বইয়ের ছায়া, ঠোঁটে দেরি করা সাহস। বয়স ঠিক বাইশ তেইশ বলেই মনে হয়। মাথায় ওড়না, চোখে স্থির ভালোবাসা।

    তোমার নাম রিমা?

    রিমা হেসে বলল,

    আপনার কবিতাগুলো আমি এখনো মুখস্থ করে ফেলিনি, কিন্তু একদিন পারব।

    কথা চলতে থাকে। শহরের কোলাহল ফিকে হয়ে যায়, দুজন মানুষ এক পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে থাকে—যেখানে বয়স কেবল সংখ্যা, আর ভালোবাসা মানে একে অপরের শব্দ বুঝে ফেলা।

    রুমী ভাবেন, জীবনে প্রথমবার কেউ তার কবিতার ভেতরের মানুষটিকে দেখে ফেলল। শুধু শব্দ নয়, নীরবতাও।

    পর্ব ৪: আকাশ ছুঁয়ে ফেলার গল্প

    রিমা ও রুমীর মাঝে কোনো আনুষ্ঠানিকতা নেই। তারা প্রেমিক–প্রেমিকা নয়, আবার একে অপরের প্রেমিক ছাড়া কেউও নয়।

    সেই বিকেলের পর থেকে তাদের দেখা হয় মাঝে মাঝে। চায়ের কাপে, বইয়ের দোকানে, ধীরে হাঁটা রাস্তায়।


    রিমা এখন সরাসরি মন্তব্য করে রুমীর কবিতায়।
    আর রুমী… রুমী লিখতে গিয়ে বারবার রিমার দিকে ফিরে যান।

    একদিন রিমা বলল,

    আপনি জানেন, আমি প্রথম কবে আপনার কবিতা পড়ি?

    রুমী মাথা নাড়ালেন।

    আমার মা মারা যাওয়ার পর। আমি খুব একা হয়ে পড়ি। হোস্টেল ঘরে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ এক বন্ধুর শেয়ার করা আপনার পোস্ট দেখি—

    ‘যারা হারিয়ে যায়, তারা দূরে থাকে না,
    তারা মিশে যায় আমাদের নিঃশ্বাসে।’

    তখন থেকেই আপনার লেখা আমার মা হয়ে যায়। আমার ঘুমপাড়ানি গান হয়ে যায়। আপনিও।

    রুমী বুঝে উঠতে পারেন না। বলার কিছু খুঁজে পান না।
    শুধু বলেন,

    আমি তো ভাবিনি, আমার কবিতা কেউ এভাবে পড়বে।

    রিমা হাত বাড়িয়ে বলে,

    আপনার কবিতা তো আমি পড়িনি, আমি আপনাকেই পড়েছি—লাইন বাই লাইন, নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে।

    সেই সন্ধ্যায় তারা একসঙ্গে সায়েন্স ল্যাবের রেলিংয়ে বসে দেখল আকাশ।
    রিমা বলল,

    এই আকাশ আমাদের প্রেমের মত—অথই, অসম, অথচ খুব সত্যি।

    রুমী চুপ করে থাকেন। তিনি বোঝেন, এই মেয়েটি কোনো ভ্রম নয়। সে কবিতার পাতায় আসা এক বাস্তব স্পর্শ, যে তাকে আবার জীবন দিয়েছে।

    পর্ব ৫: শেষ মানেই থেমে যাওয়া নয়

    বছর ঘুরে গেছে।
    শহরের ক্যালেন্ডারে অনেক পাতা উলটে গেছে, কিন্তু রুমীর মনে এখনো আটকে আছে সেই বিকেলটা—যেদিন রিমা বলেছিল,

    আপনার কবিতাগুলো আমি মুখস্থ করে ফেলবো একদিন।

    রিমা এখন মাস্টার্সের ছাত্রী। ক্লাস করে, কিছু টিউশনি করে, আর রুমীর পাশে বসে তার নতুন লেখা পড়ে। কখনও শুধরে দেয় শব্দের ভারসাম্য, কখনও বলে,

    এইখানে আরও মায়া যোগ করুন।

    রুমীর বয়স বাড়ছে। হাঁটুর ব্যথা বেড়েছে, তবু সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি লিখেন। কারণ জানেন—পাশের টেবিলে একদিন সেই লেখা পড়ে কেউ নিঃশ্বাস ফেলবে।

    তাদের সম্পর্কে কোনো সামাজিক নাম নেই। না তারা স্বামী-স্ত্রী, না প্রেমিক-প্রেমিকা, না কোনো ঘোষণাবাহক যুগল।


    তবু একটা সম্পর্ক এমন আছে, যেটা “তুমি” বললেই মনে হয়, পৃথিবী থেমে গেছে একটু।

    একদিন রুমী হঠাৎ বললেন,

    রিমা, তুমি জানো তো, আমি চাই না আমার কবিতাগুলো আমার মৃত্যুর পর হারিয়ে যাক।

    রিমা হেসে বলল,

    আপনি মরবেন না। আমি বেঁচে থাকতে দেবো না মরতে। আমি আপনার কবিতাগুলোর কবর খুঁড়তে দেবো না।

    রুমী অবাক হয়ে তাকালেন।
    রিমা তার ফোন বের করল, দেখাল—একটি ওয়েবসাইট খুলেছে, যেখানে রুমীর সব কবিতা টাইপ করে রাখছে।

    এই ওয়েবসাইটের নাম — rumikobita.com
    এখানে আপনি থেকে যাবেন। আপনার লেখা, আপনার ভালোবাসা, আপনার আমি।

    রুমী তখন বুঝলেন—শেষ মানে থেমে যাওয়া নয়।
    তাদের এই অসম প্রেম কখনো নাম পাবে না হয়তো,
    তবু তা থেকে যাবে বাতাসে, বইয়ের পাতায়, আর কারও নিঃশ্বাসে।

    একদিন কেউ বলবে—

    এক কবি ছিলেন, যিনি শেষ বিকেলে আবার জীবন পেয়ে গিয়েছিলেন—একজন পাঠিকার চোখে।

    সমাপ্ত

    © আলম