পালমার্সটন নর্থে বসবাস আর বাস ভ্রমণ
সভ্যতা মানুষকে যতটুকু দেয় তার চাইতে ঢের বেশী কেড়েই নেয়। অন্তত আমার সেরকমই ধারণা। এই যেমন মায়া মমতা ভালবাসা সবই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সভ্যতা আর করে ফেলেছে সহজলভ্য। মাত্র একদিন মা দিবসে মা’কে ভালবাসা জানাবো একদিন বাবা দিবসে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাবো, জন্মদিনে বন্ধুকে মনে করে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলবো না।অন্য সবদিন সে আমার মনে নাই বা থাকলো – কি যায় আসে তাতে! বিবাহ বার্ষিকীতে একদিন ঘটা করে অনুষ্ঠান করবো আর তাতেই প্রমাণিত হবে জগতের কাছে যে আমরা কতটা সুখী। নিজের অন্তরে অনুভবের চাইতে আজকাল লোক দেখানো কৃত্রিম প্রকাশ মানুষের মাঝে তুমুলভাবে বেড়ে গেছে আর সাথে সাথে টান পড়ছে ভালবাসার। এর অভাবে কিছু মানুষ মারা যাচ্ছে আর কিছু বিভ্রান্ত হয়ে নকলের মুখোশ পরে ভুল ভালবাসা বিকোচ্ছে।আমি এখনো মামুলী তাই প্রতিদিন আমার জন্যে মা দিবস বাবা দিবস বন্ধু দিবস আর ভালবাসা আমার প্রতি মূহুর্তের অলংকার। অনেকে বলে থাকেন ভুল মানুষে আর ভুল জায়গায় ভালবেসে নিজেকে নিঃস্ব করতে নেই। আমি বলি ভালবাসার কোন ভুল নেই, কোনো ভুল মানুষ নেই আর তাতে শুধু দিনে দিনে সমৃদ্ধই হওয়া যায় তবে তা প্রকৃত ভালবাসা হওয়া চাই।
প্রমার বাবার চাকুরীর পর পালমার্সটন নর্থে প্রথম বিবাহ বার্ষিকিতে কেন জানি আমার একটা হীরের আংটির শখ হয়েছিলো। পরে অবশ্য হীরের অনেক গহনাই কেনা হয়েছে জন্মদিনে আর বিবাহ বার্ষিকিতে তবে সেগুলো আমার চাকরী শুরুর পর এবং সংগত কারণেই তা দু’জনের টাকায়। আমরা একদিন দোকানে গেলাম এবং মোটামুটি সামর্থের মধ্যে তিন পাথরের একটা আংটি সে কিনে দিয়েছিল। আমার কাছে ঐ আংটি বা তার দামের চাইতেও মুহূর্তটি বড় ছিল আর তা এখনো সতেজ হয়ে বুকে আছে। এজন্যে উপহার কিনবার আর দেবার সময়টুকু যথাসম্ভব সুন্দর করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। সেই সুন্দর মুহূর্ত তখন আরও অনেক অভিনব মুহূর্তর জন্ম দিতে পারে।
পালমার্সটন নর্থে আমাদের বেশ ভালো সময় কাটতে থাকলো। কম সংখ্যক বাঙ্গালী কোনো শহরে থাকলে সবাই সবাইকে চিনে আর সবার সাথেই মিশে। ঈদে সব বাসায় যেতে হবে, সবাই আসবে আমার বাসায়। সে এক অন্যরকম মজা। আমরা দু’জনই ওখানকার সংগঠন মানোওয়াটো বাঙ্গালী সমিতিতে সক্রিয় হলাম। আমি সাংস্কৃতিক দিকে আর প্রমার বাবা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলো। আমরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলাম করলাম আর তাতে বহু বৎসর ধরে জড়িত এবং সম্ভবত সংগঠনের উদ্যোক্তরা সন্ধ্যা বৌদি আর চ্যাটার্জি দাদা ছিলেন কেন্দ্রবিনদু। তাছাড়াও হুদা ভাই বৌদি, মামুন ভাই জলি ওনাদের বেশ মনে পড়ে।
আমি যতটুকু পারি ঘরে বসে পড়াশুনা করেই ইউ এস এম এল এ দ্বিতীয় পর্ব দেবার সিদ্ধান্তে নিলাম। তার জন্যে সুদূর অকল্যানড যেতে হবে। আমি মা অতএব ছোট্ট প্রমার দায় আমারই আর প্রমার বাবা রেজিস্ট্রারের দায়িত্বশীল পদে থাকবার জন্যে তার পক্ষে কোনোই ছুটি নেয়া সম্ভব হলো না আমার পরীক্ষা উপলক্ষে। তবে সে আমাদের জন্যে বাসের টিকিট কেটে দিয়েছিল আর সকাল সকাল কাজে যাবার আগে বাসে তুলে দিয়েছিল। আমি তখন বুঝতে পারিনি মোটেই চার বৎসরের ছোট্ট প্রমাকে নিয়ে আট নয় ঘন্টা বাস জার্নির পরিনাম। আর তারপর আত্মীয়ের বাসায় তাকে রেখে পরদিনই সারাটাদিন পরীক্ষা দেবার দুঃসাহস আমি কেমন করে করেছিলাম। প্রমা মা আমার শান্ত স্বভাবের তাই কান্নাকাটি করতো না। তাই বলে আমি ওর প্রতিটা কষ্টের অনুভব বুঝেছি আর আজ অবদি মনে রেখেছি। বলাই বাহুল্য প্রমার তো না ই আমারও এর আগে বাসে এতত বড় ভ্রমণের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
চার ঘন্টা পর বাস একটা ছোট্ট শহরের রেস্টুরেন্টে থামল দুপুরের খাবার আর টয়লেটের কাজ সারবার জন্যে। প্রমার মুখ ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে, ক্ষুধায়, জার্নিতে আর পেশাবের বেগে। আমি দেখলাম লোকজনের বিশাল লাইন রেস্টুরেন্টের সামনে তাই আমি ওকে প্রথম টয়লেট সারিয়ে আনতে গেলাম। ফিরে এসে খাবার পেতে বড্ড দেরী হয়ে গেলো। যখন প্রমার হট চিপস আর খাবার নিয়ে বসলাম তখনই হলো বাস ছাড়বার উপক্রম। আমি কিছুটা মুখে দিয়ে আমার খাবারটা নির্দবিধায় ফেলে দিলাম আর প্রমার চিপস গুলো হাতে নিয়ে বাসে উঠতে গেলাম। বাস ড্রাইভার ভীষণই বিরক্তির সাথে আমাকে নোটিশটা দেখালো যেখানে পরিষ্কার লিখা আছে শুধুমাত্র পানি ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য বা পানীয় নিয়ে বাসে উঠা নিষেধ। আমি প্রমার চিপস, কমলার রস ফেলে দিয়ে অশ্রুসজল চোখে বাসে উঠেছিলাম আর ভেবেছিলাম এ কোন দেশে আসলাম যেখানকার মানুষ এতো বর্ণবাদী।
আমার পুরো ভ্রমণে একবারও মনে হয়নি যে সে তার কাজ রুটিন মাফিক করে গিয়েছিল। আমাকে আঘাত করবার জন্যে তার আলাদা কোনো ইচ্ছেই ছিল না। আমি পরদিনই হয়তো তাকে মাফ করে দিয়েছি কিন্তু আজ অবধি ক্ষতটা লালন করছি।
চলবে…