অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩২)

Photo of author

By নবনিতা শেখ

“ভাবি! কেমন আছো?”

কারো মিষ্টি কন্ঠের সুপরিচিত ডাক শুনে ঠোঁটে হাসির রেখা প্রশস্ত করে পিছু মুড়লাম। নিশার মায়াবী মুখশ্রী দেখতেই আমি প্রশ্ন তুললাম,“এতক্ষণে এলে? আসতে এতো দেরি হলো যে?”

নিশা তার উঁচু পেট হাতে চেপে এগিয়ে এলো এদিকে। আমি ওকে নিয়ে বসিয়ে দিলাম বিছানায়। নিজেও সামনে বসলাম।

আমার দিকে তাকিয়ে নিশা বললো,“রুদ্র ভীষণ ব্যস্ত গো। ভাইয়ার কিছু কাজের জন্য শহরের বাইরে গেছে। একা ছিলাম তো, এজন্য আসতে দেরি হলো।”

“সে কি! একা এলে কেনো? আমাকে বলতে। আমি নিয়ে আসতাম।”

“আমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি ভাবী।”

“কিন্তু… আচ্ছা রুদ্র ভাইয়া আসবে না?”

“চলে আসবে সন্ধ্যার আগেই।”

“আচ্ছা! এখন এটা বলো তো! রুদ্র ভাইয়াকে তোমার সেই ‘ভালোবাসি না, একটুও না’ বলে অত্যাচার করাটা কি এখনও চলছে?”

নিশা হাসলো। অনেক গুলো মাস সময়ের সাথে পেরিয়েছে। আমাদের সেই পিচ্চি নিশাও মা হতে চলেছে। নয় মাস চলছে। আর আমার সোনার আজ জন্মদিন।

নিশা জিজ্ঞেস করলো,“আমার কিটিক্যাট কই ভাবি?”

নিশার কথার প্রেক্ষিতে হাসলাম আমি। আমার সোনাকে নিশা আদর করে ‘কিটিক্যাট’ বলে ডাকে। বিড়ালের বাচ্চার মতো দেখতে হয়েছিলো বলেই নিশার এই উদ্ভট নামের আবিষ্কার। বড্ড আদুরে একটা নাম।

আমি নিশাকে বললাম,“তোমার ভাইয়ের সাথে আছে।”

“আচ্ছা! ভাবি!”

“হুম, বলো।”

“নাহ্, কিছুনা।”

আমি জোর করলাম বলতে,“কিছু তো অবশ্যই। বলে ফেলো।”

“আমার কয়েকদিন ধরে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে ভাবি।”

“কীরকম?”

“জানিনা। বুঝতে পারিনা। খারাপ লাগে ভীষণ।”

“ওগুলো কিছু না। প্রেগন্যান্সিতে এরকম হয়। স্বাভাবিক এটা।”

নিশা মিহি হেসে বললো,“আমার কাছে এটা স্বাভাবিক লাগছে না কেনো ভাবি?”

“বেশি চিন্তা করছো তুমি। দেখবে, সব ভালোয় ভালোয় হয়ে যাবে।”

“হুম। তাই যেনো হয়।” —কথাটি বলে, একটু থেমেই আবারও আমাকে ডাকলো, “ভাবি?

“হ্যাঁ!”

“আমার কিছু হয়ে গেলে…”

কথাটি শেষ করতে না দিয়েই বললাম,“বেশি বকছো কিন্তু এবার।”

নিশা মাথা নিচু করে ফেললো। পেটের উপরে হাত বুলিয়ে নিলো। এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো,“আমার অবর্তমানে আমার বাচ্চা একা হয়ে যাবে, তাইনা?”

আমি বুঝতে পারলাম। আমারও ডেলিভারির আগে এরকম অনেক বাজে চিন্তা মাথায় এসেছিলো। হয়তো ওরও তাই হয়েছে। তাই শান্ত থাকলাম।

নিশা আবারও বললো,“আচ্ছা, আমি না থাকলে যদি রুদ্র বিয়ে করে নেয়? হাজার হোক, পুরুষ মানুষ তো! স্ত্রীর প্রয়োজন আছে তার সংসারে। আমার বাচ্চা সেখানে ভালো থাকবে তো?”

মুচকি হেসে বললাম,“কিছু হবে না তোমার। আর তোমার বাচ্চা কখনো একা হবে না। তুমি আছো, আমি আছি। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তোমার কিটিক্যাট আছে।”

নিশা এখনও উদাস মনে নিজের পেটের দিকে চেয়ে আছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেনো কোনো বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়াচ্ছে।

নিশা ওভাবে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “ভাবি! আমার কি রুদ্রকে বলে দেওয়া উচিত? অনেক তো অভিমানে ছিলাম।”

আমি নিশার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলা উচিত?”

নিশা হেসে বললো,“এই-ই যে! তাকে ভালোবাসি।”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।”

নিশা আমার দিকে তাকালো অনেকক্ষণ বাদে। নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে বললো,“তাহলে, কালই বলবো।”

তখন সেখানে আসলেন আরহান। আমি তাকে দেখে এগিয়ে গেলাম। আরহানের কোল থেকে আমার ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে নিজের কোলে জড়িয়ে নিলাম। আরহান মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে নিশার পাশে বসলেন।

জিজ্ঞেস করলেন,“কেমন আছো?”

“ভালো আছি ভাইয়া। তুমি?”

“ভালো।”

আর কোনো কথা নেই। আরহান বরাবরই বাকি সবার সাথে কম কথা বলেন। এটা নতুন না। তখনই নিহান আমার কোল থেকে নড়ে চড়ে উঠে কেঁদে দিলো। ছেলের নাম, আরহান ‘নিহান’ রেখেছেন। আমাদের দুজনের নামের সাথে মিলিয়ে।

এদিকে আমার বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো। সে কী কান্না! অনেক চেষ্টা করছি থামানোর। কিন্তু কে থামে!

নিশা একটু কষ্ট করে উঠে এলো আমার কাছে। এগিয়ে এসে আমার কোলে থেকেই নিহানকে কান্না থামানোর জন্য বিভিন্ন অদ্ভুত বাক্য, শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলো। আর এটা কাজে লেগেও গেলো। কান্না থামিয়ে দু’গাল ভরে হেসে দিলো। দন্তহীন এই হাসিটা ভীষণ সুন্দর!

নিশা ওভাবেই বললো,“আমার কিটিক্যাট কিন্তু ভীষণ পাজি হয়ে যাচ্ছে।”

নিহান বুঝলো কি না জানিনা। তবে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। অস্পষ্ট স্বরে আধো আধো বুলিতে বললো,“মা,মানি, মাম্মানি, মাইই।”

আমি মুচকি হাসলাম। আমার বাচ্চাটা কী সুন্দর ডাকে! এই বয়সে, কিছু ডাক শিখেছে। যেমন: পাপা,মাম্মা, দাদ্দি, মাম্মানি, মানি, মা, মাই সহ আরো বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করে, যা একদম অস্পষ্ট। কেটে কুটে কিছু শব্দ বুঝে নিয়েছি।

_____________________

সন্ধ্যায় বাড়িতে অনুষ্ঠান। সাজানো হয়েছে ভীষণ সুন্দর ভাবে। নিহানকে দীপ্তির কাছে রেখে আমি রান্নার দিকটা সামলাচ্ছি। আজ অনেকদিন বাদে এলাম রান্না করতে। ছেলের প্রথম জন্মদিন বলে কথা। নিজে না রান্না করলে হয়?

বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই এসেছে। তাদের বাচ্চা কাচ্চা সব পুরো বাড়ি দৌঁড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

কিচেন থেকে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আরহানের মামাতো ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা খেলছে। হুট করেই নজরে একটা সূক্ষ্ম জিনিস বিঁধলো। একটা মেয়ের হাতের জুসের গ্লাস থেকে অর্ধেকটা সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছে।

কেউ পড়ে যেতে পারে এতে। পাশে থেকে হালিমা খালাকে বললাম,“সিঁড়িতে না জুস পড়েছে। একটু ক্লিন করার ব্যবস্থা করুন।”

“আচ্ছা, একটু পর করছি।”

পুনরায় সবাই নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে নিজের উপর ভীষণ অবাক হই। কতোটা সাংসারিক হয়ে গিয়েছি আমি! ইশ!

আরহান এলেন কিচেনে। হালিমা খালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“গেস্টদের কী লাগবে, একটু দেখে আসুন।”

হালিমা খালা নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। আমি নিজের কাজ করে যাচ্ছি। আরহানকে যেতে না দেখে উনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী চাই?”

“বউ চাই।”

আরহানের সহজ সরল স্বীকারোক্তি শুনে আমি কপাল কুঁচকালাম। পরপরই হেসে দিলাম। এতে আরহান তেজী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“নিজের বউ চাই। এতে হাসির কী আছে?”

“বা রে! হাসি পেলে হাসবো না। আপনি এভাবে বউ পাগল হয়ে যাবেন। এও দেখার ছিলো!”

কথাটা বলে আবারও হেসে দিলাম। আরহান “হাসো হাসো! হাসতে থাকো। দিন আমারও আসবে।” বলেই প্রস্থান করলেন।

আমি ওভাবেই হেসে যাচ্ছি। লোকটা এতটা ভালোবাসে আমাকে। বলার বাইরে। এইতো সেদিন। আমার লিভার পেইন উঠলো। আমি যতোটা না কষ্ট পেয়েছি, আরহান তার থেকে অনেকগুণ বেশি যন্ত্রণা অনুভব করেছে। সেদিন আরহানের চোখে দ্বিতীয়বার পানি দেখেছি। আমারও নিশার মতো বারবার মনে হচ্ছিলো, এইযে ওটিতে যাচ্ছি। ফিরতে পারবো তো? সেদিন আরহানকে নিষ্পলক দেখে গিয়েছি অনেকক্ষণ। মস্তিষ্কে একটা কথাই বিচরণ করেছিলো, আরহানকে আবার দেখতে পাবো তো! আমার না! উনাকে ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি। একটুও না।

হুট করেই কারো উচ্চকন্ঠে চিৎকারের আওয়াজে আমি চকিতে চাইলাম আওয়াজের উৎসের পানে। স্তব্ধ, হতবিহ্বল আমি ভয়ে জমে গেলাম। পুরো শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। হাতের, কাঁচের বাটিটা গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। বিকট আওয়াজে ভেঙ্গে গেলো। ততক্ষণে বাড়িশুদ্ধ মানুষ সিঁড়ির সামনে জড়ো হয়েছে।

নিশা কিছুক্ষণ আগেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে। আরহান দ্রুত এগিয়ে গেলো। কোনোকিছু বুঝতে পারছে না। এতক্ষণে নিশার সাদা কুর্তিটা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছে। আমি এগিয়ে যেতেই আরহান, নিশাকে পাঁজা কোলে তুলে বাড়ির বাইরের দিকে অগ্রসর হলেন।

এতক্ষণে মা কেঁদে কেটে অস্থির। নিহানকে দীপ্তির কাছে রেখে বাকিরা মিলে নিশাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

__________________________

নিশাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরহান, আমি ও মা বাইরে পায়চারি করছি। রুদ্রকে খবর দেওয়া হয়েছে, রাস্তায় আছে।

নিজেকে দোষী লাগছে। কেনো সিঁড়িতে পড়ে থাকা জুস মুছে দিলাম না? আজ গাড়িতে পুরোটা পথ নিশা উল্টা পাল্টা বলে এসেছে। সে বারবার বলছিলো,“আমার কিছু হয়ে গেলে,আমার বাচ্চাকে দেখে রেখো। রুদ্র কই? ও আসবে না? আমি দেখবো তো ওকে।”

প্রচন্ড যন্ত্রণায় নিশা বারবার রুদ্রের নাম জপছিল। ওকে যখন ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো, ও যেতে চাচ্ছিলো না। চক্ষুদ্বয় চাতক পাখির ন্যায় রুদ্রের সন্ধ্যান করছিলো। কান্না করছিলো নিশা। কাঁদতে কাঁদতে শেষে একটা কথাই বলেছে,“ওকে আর দেখা হলো না আমার।”

আরহানকে কখনো ভীত হতে দেখিনি আমি। তবে আজ…

বন্ডে সাইনের সময় উনার হাত কাঁপছিলো। আজ ভীষন অস্থির লাগছে আরহানকে। নিশাকে ওটিতে ঢোকানোর পর থেকে হাঁসফাঁস করছেন আরহান। পুরো করিডোর পায়চারি করছেন। আর মা! উনিতো পূর্ব ভঙ্গিতে কেঁদেই চলেছেন।

কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো, আমার এক মা অন্য মাকে সামলাচ্ছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছি সবাই আর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছি।

দেখতে দেখতে দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। ভয়ে হাত পা শিরশির করছে। আজ যেই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে যেকোনো কিছু হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। বারবার আজ সকালের কথা মনে পড়ছে। নিশার বলা সেই কথা গুলো। মেয়েটা বলছিলো, তার অস্থির লাগছে। আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত ছিলো।

আমার ভাবনার মাঝেই ওটির দরজা খুলে গেলো। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইলাম। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে সবার মুখে এক চিলতে হাসির দেখা মিললো। একটা নার্স বাচ্চাটিকে কোলে করে বেরিয়ে এলো।

আরহান এগিয়ে গেলেন। নার্স, বাচ্চাটিকে আরহানের দিকে দিয়ে বললো,“মেয়ে হয়েছে।”

আরহানের মুখের হাসি, আরো খানিকটা প্রশস্ত হলো। কিন্তু নার্সের বিষণ্ণ মুখ দেখে আরহানের হাসি থেমে গেলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সাহস যুগিয়ে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম,“পেশেন্ট? পেশেন্ট কেমন আছে?”

নার্স মাথা নিচু করে রইলো। তখন ভেতর থেকে সিনিয়র ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। আমাদের সবাইকে একবার দেখে নিলেন। অতঃপর মিহি কন্ঠে বললেন,“উই আর সরি।”

আরহান কেঁপে উঠলেন। মা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। আরহান জিজ্ঞেস করলেন,“আর ইউ কিডিং মি?”

“নো। অনেক ক্রিটিকাল একটা কেইস ছিলো। মা ও বেবির মাঝে যেকোনো একজনকে বাঁচানো যেতো। আমরা তখনই আপনাদের ইনফর্ম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পেশেন্ট আমাদের রিকুয়েস্ট করলো, যাতে আপনাদের না জানাই, এবং বাচ্চাকে বাঁচাই। আমরা উনার কথা শুনতে চাইনি। কিন্তু.. শেষ মেষ উনার রিকুয়েস্ট এর জন্য বাধ্য হই।”

আরহান একবার তার কোলে কান্না করতে থাকা বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে নিলো। চোখের বাঁধ ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আরহানের। পরপর এতো ধাক্কা উনার জন্য সহনীয় নয়।

তখন সেখানে রুদ্র এলো। বড্ড এলোমেলো ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ঘামে পরনের ব্লু শার্টটি শরীরের সাথে চিপকে আছে। আরহান মাথা নিচু করে আছে। রুদ্রের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। রুদ্র এগিয়ে এসে বললো,“আমার নিশা কোথায়?”

আমরা সবাই পাথরের ন্যায় বসে আছি। রুদ্র আরহানের কোলে বাচ্চা দেখা মাত্রই দ্রুত এগিয়ে সেদিকে গেলো। বাচ্চাটিকে দেখতেই তার ঠোঁটে হাসির দেখা মিললো।

মিষ্টি হেসে বললো, “মাশাআল্লাহ স্যার! একদম আমার নিশার কপি হয়েছে।”

তখন অপারেশন থিয়েটার থেকে স্ট্রেচারে করে সাদা কাপড়ে ঢাকা নিশাকে আনা হলো। রুদ্র সেদিকে দেখেনি। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,“ম্যাম! নিশা কোথায়? কেমন আছে ও? নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে জানেন? আমার নিশার সবচেয়ে কষ্টের টাইমে আমি ছিলাম না ওর পাশে। এই নিয়ে তো সারাজীবন খোটা দিতে ছাড়বে না।”

কথাটি বলে রুদ্র হালকা হাসলো। আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে দিলাম। আমার কেনো যেনো নিশার চেয়ে বেশি রুদ্রের জন্য কষ্ট লাগছে। যে চলে গেলো, সে তো গেলোই। কিন্তু যে থেকে গেলো, অপূর্ণতাসহ এই কষ্ট নিয়েই বাকিটা জীবন থাকতে হবে।

আমার কান্না দেখে রুদ্র কপাল কুঁচকে ফেললো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, “ও.. ও ঠ..ঠিক আছে?”

কাঁদতে কাঁদতে মাথা দুই পাশে নেড়ে ‘না’ বোঝালাম। রুদ্র দুই কদম সরে গেলো। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় ও?”

ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল, স্ট্রেচার বরাবর ইশারা করে বললাম,“ও.. ঐযে।”

রুদ্র সাদা কাপড়ে মোড়ানো নিশাকে দেখে দৌঁড়িয়ে সেদিকে গেলো। কিছুটা সামনেই দাঁড়িয়ে গেলো। বার কয়েক হাত এগিয়ে মুখের সামনে থেকে কাপড় সরানোর প্রচেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। কিছুই পারছে না। কেনো পারছে না?

অনেকক্ষণ বাদে পুনরায় নিশার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। কম্পনরত হাত দিয়ে নিশার মুখের কাপড় সরিয়ে ফেললো। নিশার মায়াবী মুখশ্রী দেখতেই রুদ্রের পুরোনো স্মৃতি সব মনে পড়তে লাগলো।

সেইযে প্রথম দেখা। যখন নিশা বাচ্চা ছিলো। রুদ্র ছিলো কিশোর। সেই কিশোর মনে ভালোলাগার বীজ বোপন করেছিলো নিশা নামক এই মায়াবিনী। সে মায়া তৈরি করেছিলো। ধীরে ধীরে সেই ভালোলাগা, ভালোবাসায় পরিণত হলো। কিন্তু সাধ্যের বাইরে ছিলো নিশা। পাবার আশা সেখানেই দাফন করে দিলো। তারপর একদিন ভালোবাসার মানুষটির চোখে নিজের জন্য অপেক্ষা দেখলো। তার ভালোবাসা পাবার আকাঙ্খা দেখলো। সেদিন রুদ্রের খুশির সীমা ছিলো না। কিন্তু মাঝে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হলো। শেষ মেষ নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পেলো। কিন্তু সে শাস্তি দিয়েছে। ভালোবাসি বলেনি। কোনোদিনও ভালোবাসি বলেনি রুদ্রকে।

হাত এগিয়ে নিশার গালে রাখলো রুদ্র। হেসে হেসে বললো, “এ..এই নিশা। নিশাপাখি আমার। উঠো না। এইযে এসে গেছি তো আমি। জানো, আমাদের বেবি একদম তোমার মত দেখতে হয়েছে। দেখবে না তুমি? এই নিশাপাখি। উঠো না সোনা। আই প্রমিজ, কোনোদিন জ্বালাবো না, বিরক্ত করবো না। প্লিজ উঠো। আচ্ছা, এরপর থেকে তোমার সিরিয়াল দেখার টাইমে খেলা দেখা নিয়ে ঝগড়া করবো না। রান্না যেমনই বানাও, খেয়ে নেবো। যখন যা বলবে, সব মানবো। তোমার সব কথা শুনবো পাখি। প্লিজ উঠে যাও। শাস্তি দিয়ো না আমাকে। আমি বাঁচতে পারবো না তোমাকে ছাড়া। নিশা…”

কেঁদে দিলো রুদ্র। ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু রুদ্রের চিৎকারে আশে পাশের সব মানুষ ভিড় জমালো। কান্না করলো। মৃত নিশাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,“তোমাকে বলেছিলাম না? তোমাকে পাবার আশা রাখিনি। ছেড়ে যাওয়া সহ্য করতে পারবো না। এটা কেনো করলে? কেনো?”

রুদ্র কাঁদতে লাগলো। কাঁদছি আমিও। মা সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। একমাত্র মেয়ের এমন কিছু মানা তার জন্য সহজ না। আরহান যেভাবে ছিলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আরহান সবার সাথে তেমন কথা বলতেন না। তবে আমি দেখেছি, সবার খেয়াল রাখতেন। সবসময়। নিজে না পারলে, আমাকে বলতেন। আর সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন নিজের আদরের বোনকে। লোক দেখানো ছিলো না সেই ভালোবাসা।

আরহান বাচ্চাটিকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

রুদ্র পাগলের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে। তাকে থামানোর সাধ্য কারো নেই। কীভাবে থামাবে?

একটা মানুষ ভালোবাসা না পেলে কষ্ট পায়। পেলে খুশি হয়। কিন্তু যে পেয়েও হারিয়ে ফেললো, সে?

কাউকে না পেলে নিজের অবুঝ মনকে বোঝানো যায়, ‘হয়তো সে আমার না’। কিন্তু একবার তাকে পেয়ে যাবার পর, সে আসক্তি হয়ে যায়। এটা বড্ড অদ্ভুত আসক্তি।

পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা তো কেবল সে-ই বোঝে, যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কাউকে নিজের করে পেয়েছে, এবং নিজ-চোখের সামনেই তার হারিয়ে যাওয়া দেখেছে। তাকে আমরা কেবল সমবেদনা জানাতে পারি। দম বন্ধকর কষ্ট তো সে-ই পাচ্ছে। ভালোবাসা কখনো হারায় না, তবে হারিয়ে যায় ভালোবাসার সেই প্রিয় মানুষটি। সকল হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষদের জন্য রয়েছে কেবল ‘দীর্ঘশ্বাস’। আর কিছুই তো করার নেই। অতঃপর তারা রয়ে যাক আজীবন, স্মৃতির পাতায় চোখ বুলিয়ে, বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা এক দীর্ঘশ্বাস রূপে।

চলবে…