প্রবাস জীবন (পর্ব-৬)

Photo of author

By Shahnaz Parveen

পালমার্সটন নর্থ যাত্রা আর বন্ধুত্ব

ভাগ্যটা বিধাতা নিজেই তৈরী করে দেন, এতে কারো কোনো হাত নেই। আমার মতে সকলের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ,রিজিক এমনকি কে কোথায় কখন কি করবে সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত। আর আমরা কি কষ্টই না করছি প্রতিমুহূর্ত সেই রম্যনাটকে অভিনয় করতে গিয়ে। কেউ ধনী কেউ গরীব কেউ সক্ষম কেউ অক্ষম কেউ উদার কেউবা কৃপণের ভূমিকায় নিরলস পরিশ্রম করে চলেছি। এতো এতো ধনী পৃথিবীতে থাকতেও যেখানে মাত্র একজন ধনী পৃথিবীর সকল ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে সেখানে প্রতি মিনিটে ক্ষুধায় কতজন মারা যাচ্ছে। অনেকেই যখন বলে দেখো দেখো আমি নিজ পরিশ্রমে নিজ শক্তিতে এতোদূর এসেছি আর এতো বড় হতে পেরেছি- আমি তখন মনে মনে হাসি আর বলি সবই তাঁর ইচ্ছে।

আমি ইউ এস এম এল এ পার্ট ওয়ানের ফর্ম জমা দিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকলাম। পড়াশুনা তেমন হয়নি, সারাদিন ঘর সংসার প্রমাকে দেখাশুনায় সময় পার হয়ে যায়। তারপর যখন পড়তে বসি চিন্তা আর অবসন্নতা মনকে ছেয়ে ধরে। ঘুম পায়,ভীষণ ঘুম পায়। মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি আর স্বপ্নে দেখি আমি সবার শেষে পরীক্ষার হলে পৌঁছেছি ততক্ষণে সবার লিখা প্রায় শেষ। অথবা আমি যেগুলো জিনিষ রিভাইজ করে আসতে পারিনি সেগুলো সব প্রশ্নপত্রে আর আমি কিছুই পারছি না। সময় সময় অবশ্য ঘুমের মধ্যে আমি দেখি পাতার পর পাতা আমি পড়ে ফেলছি, হঠাৎ ঘুম ভাঙলে চেষ্টা করি দেখিতো যা পড়লাম তার কিছু মনে আছে কিনা! আমার কারো সাথে জোট করে পড়বার সৌভাগ্য হলো না বা একদিনও লাইব্রেরিতে যাওয়া হলো না। আমি প্রমাকে খাওয়াই আর পড়ি, রান্না করি আর পড়ি, সকল কাজে প্রমা আর বই আমার সঙ্গী। তবু আমি এক হীনমন্যতায় ভুগতে থাকলাম যদি আমি পাশ করতে না পারি? চুরি করে ফর্ম জমা দেবার সাজাটা ঠিক মিলবে আর সহজে জীবনে পরীক্ষার কথা তুলতে পারব কিনা সন্দেহ।

আল্লাহর অশেষ রহমতে পরীক্ষা আমার মন্দ হলো না আর রেজাল্ট ও তদ্রুপ বেশ ভালোই পেলাম। ওমন নম্বর দুই চারজন পেয়েছে হয়তোবা। আমার মনে দৃঢ়তা চলে আসল যে কোনো উপায়েই আমাকে পড়াশুনা চালিয়েই যেতে হবে আর কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে হবে। আমি শুধু শুধু বাংলাদেশর সবচাইতে ভালো মেডিক্যাল কলেজ থেকে সন্মানের সাথে পাশ করে আসিনি। ইতোমধ্যে প্রমার বাবা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা পাশ করে চাকুরী যোগাড় করে ফেলল পালমার্সটন নর্থ নামের এক শহরে। আমাদের সেখানেই দ্রুত যেতে হবে আর আমি বুঝে গেলাম আমার সংগ্রাম তখন থেকে বাড়বে বৈ কমবে না। আমাদের বাসার যৎসামান্য ফার্নিচার বিক্রি করে দিলাম আর বাকী জিনিষগুলো যারা আসবাবপত্র কিনল তাদের এমনিতেই দিয়ে দিলাম। প্যসিফিক আইল্যনড এর যুগল তাতে দারুন খুশী হলো। আমি আমার স্বামীর বেতনের সংবাদ শুনে ওখানে নতুন জিনিষপত্র কিনে ভালমতন বাসা সাজানোর পরিকল্পনা মনে মনে করে ফেললাম। ওখানে হাসপাতালের দুই বেডরুমের একটা বাসা আমাদের জন্য বরাদ্দ করে রাখা হয়েছিল।

তবে আমাদের মনে সামান্য দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো গাড়ির ব্যপারে। আমরা আমাদের পুরনো হোনডা সিভিক গাড়িতে সাত আট ঘন্টা দূরযাত্রায় পরিবহন করে ঝুঁকিমুক্ত পৌঁছাতে পারব কিন এব্যপারে সন্দেহ জাগলো। এর পরিপ্রক্ষিতে আমার সদয় বন্ধু মোমিন আমাদের অতদূরের শহর পর্যন্ত সঙ্গ দিতে রাজী হলো এবং কথা হলো ও দুই একদিন পালমারসটন নর্থ থেকেই আবার অকল্যনডে ফিরে আসবে। আমি প্রমা, তার বাবা আর মোমিন যথারীতি সকাল সকাল রওনা করলাম। সাথে ছিল গাড়ি ভর্তি নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল। অনেকটা পথ গাড়ি ভালোই চললো তবে শেষরক্ষা হলো না। এখানে বলে রাখা ভালো যে নিউজিল্যান্ডের প্রায় সব শহরে যাবার পথই বেশ দূর্গম আর পাহাড়ী। একবার চূড়োয় উঠতে হয় বেশ খানিকটা উপর আবার নামতে হয় ঢাল বেয়ে আর এরকম চক্রাকারে চলতেই থাকে। আমরা দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম আর বেশ খানিকটা পথ তারপর ভালোমতনই এগুলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন প্রায় রাত নেমে এসেছে তখন গাড়ি উচ্চগামী পথে আওয়াজ দিতে শুরু করলো যে তার কষ্ট হচ্ছে। তারপর আর বেশীক্ষণ লাগল না/একেবারে নির্জন এক পাহাড়ী জঙ্গলা জায়হায় গিয়ে গাড়ি পুরোই মারা গেলো। আশপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার পূরোই অরণ্য, জনমানব বা বাড়িঘরের অস্তিত্ব নেই। সেইযুগে সেলফোনের তেমন প্রচলন ছিল না বিধায় আমাদের বা মোমিনের সেই সুবিধাও নেই।

ভয়ে আমার আত্মা প্রায় খাঁচা ছাড়া, ছোট্ট তিন বৎসরের প্রমাসহ অত রাতে আমরা কি বিপদেই না পড়লাম। এই বুঝি দূর্ধর্ষ ডাকাত বা ছিনতাইকারী আমাদের ধরলো! মোমিন সাহস করে বললো “ঐ দূরে প্রায় এক দেড় কিলোমিটার তো হবেই আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। ওটা নিশ্চিত কারো বাড়ি, আমি এগিয়ে দেখি কাউকে পাই কিনা। রশীদ ভাই আপনি থাকেন ওদের সাথে।” বেচারা কষ্ট করে কতক্ষণ তা বলতে পারব না পাহাড়ী পথে হেঁটে হেঁটে যেই বাড়ির আঙিনায় পৌঁছেছে। ওমনি বিশাল এক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ও ভাবল বাঁচার আর উপায় নেই, কুকুরের আক্রমণেই শেষমেষ মৃত্যু। ওর প্রাণপন চিৎকারে বাড়ির মালিক এক মহিলা অবশেষে বেরিয়ে এলো। মোমিন আমাদের বিপদটা বুঝিয়ে বলে একটা ফোন করতে চাইলে মহিলা তা করতে দিলো। অবশেষে আবার অতটা পথ অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে ফিরে এলো। আমাদের অতঃপর পালমার্সটন থেকে প্রমার বাবার দুই বন্ধু মোখলেস ভাই আর শরীফ ভাই নিতে আসলেন । আমি আবার নিশ্বাস নিলাম তখন। উনাদের হাসিমুখ ভুলবার নয়। জানতে পারলাম আমরা বুলস শহরের কাছাকাছি ছিলাম। ওখানে এক জিপির নাকি প্লেন আর হেলিকপটার আছে। তাতে করে আমরা বাকী পথ যেতে পারতাম! আমরা বাকীটা পথ গাড়িতে বসে মোমিনের লোমহর্ষক কাহিনী শুনতে থাকলাম। আমি ভাবলাম জীবনে কোনো কোনো বন্ধুর একদিনের অবদানের জন্যেই আজীবন সেই বন্ধুর কাছে ঋণ থেকে যায় যা কোনোদিন শোধ করবার নয় । ভালো থাকুক মোমিন আর তার সংসার। ভালো থাকুক বন্ধুতব ..ভালো থাকুক মানবতা।

চলবে…