চলমান গাড়ি এসে থামলো বিশাল বড় এক ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে। চারিদিকে গার্ডস। আরহানের বাড়ি এটা। গাড়ি থেকে আরহান নামলো। রুদ্র এখানে থাকে না। বাড়ির পাশেই স্টাফ কোয়ার্টার আছে। রুদ্র সেখানেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। নিজস্ব দুনিয়া বলতে স্যার, কাজ আর অব্যক্ত এক ভালোবাসা রয়েছে তার।
রুদ্র কোয়ার্টারে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়ি স্টার্ট দিলো। আরহান থামিয়ে দিলো। থেকে যেতে বললো। রুদ্রের অস্বস্তি হচ্ছে এখানে থাকার কথা শুনতেই। তবুও তার স্যারের কথা ফেলতে পারলো না।
আরহান ধীরকণ্ঠে “কাম” বলে বাড়ির ভেতরের দিকে পা বাড়ালো। রুদ্র আরহানকে অনুসরণ করে বাড়িতে ঢুকলো। বাড়িতে ঢুকতেই রুদ্রের নজর গেলো ড্রয়িং রুমে থাকা এক অপ্সরীর দিকে। সোফায় বসে আছে। নজর তার টিভিতে। উপভোগ করছে কার্টুন। নিষ্পাপ মুখশ্রীতে রয়েছে একরাশ মায়া। আর এই মুখখানা দেখেই রুদ্রের হৃদপিন্ড থমকে গেলো। চারিপাশ ভুলে তাকিয়ে রইলো এই মোহময়ী নারীর দিকে। নিজ মনকে একাজে প্রায়ই নিষেধাজ্ঞা জানায় রুদ্র। কিন্তু মন কি আর কথা শোনে?
“ভাইয়া! চলে এসেছো?”
নিশার সুরেলা কণ্ঠে ধ্যান ভাঙলো। রুদ্রের খেয়ালে এলো, এইমাত্র সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলো। নিশাকে দেখলে কেনো যে রুদ্রের হৃদপিন্ড অসুস্থ হয়ে যায়!
আরহান নিশার কথার উত্তরে হালকা আওয়াজে “হুঁ” বলে রুমে চলে গেলো। নিশা জানে তার ভাইয়া এরকমই। তাই কিছু মনে করলো না। তবে অন্য কেউ হলে, নিশ্চয়ই অপমানিত বোধ করতো। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে চোখ ঘুরালো দরজার দিকে। চোখ দুটো স্থির হয়ে গেলো। সামনে দাড়িয়ে আছে এক সুঠাম দেহের অধিকারী পুরুষ। শ্যাম বর্না পুরুষ বোধ হয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দেখতে হয়! দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলো নিশা। রুদ্র একটা চাঁদ। তাকে দেখতে পারবে, কল্পনায় স্বপ্ন বুনতে পারবে, তবে ছুঁতে পারবে না। সেই সাধ্যি নেই নিশার। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। রুদ্রও প্রস্থান করলো।
আরহান নিজের রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে নিলো। গোডাউনেই চেঞ্জ করে সব রক্ত শরীর থেকে ধুয়ে এসেছিলো। তাই বাড়ির কেউ এটা দেখেনি। আরহানের এই সিক্রেট গুলো তার মা-বোন জানে না।
রাত বাজে বারোটা। আরহানের এখন বেরোতে হবে। উদ্দেশ্য তার শুকতারা। সে তার শুকতারাকে না দেখে থাকতে পারে না। সম্ভব হলে, খুব আগেই নিজের কাছে নিয়ে আসতো। কিন্তু বাঁধা হয়ে মাঝে ছিলো তৃষ্ণা। আরহানের সবচেয়ে বড় শত্রু। আরহানের এর আগেও অনেক শত্রু হয়েছে, তবে কখনো কাউকে নিয়ে এতোটা বিপাকে পড়তে হয়নি। খুব চালাক এই তৃষ্ণা। নীলাভ চক্ষুদ্বয়ের অধিকারী। অধর জুড়ে রয়েছে নেশাক্ত এক হাসি। সমগ্র চেহারা মাদকতায় ভরপুর। আসক্তি তার নারী। যখন যেই নারীকে ভালো লেগেছে, সেই নারী নিজ থেকে তাকে সাড়া দিয়েছে। গান এবং গান(বন্দুক) দুটোতেই সেরা তৃষ্ণা। আর তার ডানহাত ছিলো এই গুপ্তচর। যাকে দিয়ে আরহানের সব খবরাখবর নিতো। একে শেষ করে দিয়েছে আরহান। এখন তৃষ্ণা দুর্বল। আরহানেরতো একমাত্র ভয় তার শুকতারা কে নিয়ে। আর এই তৃষ্ণা আরহানকে হারাতে যেকোনো লেভেলে নামতে পারে। কোনো ভাবে আরহানের উইক পয়েন্ট যদি ধরে ফেলে! তাই লুকিয়ে রাতের বেলায় তার শুকতারাকে দেখতে যায়। যেমনটি এখন বেরোচ্ছে।
________________________
রাতের গভীরতা বেড়ে গিয়েছে। নিস্তব্ধ রাত্রিতে কারো পায়ের ঠকঠক শব্দ ভেসে এলো আমার শ্রবণ ইন্দ্রীয়তে। গভীর ঘুমে মগ্ন আমি। তবুও এই শব্দ শুনতে পারছি। আঁখি পল্লব মেলতে অক্ষম। প্রতিরাতের মতো এবারেও। ছায়ামানব এগিয়ে এসে হাঁটু মুড়ে বসলো মেঝেতে। এই ছায়ামানবতো আরহানই। প্রতিবারের মতো আমার ডান হাতটি নিজের হাতে নিলো। হাতের পিঠে এঁকে দিলো, উষ্ণ পরশ। গভীর নয়নে দেখে যাচ্ছে তার শুকতারাকে। এ দেখায় এতো শান্তি! যেদিন প্রথম দেখেছিলো, সেদিন থেকে আমাকে দেখলেই আরহানের এমনটি লাগে।
আজ থেকে বছর খানেক আগেই তো দেখেছে। এয়ারপোর্ট থেকে ব্যাক করার পর, যখন আরহানের গাড়ি জ্যামে আটকে গিয়েছিলো, তখন ফুটপাত ধরে হেঁটে চলছিলো এক মেয়ে। তাকে দেখেই তো আরহান থমকে গিয়েছিল। এক মায়াবিনীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। সেই দিনটি কি আরহান ভুলতে পারে? মনে আছে প্রতিটি মুহূর্ত। এখনও ভাবতে গেলে সব জীবন্ত লাগে। সেদিন সেই মায়াবিনীর হৃদয় ছিলো ভীষণ ভারাক্রান্ত। একলা পথে গোমড়া মুখশ্রী নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। পরনে সুতির থ্রিপিস। ওড়নাটা মাথায় দেওয়া। সামনে ছিলো এক কৃষ্ণচূড়া গাছ। মাথাটা খানিক উঁচু করলো। রক্তলাল কৃষ্ণচূড়া দেখে তার ভারাক্রান্ত হৃদয়, নিমিষেই খুশির ঝলকানি দিয়ে উঠলো। আহা! জীবন নাই বা সুন্দর হলো। প্রকৃতি কি সুন্দর! প্রাণখুলে হেসে উঠলো মেয়েটি। আর আরহান সেই হাসিটি রাস্তার পাশে গাড়িতে বসে তৎক্ষনাৎ মুঠোফোনে বন্দী করে নিলো। এরপর কয়েক রাত নিদ্রাহীন কেটেছে। ব্যাস্ত নগরীতে নির্ঘুম থেকে আরহান তার শুকতারাকে নিয়ে বুনেছে অজস্র স্বপ্ন। তবে নিজের মনের অনুভুতি সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলো আরহান। বুঝতে পেরেছিলো দ্বিতীয় দেখায়। এইতো কিছু মাস আগেই। গভীর রজনীতে, ছাদের একপাশে রেলিং ধরে দাড়িয়ে ছিলো সেই মেয়েটি। চোখ দুটো নিক্ষিপ্ত ছিলো ঐ অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশপানে। সেদিন দ্বিতীয় বারের মতো আরহানের হৃদপিন্ড থমকে যায়। তাও একই মানুষের জন্য। মনের কোঠায় সেই মেয়েটির জন্য “শুকতারা” সম্বোধনটি বরাদ্দ হয়ে যায়। সে বার আরহান তার মনের সুপ্ত অনুভুতি সম্পর্কে অবগত হয়েছিলো। কিন্তু, তৃষ্ণা….
আরহান মস্তিষ্কের পুরনো স্মৃতিচারণ আপাদত বন্ধ করলো। নেশাক্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার শুকতারার দিকে। ঘর্মাক্ত মুখশ্রী, টানা টানা নেত্র, আলগা হওয়া অধরযুগল, ফুলো কপোল সব মিলিয়ে আরহানের একটাই কথা বলতে ইচ্ছে হয়,“আমার প্রতিটি নির্ঘুম রাত ধন্য, তোমার এরূপ দেখার সৌভাগ্য পেয়েছি…”
আলতো ভাবে হাত স্পর্শ করলো তার শুকতারার ঠিক কানের নিচে।বৃদ্ধাঙ্গুল গালে কিছু এঁকে বেড়াচ্ছে। আরহানের স্থির দৃষ্টি তার শুকতারার নেত্রযুগল থেকে সরে অবলোকন করলো গলার নিচে। এই কালচে তিলে। অপর হাত এনে ছুঁয়ে দিলো এই নেশাক্ত তিলকটির উপর। মৃদু ধারালো স্বরে উচ্চরিত হলো,“সেদিন ভার্সিটিতে যাওয়ার সময়, তোমার এই তিলের দিকে একটা শু*য়ো*রে*র নজর পড়েছিলো। তাকে তো সরিয়ে দিয়েছি। কিন্তু রাগ দমছিলো না। তাই তোমার সাথে ওমন করেছিলাম। আর তোমার সাথে যে এরকম হচ্ছিলো বাড়ির ভেতরে, তা আমার জানা ছিলো না। দুঃখিত..!”
__________________________
মেঘলা আকাশ দুড়ুম দুড়ুম আওয়াজ করেই চলছে। অন্ধকার হয়ে আছে চারিপাশ। বর্ষণের এই আমেজে এমনটা প্রায়শই ঘটে। আকাশ ভেঙ্গে গড়িয়ে পড়লো ফোঁটা ফোঁটা পানি। ধীরে ধীরে এই ধারাপতনের জোর বেড়েই চলেছে। হয়তো প্রতিটি ফোঁটা একটি অপরটির সাথে অঘোষিত প্রতিযোগিতা শুরু করেছে, কে আগে নিজেকে এই ধরণীতে বুকে মাখতে পারবে। নিকষ কালো আকাশের বদন পাল্টে গেলো নিমিষেই। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে অনেকটা। বৃষ্টির তেজ থাকলেও, অন্ধকারের রেশমাত্র নেই আর।আমি সকালে ঘুম থেকে উঠেই এখানে দাড়িয়ে আছি। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গিয়েছে আজ। দেখতে দেখতে আরো একটি সপ্তাহ চলে গেলো। প্রতিরাতে ছায়ামানবকে অনুভব করি। কিন্তু সমস্যা সেই একই, দেখতে পারি না। সেদিন মীরা আপুকে জিজ্ঞেসও করেছিলাম, ঐ ঘটনার ব্যাপারে। আপু বলতে নারাজ। যে সেই কাজটি করেছে, সে যেনো আপুর মুখ তালা মেরে চাবি নিজের কাছে রেখে দিয়েছে। আপুকে আর সে বিষয়ে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করিনি। তিনদিন পর ছোটমা চলে এসেছিলো। আঘাত খুব একটা পায়নি ভেবেছিলাম। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল হয়ে গেলো। ছোটমা এখন কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। হাটতে পারে, তবে কুঁজো হয়ে। ডান হাত পুরোটাই ভেঙ্গে গিয়েছে। মারাত্মক আঘাত!
গত এক সপ্তাহ ধরে ভার্সিটিতে যাওয়া হয়না আমার। ছোটমা, আপু দুজনেই অসুস্থ ছিলো। প্রতিটি কাজে নির্ভরশীল আমার উপর। আপুর হাত অনেকটা ঠিক হয়েছে। তবে ছোটমা এখনও একা চলতে পারে না। আশ্চর্যের কথা হচ্ছে, যেই ছোটমা আমাকে এক বেলা কটূক্তি না করতে পারলে শান্তি পেতো না সেই ছোটমা বাড়ি ফেরার পর থেকে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেনি। খারাপ ব্যবহার করবে কি করে! অজ্ঞাত কোনো কারণবশত ছোটমা আমার সাথে কথা বলতেই ভয় পাচ্ছে। আর আপুও কোনরকম বাজে আচরণ করছে না।
আজ ভার্সিটিতে যাবো। রান্না বান্না সেরে নিলাম। ছোটমাকে খাইয়ে দিলাম। আপুর হাত অনেকটা সেরেছে বিধায় নিজ হাতেই খেতে পারে।
____________________
আজ ভার্সিটিতে নবীন বরণ। থার্ড ইয়ারে আমরা। সেজন্য প্রায় সব দায়িত্ত্ব আমাদের। প্ল্যান অনুযায়ী শাড়ি পরতে হবে। আমি রাজি ছিলাম না। শাড়িও ছিলো না আমার। কিন্তু রুশী বললো,“আমার শাড়ি পরার ভীষণ ইচ্ছে জেগেছে। তবে তুই না পরলে আমিও পরবো না।” রুশীর জোরাজোরিতে আর নাকোচ করার সাধ্য হলো না। এদিকে শাড়ি নেই বলে, অয়ন আর রুশী মিলে একটা লাল পাড়ের কালো শাড়ি কিনে দিয়েছে আমায়। সাথে ম্যাচিং অর্নামেন্টস।
সকালে উঠে শাড়ির প্যাচ দিতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে আমার। কিভাবে পরে? জানিনা তো আমি। বহুত মুশকিলে, ঘণ্টা দুইয়েক সময় লাগিয়ে হালকা পাতলা ভাবে শাড়ি জড়িয়ে নিলাম। আঁচল ছেড়ে দিলাম। হাঁটু লম্বা চুলগুলো মুক্ত রাখলাম। মুখে আহামরি কিছু দিলাম না। একটু খানি কাজল লাগালাম। রুশী বলে, আমার কাজল কালো চোখ নাকি ভীষণ নজর কাড়া। কানে রুশীর দেওয়া সিলভার ঝুমকা পরলাম। ব্যাস! এতেই হয়ে গিয়েছে।
ভার্সিটিতে যাওয়ার আগেই রুশীর কল এলো। ওর আজকে আমাকে পিক করতে আসার কথা ছিলো। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বললো,“ঠিক আর কয় ঘন্টা লাগবে মহারানীর? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। তোকে না বলেছি কখন বেরোতে হবে? দেড় ঘণ্টা লেট তুই। কই তুই? আর পাঁচ মিনিট টাইম দিচ্ছি। এখন না এলে আজ যাবোই না আমি।”
কথাটা শেষ করেই ফোন কেটে দিলো। আমার কাছ থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা করলো না। আমিও ফটাফট আরেকবার নিজেকে আয়নায় দেখে নিলাম। নাহ্! খুব একটা বাজে দেখাচ্ছে না!
বাড়ি থেকে বেরোতেই বাইরে রুশীর গাড়ি দেখা গেলো। আমি এগিয়ে গেলাম। পেছনে মুখ গোমড়া করে অন্যদিকে ঘুরে বসে আছে। পরনে আকাশী রঙ্গা এক শাড়ি। ফর্সা দেহে এমন শাড়ি খুবই মানানসই। আর তা যেনো রুশীকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
আমি ভেতরে ঢুকে বসলাম। আমি ঢুকতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো ড্রাইভার। রুশী আমার আসার আভাস পেয়ে গাল দুটো আরো ফুলিয়ে বসলো। খানিকটা হেসে দিলাম।
“আমাকে কেমন দেখাচ্ছে বলবি না?”
আমার কথায় তাকালো না, ফুলো গালে বাচ্চামো স্বরে বললো,“কতক্ষন অপেক্ষা করিয়েছিস! কথা নেই তোর সাথে। যা!”
আমি মিটিমিটি হেসেই যাচ্ছি। এতে ওর রাগ বাড়ছে বৈ কমছে না। আমি এই মিষ্টি মেয়েটিকে দেখছি। আমার বোন। হ্যাঁ! আমার বোন এটা। আমার চুপ হয়ে যাওয়া দেখে রুশী আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। আর চোখ সরালো না। রাগ সব জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে মারলো। উল্লাসিত কন্ঠে বলল,“বীনু! তোকে কি সুন্দর লাগছে! আমি ছেলে হলে এখনি তোকে কি*ড*ন্যা*প করতাম।”
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম ওর কথায়।
__________________
চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। পুরো ভার্সিটি সজ্জিত হয়েছে নতুন আমেজে। আমি আর রুশী ক্যাম্পাসে এসে খুঁজে চলেছি অয়নকে। পুরো ক্যাম্পাস আধঘন্টা ধরে খুঁজলাম। কোথাও নেই। হাপিয়ে উঠলাম দুজনেই। একেতো শাড়ি পরেছি, তার উপর শাড়ি পরে দৌড়াচ্ছি। উফ!
ফাইনালি স্টেজের পেছনে দেখা মিললো। কাজে ব্যাস্ত আছে অয়ন। পরনে ব্লু মিক্সড সাদা পাঞ্জাবি। রুশীর দিকে তাকালাম এক পলক। তার স্থির দৃষ্টি সামনে দাড়িয়ে থাকা এই সুদর্শন পুরুষটির উপর। চোখে ভালোবাসার এক সাগর রয়েছে। মনে কি রয়েছে?
আমি হাত নেড়ে অয়নের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। অয়ন মুখে হাসি ফোটালো এদিকে তাকিয়ে। আমি রুশীর হাত ধরলাম। এগিয়ে যাচ্ছি অয়নের দিকে। অয়ন রুশীকে দেখে প্রশস্তিত হাসি সংকোচিত করলো। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলো এই শুভ্র রঙ্গা মেঘ পরীর দিকে। আঁখি পল্লব মেলতে যেনো ভুলে গিয়েছে। কোনো পুরুষের কাছে তার ভালোবাসার নারী, নিশ্চয়ই ভুবন ভোলানো সৌন্দর্যের অধিকারিণী।
এদের দুজনের এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আমার নিজেকে কাবাবে হাড্ডি মনে হচ্ছে। ইশ! এরা যেনো শতজনমের চক্ষু তৃষ্ণা মেটাচ্ছে।
“আজ স্পেশাল গেস্ট হিসেবে কে আসবে জানিস?”—পাশ থেকে ফাইনাল ইয়ারের একটা আপুর আওয়াজে ধ্যান ভাঙলো আমার। আপুটি তার একজন ফ্রেন্ডকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলছে। না চাইতেও এদের কথোপকথন আমার কর্নে ভেসে আসছে। সামনের মেয়েটি বললো,“তুই জানিস না কে আসবে?”
মেয়েটির “না” বোধক ইঙ্গিতের প্রেক্ষিতে বলে উঠলো,
“তৃষ্ণা”
নামটি শুনতেই অপর মেয়েটির মুখের আদল বদলে গেলো। শুধু মেয়েটি না। পাশে দাড়িয়ে থাকা সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়লো। আমি কিছু বুঝতে না পেরে তাদেরই একজনকে জিজ্ঞেস করে বসলাম,“তৃষ্ণা কে আপু?”
তারা যেনো আমার কথাটি শুনে তব্ধা খেয়ে গেলো। সবগুলোর মুখ “হা” আকার হয়ে গেলো। আমি অবুঝ নয়নে চেয়ে রইলাম। একটা আপু বলেই বসলো,“সিরিয়াসলি তুমি তৃষ্ণা কে চেনো না?”
আমি মাথা দুইদিকে নাড়িয়ে না ইশারা করলাম। একজন আপু নিজেকে শান্ত করেও উত্তেজিত কন্ঠে বলল,“তৃষ্ণা হচ্ছে আমাদের সবার ক্রাশ। আমরা যখন ফ্রেশার ছিলাম, তখন ফাইনাল ইয়ারে ছিলো। বর্তমানে নামকরা সিঙ্গার। মানা যায়, তুমি সিনিয়র তৃষ্ণাকে চেনো না। কিন্তু সত্যিকি সিঙ্গার তৃষ্ণাকে চেনো না?”
আমি পুনরায় “না” ইশারা করলাম। গান শোনা হয়না আমার। কি করে শুনবো? সে সময় আছে? একটা আপু বললো,“তার নীল চোখ! উফ! হাজারও মেয়ের খুন হয়েছে…”
অন্য একজন আপু বললো,“তার হাসিটা কি সুন্দর! কতো মেয়ে পাগল হয়েছে..”
পাশের আরো একজন বললো,“পার্সোনালিটি দেখেছিস! পুরোটাই ক্রাশ ম্যাটেরিয়াল।”
আমি প্রস্থান করলাম। একটা ছেলেকে নিয়ে এতো বলার কি আছে? আমার পিছে পিছে রুশী ও অয়নও এলো। এতোদিন আমি শুধু গেস করেছিলাম, অয়নের মনে রুশীর জন্য ফিলিংস আছে। আজ বুঝে নিলাম, দুজনের মনেই দুজনকে নিয়ে অনেক বেশি কিছুই আছে।
কিছুটা দূরে নজর যেতেই দেখলাম একটা মেয়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলাম মেয়েটির কাছে। গ্রীন স্যুট পরা মেয়েটিকে শ্যামবর্ণবিশিষ্ট রূপবতী বলা চলে। মুখশ্রীতে ঘনকালো আঁধার। কেনো?
পাশে দাড়িয়ে কাঁধে হাত রাখলাম। মেয়েটি কেঁপে উঠলো। আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কি মায়ায় ভরা চাহনি! হৃদযন্ত্র ধুক করে উঠলো আমার। দুবার নিশ্বাস ছাড়লাম। তৃতীয়বার নিশ্বাস নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,“কি হয়েছে? আমাকে বলতে পারো। আমি তোমার বোনের মতোই।”
মেয়েটির বিষন্ন নয়নের কার্নিশে দু ফোঁটা অশ্রু জমা হয়ে উঠলো । ভার হৃদয় থেকে উচ্চারিত হলো,“আপু!”
আমি “হুঁ” বলায় মেয়েটির অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,“কি হয়েছে?”
মেয়েটি বললো,“ঐ ছেলেটি ডিস্টার্ব করছিলো আপু।”
“কোন ছেলেটি?”
মেয়েটি হাত দিয়ে কিছুটা দূরে, বাইকে বসে থাকা একটা ছেলেকে ইশারা করে দেখলো। ছেলেটি আমাদের ব্যাচের। অন্য ডিপার্টমেন্টের। তবে যতটুকু জানি, ভীষণ উচ্ছল।
মেয়েটির হাত ধরে বললাম,“চলো, আমার সাথে চলো।”
আসার পথে জিজ্ঞেস করলাম,“নাম কি তোমার?”
“দীপ্তি”
তখনই কানে একটা গান এলো। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। থেমে গেলাম।
“চুরায়া হি কিউ যাব ওয়ো তোড়না হি থা?
দিলভী ওয়ো টুটা হ্যায় যো মেরে পাস নেহি
দিখায়া হি কিউ যাব মুহ মোড়না হি থা?
সিনে মে হাওয়া তো হ্যায় পার ওয়ো সাস নেহি হ্যায়
মেরে পাস নেহি হ্যায় কই সাথ নেহি হ্যায়
যো বাতা দে মুঝে বাত ইয়ে খাস নেহি
দিল উদাস সেহি হ্যায় কই আস নেহি হ্যায়
পাগলী আখো কি নামী ইয়ে বারসাত নেহি
ম্যায় ভি না জানে কাহা খো গেয়া থা
জিন্দেগি মুঝসে খাফা হো গ্যায়ী
জিস দিন কি ইস দিল নে খুদসে মোহাব্বত
তো জিন্দেগি ভি মুঝসে ফিদা হো গ্যায়ি
মেরে পাস নেহি হ্যায় কই সাথ নেহি হ্যায়
অর না হ্যায় আব কিসিকা ইন্তেজার কাহি
তেরে বারে মে না সৌচু অ্যায়সা রাত নেহি হ্যায়
পার তু তোরে দিল মেরা তেরি ঔকাত নেহি
অঙ্খো মে ধুঁয়া থা ম্যায়নে দেখাহি নেহি
খুশি পিছে হি থি খারী দাবে ইয়ে হাসি
দিল ভি বোলা, সুন বাওয়ারে আখিও কি দুশমান
না ম্যায় কাভি টুটা থা না খোয়া থা কাভি
তেরে পাস ইয়েহি হুঁ ইয়ে আওয়াজ ম্যায় হি হুঁ
ইয়ে কাহানি তেরি মেরি হ্যায় ইয়ে জামানে কি নেহি
ম্যায় ধারাক্তা রাহু, তু ভি ইউ হাসতা রাহে
দুনিয়া জায়ে সালি ভার মে কই পারওয়া হি নেহি
এক রাত জাগা মে ম্যায়নে দেখা থা সাওয়েরা ”
আওয়াজে অন্য কিছু ছিলো। হারিয়ে গিয়েছিলাম গানটিতে। চারিদিকে সবাই চিল্লিয়ে উঠলো। মেয়েদের কণ্ঠ বেশি শোনা যাচ্ছে। সবার মুখে একটাই শব্দ। তৃষ্ণা..!
চলবে…