অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩১)

Photo of author

By নবনিতা শেখ

আয়নায় নিজের আট মাসের উঁচু পেটটা দেখলাম। কীভাবে যে সময় দৌঁড়ায়! সেদিনের শুকনো আমিটা আজ কেমন গলুমোলু হয়ে গিয়েছি। প্রেগন্যান্সির দরুন মুখের উজ্জ্বলতা বেড়েছে অনেক গুণ বেশি। চেহারায় সারাটা ক্ষণ একটা খুশির ঝলক থাকে।

আজ ছয়মাস পার হলো। হুট করেই সেই ভয়ংকর রাতের কথা মাথায় চলে এলো। আমার উজ্জ্বল মুখশ্রীতে ঘন কালো আঁধার নেমে এলো। আজ তৃষ্ণার মৃত্যুর অর্ধবর্ষ পূর্ণ হলো। সেদিন তৃষ্ণার জন্য আমার ছটফটানির মানেটা বুঝতে অবশ্য আমার বেশ সময় লেগে গিয়েছিল।

এতটা সময় নিয়ে জানতে পারলাম। একটা মেয়ে… মেয়েদের ব্যাপারটা বলছি, কারণ আমি মেয়ে। ছেলেদেরটা জানিনা। তো বলি, একটা মেয়ে যতই এক পুরুষে আসক্ত হোক না কেনো! যতই একজনকে ভালোবাসুক না কেনো! যখন সে জানবে তাকে কেউ মন থেকে ভালোবাসে; যদি সেই মেয়েটি ভালোবাসার মর্ম বুঝে থাকে, তবে সেই ছেলেটির প্রতি একটু হলেও দুর্বল হবে। এটাই স্বাভাবিক। হাজার হোক, সেই ছেলেটি তো তাকে ভালোবাসে।

এমনটাই ঘটেছিলো আমার সাথে। তৃষ্ণা! নামটাতেই ছিলো অদ্ভুত এক তৃষ্ণা। যার নীলাভ চক্ষুদ্বয়ে ছিলো অতল দুঃখ-সাগরের গভীরতা। যেকোনো নারীকে ভাসাতে সক্ষম ছিলো সেই নয়ন জোড়া। সেই অধর যুগল ছিলো নেশাক্ত। হাজারো নারী সেই নেশাক্ত ওষ্ঠের হাসিতে মরতো। আর সেই পুরুষটি ছিলো এই আমিতে আসক্ত। তার অতীত নিয়ে ভাববো না। মানুষ ভুল পথে যায়। যেতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। তবে সবাই ভুল পথে চলতে চলতে ঠিক পথের সন্ধ্যান পায়না। তৃষ্ণা পেয়েছিলো। ভালো হতে চেয়েছিলো। সঠিক রাস্তা ধরলো। কিছুদূর এগোতেই, জীবন তার কাছ থেকে তার নিশ্বাস কেড়ে নিলো।

তৃষ্ণার এভাবে মৃত্যুটা মেনে নেওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না। কেননা সে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো। সেদিন যে শুট করেছিলো, সে আমাকে মারার উদ্দেশ্যেই করেছিলো। তৃষ্ণা মরতে মরতে, আমাকে এই নতুন জীবন দিয়ে গেলো। আমি তার ঋণ শোধ করতে পারলাম না। সে মরতে মরতেও নিজের ভালোবাসাটা দেখিয়ে দিয়ে গেলো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। সময় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। সেদিন আমাকে যে মারতে চেয়েছিলো, তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত, আমাকে এতদিন যে মারতে চেয়েছিলো, এটা সে ই ছিলো। কিন্তু আমার উপর আর আক্রমণ হয়নি। পুরোপুরি নিরাপদ এখন আমি।

এই ছয় মাসে আরো একটা ঘটনা ঘটেছে। মাহী মিসিং। বেচারীকে কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ছয় মাস সবাই হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে তাকে। পুলিশ দিনরাত তার খোঁজে লেগেই আছে। কোথাও নেই মাহী। ওদিকে লন্ডনে মাহীর মা-বাবার অবস্থা বেহাল। এক মেয়ে সুইসাইড করলো। আর অন্য মেয়ে লাপাত্তা।

আয়নায় পুনরায় নিজেকে দেখে নিলাম। শাড়ি পরা এখন আমার জন্য একদম নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। পরনে ঢোলা ফ্রক। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে বিরক্তিকর একটা চেহারা নিয়ে চিরুনিটা উঠিয়ে নিলাম। এখন খুব অলস হয়ে গিয়েছি আমি। একটা কাজ ও নিজে থেকে করতে ইচ্ছে করে না। সব কিছুতেই বিরক্তি লাগে। গাল দুটো ফুলিয়ে আবারও চিরুনিটা নিজের জায়গায় রেখে নিলাম। আঁচড়াবো না। ভালো লাগছে না। মানে, আলসেমি আর কি!

হুট করেই কোত্থেকে যেনো আরহানের আগমন ঘটলো। মিষ্টি হেসে বললেন,“গুড মর্নিং। উঠে গেছো?”

“হুম।”

“ফ্রেশ হয়েছো?”

“হুম।”

“মনে মনে আমাকে বকছিলে?”

“হুম। এই না।”

আরহান হাসলেন। আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,“আপনাকে বকতে পারি?”

মুচকি হেসে বললেন, “টেন্সড তুমি?”

“একটু।”

“কী নিয়ে?”

“ঐযে.. মাহী।”

সঙ্গে সঙ্গে আরহানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলেন। সেকেন্ড পাঁচেক পর চোখ খুলে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি এনে বললেন,“খোঁজ চলছে তো। পেয়ে যাবে।”

আমি তাকিয়ে রইলাম আরহানের দিকে। আরহান মিষ্টি হেসে, সামনের টুলের দিকে ইশারা করে বললেন,“বসে পড়েন এখানে।”

অতঃপর আরহান আমার খোঁপা খুলে দিলেন। সামনের চিরুনি ও তেলের বোতল নিয়ে,চুলে তেল লাগিয়ে, আঁচড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি স্থির দৃষ্টিতে আয়নায়, আরহানকে দেখে যাচ্ছি। সব শেষে উনি বিনুনী গেঁথে দিলেন। এগুলো আরহানের দৈনন্দিন রুটিনে এসে গিয়েছে।

শেষ হতেই আরহান বললেন,“ডান। এবার আসো, ব্রেকফাস্ট করবো।”

“হুম।”

আমি উঠে দাঁড়াতে নিলেই পেটে হাত রেখে বসে পড়ি। মুখ দিয়ে “আহ্” শব্দ করি। আরহান অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “কী হয়েছে?”

ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,“কিক দিয়েছে।”

___________________

মুখে ঝিরিঝিরি পানির ফোঁটা পড়তেই ঘুম উবে যায় রুদ্রের। কপাল কুঁচকে ফেলে। অথচ অধর কোণে মিষ্টি হাসি। চক্ষুদ্বয় বন্ধ রেখেই বললো,“প্রতিদিন এভাবে ঘুম ভাঙানোটা কিন্তু দারুন লাগে।”

নিশা মিষ্টি হেসে বললো,“আমারও।”

ভেজা চুলগুলো মুছে টাওয়েলটা ব্যালকনিতে শুকাতে দিয়ে এলো। রুমে ফিরে দেখে, রুদ্র উঠে গিয়েছে। নিশা এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে। রুদ্র নিশাকে জড়িয়ে ধরে বললো,“হ্যাপি সিক্সথ মান্থস অ্যানিভার্সেরি পিচ্চি।”

নিশা মুচকি হাসলো। কিন্তু শেষের ‘পিচ্চি’ সম্বধনটা শুনতেই রুদ্রর বুকে থেকে মুখ তুলে বললো,“এই! আপনার এখনো আমাকে পিচ্চি লাগে? ক’দিন বাদে পিচ্চির মা হবো, আর আপনি!”

রুদ্র হাসলো। বড্ড অদ্ভুত ভাবে হাসলো। চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেলো। চাপ দাঁড়ি বিশিষ্ট গাল দুটো অনেকখানি প্রসারিত হলো। অধর যুগল নেড়ে উচ্চারণ করলো,“ভালোবাসি।”

প্রতিবারের মতো নিশার জবাব,“ভালোবাসি না। একটুও না।”

এতেও রুদ্রের হাসির রেশ মাত্র কমেনি। ওভাবেই বললো,“আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসো আমাকে।”

নিশা মাথা নিচু করে হেসে প্রস্থান করলো। এই ছয়মাসে লজ্জা, অভিমান, জড়তার মিশ্রণের ফলে নিশা, রুদ্রকে ‘ভালোবাসি’ কথাটি বলতে পারেনি। এরকমটা প্রায় অনেক সংসারে হয়। ভালোবাসা থাকলেও সেই ভালোবাসার কথা প্রকাশ হয়না অনেক সংসারেই। কিন্তু এদের টুনটুনির সংসারটা একটু ভিন্ন। রুদ্র ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসি বলেই যাচ্ছে। এদিকে নিশা, সে পারছে না। বলছে না। কিংবা চাইছে না বলতে।

_________________

“দীপ্তি! মা! আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও তোমাদের সাথে। এখানে থাকবো না আমি।”

“কিন্তু কেনো?”

মায়ের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,“আমার মতো অবলা, নিরীহ মেয়ের প্রতি এভাবে অত্যাচার হচ্ছে এখানে।”

মা আঁচলের কোণায় মুখ ঢেকে হাসলো। দীপ্তি ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কিন্তু চেষ্টা তো ব্যর্থ! হলো না। ফিক করে হেসে দিলো দীপ্তি। এতে আমি আমার ফোলা গাল দুটো আরো খানিকটা ফুলিয়ে ফেললাম।

আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরহান এগুলোতে পাত্তা না দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাবে বললেন, “যতো যা’ই করো না কেনো, কোনো লাভ নেই। চুপচাপ খেয়ে নাও।”

আমি পুনরায় আরহানের হাতের ফ্রুটসের প্লেটটা দেখলাম। এগুলো কি কম অত্যাচার? সেই শুরু থেকেই এরকমটা করে এসেছেন আমার সাথে। কোনরকমে খেতাম, বাকিটা ফেলে দিতাম। এখন সামনে বসে আছেন সবাই, আর আমাকে খেতে হবে।

কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম, “প্লিইজ!”

“কোনো কথা না। চুপচাপ খাও।”

প্লেটটা নিয়ে মুখ ফুলিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলাম। মা আর দীপ্তি মাঝে মাঝেই এই বাড়িতে আসে। আজও এসেছে। এখন জেদ ধরে বসেছি, আমি এখানে থাকবো না। কিন্তু একেতো আমার মা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না, তার উপর আরহান আমাকে যেতে দেবে না। এরা কেউ আমার কথা শোনে না।

___________________

গভীর নিস্তব্ধ রাত। আরহান আজ অনেক দিন বাদে, পুনরায় তার ফ্যাক্টরির পুরনো গোডাউনে পদার্পণ করলেন। বেশ অনেকগুলো কক্ষ আছে এখানে। তন্মধ্যে সর্বশেষ কক্ষটির অবস্থা সবচেয়ে নাজেহাল। অন্ধকারের গভীরতা সেখানে সবচেয়ে বেশি। আলোর রেশ মাত্র পৌঁছতে অক্ষম সেই কক্ষে। দেয়াল গুলো ক্ষয় হয়ে প্রায় ভেঙ্গে গিয়েছে। ধুলোবালির একটা আস্তানা।

প্রবেশ পথে আরহানের সাথে তার বিশ্বস্ত কর্মচারী আবদুলের দেখা হয়। কালো রঙের হুডি, প্যান্ট, ক্যাপ, মাস্ক, গ্লাস, গ্লাভস, পরিহিত আরহানকে দেখে আবদুলের বুঝতে বেগ পোহাতে হয়নি যে এটা তার বস। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মাস্ক ও গ্লাসের ভেতরে রয়েছে আরহানের গম্ভীর মুখশ্রী।

আরহান রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “টেল মি অ্যাবাউট হার কন্ডিশন।”

শান্ত, নিস্তব্ধ ফ্লোরে আরহানের ভারী কণ্ঠ দেয়ালে দেয়ালে বেজে উঠলো। গার্ডসরা সব সটাং মেরে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে গেলো। এক চুল নড়াচড়া বন্ধ তাদের।

আবদুল মাথা নিচুরত অবস্থায় বলা শুরু করলো,“কোনো কথা বলেনা সে। আপনার কথা মতো দিনে এক বেলা খাবার দিচ্ছি মাত্র। তাও কোনো হেল-দোল নেই। চুপচাপ খেয়ে নেয়। এই মেয়ে একটা সাইকো স্যার।”

“লাইট অন করে দাও।”

আরহান ভীষণ শান্ত এখন। তার চেয়েও শান্ত তার কণ্ঠস্বর। হাতের ইশারায় আবদুলকে নিজের কাজে যেতে বলে গতিশীল পা জোড়া নিয়ে গেলো সোজা রাস্তায়, একদম শেষ কক্ষে। যেটা আঁধার। যেটায় এখন রয়েছে এই কাহিনীর সবচেয়ে গভীর সত্যিটা।

কক্ষের প্রবেশ দোর খুলতেই একটা আওয়াজ তৈরি হলো দরজার দ্বারা। অন্ধকার কক্ষ মুহূর্তেই আলোকিত হয়ে গেলো। কক্ষের শেষ প্রান্তে, এক কোণায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে একজন তরুণী। মাথা নিচু। কারো আসার আওয়াজ তার শ্রবণ ইন্দ্রীয় অবদি পৌঁছেছে, তবে সে তার মনে মাথা তুলে তাকানোর ইচ্ছে পোষণ করেনি। যেভাবে ছিলো, সেভাবেই বসে রইলো। আরহান তার সামনে গিয়ে কক্ষের মাঝ বরাবর রাখা চেয়ারে বসে পড়লো।

শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,“কেনো করলে এমনটা?”

চেনা কণ্ঠ পেয়ে মেয়েটি ফট করে মুখ তুললো। চুলগুলো জট বেঁধে আছে। পরনে ছয় মাস আগের সেই জামাটা প্রায় নষ্ট হয়ে, গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। সেই মিষ্টি চেহারাটা ভয়ংকর রকমের হয়ে আছে। চোখ দুটো লাল। গাল ভেঙ্গে এসেছে। পুরো শরীর ময়লার আবরণে ঢেকে আছে। বাজে একটা স্মেল আসছে তার দিক থেকে। জীর্ণশীর্ণ অবস্থা মাহীর।

আরহান তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে পুনরায় প্রশ্ন তুললো, “হুয়াই?”

মাহী শান্ত। ভীষণ শান্ত। চোখ সরালো আরহানের পানে থেকে। ফ্লোরে দৃষ্টি রেখে মৃদু হাসলো। এরপর হাসির রেখা বড় করলো। হালকা শব্দ করে হাসলো। সেই শব্দ বাড়তে লাগলো। অতঃপর উচ্চ শব্দে হাসা শুরু করলো।

আরহানের রাগ বাড়ছে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“বলবে?”

মাহী হাসি থামালো। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফিসফিসিয়ে বললো,“তোমাকে বলতে পারি। কিন্তু প্রমিজ করতে হবে, কাউকে বলবে না।”

মাহীর এমন বাচ্চামো স্বরে কথা শুনে আরহান ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। মাহী আবার বলা শুরু করলো,“আমি তো ঐ ছেলেকে মারতে চাইনি। ঐ মেয়েকে মারতে চেয়েছি। বীনি! বীনিকে মারতে চেয়েছি।”

“এটা জানি। কিন্তু কেনো? ও তোমার ক্ষতি করেনি।”

মাহীর মুখের হাসি উবে গেলো। চেহারায় ভয়ঙ্কর রাগের রেশ লক্ষ্য করা গেলো। তেজী কন্ঠে বললো,“করেছে। করেছে ও।”

কথাটা বলে কেঁদে দিলো মাহী। কাঁদতে কাঁদতেই বললো, “ও আমার কাছ থেকে আমার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।”

আরহান ফট করে দাঁড়িয়ে গেলো। দ্রুত ও অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মানে?”

“মানে ওর জন্যই তো আমি আমার আরহানকে পেলাম না।”

“আমি কবে তোমার ছিলাম? কীসব বলছো?”

মাহী কান্না থামিয়ে পুনরায় হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,“আরে বুদ্ধু। আমি তোমাকে কখন বললাম? আমি তো আমার প্রাণ, আমার আরহানের কথা বলছি।”

“আমিই তো আরহান।”

“এই পঁচা ছেলে! নিজেকে আমার আরহান বলছো কেনো? মেরে দেবো। একদম মেরে দেবো তোমাকে। সবার মতো।”

কথাটা বলে মাহী তেড়ে আসলো আরহানের দিকে। আরহান সেকেন্ডের মাঝেই মাহীর সিচুয়েশন বুঝে নিয়েছে। তাই আর অপেক্ষা না করে বললো,“আমি মজা করছি। আমি আরহান নই।”

এতে মাহীর রাগ না কমলেও শান্ত হয়েছে। আবারো নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। কোণার সেই জায়গাটাতেই। জোড়ে জোড়ে কয়েকটা শ্বাস ছাড়লো। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো যে!

আরহান এসব লক্ষ্য করে বুঝলো, মাহী মানসিক ভাবে অনেকটা অসুস্থ হয়ে আছে।

মাহী ফ্লোরে তাকিয়ে নিচুকণ্ঠে বললো,“তুমি পঁচা। তোমাকে কিছু বলবো না।”

আরহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“আরহানকে চাই?”

মাহী চোখ তুলে আরহানকে দেখে বললো,“এনে দেবে ওকে?”

“আগে বলো, কেনো এমনটা করলে?”

মাহী আবারও হাসলো। হাসি যেনো থামছেই না। হাসতে হাসতেই বললো,“আরহানকে ভালোবাসি। সেই ছোট্ট থেকেই ভালোবাসি।”

এরপর নিজের দুই হাত ছড়িয়ে বললো,“এত্ত গুলো ভালোবাসি।”

আরহান অবিশ্বাস্য চাহনিতে মাহীকে দেখে যাচ্ছে। মাহী পুনরায় বলা শুরু করলো,“তারপর একদিন দিভাই আমাকে এসে বলে, সে নাকি আমার আরহানকে ভালোবাসে। সেদিন জানো? অনেক কেঁদেছিলাম। এরপর দেখি আমার আরহান ওকে পাত্তা দেয়না। সে কী খুশি আমার! সবসময় আরহানের ইচ্ছে মতোই থাকি। ওর না! বাঙালি কালচার পছন্দ খুব। এজন্য সবসময় সেভাবেই থাকতাম। এভাবেই চলছিল দিন। ভেবেছিলাম, মমকে বলবো, আমি আরহানকে বিয়ে করতে চাই। তারপর বিয়েও করে নেবো, কিন্তু!”

মাহী থামলো। রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দুই হাত এগিয়ে ফ্লোর খামচে ধরে বললো,“সেদিন দিভাই কল দিয়ে বললো, আমার আরহান নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। আমি সহ্য করতে পারিনি। যেখানে,আরহানকে আমি আমার বোনকেও দিতে চাইনি, সেখানে অন্য কাউকে কিভাবে দেই? সেদিন দিভাইকে শুধু এটা কথাই বলেছিলাম,‘আরহানকে অন্য কারো হতে দেওয়ার মতো দয়ালু আমি নই’। এরপর যতো দ্রুত পেরেছি, বিডি ব্যাক করেছি। এসে দেখি দিভাই রেগে গিয়ে বললো,‘আমার আরহানকে নাকি শেষ করে দেবে’। ওকে থামানোর জন্য বুঝিয়েছি, আরহান অন্য কাউকে ভালোবাসে। তার সাথেই হ্যাপি থাকবে। ও যেনো এসব না ঢুকে। এতে আমার দুটো লাভ হয়েছে। একেতো দিভাই আমার রাস্তা থেকে সরলো, দ্বিতীয়ত আমার আরহানকে কিছু করবে না। তারপর আমি আরহান আর বীনিকে আলাদা করতে চাইলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, ভুল বোঝাবুঝি ক্রিয়েট করবো। কিন্তু ওদের মধ্যেকার ভালোবাসা দেখে সেটার সম্ভাবনা পেলাম না। কিন্তু… আমার আরহানকে অন্য কাউকে কী করে দিয়ে দেই? অনেক প্ল্যান কষলাম, বীনিকে সরানোর। কিছু করার আগেই আমাকে লন্ডন ব্যাক করতে হলো, মম অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো কি না!”

কথাটা শেষ করে মাহী অদ্ভুত ভাবে হাসলো। এরপর বললো,“কিন্তু আমি দমে যাইনি। সেখানে থেকেও বীনির উপর নজর রেখেছি। ওকে মারার অনেক প্ল্যান করেছি। কিন্তু আমার আরহানটা ওকে এতো ভালোবাসতো! সব প্ল্যান ফেইল হয়ে যেতো।

বীনির বাবা মারা গেলো যেদিন, সেদিনও আমার লোকই বীনির উপর অ্যাটাক করেছে। কিন্তু! আরহান বাঁচিয়ে নিলো আবার। সেদিন জানো? একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো। অনেক বাজে ঘটনা। এমন ঘটনার জন্য অপ্রস্তুত ছিলাম আমি। শুনবে কি?”

আরহান উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মাহী মুখে হাত রেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, “দিভাই জেনে গেলো, আমি এসব করছি। দিভাই মুখে যতো যা’ই বলুক না কেন! কিছু করতে পারতো না। ভীতু ছিলো কি না! তাই তো আমাকে এসব করতে না করলো। আমি সেদিন উত্তেজিত হয়ে আমার আরহানের ব্যাপারে সব ফিলিংস জানিয়ে ফেলেছিলাম। এসব শুনে দিভাই আমাকে ঘৃণা করলো। এক প্রকার কথা কাটাকাটি চললো। সব মিটিয়েও নিয়েছিলাম। তারপর দেখি ও লুকিয়ে তোমাকে কল দিয়েছে। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। শাস্তি তো পেতেই হতো। সে রাতে আবার মম-ড্যাড বাসায় ছিলো না। তাই….”

মাহী উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। আরহান অবুঝ দৃষ্টিতে মাহীর পানে তাকিয়ে বললেন,“মেরে দিলে?”

মাহী হাসি থামিয়ে বললো,“হ্যাঁ। আমাকে কেউ ধোঁকা দেবে, আর তাকে ছেড়ে দেবো? অনেক ঠান্ডা মাথায় ওকে খুন করতে হয়েছে। এমনিতে বিষন্নতায় ছিলো ও, তাই প্রি প্ল্যানড মার্ডারকে, সুইসাইড কেইস বানিয়ে ফেলতে বেগ পোহাতে হয়নি। তারপর এভাবেই চলছিলো। আবারো বীনিকে মারার জন্য আদা জল খেয়ে নেমে পড়লাম মাঠে। কিন্তু….যখন শুনলাম ও প্রেগন্যান্ট! আর পারলাম না। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। চলে এলাম। জুনিয়রকে নিয়ে খেলতেই। কিন্তু পারলাম কই? কোত্থেকে ঐ তৃষ্ণা বাঁচিয়ে দিলো। নয়তো আজ বীনি টপকে যেতো। আর আমার আরহানকেও আমি আবার পেয়ে যেতাম।”

এসব শুনে আরহান শান্ত আছে। অতিরিক্ত রাগে তো আরহান অতীব মাত্রায় শান্ত হয়ে পড়ে। তেমনটাই হয়েছে। চোখ বন্ধ করলো। মাহী যেভাবে বসে ছিলো, সেভাবেই রইলো।

আরহান উঠে দাঁড়ালো। চোয়াল শক্ত তার। অথচ মুখে হাসি। নম্র কন্ঠে মাহীর উদ্দেশ্যে বললেন,“ইউ ডোন্ট হ্যাভ দ্য রাইট টু লিভ।”

“এই কই যাচ্ছো? আমার আরহানকে দিয়ে যাবে না?”

নিঃশব্দে প্রস্থান ঘটালেন আরহান। গাড়িতে উঠে একজনকে কল দিলেন। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই আরহান বললেন,“গোডাউনে আগুন লাগিয়ে দাও।”

“স্যার! ঐ মেয়েটা?”

“পুড়ে যাক।”

কল কেটে দিলো। আপনমনে বললেন,“আরহানকে ভালোবাসে! তাহলে পুড়তে থাকুক। যতো পুড়বে, ভালোবাসা খাঁটি হবে। আরহান আবার ভেজাল জিনিস পছন্দ করে না।”

কথাটি বলেই বাঁকা হাসলেন। কাহিনীর সমাপ্তি নেই, তবে… এই গেইমের সমাপ্তি ঘটলো। কারণ, গেইমার নিজেই মরে গেলো।

চলবে…