ঘরোয়া ভাবে বিয়ের কথা হলেও, পুরো বাড়ি আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে। তেমন মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এখানে থাকা আত্মীয়দের বলা হয়েছে। আর আমার মা ও দীপ্তিকে। আমার ভাবনায় একটা কথাই আসছে, উনাদের আত্মীয় এতো কেনো? পুরো বাড়ি মানুষে গিজগিজ করছে। আরহানের মেয়ে কাজিন এসেছে অনেকেই। তাদের কাজ একটাই, হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই তাকে নিয়ে নিজেদের মাঝে আলোচনা করা। রাত থেকেই তাদের এসব কার্যক্রম চালু আছে। কাল রাতেই এসেছে অনেকে।
কিছুক্ষন বাদেই বিয়ে। তৈরি হয়ে নিচ্ছি। ম্যাজেন্টা কালারের একটা কাতান শাড়ি পরে নিলাম। সাথে গোল্ডের অর্নামেন্টস। চুলগুলো খোঁপা বেঁধে নিলাম। কাজল লাগানোর সময় আরহান ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি আরহানকে একবার দেখে পুনরায় নিজ কার্যে মনোযোগী হলাম।
“শাড়ি পরেছো কেনো?”
আরহানের কথা কানে যেতেই কপাল কুঁচকে ফেললাম। শাড়ি পরেছি কেনো মানে? কী বলছেন উনি? বিয়ে বাড়ি, আর শাড়ি পরবো না?
আমি বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলাম,“শাড়ি পরতে পারবো না?”
আরহানের সোজা কথা,“না।”
“কিন্তু কেনো?”
“এই সময়ে শাড়ি পরা উচিত না তোমার। পড়ে গেলে?”
“আরে! পড়বো না তো।”
“দেখো! আমি এই রিস্ক নিতে পারবো না।”
“এই! আর কোনো প্রেগন্যান্ট মহিলা শাড়ি পরে না?”
“আবারও বলছি। সবাই তোমার মতো বউ পায়না। তোমাকে কোনোমতে হারা…”
আরহান এটুকু বলে থেমে গেলেন।
একটা শুকনো ঢোক গিলে বললেন,“তুমি অনেক আদুরে আমার কাছে। তোমার জন্য সবসময় এক্সট্রা কেয়ার থাকবে।”
“আচ্ছা। আপনিতো আছেনই, আমাকে সামলানোর জন্য। কিছুই হবে না।”
“কিন্তু, শাড়ি..”
আমি আরহানের হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বললাম, “প্লিইজ..”
“আচ্ছা। তবে সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকবে।”
______________________
তৈরি হয়ে নিশার রুমে গেলাম। লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা পরিহিত নিশাকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। তার মায়াবী মুখশ্রীতে আজ যেনো মায়া অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। কী সুন্দর লাগছে! পাশে পার্লারের কিছু মেয়েরা ওকে সাজিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু কাজিনরা নিজেরা নিজেদের মতো সাজছে, গল্প করছে।
আমি এগিয়ে গিয়ে নিশার পাশে দাঁড়ালাম। নিশা আমাকে ওর পাশে আসতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। নিশার অধর কোণে হাসি দেখে আমারও ঠোঁটে হাসির রেখার দেখা মিললো। ভালোবাসাকে পূর্ণতা পেতে দেখা কতোটা শান্তির!
তখনই অয়ন ও রুশীর কথা মনে পড়লো। সবকিছু ঠিক থাকলে এই পূর্ণতা ওদেরও ভালোবাসায় ও পেতো। মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেলো। অয়নের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি আর। অনেক খুঁজেছি। আরহানকে বলেছি। সেও পায়নি। একটা মানুষ এভাবে কী করে হারিয়ে যায়?। ভার্সিটির সেই দিনগুলো খুব মিস করছি। একটা সময় কতো আনন্দে ছিলাম। আলাদা হবার কথা কল্পনাও করিনি। তবে আলাদা হওয়াটা নিয়তিতে লেখা ছিলো। কিন্তু এভাবেই আর এতো জলদি! এটা মেনে নেওয়া খানিকটা কষ্টের।
সম্পূর্ণ সাজানো শেষ হলে নিশা উঠে দাঁড়ালো। আমি নিশার আপাদমস্তক অবলোকন করে নিলাম। একটা মেয়েকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে, যখন সে বউ সাজে।
“ভাবী! আমাকে কেমন লাগছে?”
নিশার কথাটা শুনে মুচকি হেসে বললাম, “পাগলকরা সুন্দর লাগছে।”
নিশা মাথা নিচু করে হাসলো। লজ্জা পাচ্ছে হয়তো। তখন রুমে মা প্রবেশ করলেন। নিশাকে দেখে বললেন, “মাশাআল্লাহ! আজ আমার মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো আকাশ থেকে চাঁদ এসে নেমেছে। কারো যেনো নজর না লাগে!”
কথাটা বলে মা নিজের চোখের নিচের কাজল এক আঙ্গুলে নিয়ে নিশার কানের পেছনে লাগিয়ে দিলেন। পরমুহুর্তে একই কাজ আমার সাথেও করলেন।
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেলতেই মা বললো,“আজ আমার দুটো মেয়েকেই অনেক সুন্দর লাগছে। তোরা সুখী হ মা।”
মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলাম মাকে। নিশাও মাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের চোখের কার্নিশে অশ্রুকণা। হ্যাঁ! প্রতিটি মেয়ের বিয়েতেই মায়ের চোখ ভেজা থাকে। এটা নতুন না। বলা যায়, প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত একটা রীতি এটা।
________________________
একটা মেয়ের বিয়েতে, সবচেয়ে বেশি খাটতে হয় তার ভাইয়ের। কাজের জন্য হাজারো লোক থাকলেও, সেই ভাই কোনো ফুরসৎ পায়না। যেমনটা আরহান পাচ্ছেন না। প্রচুর কাজ। সবাই সবটা করলেও, সেসব আরহানকে দেখতে হচ্ছে। সেজন্য আমাকে সময় দিতে পারছেন না। তবে হ্যাঁ! এতেও উনার শাসনের বিন্দুমাত্র অবসান ঘটেনি। আমাকে মায়ের সাথে বসিয়ে রেখেছেন। কড়া হুকুম আছে উনার। এখান থেকে এক পাও এদিক সেদিক সরা যাবে না।
একটু বাদে আরহান এলেন। হাতে জ্যুসের গ্লাস। আমার দিকে এগিয়ে বললেন,“টায়ার্ড লাগছে? ড্রিংক ইট। বেটার ফিল করবে।”
আমি গ্লাসটা হাতে নিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,“মা! আপনার ছেলে ওভার পজেসিভ হয়ে যাচ্ছে, দেখুন। মাত্রই তো এসেছি।”
মা মুচকি হেসে বললেন,“ঠিকই করছে আমার ছেলে। সবসময় তোমার সাইট নিই বলে এটা ভেবো না, এখনও নেবো। চুপচাপ এটা খেয়ে নাও।”
আমিও ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় ভাব নিয়ে ,“মা-ছেলে একদম একরকম” বলে গ্লাসে চুমুক দিলাম।
আরহান হালকা হেসে, পুনরায় নিজের কাজ করতে চলে গেলেন। তখন সেখানে আসলো মা আর দীপ্তি। আমি উঠে দীপ্তিকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমার কাছে এসে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলো। এরপর আমার দুই মা মিলে কিছুক্ষণ গল্প করলো। দীপ্তি বউ দেখবে বলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো, সাথে আমার মা-ও।
বেশি কাউকে ইনভাইট করা হয়নি, তবুও ভালোই মানুষ এসেছে। এদের মধ্যে এক কোনে আমার চোখ আটকে গেলো। কালো পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটিকে দেখে চোখ বড়-সড় হয়ে গেলো। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদেই চোখের আড়াল হয়ে গেলো।
মাকে জিজ্ঞেস করলাম,“মা! তৃষ্ণা এসেছে?”
“হ্যাঁ। ওকে আসতে বলেছি আমি। আমার আরেকটা ছেলে ও। ওকে ছাড়া মেয়ের বিয়ে দিই কী করে বল?”
খানিকটা শান্ত হয়ে বললাম “ওহ্ আচ্ছা”। হুট করেই কেউ একজন পেছন থেকে আমার চোখের উপর হাত রাখলো।
আমি তার হাতের উপর হাত ছুঁয়ে বললাম,“কে?”
“গেস করো।”
“উম…. কে?”
“ভাবতে থাকো।”
আমি ভাবতে লাগলাম। সেকেন্ড পাঁচেক পরেই মাথায় এলো। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে হাসির রেখা এলিয়ে বললাম,“মাহী?”
আমার চোখ ছেড়ে দিলো। সামনে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে মুঁচকি হেসে বললো, ইয়েস! আমার সুইট ভাবী।”
“কখন এলে তুমি?”
“মাত্রই এসেছি।”
“তুমি নাকি নিশার বিয়েতে আসতে চাও নি?”
“তা অবশ্য চাইনি। কিন্তু আরো একটা গুড নিউজ পেলাম। না এসে থাকতে পারি? তুমি তো আর বললে না, নতুন মেহমান আসছে। নাহলে আগেই চলে আসতাম।”
“আরে! খেয়াল ছিলো না বুঝলে?”
“যাই হোক! তোমার খেয়াল না-ই থাকতে পারে। আমি আবার তোমার ব্যাপারে সব খোঁজ-খবর রাখি।”
“তাই?”
“হ্যাঁ। দেখলে না! জুনিয়র আসার খবর পেয়ে আর থাকতে পারলাম না সেখানে। চলে এলাম জুনিয়রকে নিয়ে খেলতে।”
কথাটি বলে মাহী হাসলো। আমিও হাসলাম। এতো মিষ্টি এই মেয়েটি! কারো সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। কখনো রাগ করে না। কখনো কাউকে কটূক্তি করে না। বাইরে থেকে পারফেক্ট একটা মেয়ে বলা যায়। তবে, কে জানে? অন্তরে কী আছে?
_____________________
বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। নিশার বিদায় হয়েছে বেশ অনেক্ষণ আগে। রুদ্র একটা এপার্টমেন্ট কিনেছে, নিজের জমানো টাকায়। বর্তমানে সেটায় উঠেছে। আরহান এতে আটকায়নি। প্রতিটি মেয়ের একটা সুখের কুঁড়েঘর থাকা উচিত। যেটাতে কেবল সে আর তার স্বামী থাকবে। তবে বিদায়ের সময় নিশার কান্না দেখে আরহান নিজেকে আটকাতে পারেনি। সকলের অগোচরে যে উনি, উনার চোখের পানি মুছে নিয়েছিলেন, তা আমার নজর এড়ায়নি। মা কেঁদেছেন। কেঁদেছি আমিও। একটা বছরে অনেক মায়ায় জড়িয়েছিল মেয়েটা। এতোটা ভালোবাসা আমি ছোট থেকে পাইনি। তাই কষ্টটা বেশি লেগেছে।
আজ মেহমানরা সবাই থেকে যাবে। সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সন্ধায় আমি রুমে গিয়ে আরহানকে সেখানে বসে থাকতে দেখলাম। আজ কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমার। সব কাহিনী এভাবেই এগোতে পারেনা। কিছু রহস্য উন্মোচন প্রয়োজন। সব খোলাসা না-ই হলো, আংশিক হোক!
আমাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে আরহান মুচকি হাসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আরহানকে,“মন খারাপ?”
“তোমার থেকে আর কী লুকোবো? হ্যাঁ। খারাপ একটু।”
“আচ্ছা। এককাজ করা যায়। ওদেরকে কয়দিন বাদে এই বাড়িতেই নিয়ে আসি।”
“না। এটা ঠিক হবে না।”
“কেনো?”
“কারণ এটা ওর সংসার না।”
“ওখানে একা থাকতে ভালো লাগবে না তো নিশার।”
“ওর যখনই একা লাগবে, ও চলে আসবে। কিন্তু পার্মানেন্টলি না।”
“আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ চুপ রইলাম দুজনেই। খানিকক্ষণ বাদে আমি আরহানকে ডাকলাম,“শুনেছেন?”
আরহান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“বলো।”
“কিছু জানার ছিলো।”
“কী?”
“তৃষ্ণার ব্যাপারে…”
এটা বলতে অবশ্য বেশ ইতস্তত বোধ করছিলাম। বলার পর আরহান চুপ রইলেন।
এরপর বললেন,“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ও। ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি। একসাথে পড়াশোনা করেছি। খেলাধূলার সঙ্গী ছিলো ও। আমাদের বাবারাও বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। সেই হিসেবে আমাদের ফ্রেন্ডশিপ আরো গাঢ় হয়েছে। ছোটবেলায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম। সেটা হচ্ছে, আমার আর ওর পছন্দ এক। এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। আমরা প্রায়ই একসাথে শপিং করতে যেতাম। এমনও হয়েছে, কোনো শার্ট সেই মলে লাস্ট পিস আছে, আর আমার পছন্দ এবং আমি কিনেও নিয়েছি। সেটা ওর লাগবেই। সেটা ছাড়া ওর আর কিছুই পছন্দ হয়না। আমার যেকোনো খেলনা ওর পছন্দ হয়ে যায়। যেকোনো না! সব। আমার সবকিছু ওর পছন্দ হয়ে যায়। শুধু মাত্র জামাকাপড় কিংবা খেলনার ক্ষেত্রে এরকমটা হয়নি। হয়েছে মানুষের ক্ষেত্রেও। ছোট থাকতে, একদম ছোট থাকতে আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। হাই স্কুলে পড়তাম আমি তখন। আর মেয়েটা আমার স্কুলের অপজিটের একটা প্রাইমারি স্কুলে। খুব সম্ভবত ক্লাস টু’তে পড়তো। সবসময় দুই ঝুঁটি করতো। ছোট মুখটা, ঘন লম্বা চুল দিয়ে ঢেকে থাকতো। বড্ড মিষ্টি ছিলো। যে কেউ, একবার দেখলে, দ্বিতীয়বার দেখতে বাধ্য থাকতো। দুর্ভাগ্য বসত সেই মেয়েকে ওরও পছন্দ হয়ে যায়। এই নিয়ে ওর আর আমার মাঝে কম ঝামেলা হয়নি। বোঝো! সেই বয়সে একটা মেয়েকে নিয়েও ঝগড়া হয়েছে।”
আরহান হাসলেন। এটুকু বলে থামতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,“এরপর মেয়েটি?”
“এরপর আর তাকে খুঁজে পাইনি। হয়তো স্কুল চেঞ্জ করেছে। তবে জানো? সেই মেয়েটি আর তোমার মাঝে, অদ্ভুত কিছু মিল লক্ষ্য করেছি আমি। তোমাদের ফেসকাটিং একরকম। আর মায়াও। এই! রেগে যেয়ো না শুকতারা। কম্পেয়ার করছি না একদম। জাস্ট বলছি।”
আমি বিস্মিত চোখে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম,“কোন স্কুলে পড়তেন।”
আরহান স্কুলের নাম বলতেই আমি মিষ্টি হেসে বললাম,“এরপর? একটা মেয়েকে নিয়েই এতো দূরত্ব?”
“নাহ্।”
“তবে?”
“এরপর আবার দুজন সেই মেয়েটিকে ভুলে এগিয়ে যাই। যতো যাই হোক, দুজনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। তারপর আশরাফ আঙ্কেল আর তানিয়া আন্টি মারা যায়। দুজনের মৃত্যু অনেক রহস্যময় ভাবে হয়েছে। সেদিন কলেজে গার্ডিয়ান মিটিং ছিলো। শেষ হতেই ফ্যামিলি সহ লং ট্রিপে গিয়েছিলাম। ছুটি ছিলো তো কিছুদিন! এজন্যই। কয়েকদিন বাদে আঙ্কেল-আন্টির খবর পেয়েছিলাম। পেয়ে যখন সেই বাড়িতে গেলাম, তৃষ্ণা ছিলো না। ওকে অনেক খুঁজেছি। আর পাইনি।”
আরহান থেমে গেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“তাহলে শত্রু কী করে হলো?”
“অনেক বছর পর দেখা হয়। এক মাদক ব্যবসায়ী রূপে ওকে দেখে আমি অবাক বনে যাই। তারপর ওকে সিঙ্গার হিসেবে দেখি। তিনটি চেহারা নিয়ে ঘুরছে তৃষ্ণা। মানুষের দুটো মুখোশ থাকে। একটা সবাইকে দেখায়, আর অন্যটা গোপন থাকে। কেউ দেখতে পারেনা সেটা। কিন্তু ওর তিনটা। একটা সবাইকে দেখায়, সিঙ্গার তৃষ্ণা; একটা গোপনে করে যায়, মাফিয়া তৃষ; আর একটা সেই তৃষ্ণা, যাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। মনের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে। তোমাকে ভালবেসেছিলো ওর মনের ভেতরে লুকোনো তৃষ্ণা। এজন্যইতো, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো জানতেই ছেড়ে দিলো। ওর সাথে আমার ঝামেলার শুরুটা হয়, আমি ওকে বলি, এসব ছেড়ে দিতে। সে তা ছাড়ে না। উল্টো আমার রাস্তার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ওর নারী আসক্তি আর ড্রাগ সাপ্লাই দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। আর এদিকে আমাদের শত্রুতাও। কেনোনা আমিও এসবে ওর বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছি।”
আমি স্তব্ধ রইলাম। সম্পর্ক তৈরি করতে অনেক কাঠ-খর পোড়াতে হয়। কিন্তু! ভাঙ্গার জন্য এক মুহূর্তই যথেষ্ট। আরহান হুট করেই মুচকি হাসলেন। আমি সেই হাসির মানে না বুঝে, অবুঝ দৃষ্টিতে উনার পানে তাকালাম।
আরহান তা দেখে বললেন,“কিছুদিন হলো তৃষ্ণা এসব ছেড়ে দিয়েছে। আর আমি খুব জলদি আমাদের মধ্যেকার রেষারেষি সব মিটিয়ে নেবো।”
এমন একটা খুশির সংবাদ শুনে আমার মুখেও হাসি চলে এলো। মুচকি হেসে বললাম,“যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটা নিউজ দেবার ছিলো।”
আরহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী?”
আমি আরহানের আরো নিকটবর্তী হলাম। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,“যদি বলি, সেই মেয়েটা আমিই, তবে কী মেনে নেবেন আমাকে?”
আরহান চোখ দুটো বড় করে ফেললেন। হয়তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি উনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি বিশিষ্ট গালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলাম। সেকেন্ড পাঁচেক সময়কাল এই উষ্ণ পরশ বিদ্যমান ছিলো। এরপর একটু দূরে সরে হাসতে হাসতে বললাম,“আমিই। আপনাদের দুজনের জন্যেই বাবা আমাকে স্কুল চেঞ্জ করিয়েছিলেন।”
__________________________
প্রায় রাত হয়ে এসেছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আমার কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছিলো। তাই হাওয়া খেতে বাড়ির পেছনের দিকটায় এলাম। চারিপাশে শীতল বাতাস। কিছুদূর এগোতেই আমি থেমে গেলাম। সামনে তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে। আমি চলে যেতে উদ্যত হলাম। কিন্তু তৃষ্ণা আমাকে তার আগেই দেখে ফেললো।
উঁচু কন্ঠে ডাক দিলো,“শুনেন!”
আমি পিছু ঘুরে তাকাতেই তৃষ্ণা বললো,“আপনি এসেছিলেন, এখানে থাকেন। আমি যাচ্ছি।”
“না। সমস্যা নেই। আপনি থাকুন।”
তৃষ্ণা হালকা হেসে বললো,“আপনার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো। বলতে পারি?”
আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি এনে বললাম,“হুম।”
এগিয়ে গেলাম তৃষ্ণার দিকে। দুই হাতের দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালাম। তৃষ্ণা মাথা নিচু করে বললো,“আপনার সাথে যা করেছি, তা অন্যায়। মনে রাগ পুষে রাখবেন না।”
আমি তৃষ্ণার কথায় স্বাভাবিক হলাম। মন থেকে হেসে বললাম,“সমস্যা নেই। আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন, এই অনেক। সবাই পারে না এটা।”
তৃষ্ণা চোখ তুলে তাকালো। চোখাচোখি হলো আমাদের। হুট করেই তৃষ্ণার দৃষ্টি আমার পেছনে চলে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলো কিছু। বুঝতে পেরেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। বিকট এক শব্দ কানে এলো। চোখ মুখ কুঁচকে ফেললাম। ধাক্কাটা আলতো করে দেবার কারনে আমি পড়ে যাইনি।
কিছুক্ষণ বাদে চোখ খুলে দেখলাম, তৃষ্ণা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। লাইটের মৃদু আলোয় তার রক্তে ভেজা শরীর দৃশ্যমান। আমি এমন কিছু দেখা মাত্রই অস্থির হয়ে পড়েছি। ছুটে গেলাম তৃষ্ণার কাছে। সে এখনও তাকিয়ে। আমাকে দেখে হালকা হাসলো। মুখ দিয়ে রক্তবমি হচ্ছে। সেভাবেই হাসছে। নীলাভ চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। কী ভয়ঙ্কর! আমি কান্না করে দিলাম।
তৃষ্ণার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কান্না করছি। মাথা কাজ করছে না। কী করবো এখন?
তৃষ্ণা তার অন্য হাতটি উঠালো অনেক কষ্টে। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে আমার হাতের মুঠো শক্ত করে ধরলো। আমার দুই হাতে রক্ত। এতো রক্ত! অনেক কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই তৃষ্ণার!
কিছুক্ষণ বাদে তৃষ্ণা সব কষ্ট হজম করে বললো, “আ..আমি ধন্য ন..নয়ন..নয়নতারা। আপনার স্পর্শ প…পেয়েছি। আমি ধন্য।”
আমি ঠোঁট চেপে কান্না থামিয়ে বললাম,“আপনার কষ্ট হচ্ছে! কষ্ট হচ্ছে? এই? কী করবো আমি? কী করবো? বলে দিন না! আপনার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। আমারও হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। কী করবো আমি? বলে দিন না!”
আমার অগোছালো, এলোমেলো কথা শুনে তৃষ্ণার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আমি এতো উতলা হচ্ছি কেনো জানিনা!
তৃষ্ণা আমার হাত দুটোতে নিজের হাতের বল প্রয়োগ করলো। বন্ধন জোরালো করলো। যেনো কেউ উনাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণা যেতে চাচ্ছে না।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “ইশ! কী ভাগ্য আমার। প্রিয় ম..মানুষটি উতলা হচ্ছে আমার জন্য। কীযে খুশির! আগে জানলে, অনেক আ..আগেই মরতাম নয়নতারা। আ..আমি আমার প্র..প্রমিজ ব্রেক করলাম নয়নতারা। আবারও ব…বললাম আপনাকে। ভা..ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। ম..মরতে মরতে ভালোবাসি। আমার মিথ্যেয় ঘ..ঘেরা জীবনের, এক…মাত্র সত্যি আপনি। ভালো…বাসি আপনাকে।”
তৃষ্ণা থেমে গেলো। শুধু তৃষ্ণা না। পুরো প্রকৃতি থমকে গেলো। গড়িয়ে পড়লো আমার চোখের শেষ বিন্দু জল। নিভে গেলো একটা জীবন। যেই জিবনটা ছিলো অপ্রাপ্তিতে ঘেরা। কার জন্য নিভলো? অবশ্যই আমার জন্য। জীবনযুদ্ধে হেরে গেলো। নাহ্! জিতে গেলো। কেননা সে ভালবেসেছে। ভালোবেসে মরেছে। ভালোবাসায় জিতেছে।
চারিপাশে সবকিছু অসহ্য লাগছে। কেউ নেই কেনো? আমার মুখ দিয়ে শব্দ আসছে না কেনো? কথা বলতে পারছি না কেনো? চিৎকার করতে চাচ্ছি। পারছি না কেনো? এতো অস্বস্তিকর অনুভূতি! পুরো শরীর অবশ হয়ে গেলো কি!
অনেকটা সময় বাদে আমার গলায় স্বর এলো। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে দুমড়ে কেঁদে উঠলাম। আরহানসহ বাড়িসুদ্ধ লোক বাড়ির পেছনে চলে এলো, যেখানে আলগোছে শুয়ে আছে তৃষ্ণা, থম মেরে বসে আছি আমি। আরহান তৃষ্ণাকে মাটিতে লুটিয়ে থাকতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার পা জোড়া ওখানেই থমকে গেলো। মাটি যেনো আরহানের পা-কে সেখানে আটকে রেখেছে। আমি এক দৃষ্টিতে তৃষ্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। যা খোলা আছে। শক্ত করে ধরে রাখা হাতের বাঁধন আরো জোড়ালো হয়েছে।
আমার শাশুড়ি মা এসব দেখে দৌঁড়ে তৃষ্ণার কাছে এসে কেঁদে দিলেন। আমার মা সেখানেই “বাবাই” বলে নিচু কণ্ঠে বুলি আওড়ালো। তাও চুপ হয়ে গেলো। মা নিজেও গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। আশেপাশের সবাই মাকে ধরলো। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।
দীপ্তি চুপ করে তৃষ্ণার পাশে বসলো। অনুভূতিহীন গলায় জিজ্ঞেস করলো,“ভাইয়া?”
কারো কোনো রাও না পেয়ে দীপ্তি হেসে দিয়ে বললো,“আরে তোমরা সিরিয়াস হয়ো না। ভাইয়া মজা করছে। এরকম আগে থেকেই করে। যা দুষ্ট না!”
তারপর তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললো,“দেখ ভাইয়া! সবাই সত্যি মনে করছে। মা কিন্তু এবার সেন্সলেস হয়ে গেছে। জলদি ওঠ। নাহলে কিন্তু তোর সব ব্ল্যাক আউটফিট পুড়িয়ে দেবো এবার। ভাইয়া ওঠ।”
এটুকু বলে দীপ্তি ধীরকণ্ঠে বললো,“এতেও হচ্ছে না!”
তারপর সবার দিকে তাকালো। নিজের ভাইকে আবারও দেখে বললো,“ভাইয়া! এবার কিন্তু কেঁদে দেবো। তোর ছুটকি কেঁদে দেবে। তুই না আমার কান্না সহ্য করতে পারিস না! ভাইয়া ওঠ।”
দীপ্তি কেঁদে দিলো। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,“ভাইয়া! ওঠ না! দোহায় লাগে। মজা ভালো লাগছে না। ওঠ প্লিজ।”
মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,“আন্টি আপনি বলেননা উঠতে। আপনার কথা শুনবে। ও উঠছে না কেনো?”
মা আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে দিলো। আমি তৃষ্ণার খোলা নীলাভ চোখের দিকে দেখে যাচ্ছি আর একনজর আশেপাশে দেখে নিচ্ছি। আরহান এখনও ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ বাদে আমি আরহানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। আরহানও তার নজর তৃষ্ণার পানে থেকে সরিয়ে আমার পানে ঠেকালেন। সেকেন্ড যেতেই হন্তদন্ত হয়ে তৃষ্ণার পাশে এসে হাঁটু মুড়ে বসলেন। মা সরে, জায়গা দিলো।
অস্থির কন্ঠে বললেন,“হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। সরো তোমরা।”
আরহান তৃষ্ণার পেশীবহুল শরীর অনেক কষ্টে কাঁধে তুললেন। যেতে নিলেই কিছু একটা বেঁধে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, আমার হাত তৃষ্ণার হাতের মুঠোয়। আমি ছাড়াতে চাইলাম। পারছি না। একটুও পারছি না। মা হেল্প করলো। তবুও হচ্ছে না। কেনো হচ্ছে না?
মৃত্যু নাকি সবার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। অথচ তৃষ্ণা পেলো। ভালোবাসা পেলো। একচোখে তার মৃত্যু ছিলো, আর অন্য চোখে তার জন্য আমার অস্থিরতা। দুটো একসাথে দেখতে পেলো। শান্তি পেলো। কিছু পেয়েতো দুনিয়া ত্যাগ করলো। এই বা কয়জন পায়?
চলবে…