সেঁতসেঁতে ভাঙ্গা টিনের চালাঘরে
‘টিনের চোখের’ ছিদ্র দিয়ে
টপটপ করে ঝরে পড়ছে বৃষ্টির ফোঁটা
মশারির উপর,
আর মজিদ মাস্টারের একমাত্র তরকারীর বাটি
বিশ্বস্ত সহচরের মতো যেন ঠিকঠাক বসে আছে
একেবারেই বৃষ্টি-ফোঁটার নিচে।
বেরসিক জানালার পাল্লা দুটিও
কেন জানি আজ অজানা কোন বিরহে
আর মাতাল কোন বৃষ্টির পরশে যেন
বেহায়া হয়ে উঠছে বারবার,
হতচ্ছাড়া জং ধরা ছিটকিনিটাও
যেন ক্ষয়ে যাওয়া এক ‘ক্রোধান্বিত হাঁড়’।
একাকিত্বের সহচর চেয়ারটির
একখানা পা যেন ‘ঝুলে থাকা এক প্রতিবন্ধী’
বাকি তিনখানা কোন এক অদৃশ্য মায়ায়
অলিখিত এক নিষেধাজ্ঞা বুকে নিয়ে
সেঁটে আছে কোন মতে…
যেন ‘যাই যাই করে যাবেনা’ বলে
টিকে থাকা এক ‘মানবিক কংকাল’।
মশারির ভেতর থেকে আকাশ দেখতে দেখতে
বেয়াড়া বৃষ্টির অঝোর ধারার কান্না দেখতে দেখতে…
আর জানালার ফাঁক দিয়ে……
কদমঘেরা ‘বাদল-মেঘের ছায়া’ দেখতে দেখতে
গাঁয়ের বনঝোপ-নদী-মাঠে লুকিয়ে থাকা পরিত্যক্ত শৈশব দেখতে দেখতে
প্লাস্টিকের চিরুনি দিয়ে ‘অদৃশ্য আয়নায়’
চুল আর তালু আঁচড়াতে আঁচড়াতে
‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গুনগুন করে গাইতে গাইতে,
মজিদ মাস্টার হাতে নিলেন তার কবিতার খাতা
লিখলেন তার অমর কবিতাখানি……….
একদিন এইখানে গৃহ ছিল
একদিন এইখানে আমি ছিলাম
একদিন এইখানে সুখ ছিল
এক দিন এইখানে সুর ছিল
একদিন এইখানে কবিতা ছিল
সিগারেট ছিল…
ছাইদানি ছিল…
ফুলের টব ছিল..
কবিতার আড্ডা ছিল…
জীবনানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ছিল,
হ্যাগার্ড, টলস্টয়, নীটশে, এমারসন, টুর্গেনেভ…..
….. সবাই ছিল……
জোনাকজ্বলা রাত ছিল…
মায়ের ডাকা ‘খোকা’ ছিল
বাবার হাতের ‘লাঠি’ ছিল
ভরসা ছিল…
বিশ্বাস ছিল…
বকুনি ছিল…
ভালোবাসার সুগন্ধি ফুলও ছিল
তোমার দেয়া ‘ভুলনা আমায়’ রুমাল ছিল
একদিন এইখানে তুমি ছিলে বলে
একদিন এইখানে সব ছিল
আর ছিল…
‘থালা ভর্তি অভাবের’ নিত্য আনাগোনা।
এখন আর এইখানে কিছুই থাকে না
শুধু থাকে আমি কিংবা আমার ছায়ামায়া স্মৃতি
আমার ভাঙ্গা চেয়ার
আমার প্রিয় বাটিখানা
যত্নে রাখা চিঠি গুলো
সবই যেন হাওয়ার কুহক
কারন তুমি নেই বলে…
আসলে এখানে আর কেউই থাকে না।
মশারির ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা লোকটি
হঠাৎ মশারির চারটি গোন ছিঁড়ে ফেলে
আর স্বপ্ন ঘোরে চিৎকার করে বলতে থাকে….
আমার কবিতার খাতা ফিরিয়ে দাও
আমার টাপুর টুপুর বৃষ্টির ফোঁটা ফিরিয়ে দাও
আমার শৈশবটি ফিরিয়ে দাও
আমার মধ্যদুপুরের একপশলা বৃষ্টি ফিরিয়ে দাও।
গভীর তন্দ্রা থেকে হঠাৎ জেগে উঠে মজিদ মাস্টার
শিশুচক্ষুর অন্তরাল থেকে
দিগন্তে মুছে যাওয়া গ্রামের আড়াল থেকে
ছেঁড়া-পুরোনো-ধুলোমলিন বইয়ের পাতা থেকে
চাওয়া-পাওয়ার মাঝখানে লুকানো বিষন্নতা থেকে,
ভালোবাসা ও অনভ্যস্ত কষ্টের মাঝখান থেকে
কাল ও মহাকালের মাঝখানে গড়ে উঠা
‘অবৈধ আবাসন’ থেকে…..
চিৎকার করে বলে ওঠে…..
“এইবার পৃথিবীকে শিক্ষা দিয়ে যাব আমি…
… সক্রেটিসের মতো নয়
… এরিস্টটলের মতো নয়
… পাঠ্যপুস্তকের মতো নয়
… পুঁজিবাদী শিক্ষা নয়
… অর্থতন্ত্রের শিক্ষা নয়
… ঠিকে থাকার শিক্ষা নয়
মানুষ ও মানবিক হওয়ার শিক্ষা।”
বাহিরে তখনও অঝোর ধারায় বৃষ্টি
আকাশে বিদ্যুৎ চমকানি……….
আরণ্যক শামছ
অক্টোবর ২২, ২০২১ইং