পড়ন্ত বিকেল (পর্ব-৫)

Photo of author

By Sabiha Khan

সন্ধ্যায় মোস্তাক অফিস থেকে এসে চা না খেয়েই প্রতিদিনের মতো বাসার সামনের খোলা মাঠটায় হেঁটে আসলো। আজ সকালে হাঁটা হয়নি। কারণ নদী ডাকেনি। নদী নামাজ পড়েই সকালে ব‍্যস্ত ছিলো রান্নাঘরে। কথা ছিলো ইমন আসবে। দুপুর পর্যন্ত একগাদা খাবার রান্না করেছে সে। ইমন দুপুরে খেয়েই চলে গিয়েছিলো। তাই রান্নার চিন্তায় একদমই ভূলে গিয়েছিলো ডাকতে। এটা নদীর অন‍্যায়ই হয়েছে, মনে মনে নিজেকেই অপরাধী ভাবছিলো। বেচারা আজকের নামাজটাও পড়তে পারেনি। হেঁটে এসে ফ্রেস হলে চা দিলো নদী কিছু হালকা নাস্তার সাথে। নাস্তা খেতে খেতেই মিতালি বাবাকে বললো, দেখো না বাবা, মা, আমার মেয়েকে একটা সুয়েটার বানিয়ে দিচ্ছে না। মোস্তাক বললো, তোর মা ইচ্ছে করলেই পারে। গতবছর একগাদা নানা রঙের সুয়েটারের সূতো এনে দিয়েছি। তাছাড়া আগেরও অনেক সূতো আছে তো মনে হয়। আর কিনে দিবো না। আজকাল হাতের তৈরী সুয়েটার পড়তে ভালো লাগে না। বউমা ঠিকই বলেছিলো। নদী বুঝতে পারলো, এসব সব সকালের রাগ। নদী পরিবেশটা বদলে দেবার জন‍্য হেসে বললো, বেশ তো এখন থেকে আমেরিকা আর কানাডার তৈরী সুয়েটার পড়ো। তারপর মিতালির দিকে তাকিয়ে বললো, আছে সূতো। কিন্তু ডিজাইনটা তো বলে দে। মিতালি বললো, মা তুমি আমাকে একটা বড় ফ্রক বানিয়ে দিয়েছিলে অনেক রঙ মিশিয়ে, মনে আছে? ঠিক তেমনি একটা মুচকানকেও বানিয়ে দাও। নদী বললো, অনেক সময়ের ব‍্যাপার রে। আমি ভাবছিলাম দুটো রঙ মিশিয়ে কিছু একটা বানিয়ে দিবো। মোস্তাক নাতনিকে কোলে নিয়ে কিছুটা বিরক্তির স্বরেই বললো, এইটুকু বাচ্চার একটা ফ্রক, কতোইবা সময় লাগবে তোমার? নদী বললো, সময় লাগবে কারণ মিতালির ডিজাইনটা বেশ কঠিন ছিলো। তাছাড়া একটু বড় করে বানিয়ে দিলে বেশ কিছুদিন পড়তে পারবে। মিতালি নদীর দিকে তাকিয়ে পায়েস খেতে খেতে বললো, কোন প্রয়োজন নেই মা। ছোট করেই বানিয়ে দিও। মোস্তাকের কোল থেকে নাতনিকে কোলে নিয়ে নদী বললো, ঠিক আছে, বানিয়ে দিবো। মনে মনে ভাবলো, অফিসের ঝামেলাটা নেই এখন। বিকেলে তো বসেই থাকি। তাছাড়া অনেক রাত পর্যন্তও যদি বুনি তাহলে ঠিকই হয়ে যাবে। মুখে বললো, তবে আজ আর হাত দিবো না। কাল দিনের আলোতে দেখবো কোন রঙটার সাথে কোন রঙটা যায়। নদী বললো, আজ কিছু আচার করবো মিতালির জন‍্য। মিতালিকে দিয়ে দিবো সাথে। মিতালি বললো, আচার বানাও। খেয়ে যাবো কিন্তু সাথে আমি একটা আচারের বোতলও নিবো না কিন্তু। তোর তো আমার হাতের আচার খুব পছন্দ রে। তাই ভাবছিলাম, নদীকে থামিয়ে দিয়ে মিতালি বললো, মা ফ্রকটাই বানিয়ে দাও। স্মৃতি থাকবে আমার মেয়ের। নদী আচার বানাতে ব‍্যস্ত হয়ে পড়লো। আচার বানাতে বানাতে নদী ভাবলো, শুধুই স্মৃতির জন‍্য সুয়েটার বুনবে? ভালো। তাও মিতুটা তার স্মৃতি তো রাখতে চাচ্ছে। খোকাতো হয়তো তাও রাখবে না। রাতে ঘুমানোর সময় ঘড়িটা এ‍্যালার্ম দিয়ে রাখলো। আজ মোস্তাক বেশ রেগেছে নদীর উপর। কারণ নদীর সাথে মোস্তাক প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া একটি কথাও বলেনি, যা অন‍্যদিন বলে।। নদী ভাবলো, এই দীর্ঘ সংসারজীবনে আজই প্রথম সকালে ডাকতে একদমই ভুলে গেছি আর তাতেই এতো অভিমান? মোস্তাকের গায়ে পাতলা চাদর দিয়ে ভাবলো নদী, মিতালি ঠিকই বলেছে, বড্ড ভূলো মনের হয়ে গেছে নদী। বয়স হয়ে গেছে তার।পরদিন দুপুরের পর সুয়েটারের সূতোর বাক্সটা নিয়ে নদী তার প্রিয় পিছনের বারান্দায় বসলো। অনেক রঙের সূতো। বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো। বেশিরভাগ কোন রঙটা দিবে? শেষমেশ গোলাপী রঙটাই বেছে নিলো নদী। কিন্তু তার ভিতরে কোন কোন রঙ থাকবে? একটা করে সূতো নিয়ে গোলাপী রঙের সাথে ধরছে। নীল রঙটা বেশ ফুটছে। কিছু হলুদ এবং লাল রঙও নিলো। কিন্তু অনেক রঙ দিয়ে মিতালির ফ্রকটা বানিয়েছিলো সে। তাই আরো কিছু রঙ দরকার। সবুজ রঙটা? হঠাৎ একটা রঙের সূতো নিয়ে নদী যেন খানিকটা চমকে উঠলো। এই রঙটা কোথায়, কোথায় দেখেছে সে? ঠিক খয়েরীও নয়, একটু কালচে খয়েরী রঙ…….

নদী যেন নিজের অজান্তেই ফিরে গেলো ঠিক চল্লিশ বছর আগে। তাদের বাসার সামনাসামনি সরকারি অনেক বাসা ছিলো। নদী তখন সবে কলেজের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিছুদিন পরেই পরীক্ষা। কলেজ বন্ধ দিয়ে দিয়েছে। বাসাতেই পড়ছে সবাই। নদীও সারাদিন পড়াতেই ব‍্যস্ত থাকে। রেজাল্ট ভালো না হলে ভারসিটিতে ভর্তি হতে পারবে না। গতকাল ঘর থেকেই বের হয়নি সে। যদিও সে প্রতিদিনই হাঁটে। সেদিনও সন্ধ‍্যার আগে নদী হাঁটছে তাদের বাসার সামনের সরকারি কোয়াটারের চিকন রাস্তাটায় আর সারাদিন যা পড়েছে তা যেন আপন মনেই পুনরায় ঝালাই করছে মাথায়। বাসায় ফেরার সময় হঠাৎ নদী দেখলো ঝাকড়া চুলের একটি ছেলে তাদের বাসার ঠিক সামনের বাসার বারান্দায় বসে গিটার বাজাচ্ছে। কখনো দেখেনি নদী এই ছেলেটিকে। ইংরেজি গানের সুর তুলছে। নদীর প্রিয় গান। প্রায়ই সে এই গানটি শুনে। নদী সহসাই নিজের অজান্তেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ছেলেটি হেসে নদীর দিকে তাকিয়ে বললো, ঠিক বাজাচ্ছি তো? নদী কিছুটা থমকে গিয়ে বলেছিলো, হ‍্যাঁ। একদম ঠিক। ছেলেটি তাকে আরো অবাক করে দিয়ে বললো, প্রায়ই এই গানটি তোমাদের বাসায় বাজে। সরি তুমি বলে ফেললাম। নদী তাড়াতাড়ি বললো, ঠিক আছে। কে শুনে? আবার প্রশ্ন। নদী আপনমনেই বলেছিলো, আমিই শুনি। হুম, আমি দেখি প্রতিদিনই তুমি জানালার পাশে টেবিলে পড়ছো। এতো কি পড়ো? আমার পরীক্ষা যে সামনে। ওহ্ সরি। আমি জানতাম না। আগে কোনদিন দেখিনি কেন তোমাকে? আবার প্রশ্ন। আমাদের বাসা তো এখানেই ছিলো নদী অবাক হয়ে বলেছিলো। তাহলে হয়তো লক্ষ‍্য করিনি। অবশ‍্য আমি এখানে থাকি না। ঢাকায় থাকি। ভারসিটির পরীক্ষা শেষ, তাই ঘুড়তে এসেছি বাবা মায়ের কাছে। দশদিন হলো আমি দেখছি, প্রতিদিন সন্ধ‍্যার আগে তুমি আপন মনেই হাঁটো একা একা এই রাস্তাটায়। মনে হয় এদিকে প্রাচীর তুলে বন্ধ করে দিবে। সব ফাইনাল হয়ে গেছে শুনলাম। নদীর কোন মাথা ব‍্যাথা নেই। তুললে তুলুক প্রাচীর। যদিও সরকারি কোয়াটারের ভিতর দিয়ে যে রাস্তা সেটাই তারা বেশিরভাগ ব‍্যবহার করে। এর কারণ খুব সহজেই মেইন রোডে চলে যাওয়া যায় অল্প সময়ে। তবে নদী চলে যেতো তাদের বাসার পেছনের রাস্তা দিয়ে। পাড়ার সব মেয়েদের সাথে দল বেঁধে কলেজে যায়। কোন প্রাচীর না থাকাতে সরকারি কোয়াটারের সব বাসাগুলি দেখে তারা এবং কোয়াটারের একটি মেয়ের সাথে নদীর বেশ ঘনিষ্ঠতাও আছে। কারণ নদীর সাথেই পড়ে সে। বেলা। নদীর বেশ খারাপ লাগলো কথাটা শুনে। শহরের বড়চাইতে বড় শাড়ির দোকানটা নদীদের। কোয়াটারের সব মহিলারা দল বেঁধে তাদের দোকানে যায় শাড়ি কিনতে এবং তাদের বাসায়ও আসে। মায়ের সাথে বেশ আড্ডা হয় তাদের। নদী আর কথা বাড়ালো না, চলে এসেছিলো ওখান থেকে। কিন্তু এরপর থেকে সে পড়তে বসলে সামনে তাকালেই দেখতো ছেলেটি বেতের চেয়ারে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাদের বাসার দিকে। কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতো সে। নদী জানালার পর্দাটা টেনে দিতো। কিন্তু মা এসেই আবার পর্দা সরিয়ে দিয়ে বলতেন, দিনেরবেলা অন্ধকার করে রেখেছিস কেন ঘরটাকে। নদী কিছুই বলতে পারতো না। বড়ভাইয়া সবে চাকুরীতে ঢুকেছে। সেও ঢাকাতেই থাকে। নদী পরীক্ষা শেষ করেই ঢাকা যাবে বেড়াতে বড়বোনের বাসায়। দুলাভাই ব‍্যাংকে চাকুরী করেন। দুইবোন মিলে দাদার বিয়ের বাজার করবে। দাদার জন‍্য মেয়েও ঠিক করা হয়ে গেছে। নদীর পরীক্ষার কিছুদিন পরেই বিয়ে। নদী দুদিন বাসা থেকে বের হলো না। দুদিন পর নদী গিয়েছিলো কোয়াটারের বেলাদের বাসায়। বেলার সাথে বেশ কিছুক্ষণ পড়াশুনা নিয়েই কথা হলো। বেলাও পরীক্ষা দিবে তার সাথে। অংকে ভিষণ কাঁচা। কিছু অংকও সে বুঝিয়ে দিলো বেলাকে। তারপর বাসার দিকে আসতেই হঠাৎ পেছন থেকে শুনলো, এই শুনো। শুনছো?

চলবে…

সাবিহা খান, লন্ডন