কন্ট্রোল জেড

Photo of author

By Akhtar Hossain

-‘বুঝতে পেরেছো দীদু, এখন শিক্ষিত মানেই কম্পিউটিং আর ড্রাইভিং জানা। আর তা না হলে তুমি অশিক্ষিত….!’
প্রথম দিন পঁয়ষট্টি বছরের জোহরা বেগমের ষোল বছরের নাতি আদনান এই কথাটা বলেই তাঁকে কম্পিউটারে হাতে খড়ি দেয়।
প্রথম দিন তো খুবই অসুবিধা হচ্ছিলো।
মাউস ধরতেই পারছিলো না।
অদ্ভুত নাম! মাউস!
ইঁদুরকে নাকি ইংলিশে মাউস বলে। ইঁদুর দিয়ে কম্পিউটার শেখা? কেন রে বাপু, আর কোনো নাম পাওয়া গেলো না আল্লাহর এই এতো বড় দুনিয়ায়? শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের সাহায্য নিয়ে শিক্ষিত হতে হবে?
ডানে নিতে বামে যায়, বামে নিতে ডানে। রাইট বাটন, লেফট বাটন, ক্লিক, ডাবল ক্লিক, এগুলো বুঝতেও বেশ সময় গেছে। এমন কি, অবাক কাণ্ড, ডাবল ক্লিক আয়ত্ত করতে পাক্কা পাঁচটা দিন গেছে। তর্জনী দিয়ে দুবার দ্রুত চাপ দিতে গিয়ে কেমন যেন আঙ্গুল নিয়ন্ত্রণে থাকছে না। প্রথম বারের পর দ্বিতীয়বার চাপ দিতে গিয়ে বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। আবার দ্রুত করতে গিয়ে দুবারে আঙ্গুলকে থামানো যাচ্ছে না। তিন চারবার চাপ পড়ে যাচ্ছে। আদনান তো হেসেই কুটি কুটি।
কিন্তু না, শুরু যখন করেছে, শেষটাও দেখে ছাড়বে, জোহরা বেগমের এমনই জেদ চেপে যায়। শিক্ষিত তাকে হতেই হবে। এ বয়সে ড্রাইভিংটা আর হবে না। তবে, ঘরে বসে নাতির সাহায্যে কম্পিউটার চালানোটা তো শেখা যেতে পারে। অন্ততঃ অশিক্ষিত নামটা ঘুচে যাক! নিজেকে আর অশিক্ষিত ভাবতে চায় না জোহরা বেগম।
আদনান তার ড্যাডির মাকে কম্পিউটার শেখাতে শেখাতে মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন করে বসে, জোহরা বেগম আগে খুব অস্বস্তি বোধ করতো। এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই তো সেদিন আদনান হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করে বসলো, ‘দীদু, তোমার বয়স এখন কতো হলো?’
-আমার বয়স জেনে কী করবে রে দাদু ভাই…’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় জোহরা বেগম।
এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নামিয়ে মুখটা কানের কাছে এনে বলে, ‘দীদু, তোমার যখন আমার মতো বয়স ছিলো, তোমার কোনো বয় ফ্রেন্ড ছিলো না?’
জোহরা বেগম নাতির দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায়। এই পঁয়ষট্টি বছর বয়সে ঊনপঞ্চাশ বছর আগের ষোল বছর বয়সের কথা ভুলেই গিয়েছিলো জোহরা বেগম। তাই তো, সেই ষোল বছর বয়সটাতো ঊনপঞ্চাশ বছর হলো পেরিয়ে এসেছে!
কেমন ছিলো সেই বয়সটা?
বয় ফ্রেন্ড? এ ধরনের কোনো বস্তু বা কোনো প্রাণী থাকতে পারে, সেটাই তো জানতো না জোহরা বেগম! ফ্রেন্ড মানে বন্ধু তো বন্ধুই; এর মধ্যে বিভাজন আছে না কি? ছেলে বন্ধু, মেয়ে বন্ধু! বন্ধু তো দূরের কথা, তেরো হতে না হতে তো স্কুলে যাওয়া প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। স্কুলের হেড মাস্টার বাসায় এসে আব্বাজানের হাত ধরে অনুরোধ করায় স্কুল যাবার অনুমতি পাওয়া গিয়েছিলো। কিন্তু, বিকালে গ্রামের আরও ছেলেমেয়েদের সাথে হৈ চৈ করতে করতে মাঠে খেলা, সেটা বন্ধ হয়ে গেলো।
-কই, দীদু, কিছু বললে না তো! বলো না, তোমার ক্রাশের গল্প খুব শুনতে ইচ্ছা করছে…’ এবার আদনান দাদীর গলা জড়িয়ে ধরে।
জোহরা বেগমও হাসতে হাসতে বলে, ‘ভাই রে, আমরা তো বাংলা যুগের মানুষ, বাংলা ছাড়া তেমন কিছু বুঝি না। এই যে কাশ না ফাঁস বললে, শুনে তো আমার গলায় কাশ চলে এলো, গলায় ফাঁস লেগে গেল…!’
-আরে দীদু, কাশ ফাঁস নয়, ক্রাশ! ক্রাশ মানে এই ‘লাভ’ আর কি, লাভের মতোই…’।
নাতির কথায় দাদী বোকার মতো চেয়ে থাকে। আদনান আরো পরিষ্কার করে বলে, ‘তাও বুঝলে না? লাভ মানেও জানো না?’
‘লাভ’ মানে জানবে কেমন করে জোহরা বেগম?
গ্রামের ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া অতি সাধারণ একটা কালো রঙের মেয়েকে ‘লাভ’ করবে কে? বরং, তারই ভালোলেগেছিলো সমবয়সী একটা ছেলেকে।
মুখ ফুটে কোনোদিনও বলতে পারেনি। স্কুলে যাওয়া আসার পথে অপলকে দেখতে পেলে তাকিয়ে থাকতো। চোখে চোখ পড়লেই দ্রুত সরে যেতো।
সেই ছেলেটি একদিন হারিয়ে যাবার আগে ছন্দবদ্ধ দুটি বাক্য লিখে তাকে দিয়েছিলো, ‘ময়ূরকণ্ঠী রঙে দেখো রাত্রি সেজেছে / তাই তো আমার মন যে তোমায় ভালোবেসেছে।‘
কিন্তু, সে হারিয়ে গেলো কেন? কোথায় চলে গেলো? মাথাভরা ঝাকড়া চুলের ছেলেটা কি তাকে ভালোবেসেছিলো? এই দুটি বাক্য কি তাকেই উদ্দেশ্য করে লেখা? নাহ, আসলে জোহরা বেগমকে কেউ ভালোবাসেনি, ভালোবাসার আবেদন জানাতে কেউ আসেনি!
হঠাৎ একদিন জানতে পারলো শহরের এক বেশ ধনী মানুষ তাকে বিয়ে করতে চায়।
ঘটক হলো শহরে বাস করা মুদি দোকানী তার চাচা। পাত্রের বয়স একটু বেশী বটে; আবার দোজবরে! কিন্তু, এমন পাত্র সচরাচর মেলে না।
এ পর্যন্ত জোহরা বেগমের জন্য যতো পাত্র দেখা হয়েছে, সবাই ফর্সা মেয়ে খোঁজে।
গায়ের রঙ হতে হবে টকটকে, রাজকন্যার মতো! জোহরা বেগম তো রাজকন্যা নয়।
নিজের ক’ বিঘা জমি আর বাকীটা অন্যের জমি বর্গায় চাষ করে জোহরা বেগমের আব্বাজান। একে গরীব কৃষকের মেয়ে, তার ওপর গায়ের রঙ কালো। গ্রামের রাজা-রাণীর রাজপুত্ররা ফিরে ফিরে যায় মুখ ঘুরিয়ে। কালো মেয়ে জোহরার বিয়ে আর হয় না। তার প্রায় দ্বিগুণ বয়সী লোকটার সুন্দরী বউ ছিলো। সে না কি কার সাথে কোথায় চলে গেছে। সেই থেকে ফর্সা মেয়েদের ওপর সে মহা খ্যাপা! গ্রামের কম পড়ালেখা জানা কালো রঙের পাত্রী খুঁজছে। খুঁজতে খুঁজতে জোহরা বেগমকে পেয়েছে। কন্যাদায়গ্রস্ত জোহরা বেগমের গরীব আব্বাজান শহরের এই রকম সচ্ছল পাত্র, হোক দোজবরে, কোনো আপত্তি করেনি।
আর জোহরা বেগম?
তার আবার মতামত কি!
আটাশ বছরের জালাল মিয়ার ছিলো জমি কেনা বেচার ব্যবসা। নিজেও জমি কিনে রাখতো। কিছুদিন পর ভাল দাম পেলে বেচে দিতো। অন্যের জমিও কেনা বেচার কাজ করতো। আয় উপার্জন মন্দ ছিলো না। ঢাকা শহরে নিজের বাড়ি করেছে। দুই ছেলে এক মেয়েকে পড়াশোনা করিয়েছে, ভালো বিয়ে দিয়েছে।
‘জমির দালাল’ এই নামটা তার সন্তানেরা ঘুচাতে না পারুক, নাতি-নাতনিরা নিশ্চয়ই ঘুচিয়ে দেবে, এমন একটা আশা গোপনে তিনি পোষন করতেন।
কিন্তু, সেই সাফল্য জালাল মিয়া দেখে যেতে পারেনি। মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে, ডাক্তারের ভাষায় ‘ম্যাসিভ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ হওয়ায় মারা যায়।
স্বামী যখন হঠাৎ করে মারা যায়, জোহরা বেগমের বয়স তখন বেয়াল্লিশ কি তেতাল্লিশ। স্বামী হারিয়ে এখন ছেলেদের সংসারে নাতি-নাতনি নিয়ে ভালোই আছে।
নাতি নাতনীরা সবাই ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াশোনা করছে।
এই আদনানের তখন জন্মই হয়নি। প্রায় সাতাশ বছর লোকটার সাথে ঘর সংসার করেছে। লোকটার অনেক দোষত্রুটি ছিলো। নেশা টেশার বদ অভ্যাস ছিলো। মাঝে মাঝে বাইরেও রাত কাটাতো।
কিন্তু, খুব স্পষ্টবাদী আর সত্যবাদী ছিলো। অনেক কথা জালাল মিয়া অবলীলায় তার স্ত্রীর কাছে বলতো, যা জোহরা মনে করে, এমন ভাবে কোনো স্বামী এসব কথা বলবে না।
ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়াশোনা করা জোহরা বেগম বুঝতে পারতো না স্বামীর এই গুণটাকে সে কী বলবে? স্পষ্টবাদিতা, সত্যবাদিতা, না কি নির্লজ্জতা?
মাঝে মাঝে কি জালাল মিয়া তার পৌরুষের অহং প্রকাশ করতো? এসব কথা বলে কি সে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করতো? না কি তার প্রথম স্ত্রী যে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো, সেই ক্ষোভ এই ভাবে প্রকাশ করতো?
আবার মন ভালো থাকলে তাকে আদরে ভালোবাসায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতো। মুহূর্তের জন্য হলেও তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিতো।
জোহরা বেগমকে নিয়ে কক্সবাজার, রাঙামাটি বেড়াতে গেছে।
জোহরা বেগম একবার বলেছিলো, ‘আমার খুব বিমানে চড়ার শখ…।‘
সত্যি সত্যি একদিন জালাল মিয়া তার এই গ্রাম্য কালো বউটাকে বিমানে করে চিটাগং নিয়ে গিয়েছিলো। একদিন জালাল মিয়ার কী হয়েছিলো কে জানে, হঠাৎ করে জোহরাকে জজ্ঞেস করলো, ‘আচ্ছা বলো তো কোন রঙ তোমার পছন্দের?’
জোহরা বেগম তো অবাক! স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু। এমন ভাবে সিনেমার নায়ক নায়িকারা কথা বলে। জালাল মিয়া আবার বলে, ‘ চুপ করে আছো কেন, বলো—কী রঙ পছন্দ করো…’।
কী বলবে জোহরা ভেবে পায় না। হঠাৎ-ই মনে পড়ে গেল ময়ূরকণ্ঠী রঙের কথা।
আচ্ছা ময়ুরকণ্ঠী রঙটা কেমন? সেদিন বলতে গিয়েও কিছু বলতে পারেনি।
আদনান তার দাদীকে বলছে, ‘শোন দীদু, কম্পিউটার এমন এক জিনিস। এখান থেকে কোনো কিছু হারিয়ে যায় না…।‘
-তাই?’ অবাক হয়ে জোহরা বেগম জিজ্ঞেস করে।
-হ্যাঁ, কম্পিউটার আলাদিনের চেরাগের চেয়েও পাওয়ারফুল, মানে শক্তিশালী। কম্পিউটারের কোনো কিছুই কিন্তু হারায় না। ওকে যা কমান্ড মানে আদেশ করবে, ও তাই করবে। সেগুলোই তোমাকে একটু একটু করে শিখিয়ে দেবো। কম্পিউটারের নিজস্ব ভাষা আছে। সেই ভাষাটা তোমাকে শিখে নিতে হবে। মনে করো, কোনো কাজ করতে করতে ভুল বশতঃ বা অসাবধানতায় ডকুমেন্টটা হারিয়ে গেলো। তখন কম্পিউটারকে আদেশ করবে, সেই হারিয়ে যাওয়া ডকুমেন্টটাকে ফেরত দেবার জন্য। কেমন করে? এই যে, এই বাটনটা দেখো, সিটিআরএল লেখা আছে। এই সিটিআরএল মানে কন্ট্রোল, সংক্ষেপে সিটিআরএল বলে। আর এর ওপরের রো’তেই মানে সারিতে দেখো, এই যে ‘জেড’। এই সিটিআরএল বাটনটা চেপে সাথে সাথে জেড বাটন-এ চাপ দেবে। যে ডকুমেন্টটা তুমি এই মাত্রই হারিয়ে ফেলেছো সেটা আবার ঠিক আগের মতোই ফিরে আসবে…।‘
জোহরা বেগম খুব মনোযোগ দিয়ে নাতি আদনানের কথা শুনছিলো। হঠাৎ কী হলো কে জানে, জোহরা বেগম বলে উঠলো, ‘ দাদুভাই, কন্ট্রোল জেড বাটন চেপে হারিয়ে যাওয়া ময়ুরকন্ঠী রাতকে ফিরিয়ে আনা যাবে?’

প্রথম পোস্ট : ২০ অক্টোবর ২০২০
দ্বিতীয় পোস্ট : ২০ অক্টোবর ২০২২