আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৮)

Photo of author

By Anwar Hakim

আজিমপুর টু উত্তরা
ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
আনোয়ার হাকিম।

(১৮)
মন অশান্ত। শান্ত হবে কবে? সারাক্ষণ এই এক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় । একা থাকলে বা রাতের নির্জনতায় এই চিন্তা আরো বেয়ারা হয়ে উঠে। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিয়ের উৎপাত। আম্মা ফোন করলেই এক কথা বলে। আমি রেসপন্স করিনা বলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে আমি এখনো সেই কিউটির মা জেমিকে নিয়েই পড়ে আছি। বিরক্ত হয়ে একদিন বললো, “কোথাকার কোন মেয়ে, কার বৌ দেখে পাগল হয়েছে। আর ঐ মেয়েই বা কেমন অসভ্য। কি জানি বাপু আমি এসব চিন্তাও করতে পারিনা। এই ছিলো আমার কপালে। বুড়োকালে এগুলোও হজম করতে হচ্ছে”? কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,“শোন্, ঐ মেয়েকে নিয়ে যদি কিছু করিস্ তাহলে আমাদের সাথে তোর আর কোন সম্পর্ক থাকবেনা। মান-ইজ্জত তো সব যেতে বসেছে”। আমি কোন উত্তর দেই না। দেওয়ার মত কিছু নেইও। আম্মা ইদানীং নিজে না করে মলিকে দিয়ে ফোন করায়। মলিও একদিন ধুম্ করে বলে বসলো, “তোমার সেই কিউটির মা’র নম্বর দাও তো”। আমি বিস্ময়ে হতবাক। বললাম, “কেন? কি হয়েছে”?
— ফোন দেবো। কথা বলবো। প্রয়োজনে বাড়ী বয়ে কথা শুনিয়ে আসবো। মলির ঝাঁঝালো কন্ঠ।
— হঠাৎ ক্ষ্যাপলি কেন?
— ডিসগাস্টিং। শুনলেও গা ঘিন্ ঘিন্ করে
— শুনিস না। আমার উত্তর
— সেলিম জেনে গেছে।
— কিভাবে?
— তোমার সাথে আম্মার ফোন আলাপে। শ্বশুর বাড়ীতে আমার মুখ আর থাকলো না
— কবে ছিলো? সেলিম যা করেছে উল্টো তাদেরই মুখ থাকার কথা না। তুইও তো কম কাহিনী করে বিয়েটা করিস নি। বলামাত্রই মলি ফোন রেখে দিলো। তার শ্বশুরবাড়ী নিয়ে কিছু বলা যাবে না। সেলিমকে নিয়েও না। জানি বেশ কয়দিন লাগবে এই অবস্থা কাটাতে।

জেমি সম্মন্ধে আমিও ত্যক্ত। হতাশ। আগের সেই মোহের বিপরীতে ঘৃণা বোধ হচ্ছে আজকাল। বরং শৈলীর প্রজাপতি নৃত্য মাঝেমধ্যে দোলা জাগায়। জানি এটারও ভবিষ্যত নেই। তৌহিদকে খুলে বললাম। হেসে কুটি কুটি হয়ে দম নিয়ে বললো, “তোমার চোখের আর মনের অসুখ হয়েছে। যাকেই দেখো তাকেই ভালো লাগে। এক ধরণের মানসিক বৈকল্যও বলতে পারো। ডাক্তার দেখাও। বলো তো পাত্রী দেখি”। আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই তো। মানসিক কিছু সমস্যা নিশ্চয় হচ্ছে। তা না হলে বিবাহিতা জেমি, অসম শৈলী এদেরকে নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করছি কেন? জামান ভাইও দেখালেন ডানা কাটা পরী, মডেল। আজকাল মাথা প্রায়ই ঝিম্ঝিম্ করে। প্রথমে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। পরে চিন্ চিন্ করে। তারপর ক্লান্তি বোধ হয়। খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় বদলীর বিষয়টাও চাপা পড়ে গেছে। দেখতে দেখতে পাহাড়ে দেড় বছরেরও বেশি হয়ে গেলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। আমার জন্য অতি নির্জনতা যেমন দুর্বিষহ তেমনি অতি মুখরতাও অসহ্যকর। আমি মাঝারি গোছের জীবন যাপনে সিদ্ধ। সুন্দরীদের ভালো লাগে কিন্তু তাদের সাহচার্যে ভয়। স্বভাবে ভীতু ও স্বল্পবাক হলেও সাহসী ও উচ্ছ্বল প্রাণ সুন্দরীদের ভালো লাগে। কিন্তু এ কেমন অদ্ভুত বৈপরীত্য! জামান ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম, “ভাই, হাঁপিয়ে উঠেছি। আর কতদিন”?
— বদলী? আপাতত বন্ধ। ম্যানেজমেন্ট ডিসিশন।
— আমি তাহলে মরেই যাবো
— পাগলামী করো না। ঐদিন যে মেয়েটাকে দেখিয়েছিলাম সে ব্যাপারে কিছু বললে না তো
— ভাই, আমি মাফ চাই। আমার মাথা কাজ করছে না। পারলে এখান থেকে আমাকে নিয়ে যান।
— পাগলামি করো না। মেয়ের বায়োডাটা পাঠাবো?
— ভাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

জামান ভাই কি বুঝলেন জানিনা। ফোন রেখে দিলেন। মনে হচ্ছে আরেক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়ছি। জামান ভাইয়ের সাথে সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আগামীতে হয়ত মন কষাকষি হবে। আমার ঢাকার বদলীও ঝুলে যেতে পারে। আমার ভেতরের মনোরোগ আবার চাগা দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। মাথা আর নিতে পারছেনা।

অসময়ে আম্মার ফোন। বাসায় ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে নোটিশ এসেছে। এবারের রিটার্ন এখনো জমা প্রদান করা হয়নি। ট্যাক্স রিটার্ন হয় আম্মার নামে। আমাদের এক পরিচিত উকিল চাচা আছেন। তিনি প্রতি বছর আম্মার সাথে আলাপ করে রিটার্ন দাখিল করেন। এবার পারিবারিক ঝামেলার কারণে আম্মা খেয়াল করেনি। আর উকিল চাচাও খবর করেন নি। এখন উপায়? উকিল চাচাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা। ফোন লাগাতার বন্ধ। তিনি বসেন শ্যামলীতে। এমন তো কোনোবার হয়না। করোনার মধ্যে অবশ্য তার সাথে যোগাযোগও হয়নি। উনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তাও জানিনা। ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর সম্মন্ধে সাধারণ ট্যাক্সপেয়িদের দারুণ ভীতি কাজ করে। বেছে বেছে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ফাইল নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। অথচ কোটি কোটি টাকা যারা ফাঁকি দেয় তাদের কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। হলেও আন্ডার হ্যান্ড ট্রানজেকশনে দফারফা হয়ে যায়। ছোট মামার স্মরণাপন্ন হওয়া ভিন্ন কোন পথ নাই। মামা সার্কেল কমিশনারকে বিস্তারিত বলে একটা টাইম পিটিশনের ব্যবস্থা করেছেন। স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু মাথার উপর ঘন্টা ঝুলেই রইলো।

বহুদিন পর উকিল সাহেবকে পেয়ে ভালোই লাগলো। তবে সাথে নতুন উপদ্রব যোগ হলো। আলাপের শেষে এসে বললেন, “বাবাজী, আপনার অবস্থা কি”? বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ”। তিনি আরো পরিষ্কার করে বললেন, “আপনার রিটার্ন দিয়েছেন তো”? আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “আমার আবার কিসের রিটার্ন”? উকিল সাহেব বেশ রসিক। এখন অবশ্য করোনার খোঁচা খেয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছেন। বললেন, “চাকরি করলে রিটার্ন দিতে হবে। আর আপনি তো মা শা আল্লাহ ভাল চাকরিই করেন”। বললাম, “অফিস তো সেলারি থেকে ট্যাক্স কেটে রেখেছে”। “খুব ভালো করেছে। এখন সেই কাগজ পত্র দিয়ে আপনার নামে নতুন ফাইল খুলতে হবে”। বুঝলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমারই খেয়াল করা উচিত ছিলো। বললাম, “চাচা, টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি মেইলে কাগজপত্র পাঠাচ্ছি। আপনি ফাইল ওপেন করে রিটার্ন দাখিল করার ব্যবস্থা করেন”। উকিল চাচা টাকার কথা শুনে গদ্ গদ্ হয়ে গেলেন। দেশের মানুষ। আব্বার পরিচিত ছিলো। বিশ্বস্তও।

মতিঝিলে তৌহিদের অফিস। তাকে নিয়ে রাজউকে যাবো কাজে। ঐ অফিসের কথা শুনলেই আমার আত্মা থেকে থেকে চমকে উঠে। অগনিত লোকের আনাগোনা। কারো কোন উচ্চবাচ্য নেই। কার কি ব্যাথা, কার কত খসলো জানার উপায় নেই। রেফারেন্স নিয়ে কোন কাজে গেছেন তো আপনার পদে পদে বিপদ। এটা নাই, ওটা লাগবে। এভাবে হবেনা। আজ সম্ভব না। কাগজগুলো অস্পষ্ট ফেয়ার কপি দিতে হবে। আর যেই মাত্র দফারফা হয়ে গেল আপনি বুঝবেন সরকারি অফিস কত আন্তরিক। কাজ হচ্ছে ‘ফেল কড়ি ধরো পোয়া’ গতিতে। তৌহিদ পোড় খেতে খেতে এখন সিজনড। সেকশনের পিওন দেখামাত্রই দৌড়ে আসে। ঠান্ডা গরম কি খাবে জিজ্ঞেস করে। তার মাধ্যমেই আমাদের উত্তরা প্লটের রেজিস্ট্রেশন কাজ শুরু হলো। আমাকে সালাম দিয়ে পিওন বললো, “স্যার, নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। সব দায়িত্ব আমার। ফোন দিলে এসে কাগজ নিয়ে যাবেন”। শুনেই সুখ লাগলো। পকেট যতই ফাঁকা হোক। সেই তৌহিদকে নিয়ে লালনের কাছে গেলাম। পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জে তার অফিস। ইনসিওরেন্স কোম্পানীর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। কাজও ছিলো। আমাদের পুরোনো গাড়ীটার ইনসিওরেন্স রিনিউ করাতে হবে। বরাবর সে-ই করে দেয়। বললো এখন আর লাগবেনা। বিস্মিত হলাম। বললাম, “পুলিশের ছত্রিশ বাহানার এক বাহানা এই ইনসিওরেন্স পেপার। লাগবেনা মানে”? জানলাম, থার্ড পার্টি ইনসিওরেন্সের এখন আর প্রয়োজন নেই। পুলিশও আর দেখতে চাইবেনা। তার অফিসেই লাঞ্চ হলো। কথা প্রসঙ্গে তৌহিদই প্রসঙ্গটা তুললো। লালন থতমত খেয়ে বললো, “লিভ ইট। যে যাবার সে চলে গেছে। বাট কুডন্ট নো হোয়াই”?। লালনের গার্ল ফ্রেন্ড চার বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে হুট করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছে কানাডা প্রবাসী এক জনের সাথে। নিজেকে বাঁচাতে সে কথা ঘুড়িয়ে ফোকাস ফেললো আমার উপর। নাচুনে কাঠি তৌহিদ সরব হয়ে উঠলো। টিপ্পনী কেটে বললো, “উনার দীপিকা পাডুকোন ফেসিনেশন রোগ হয়েছে”। লালন হাসলো। সে হাসিতে তাচ্ছিল্য বা রঙ্গ জাতীয় কিছু বোধ হলো না। যা বুঝলাম তা হলো সবই কপালের লিখন। লালনের ওখান থেকে বের হয়ে তৌহিদ চলে গেলো তার অফিসে। আর আমি উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকলাম।

হঠাৎই মামার অফিসের কথা মনে হলো। অফিসে গিয়ে দেখলাম মামা নেই। মফস্বল গেছেন। তাই পিওনও আসেনি। ফিরে যাচ্ছিলাম। করিডোরে সেই উচ্ছ্বল প্রিয়দর্শিনী সাবরিনার সাথে দেখা। লাস্যময়ী সাবরিনা দেখামাত্রই ফোঁড়ন কাটলেন,“মামা নেই জেনেও ভাগ্নে অফিসে যে”? তাইতো। পরশু আলাপকালে মামা বলেছিলেন দু’দিন তিনি চিটাগাং থাকবেন অফিসের কাজে। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেলো। কোন মন্ত্র বলে কিসের নেশায় কিসের আশায় এলাম বুঝে উঠতে পারলাম না। “স্যরি, ভুলে গেছিলাম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই ঢু মারতেই এসেছি”। সাবরিনা চোখ ঈষৎ কুঁচকে বললেন, “তাই নাকি? এদিকে প্রায়ই আসেন নাকি? কই এতদিন তো টের পেলাম না”। আমার সেই ডায়ালগের কথা মনে পরে গেলোঃ হে ধরণী, দ্বিধা হও। পরক্ষণেই মনে হলো ধরণী দু’ভাগ হওয়ার চান্স নেই। আমিই বরং পাংচার হয়ে গেছি। সাবরিনাই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে বললেন, “আসেন। আমার রুমে আসেন। এক কাপ চা বা কফি খেয়ে যান। নাকি এখন আর রুচি নেই”? সত্যি আমার রুচি হাওয়া হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বললাম, “পানি খাবো”। সাবরিনা হাসলো,“সিওর”। সাবরিনার রুমটা ছোট কিন্তু পরিপাটি। চেয়ারের পাশে ফাইল কেবিনেটের উপর ক্যাকটাসের বনসাই। টেবিলে ছোট্ট পারিজাত ফুলের শোভা। বললেন এটা তার বাসার ছাদ বাগানের ফুল। পানি খেলাম। গুগলী ফেস করার আগেই কেটে পড়া উত্তম ভেবে উঠতে যাবো তখন ইশারা করে বসতে বললেন “এসেই যখন পড়েছেন তখন আলাপ করি। আপনার সম্মন্ধে জানি”। আমি ঢোক গিললাম। আমার স্বভাবে দু’ধরণের চরিত্রের মিশ্রণ আছে আমি জানি। মনোবিজ্ঞানীরা এদেরকে বলে এম্বিভার্ট। এরা খানিকটা ইন্ট্রোভার্ট আর খানিকটা এক্সট্রোভার্ট টাইপের হয়ে থাকে। পালাবার উপায় খুঁজছি। সাবরিনা নিরবতা ভাঙ্গলো, “কি ভাবছেন”?
— এখন উঠবো
— ভয় পাচ্ছেন?
— উহু
— পথ ভুল করে যখন এসেই পড়েছেন তখন আলাপ করি। স্যার নেই, তাই হাতে কাজও নেই।
— আমার অন্য কাজ আছে
— কি কাজ?
— জানিনা
— এই যে বললেন অন্য কাজ আছে
— বাসায় যাবো
— যাবেন তো অবশ্যই। আপনাকে কে বেধে রাখছে? তবে একসাথে লাঞ্চ করি আগে
— জ্বীনা। থ্যাংকস
— লাঞ্চ করেন না নাকি?
— করি তো
— তো এখন করলে দোষ কিসে?

আমি এক প্রকার ছেলেমানুষী করেই উঠে পড়লাম। উঠতে গিয়ে টেবিলের পায়ায় হোচট খেলাম। সাবরিনা হাসলো। বললো, “একা বাসায় যেতে পারবেন তো”? জানি মজা নিচ্ছে। এখনো ধরণী দু’ভাগ হচ্ছেনা। কোন মতে বেরিয়ে নীচে নেমে এলাম। ভাবছি এই মেয়ে এত প্রিয়দর্শিনী, এত প্রিয়ভাষিণী কেন? পেটে খিদে তবু মন ফুরফুরে। এটা কি মনোরোগের লক্ষ্মণ?

চলব…