ভালবাসার ডেডলাইন

Photo of author

By Smaranika Chowdhury

প্রতি বছরের মতো এ বছর ও ছেলেটি এক গুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে নিয়ে ছিমছাম বাড়িটার অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বটগাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছে।প্রতিবার বুকে করে নিয়ে আসে দুর্দান্ত সাহস।এবার সে বিফলে যাবে না বলে শপথ করে আসে। লাল গোলাপের গুচ্ছটি মেয়েটির হাতে দিবেই। শুধু দিবে না তার ভালবাসার কথা ও ব্যক্ত করবে মেয়েটির কাছে।কিন্তু পাড়ায় যে ছেলেটির অসম সাহসের গল্প মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় সে ছেলেটা মেয়েটাকে দেখার পর সব ভুলে বসে থাকে।মুগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভুলে যায় সময়ের কথা।প্রতিবার ভালবাসার কথা আর বলা হয়ে উঠে না।ঘন্টা খানিক পরে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি ঘরের ভিতরে ঢুকে যায়। আর কি চোখের আড়াল হওয়ার পর ছেলেটির মনে পড়ে যায় সে কি জন্য বট বৃক্ষের ছায়াতলে দীর্ঘক্ষণ যাবত তৃষ্ণার্থ হৃদয় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আজ থেকে পাঁচ বছর আগে মেয়েটি কে দেখেছিল বৈশাখী মেলায় বান্ধবীদের সাথে হৈ হুল্লোড় করে মেলায় ঘুরে ঘুরে আনন্দ করছিল এবং হাত ভর্তি চুড়ি কিনছিল।দুরন্ত ও গিয়েছিল সে মেলায় বন্ধুদের নিয়ে।নামের সাথে ছেলেটির দুর্দান্ত মিল।কাজে কর্মে প্রতিটি বিষয়ে দুরন্ত একধাপ এগিয়ে থাকে।তার সরলতার জন্য এবং মানুষের সাথে আন্তরিক ভাবে মিশার কারণে সবাই তাকে খুব পছন্দ করে।করবেই না বা কেন,গ্রামের মানুষ যে তাদের প্রতি কাজে দুরন্ত কে কাছে পায়।যে যা বলে সে তার সাগরেদদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাই সবাই দুরন্তের দুরন্তপনা হাসি মুখে মেনে নেয়। সেদিন ও মেলায় বন্ধুদের সাথে নিয়ে গিয়েছিল মেলা ঘুরতে। কিন্তু সেই মেয়েটি কে দেখে হঠাৎ করেই দুরন্ত একদম চুপসে যায়। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অরণীর দিকে।ভ্রুক্ষেপহীন অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে তো আছেই।টনক নড়ল তখনই যখন অরণী তার বান্ধবীদের নিয়ে সে স্থান ত্যাগ করল।বন্ধুরা দুরন্তের মুগ্ধ দৃষ্টি দেখে ক্ষ্যাপাতে শুরু করে দিল। দুরন্তের বন্ধু নিলয় বলতে শুরু করল সে মেয়ের দিকে তাকিয়ে লাভ নেই।অনেক বড় লোকের একমাত্র নাতনি। পাশের গ্রামে নিবাস তার।পড়ালেখায় অনেক মেধাবী। সবে বার ক্লাস পাশ করে ভার্সিটি তে পড়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। দুরন্ত এতক্ষন হরবর করে বলতে থাকা বন্ধু নিলয়ের দিকে তাকিয়ে থাকল।কারণ এ মেয়ে সম্পর্কে এত কিছু সে জানল কি করে।নিলয় ও বুজতে পারল দুরন্ত কি চিন্তা করছে।নিলয় দুরন্ত কে খুব বেশি চিন্তা করতে না দিয়ে বলে উঠল অরণী তার মামারবাড়ির গ্রামের মেয়ে। বেশ সুন্দরী এবং বড় লোকের নাতনি বলে এক নামে পরিচিত। এতক্ষনে আসল রহস্য বুজতে পারল দুরন্ত। কিভাবে মেয়েটির সম্পর্কে নিলয় এত কথা জানে।

দুরন্ত ও কম যায় না।সে ও নিলয়ের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলল জীবনে যদি কখনো বিয়ে করি এই মেয়েটি অরণীকেই করব।

তোরা দেখে নিস দু মাস পর ভ্যালাইন্টেন ডে ১৪ ই ফেব্রুয়ারিতে আমি আমার ভালবাসার কথা অরণী কে জানাবো।

বন্ধুরা সবাই হৈ রৈ করে বলে উঠল ঠিক আছে বন্ধু আমরা তোর পাশে আছি। সেদিন আর দুরন্তদের দুরন্তপনা বেশিক্ষন চলল না।মেয়েটিকে দেখার পর দুরন্ত যেন অন্য এক দুরন্ত হয়ে গেল।সবাইকে বাই বাই দিয়ে সে বাড়িমুখো হলো।

মা বাবার একমাত্র মেয়ে অরনী ছোট বেলা থেকে দাদুর কাছে মানুষ। সুন্দর হাসি খুশি একটা সুখী পরিবার ছিল অরণীর।একটা মাত্র মেয়ে বলে মা বাবার চোখের মনি ছিল।সারাক্ষণ কথা বলে বলে ঘরটিকে মাতিয়ে রাখত।কত আর বয়স হবে অরণীর।মাত্র ক্লাস ফোরে পড়া কালীন তার বাবা হঠাৎ স্ট্রোক করে মারা যায়।অরণীর জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। বাবার শোক ভুলতে ভুলতে একবছরের মধ্যে মা ও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অরণীকে একা রেখে দেহত্যাগ করে।অরণীর বাবার মৃত্যু কে ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি অরণীর মা।তাই তো ভিতরে ভিতরে অরণীর মা এর কঠিন অসুখ দানা বাঁধে।সে অসুখ থেকে আর সেরে উঠা সম্ভব হলো না।বাবাকে হারানোর এক বছরের মধ্যে অরণী তার মাকে ও হারিয়ে ফেলল।ভীষণ একা হয়ে গেল অরণী পৃথিবীর মাঝে।তার চাচা চাচী আত্মীয় স্বজন অরণীর উপর দুর্ব্যবহার করা শুরু করে দিল।অরণীর বাবার বিশাল সম্পত্তি নিজেদের নামে করে ফেলল নাবালক এই মেয়েকে ঠকিয়ে। অরণীর এই কঠিন সময়ের কথা ঘুর্নাক্ষরে ও তার মামার বাড়িতে জানাতে দেয় নি।এভাবে কষ্টে থেকে অরণী যখন একটু বড় হলো তখন একদিন কাউকে কিছু না বলে মামার বাড়ি পালিয়ে গেল। মা বাবার সাথে প্রতিবছর বছরে দু একবার মামার বাড়ি বেড়াতে যেত বলে মামার বাড়িতে পালিয়ে যেতে সমস্যা হলো না।

অকস্মাৎ সেদিন অরণীর দাদু অরনীকে একা দাদুর কাছে চলে আসতে দেখে দাদু ভীষণ ভয় পেয়ে নাতিন কে জড়িয়ে ধরল।অরণীর মুখে বিস্তারিত সব কিছু শুনে কষ্ট পাওয়ার সাথে সাথে একটু লজ্জিত হলো।কারণ গত ছয়মাস দাদু ব্যস্ত থাকার কারণে খোঁজ খবর নিতে পারেনি।তাছাড়া মেয়ে মারা যাওয়ার পর যতবার অরনীদের বাসায় গেছে সবাই এত বেশি আপ্যায়ন করেছে যে অরণীর দাদুর মাথায় ভুলে ও খারাপ চিন্তা আসেনি।তাই তো তিনি নিশ্চিন্ত ছিলেন অরণী চাচা চাচীর কাছে ভালই থাকবে।মা বাপ মরা মেয়ের উপর এত জগন্য আচরণ করবে জানলে তিনি অনেক আগেই অরণীকে নিজের কাছে নিয়ে আসতেন।সেদিনের পর থেকে অরণী আর শহরে যায়নি চাচা চাচীর কাছে।অবশ্য আত্মীয় স্বজন ও আর তার খোঁজ খবর নিতে আসেনি।

অরণী মামার বাড়িতে চলে আসার পর গ্রামের ভালো স্কুলে অরণীকে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করিয়ে দিল।মেধাবী ছিল বলে অরণী প্রতিবছর ভালো রেজাল্টের সাথে টপাটপ প্রতিটি ক্লাস ডিঙ্গাতে লাগলো।

একমাত্র মামা মামির কোন সন্তান না থাকাতে অরণী মামার বাড়িতে সবার মধ্যমনি হয়ে বড় হতে লাগলো।

এস এস সি এইস সি বেশ ভালো রেজাল্ট করে অরণী দাদুর কাছে বায়না ধরেছিল শহরে এসে পড়বে। দাদু ও আর নাতনি কে না করতে পারেনি।পারেনি সেদিন মেলায় ঘুরতে যাওয়ার আবদারে না বলতে।তা ছাড়া মেলাটি অরণীদের মামার বাড়ি থেকে মাইল তিনেক দূরে।সাথে অরণীর চার পাঁচ জন বান্ধবী ও সাথে থাকবে।তাই দাদু অরণীর কথায় সায় দিয়ে মেলায় যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিল।

অরণী ও সেদিন মেলায় দেখেছিল দুরন্তকে।অরণী থেকে দুরন্ত হয়তো বছর চারেক বড় হবে।শ্যামল রং এর অধিকারী দুরন্ত শরীরের দিক দিয়ে বেশ সুপুরুষ দেখতে। তাছাড়া দুরন্তের চোখের দিকে সবার আগে নজর পড়ে।বড় বড় চোখে এক মায়াবী সরলতা নজর কাড়তো সবার।

অরণী তাই বাড়িতে আসার পর থেকে এক মুহুর্তের জন্য ও মায়াবী মুগ্ধতায় ভরা চোখ দুটো কে ভুলতে পারছিল না।দুজনেই যেন এক মুহুর্তের দেখাতে প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু অরণী তো দুরন্ত সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল।সেদিন অত তাড়াহুড়ো করে মেলা থেকে না এসে আরও কিছুক্ষণ থাকলে হয়তো ছেলেটার সম্পর্কে কিছু জানা যেত। অবশ্য অরণী অনেক শান্ত শিষ্ট স্বভাবের মেয়ে। আদৌ কথা বলতে পারত কিনা সন্দেহ ছিল। তাই বিষয় টা মাথা থেকে ফেলে ভার্সিটি তে ভর্তি হওয়ার জন্য মন দিয়ে পড়াশোনা করতে লাগলো।

দুরন্তের পরিবার ও খুব বেশি গরীব ছিল না।বাবার মস্ত বড় দু দুখানা দোকান আছে গ্রামের বাজারে। একটা তে বড় ভাই বসে অন্যটাতে বাবা বসে। একটা কাপড় চোপড় এর দোকান অন্যটা চাল ডাল যাবতীয় জিনিসপত্র এর। দুরন্ত অবশ্য লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে ভাই আর বাবার সাথে দোকানে বসত আর সমাজ সেবা করে বেড়াত। সেদিন শুক্রবার ছিল। বিকেলে দোকান বন্ধ ছিল বলে দুরন্ত মেলায় ঘুরতে গিয়েছিল।তাইতো দুরন্ত অরণী কে মেলায় দেখতে পেয়েছিল। বাড়িতে এসে দুরন্তের অবস্থা ও অরণীর মতো। কিভাবে অরণীর সাথে দেখা করে ভাললাগার কথা বলবে সে চিন্তায় বিভোর থাকত।

দেখতে দেখতে দু মাস হয়ে গেল।অনেক চেষ্টা করে ও দুরন্ত অরণীর দেখা পেল না। বন্ধু নিলয় ও কোন সাহায্য সহযোগিতা করতে পারছিল না।

অবশেষে দুরন্ত সিদ্ধান্ত নিল সে নিজেই অরণীদের বাড়িতে যাবে অরণীকে দেখতে। তাই তো ভালবাসা দিবসের দিন কাক ডাকা ভোরে উঠে অরণীর গ্রামের মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে অবশেষে নিলয় কে সাথে নিয়ে অরণীর বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো। এতদুর মনে যে সাহস নিয়ে এসেছে বাড়ির কাছাকাছি হতে হতে দুরন্তের সব সাহস হাওয়ায় উড়ে গেল।সে আর এক পা ও এগুতে পারলো না।বাড়ির সামনে বটবৃক্ষের নীচে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।অরণী যদি বাড়ি থেকে বের হয় তখনই দুরন্ত হাতে করে নিয়ে আসা লাল গুলাপের গুচ্ছ দিয়ে তার ভালবাসার কথা জানাবে। কিন্তু সকাল গেল,দুপুর শেষ হয়ে বিকেল হয়ে গেল। একবারের জন্যও অরণীকে বের হতে দেখল না দুজনেই। ক্ষুধা তৃষ্ণায় ক্লান্তিতে আর থাকতে না পেরে সেদিন ভারাক্রান্ত মনে দুরন্ত নিজ গ্রামে ফিরে গেল।

আসলে সেদিন অরণী ঘর থেকে বের হবে কিভাবে। তাকে নিয়ে তো তখন হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানি চলছিল।

ভালবাসা দিবসের তিন চারদিন আগে অরণী শহরে মামার সাথে গিয়েছিল ভার্সিটির ভর্তি পরীক্ষায়। কিন্তু পরীক্ষার হলে অরণীর আর বসা হলো না। বাস থেকে নেমে রাস্তা পার হওয়ার সময় মারাত্মক এ্যাকসিডেন্ট হয় অরণীর।মামা যে বাস থেকে নেমে পাশের দোকান থেকে অরণীর জন্য কিছু খাওয়া কিনছিল অরণী তা বুঝতে পারেনি।কিছুটা সময় দেরি হয়ে গেছে মনে করে সে বেখেয়ালী মনে নিজেই রাস্তা পার হচ্ছিল।খুব কাছেই যে বড় গাড়ি চলে এসেছে তা খেয়াল করতে না পারায় দুর্ঘটনাটা ঘটে গেল।মামা ও প্রথমে বুঝতে পারেনি কি হয়েছে।দোকান থেকে খাবার কিনে অরণীকে পাশে দেখতে না পেয়ে এবং লোকদের রাস্তার মাঝে ভীড় দেখে অরণীর মামার বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠলো। তাড়াতাড়ি মামা ভীড় ঠেলে অরণী কে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে হাতের খাবার গুলো ফেলে দিয়ে দৌড়ে গেল।কি করবে তখন অরণীর মামা বুঝে উঠতে পারছিল না।সবার চ্যাঁচামেচি করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলাতে সম্বিত ফিরে পেয়ে মামা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য দু একজন কে সাহায্য করতে বলল।

আজ সাতদিন হলো।অরণী হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে।এর মধ্যে দু দুটো অপারেশন হয়ে গেছে।ডাক্তার রা প্রচুর চেষ্টা করছিল অরণীকে বাঁচানোর জন্য।টাকার জোরে অরণী দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসল।মোটামুটি সুস্থ হলে অরণী বাড়িতে আসল বটে কিন্তু এ্যাকসিডেন্ট অরণীর সুন্দর চোখ দুটো কেড়ে নিল।ডাক্তার রা বলে দিল অরণী আর কোনদিন দেখতে পারবে না।

সেই দুর্ঘটনার পর থেকে হাসি খুশিতে মেতে থাকা অরণী একদম চুপ হয়ে গেল।নিজের রুম থেকে একদম বের হতো না।শুধু সকালে ঘুম থেকে উঠে আস্তে আস্তে বাড়ির দরজায় এসে স্নিগ্ধ বাতাসের স্পর্শ নেওয়ার জন্য বাড়ির দোড়গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে থাকত ঘন্টা খানেকের জন্য।এরপর আবার নিজের রুমে ফিরে যেত।
সেই ভালবাসা দিবসের পর দুরন্ত অনেক চেষ্টা করেছে অরণীর খবর নেওয়ার জন্য। কিন্তু নিলয় ও আর সাহায্য করতে পারল না।কারণ সে বি এ পাশ করে বিদেশে চলে গিয়েছিল।এদিকে দুরন্ত ও দিন দিন চুপচাপ হয়ে যেতে লাগলো। কোনকিছুতে তার যেন কোন আগ্রহ নেই।যতই অরণীকে ভুলতে চাচ্ছে তত বেশি যেন অরণীর প্রতি তার ভালবাসা বাড়তে লাগলো। যদিও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি না করে বাবার সাথে ব্যবসা দেখাশোনা করে কিন্তু বড় ভাই বিয়ে করেনি বলে নিজের বিয়ের কথা ও বাবার কাছে বলতে পারছিল না।তবে প্রতি বছর দুরন্ত লাল গোলাপ হাতে নিয়ে একদম ভোরে অরণীর গ্রামে গিয়ে সেই বট বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে থাকে।এক নজর অরণীকে দেখবে এবং ভালবাসার কথা জানাবে বলে।

প্রথম ভালবাসা দিবসে দুর্ঘটনার জন্য অরণীকে না দেখলে ও পরের বছর থেকে ঠিকই দুরন্ত অরণীকে দেখতে পেত।তবে এত চুপচাপ অরণী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকত যে দুরন্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে অরণীকে দেখতে দেখতে কোন দিকে যে সময় চলে যেত বুঝতে পারত না। অরণী যেন আরও বেশি সুন্দর হয়ে যাচ্ছিল।

দুরন্ত এখন পুরোপুরি বাবার দোকান টা সামলায়।এর মধ্যে বড় ভাই ও বিয়ে করেছে।এবার পরিবারের মধ্যে কথা হচ্ছে দুরন্তের জন্য পাত্রি দেখা হোক।এই কয় বছরে দুরন্ত কিন্তু ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারেনি অরণী অন্ধ হয়ে গেছে।বরঞ্চ প্রতিবার অরণীকে দেখতে এসে ফিরে যাওয়ার সময় একটা বোবা অভিমান সাথে নিয়ে যেত।কারণ অরণী দুরন্ত কে বৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও কোনদিন সামনে এক পা ও আগালো না একটু কথা বলার জন্য। মনে মনে তাই দুরন্তের মনে অভিমান জমা হচ্ছিল।অবশ্য যদিও দুজনের ভালো লাগার কথা নিজে জানে অন্য জন জানে কিনা সেটা ও তো অজানা ছিল, তাই অভিমান রাগ করার পর দুরন্ত আবার সব ভুলে যেত।

অরণী ও একদিনের জন্য দুরন্ত কে ভুলতে পারেনি।সে তার মনের কথা কারও কাছে শেয়ার করেনি।ক্রমশ বান্ধবীদের বিয়ে হয়ে যাওয়াতে অরণী একদম একা হয়ে গিয়েছিল। অরণী আপন মনেই নিজের দুনিয়ায় চুপচাপ থাকতে ভালবাসে। অবশ্য অরণীর দাদুর সহায় সম্পত্তি সব অরণীই পাবে বলে দু চারটি বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল,অরণী জানিয়ে দেয় সে বিয়ে করে কারো অনুগ্রহের পাত্র হবে না।
অরণী তাই একাই থেকে গেল।এদিকে দুরন্তের জন্য ও পাত্রি দেখা শুরু হয়ে গেছে।সম্ভ্রান্ত পরিবার,ধনী পরিবারের ছেলে তাছাড়া ভালো ছেলে বলে খ্যাত দুরন্তের জন্য অনেক ভালো ভালো পরিবারের মেয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ের মা বাবারা বেশ তোড়জোড় করছিল।কিন্তু দুরন্তের মন পড়ে আছে অরণীর কাছে।পাঁচ বছর আগে দেখা অরণীকে সে এক মিনিটের জন্য ও ভুলতে পারেনি।এদিকে সে অরণীর কোন খবর ও কারো কাছ থেকে সংগ্রহ করতে পারেনি।তাই বিয়ের জন্য যখন মেয়ে দেখা শুরু করল তখন দুরন্ত পাশের গ্রামের অরণীর পরিবারে ঘটক পাঠাতে বলল।দুরন্তের মা বাবা ছেলের পছন্দ আছে শুনে না করল না।ঘটক ডেকে যখন অরণীর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলল তখন ঘটক অবাক হয়ে বলল আপনারা একটা অন্ধ মেয়ে ঘরে আনবেন।দুরন্ত ঘটকের কথা শুনে খুবই মর্মাহত হলো। তার ভালবাসা অরণী চোখে দেখতে পায় না।অরণী অন্ধ হয়ে গেছে শুনেও সে তাকে বিয়ে করার জন্য মা বাবাকে তার ভালবাসার কথা জানালো।কিন্তু কিছুতেই দুরন্তের মা বাবা বিয়েতে রাজি হলো না।

সারা গ্রামে মুখে মুখে সবারই এক কথা। দুরন্ত কে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।সপ্তাহ খানেক হয়ে গেল কিন্তু দুরন্ত কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল।প্রথম দিকে দুরন্তের মা বাবা তেমন কিছু মনে আনেনি।কারণ কিশোর থাকতে দুরন্ত রাগ করে বাড়ি থেকে কয়েকদিনের জন্য কোথাও চলে যেত। কিন্তু যখন সপ্তাহ হয়ে যাওয়ার পরেও দুরন্ত বাড়ি ফিরল না তখন সবাই ভয় পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করল।

যে সাহস দুরন্ত এত বছর করতে পারেনি আজ সে তাই করল।বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা সে অরণীর গ্রামে গিয়ে অরণীর দাদুর সাথে দেখা করে সোজাসুজি অরণীকে বিয়ের প্রস্তাব দিল।দাদু হেসে বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলল অরণী বিয়েতে রাজি না।সে কারো গলগ্রহ হয়ে থাকতে চায় না বলে বিয়েতে রাজি না।দুরন্ত কিন্তু এবার নাছোড়বান্দা। সে বিয়ে অরণীকেই করবে বলে দাদুর কাছে মিনতি করতে লাগল।কিন্তু দাদু কিছুতেই যখন রাজি হচ্ছে না তখন দুরন্ত দাদুকে জানিয়ে দিল যদি সে সামনের মাসে ভালবাসা দিবসের আগে অরণী কে বিয়ে করতে না পারে তবে তার জীবন আর রাখবে না।প্রতি বছর ভালবাসা দিবসের দিন যে লাল গোলাপ পড়ে থাকত বট বৃক্ষের নীচে এবার সেখানে দুরন্তের লাশ পড়ে থাকবে।দাদু দুরন্তের কথা শুনে অবাক হয়ে গেল।কারণ দাদু ও দেখেছে কোন কোন সময় অনেক তাজা গোলাপ বৃক্ষের নীচে পড়ে থাকতে। তাই দাদুর মনটা নরম হয়ে গেল দুরন্তের প্রতি।কিন্তু তবুও দাদুকে আমতা আমতা করতে দেখে এবার দুরন্ত দাদুকে বলেই ফেলল সে অরণীকে তার একটা চোখ দান করতে চায়।অরণীর দাদু দুরন্তের কথা শুনে আবেগে কেঁদে দিল।সে থেকেই দুরন্ত আর নিজ গ্রামে ফিরে না যাওয়া তে সারা গ্রামবাসী দুরন্ত কে খোঁজা শুরু করে দিল।

আজ অরণীর চোখের পট্টি খুলবে।ডাক্তার চোখের অপারেশন করেই বলেছে অপারেশন সাকসেসফুলি হয়েছে। অরণী কিন্তু কিছুই জানে না কি হচ্ছে তার।তাকে জানাতে নিষেধ করে দিয়েছে দুরন্ত। এ ঘটনা মামা মামি আর দাদু ছাড়া কেউ জানে না।তাদের উপর ও দখল কম যায়নি।দুরন্তের জেদের কাছে অবশেষে দাদু হার মেনে রাজি হয়ে গিয়েছিল।অরণীকে চোখ দান করার ব্যাপারে তিনি আর না করলেন না।যদিও দাদু একটু স্বার্থপরের মতো কাজ করেছে দুরন্তের পিতামাতাকে না জানিয়ে তবুও তিনি ভালবাসার কাছে হার মেনে রাজি হয়ে গিয়েছিল।

অপারেশন বেডে দুরন্ত আর অরণী পাশাপাশি বেডে শুয়ে আছে।অনেক দৌড়াদৌড়ি গেছে এই অপারেশন করার জন্য। প্রায় মাস খানেক হতে চলল দুরন্ত গ্রাম ছাড়া। দুরন্তের পিতা মাতা কান্না করতে করতে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে।মনে মনে নিজেদের বুজদিল ছেলের রাগ পড়লেই বাড়িতে চলে আসবে। কিন্তু বউ নিয়েই যে ঘরে ফিরবে তারা এক মুহুর্তের জন্য কল্পনা করতে পারেনি।

সে দিন ছিল ভালবাসা দিবস।যখন দুজনের চোখের পট্টি খুলছিল।দুরন্ত জানলেও অরণী জানে না তাকে কে চোখ দান করছে।এত বড় মহান ব্যাক্তি কে হতে পারে। অরণীর মনে নানা ঝড় বয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতে পারছে তাকে যে চোখ দান করেছে সে তার পাশের বেডেই শুয়ে আছে।কিন্তু অরণীকে জানানো যাবে না তার নাম আগেই সে কথা অরণীকে জানানো হয়েছে।তাই অরণী উন্মুখ হয়ে আছে তার চক্ষু দাতাকে এক নজর দেখার জন্য।

অবশেষে রুমে ডাক্তার এল।সবাই চিন্তিত। অরণী দেখতে পাবে তো।কারণ ডাক্তার ভরসা দেওয়ার সাথে সাথে এই কথাও বলেছিল দশ পার্সেন্ট ভয় আছে অরণীর চোখে না দেখার।দুরন্ত এক চোখে সব কিছু দেখছিল।অন্যচোখে পট্টি বাঁধা। তার পট্টিও খুলবে তবে দু চারদিন পরে। অবশেষে অরণীর পট্টি খোলা হলো। ডাক্তার আস্তে আস্তে চোখ খুলতে বলল।অরণীও ডাক্তার এর কথা মতো আস্তে আস্তে চোখ খোলা শুরু করল।চোখ খোলার পরে অরণীকে জিজ্ঞেস করল সে দেখতে পাচ্ছে কিনা।উৎকন্ঠিত ভাবে সবাই অরণীর দিকে তাকিয়ে আছে।কিন্তু অরণী একবার চোখ খুলেই আবার বন্ধ করে ফেলল।কারণ তার শরীরে বিন্দুমাত্র শক্তি নেই কিছু বলার।সে যে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।আসলে ডাক্তার লাস্ট পট্টি খোলার আগে সব লাইট অফ করে দিয়েছিল।যাতে চোখ খোলার সাথে সাথে অরণীর চোখে আলো টা না পড়ে।পাঁচ মিনিট পরে আলো জ্বালিয়ে ডাক্তার আবার চোখ খুলতে বলল।অরণী গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।ডাক্তার এবার হেসে দিয়ে বলল তুমি আর একবার খুলে দেখ।এবার অরণী ডাক্তার এর কথায় আস্তে আস্তে চোখ খুলেই চিৎকার দিয়ে উঠলো দাদু আমি দেখতে পাচ্ছি।

আনন্দে সবার চোখে পানি এসে গেল।অরণী এতক্ষণ সোজা হয়ে শুয়েছিল বলে দুরন্ত কে দেখতে পায়নি।তাই দেখতে পাওয়ার সাথে সাথেই বলল দাদু তাকে দেখতে চাই একবার।যে আমাকে চোখ দিয়েছে।দাদু হেসে বলল তোর বাম পাশের বেডে ফিরে দেখ চিনিস কিনা।

অরণী দাদুর কথায় বাম পাশে ফিরে দুরন্ত কে দেখার সাথে সাথে বেডের উপর উঠে বসল।দুরন্ত কে দেখে তুমি বলেই আর কিছু বলতে পারল না বেহুশ হয়ে গেল।ডাক্তার ঘাবড়াতে মানা করে দিল সবাইকে। কিছুক্ষন পরে অরণীর হুশ ফিরে আসল।দেখে তার মাথা দুরন্ত কোলে নিয়ে বসে আছে। অরণীর বেহুশ হতে দেখে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল।কখন অরণীর মাথা কোলে নিয়ে বসে আছে সে নিজে ও জানে না।অরণী চোখ খুললে দুরন্ত অরণী কে বলল জানো গত পাঁচটা বছর আমি ভালবাসা দিবসে তোমার জন্য লাল গোলাপ নিয়ে যেতাম।আমি তোমায় ভালবাসি বলার জন্য।আজ থেকে আর লাল আর লাল গোলাপ দিতে হবে না। কারণ আমার চোখ দিয়েই তোমার প্রতি আমার ভালবাসা দেখতে পাবে।অরণী মনে মনে খোদাকে ধন্যবাদ দিল। সেও যে সেদিন থেকে দুরন্ত কে ভালবেসে ফেলেছে। তাই তো সমস্ত বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিল।

এরপর ও কিন্তু দুরন্তের পিতামাতার কাছে কিছু জানাতে চাইল না দুরন্ত। মহা ধুমধামে অরণীর মামার বাড়িতে দুজনের বিয়ে সম্পন্ন হলো।এরপর একসপ্তাহ অরণীর বাড়িতে থেকে সরাসরি দুরন্ত বউকে নিয়ে নিজের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে গেল।পরিবারের সবাই দুরন্ত কে দেখে ভুলে গেল দুরন্ত বিয়ে করে সে মেয়েকেই নিয়ে এসেছে। দুরন্ত কে আর কেউ কোন কথা না বলে বাড়িতে নতুন বউ বরণ করার জন্য আনন্দ সহযোগে উৎসব শুরু করে দিল।

স্মরণিকা চৌধুরী
৩রা মার্চ, ২০২২