সন্ধ্যার পরে সাঈদ বসার ঘরে পলি, কলি এবং নাহিদ কে জরুরি ভিত্তিতে ডাকলেন।
পলি জানে এই জরুরি সভার কারণ কি! কিন্তু তার মেজাজ খারাপ সাহেদা খানম কে দেখে, তিনি কেন পারিবারিক সকল বিষয়ে থাকবেন!
পলি, এখানে বস।
– জি ভাইজান।
– এই যে, তোরা তিন জন আমার এখানে থাকিস, আলাদা বাসা নিয়ে দেখো তিন জনের খরচ কত আসে? তুই, এতো ভালবাসা দেখাতে পারিস, আর ভাই-বোনের জন্য একজন বিবাহিত পুরুষ কে বিয়ে করতে নারাজ। তোর জন্য তোর পুরো পরিবার উঠে দাঁড়াতে পারতো।
– ভাইজান, আপনি আমাকে মাফ করে দিন।
– আমি লজ্জায় মরে যাই, আমি কত বড় মুখ করে বলেছি, আমার পলি আমার কথা রাখবে, আর তুই!
সাহেদা খানম বললেন, বাবা তুমি যেরকম চিন্তা কর, সবাই সেভাবে ভাবে না।
– জি আম্মা। ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, যা তুই, তোদের বিয়ের আলাপে আমি আর নাই।
– সাঈদ, পলির গরীব ছেলে পছন্দ, তোমাদের অফিসের কেরানী সুহেল কে কি তার পছন্দ হয়?
পলি কিছু না বলে উঠে চলে গেল। যে অফিসের সবচেয়ে বড় অফিসার, তার ভাবীর বাবা। একজন সিনিয়র অফিসার তার বড় ভাই, আর সেই অফিসের কেরানীর জন্য তার বিয়ের আলাপ হচ্ছে!
সাঈদ কলিকে, বললো দেখেসিস? তোর বোনের অবস্থা।
– ভাইজান কেরানীর সাথে বিয়ে হলে, অফিসার হয়ে, কেরানীকে ভগ্নীপতি বলতে পারবেন?
– এই, যা এখান থেকে, আর কথা বলিস না। আমার মাথা ধরেছে, যা।
পলি রুমে এসে বললো, আমার বিয়ের জন্য এতো উতলা হওয়ার কি আছে? ভাইজানের চেয়ে খালাম্মা বেশি আগ্রহী।
রাতে সাহেদা খানম বিরক্তি নিয়ে বললেন, দেখবো, কোন রাজপুত্র তোমাদের নিয়ে যায়। এখনো সময় আছে, রাজী হও।
– খালাম্মা, আল্লাহ যা কপালে রেখেছেন। তাই হবে।
সাহেদা খানম মেয়ের রুমে এসে বললেন, সাঈদ, তোমার শ্বশুর তোমার লন্ডনের ট্রেনিং এর জন্য প্রস্তাব রেডি করেছেন। লন্ডন একটা ট্রেনিং করলে অনেক টাকা ও হবে, জাহান কে নিয়ে ঘুরতে ও পারবে।
– জি আম্মা।
– তুমি চিন্তা করবেনা, আরো ছয় বছর তোমার আব্বার চাকরি আছে, শুধু কাজ করবে, মন দিয়ে।
– দোয়া রাখবেন।
– আমার ছেলে সন্তান নেই, তুমি তো আমার ছেলে।
আজ আমি আসি, রাত অনেক হলো। শুধু শুধু সময় নষ্ট করলাম।
– রাগ করবেন না আম্মা।
– না বাবা। আচ্ছা চলো, গেইট খুলে দিবে।
-জি।
রাত তিন টার দিকে কলিং বেল বাজছে, পলির ঘুম ভেঙে গেল, প্রথমবারের আওয়াজে। কিন্তু সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বারান্দায় যেতেও ভয় লাগছে।
আবারও কলিং বেল বাজছে।
পলি আস্তে করে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো, শারমিন দের বাড়ীর দারোয়ান হারিস মিয়া,গেইটে দাঁড়িয়ে কলিং বেল দিচ্ছে।
পলির যেন বুক ধক করে উঠলো। কারণ শারমিন দের বাসায় টেলিফোন আছে। বাড়ীর কোন খারাপ সংবাদ আসে নি তো!
পলি এবার ভাইজানের দরজায় নক করছে। কারণ ভাইজানের রুম ভিতরের দিকে। হয়তো আওয়াজ কানে যাচ্ছেনা।
তিন বার নক করার পর, খুব বিরক্ত হয়ে শারমিন দরজা খুললেন।
– কি?
– কলিং বেল বাজছে ভাবী।
– তোমার পাগল ভাই কি রাতের ট্রেনে চলে এসেছে?
খুব বিরক্তি ভাব নিয়ে, শারমিন রুমের ভিতরে গিয়ে বললেন, তোমার ভাই বোনের কমন সেন্স এতো কম, রাত তিন টার সময় বেল দিচ্ছে।
সাঈদ বললেন, কে রে পলি?
– ভাইজান হারিস মিয়া, অনবরত বেল বাজাচ্ছে।
– হারিস মিয়া?
– জি ভাইজান, বাড়ীর কিছু হয়নি তো!
– কি হবে? চল, দেখি।
সাঈদ দরজা খুলতেই হারিস মিয়া বলছেন, দুলাভাই আফনে জলদি ছলেন, খালুজান রে নিয়া সদরে যাইতাছে। হেয় বেহুশের মতো। আফনেরা দরজা খুলেন না ক্যারে?
– কি হয়েছে আব্বার।
– ঘামতাছে, এম্বুলেন্স কইরা নিয়া গেছে, এম্বুলেন্স আইনা। আপনি আফামনিরে নিয়া জলদি চলেন।
– আচ্ছা, দাঁড়াও আমি আসছি।
সাঈদ রুমে আসার পর শারমিন বলছেন, আমি প্রেগন্যান্ট সাঈদ এরকম ঘুম ভেঙে গেল, কেমন লাগে? এরা বুঝেনা কেন?
– জাহান আব্বাকে নিয়ে সদরে গিয়েছেন, জলদি করে চলো।হারিস মিয়া আসছে।
-.কি?আমার আব্বার কি হয়েছে?
– জানি না, তুমি চলো।
পলি, কলি, নাহিদ তিন জনই বললো ভাইজান আমরা কি আসবো?
– না, থাক। আমি যাই, তোরা দোয়া করিস।
শারমিন হাউমাউ করে কাঁদছেন, আর বলছেন আমার আব্বার কি হয়েছে। আমার আব্বা বেঁচে আছেন তো!
ও আব্বা গো….
পলির কেমন বুকের ভেতর ফেটে যাচ্ছে, শুধু আল্লাহর কাছে বলছে, আল্লাহ ভাবীর বাবাকে বাঁচিয়ে দিন, এই দুনিয়া এতিম দের জন্য খুব কষ্টের।
কলি বলছে, আপারে খালুজানের কি হলো?
– জানিনা রে!
– খালুজান অত্যন্ত ভালো মানুষ।
– আল্লাহ তারে সুস্থ করুক।
আমাদের আব্বা নানাভাই কে দেখতে গিয়ে হার্ট এট্যাক করে মারা গেলেন। আল্লাহ যেন খালুকে বাঁচিয়ে দেন। চারটা মেয়ের জন্য হলেও খালুকে বাঁচিয়ে দেন।
তিন ভাই-বোন সারা রাত জেগে আছে, আর চিন্তা করছে, কি হচ্ছে খালুর। ফযরের আযানের পর, পলি বললো, নাহিদ চল, ভাবীদের বাসায় গিয়ে দেখে আসি?
– না রে আপা, থাক। এখন না, আরেক্টু ভোর হউক, বাসা একা রেখে গেলে, ভাইজান বকাবকি করবেন।
– আচ্ছা আরও আধা ঘন্টা দেখি।
সাতটার দিকে, কলি আর পলি দুই বোন শারমিন দের বাসায় গেল। বাড়ীর সামনে অনেক মানুষ, পলির মন কেমন যেন খচ করে উঠলো।
বাড়ীর ভেতরে যেতেই দেখলো, ফরিদ উদ্দীনের লাশ বসার ঘরের খাটে রাখা। পলির যেন ভেতর ফেটে কান্না আসতে লাগলো।
ভিতরে যেতেই শারমিন চিৎকার করে বললেন পলি, আমার আব্বা নাই রে! আমার আব্বা চলে গিয়েছেন।
শারমিন, আইরিন বার বার কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। পলি ভাবীর মুখে বার বার পানি দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে। তার কোলে মাথা রেখে দিয়েছে। ভাবীর মুখ টা দেখে খুব মায়া লাগছে।
পলির মনে এতো কষ্ট লাগছে ভাবীর জন্য! ছোট্ট আয়মন বার বার গিয়ে বাবার মুখ দেখছে! আর কান্নাকাটি করছে।
সাহেদা খানম শুধু বিলাপ করে বলছেন, রাতে মানুষ টা সুস্থ ছিল, দেড়টার দিকে বললো আমার শরীর ঘামছে খুব৷ আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাও, রাস্তা যাওয়ার সময় শুধু একবার বললেন, সাহেদা আমার, চার মেয়েকে দেখে রাখবে, সাঈদ কে তোমার ছেলে করে রেখে গেলাম। এই শেষ কথা, ডাক্তার যাওয়ার পরে বললেন, রাস্তায় তিনি মারা গিয়েছেন। কেন আমাকে এভাবে একা রেখে চলে গেলে জাহানের আব্বা?
ফরিদ উদ্দীনের মারা যাওয়ার দুদিন পর, সাঈদ পলিকে বাড়ী যাওয়ার ভাড়ার টাকা দিয়ে বললেন, পলি তোরা বাড়ীতে চলে যা, আমি চিঠি লিখলে, আবার আসিস। এখন আমি ওদের বাসায়, অফিসে সব দিকে দৌড়াতে হচ্ছে। আব্বার জায়গায় কে আসবে, তা নিয়ে দুঃচিন্তা আছে।
– জি ভাইজান।
– আমি চিঠি লিখলে, তবে আসিস।
পলি আর কলি ব্যাগ গুছিয়ে, বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হলো, কবে আসবে কে জানে! তবে আবার নিজের চিন্তার চেয়ে খালুজানের জন্য কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। এভাবেও মানুষ মারা যায়?
কলি ট্রেনে বসে বললো, আপা, ভাইজান কি ভাবীদের বাসায় উঠে যাবে?
– জানিনা রে! এসব চিন্তা করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।
– আমরা কি মাস খানেক পরে আসবো?
– তাও জানিনা।
পলির মন ভাবছে, ইশ আমরা কত অসহায়, কলি আর নাহিদের মন শুধু ভাবছে,আর প্রশ্ন করছে, তাদের পড়াশোনা হবে তো! ভাইজান চিঠি লিখবেন তো!
পলি আবার ও দুই ভাই বোন কে দেখছে, আর তাদের ভাবনা নিয়েও ভাবছে…..
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী
১৯.১১.২০২১