ভাবীর সংসার (পর্ব-৪১)

Photo of author

By Annama Chowdhury

কলি রুমে এসে টেবিলের উপর টিফিন রেখে, বাবুর কাছে গিয়ে বসলো। বাবু চোখ বড় বড় করে খালামনি কে দেখছে।

রাহেলা বেগম বললেন কলি কখন এসেছিস?
– এইতো মা! টিফিন দিয়ে দিয়েছেন ভাবী! খাও।
– তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছিস কেন? তোর ভাবীকে সাহায্য করতে পারতি?
– ভাবীর বোন, খালাম্মা, বুয়া সবাই আছে। আর তোমরা খাবে তাই চলে এলাম।
– মুখটা এমন করে আছিস কেন?
– কিচ্ছু না! নাহিদ কোথায়?
– পানির ট্যাংকের ছায়ায় বসে বই পড়ছে।
– ওহ। তোমাদের খাবার দেই?
– নাহিদ কে ডেকে নিয়ে আয়।

নাহিদ এক দৃষ্টিতে বই পড়ছে। কলি গিয়ে পাশে বসলো।

কলি বসতেই বললো কি রে ঘি ভাত হজম হয়নি?
– তুই খেতে আয়।
– না, আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। আগে বল, মুখ এমন হয়ে আছে কেন? কাহিনি বল আগে?
– গভর্নেসের চাকরির খবর এসেছে।
– বুঝলাম না।
– ভাবীর বাবু হবে, জিহান ছোট। তাই আমি আর মা নাকি তার বাসায় চলে যাবো। তুই আর শাহিদ নাকি মেসে চলে যাবি।
– মামার বাড়ীর মোয়া! আমার মা, বোন কোথায় থাকবে, সে ঠিক করবে। এতো খাতিরের কারণ বুঝলাম। এখন অংক মিলেছে। বাই দ্যা ওয়ে মা কি বলেছেন।
– বলিনি এখনো। তুই খেতে আয়।
– তুই খা!

নাহিদ আর কথা না বলে উঠে দাঁড়ালো, বই কলির হাতে দিয়ে বললো, বইটা রাখ, মাকে বলিস আমি টিউশনি তে গেলাম।
– খেয়ে যা।
– তুই খা।

সাঈদ সন্ধ্যার পর মিষ্টি নিয়ে হাজির হলেন, এসে বললেন মা, মিষ্টি দিতে, তোমার বউমা ভুলে গিয়েছিল।
– যা খাবার দিয়েছ, তা রয়েছে, আবার মিষ্টি কেন?
– খাও, মা। নাহিদ যায় নি কেন?
– ওর টিউশনি ছিল।
– দুপুরবেলা কিসের টিউশনি? এতো অহংকার ওর! বুঝিনা কেন? কলি কিছু বলেছে।
– হ্যা বলেছে।
– আমার বাসায় কবে যাবে?
– বাবা তুমি আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনবে। তারপর কথা বলবে।
– বলো।
– নাহিদ সারাদিন বাসা, ভার্সিটি আর টিউশনি দৌড়ায়। শাহিদ সারাদিন দোকানে। আমি ছাড়া এদের অনেক কষ্ট হবে। আমি প্রতিদিন বিকালে জিহান দাদুভাই কে নিয়ে আসবো। নতুন বাবু হওয়ার পর, আমি প্রতিদিন দুই বার যাবো। কলিও যাবে, কলেজ থেকে এসে।
– মা, নাহিদ শাহিদ কি শিশু?
– মায়ের কাছে সব সন্তান শিশু।
– কলির যেতে সমস্যা কি?
– ও আমাকে ছাড়া যেতে চায়না।
– বরের বাড়ী কি তুমি যাবে সাথে? যত্তসব ফালতু কথা বার্তা। জাহান আগেই বলেছিল, ওরা নিতে জানে দিতে জানেনা।

কথা শেষ করেই হন হন করে চলে গেল সাঈদ। রাহেলা বেগম বললেন সাঈদ শোন…

কিন্তু শোনার আগেই চলে গেল সাঈদ।

রাহেলা বেগমের মন টা খচখচ করছে, ছেলটা এমন করে রাগ রেগে গেল। কি করবেন তিনি কষ্ট হলেও এখানে থাকবেন। কারণ এই সংসার তার, ছেলের সংসার বউমার, তার নিজের না। ছেলে ভালো থাকুক তার মতো করে। অশান্তি নতুন করে সৃষ্টি করার অর্থ নেই।

এক বছর পরের কথা…..

পলি মাস্টার্স পাশ করেছে, অনেক মন খারাপের দিন গুলোর ইতি হয়েছে। আবিদ দুই রুমের বাসা নিয়েছে, ছোট্ট টিন শেডের বাসা কিন্তু সুন্দর। আজই পলিকে নিয়ে এসেছে এই বাসায়।

ঘরে আসবাবপত্র খুবই সামান্য, একটা খাট, একটা আলমারী, একটা মিটসেইফ। আর কিছু দরকারী হাঁড়ি পাতিল কিনেছে আবিদ।

পলি শাড়ি আঁচল কোমড়ে বেঁধে জিনিস পত্র ঘুছিয়ে নিচ্ছে। অবশেষে আজ সে একটা নিজের সংসার পেয়েছে, তাই শান্তি।

যদিও সে বলেনি আলাদা হয়ে আবিদের কাছে আসবে, প্রফেসর সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন যেন আবিদ তার নিজের কাছে বউ নিয়ে যায়।

আবিদ বলছে, পলি আস্তে আস্তে সব কিনতে হবে, এখন একসাথে কিনতে পারবো না।
– কোন সমস্যা নেই।
– এখন জরুরি কিছু কি আছে?
– যদি পার, দুই জানালার দুই সেট পর্দা কিনতে পার, জানালা খুলতেই বেশ লজ্জা লাগে।
– আপাতত তোমার ওড়না দিয়ে রাখ, আমি দেখি মাস খানেক পরে কিচ্ছু করতে পারি কিনা!
– আচ্ছা, কি রান্না করবো?
– ডিম এনেছি সকালে দুইটা ভাজি কর, আলু ভর্তা কর, এখন এরকম শর্টকাট করে খেয়ে নিই। রাতে বাজার করে নিব।
– হুম।

পলি চারিদিক ভালো করে দেখছে, ছোট্ট দুটি রুম। অথচ কত মায়ায় জড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে করে সাজিয়ে নিবে সে!

রাহেলা বেগম জাহিদের বিয়ের জন্য জাহিদ কে বার বার বলছেন। বয়স ত্রিশ পার হয়ে গিয়েছে। বিয়েটা করা দরকার। কিন্তু জাহিদের এক কথা আগে কলির বিয়ে হোক।

কিন্তু অনেক গুলি পাত্রপক্ষ কলিকে দেখে গিয়েছে, তবে কেন যেন দুইপক্ষের পছন্দ এক জায়গায় মিলছেনা। এই নিয়েও রাহেলা বেগম বেশ দুঃচিন্তা করেন। রনি ঢাকায় আসলে প্রায়ই তার মামাতো ভাইয়ের কথা তুলেন। কিন্তু বার বারই না করেন রাহেলা।

সাঈদের আবার আরেকটা ছেলে হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে তিহান। রাহেলা বেগম প্রতিদিন দুপুর পরে গিয়ে নাতিদের দেখে আসেন। কিন্তু কলি যেতে চায়না, ভাবীর এতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা একদম ভালো লাগেনা।

বিকাল বেলা রাহেলা বেগম বললেন, এই কলি আমি জিহান-তিহান কে দেখে আসি। তুই ঘরে থাক। আজ এক ছেলে পক্ষ দেখতে আসার কথা ছিল। আসলে রুমির( রাহেলার ফুপাতো বোন) নাহিদের ফোনে কল দিত। তাদের নাকি বিকাল পাঁচ টায় ট্রেন৷ তাহলে আজ আর আসবেনা, এখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তুই থাক, ঘরে। আমি কিছু টুকটাক সবজি কিনবো। আর আমার দুটি ঔষধ। আসার সময় ওদের দেখে আসবো।
– আর ছেলে পক্ষ দেখা লাগবেনা। আমি চাকরি করবো।
– সে দেখা যাবে। বিয়েও জীবনের অনেক বড় একটা অধ্যায়। আমি পিঠা, পাটিসাপটা, সেমাই বানয়েছিলাম। কিন্তু তাদের সাড়ে তিন টায় আসার কথা। এখন ঘড়ি ছয়টা বাজে, আসার খবর নাই।
– এগুলো কেন রান্না করে, পয়সা নষ্ট কর।
– এতো কথা বলিস না, দরজা আটকে দে।

কলি মাকে বিদায় দিয়ে ছাদে বসে আছে। ভাবছে, সে তো দেখতে সুন্দরী ধরা যায়, লম্বা, মাস্টার্স পাশ তবুও কেন এতো এতো ছেলের সামনে বসতে হবে? যে সত্যি বিয়ে করার জন্য আসবে, তার সামনে বসে, বিয়ে হয়ে যাক। আর নয়তো বিয়ে না করলে কি হয়!

বাড়ীওয়ালার মেয়েটি দৌড়ে এসে বললো, কলি আপা নাহিদ ভাই কল দিয়েছেন।
– নাহিদ?
– হ্যা।

নাহিদ কি মনে করে কল দিয়েছে, সমস্যা হয়নি তো! কলি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলো

হ্যালো।
– এই আপা মা কোথায়? নাতিদের দেখতে গিয়েছেন।
– রুমি খালা এখন কল দিয়েছেন। তিনি ছেলেপক্ষ নিয়ে এসেছেন। তারা রাস্তার মোড়ের দোকানে এসে, বাসা চিনতে পারছেন না! আজ কেন মা বের হলেন?
– ঔষধ ও কিনবেন। আর ওদের বিকেলে ট্রেন ছিল।
– যাই হউক, এখন তুই গিয়ে নিয়ে আয় ওদের। আমি ভাইজানের বাসায় কল দিচ্ছি। আমি মতিঝিল আছি, বেশিক্ষণ লাগবেনা, আসছি।
– আমি গিয়ে নিয়ে আসবো?
– বাড়ীওয়ালা চাচা ও বাসায় নাই, নয়তো চাচাকে বলতাম।
– আমি গেলে কেমন দেখা যায়, বল?
– এখন দাঁড়িয়ে আছে, তুই যা!

কলি রুমে গিয়ে নিজের জামা বদল করে বের হয়ে মোড়ের দোকানে গয়ে দেখলো। রুমি খালা সহ তিন/চারজন দাঁড়িয়ে আছেন।

রুমি খালা তাকে দেখে সরু দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি হয়তো ভালো ভাবে দেখছেন না। তবে, এখন সে কি করবে? নিশ্চয়ই মায়ের ঔষধ টা বেশি জরুরি, নয়তো যেতেন না। আর বের হচ্ছেন দেখেই হয়তো নাতিদের দেখতে যাচ্ছেন! আর এরচেয়ে বড় কথা, তাদের ট্রেন ছিল সাড়ে পাঁচটায়, এজন্য ছয়টায় বেড়িয়েছেন মা! এখন কেন হুট করে চলে আসবেন, কে জানে এটা!

কলি এক পা এক পা, এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে, বেশ লজ্জা লাগছে। কি বলবে এরা কে জানে! কলি প্রাথনা করছে মা যেন তাড়াতাড়ি চলে আসেন…

চলবে…