ভোর চার টার দিকে, ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হলো জলির। ছেলেকে পাশে নিয়ে শুয়ে আছে সে। সিজার ছাড়াই, নরমাল ডেলিভারি হয়েছে।
রাহেলা বেগম মেয়ের মাথার পাশে বসে আছেন, গাইনি ওয়ার্ডে গিজগিজ করছে মানুষ। যত সময় যাচ্ছে ততোই মানুষ বাড়ছে।
জলির চোখে-মুখে এখনো ক্লান্তির ছাপ! জলি ছেলেকে হাতে শুইয়ে রেখেছে। জলি মাকে বললো মা, আমি বাসায় কখন যাবো?
– বাবু হয়েছে মাত্র কয়েক ঘন্টা হয়েছে, এখন বাসায় যাবি কেন? ডাক্তার এসে বলবেন কি করা যায়!
– আমার এখানে একদম ভালো লাগছেনা মা! এতো গন্ধ, আর মানুষ লজ্জা লাগছে!
– কি করবি! কিচ্ছু করার নাই। তুই তবুও সিট পেয়েছিস, দেখ, কত মানুষ নিচে শুয়ে আছে।
– মা, আমার ছেলে কার মতো হয়েছে?
– আমার নানুভাই খুব সুন্দর হয়েছে। আরো সময় গেলে বুঝা যাবে, এখন প্রতিদিন কত চেহারা বদল হবে!
– হুম, মা, নাহিদ কি এখনো হাসপাতালের বাইরে?
– হ্যা। আছে বাইরে। ভিজিটিং আওয়ারের সময় আসবে। ভাগ্নে কোলে নিয়ে কি খুশি! মামা হয়েছে প্রথমবার!
জলির বেশ লজ্জা লাগছে! জলি এক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে আছে!
কলির সারারাত এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। বাড়ীওয়ালা নিজের ছোট দুটি মেয়েকে কলির পাশে থাকার জন্য দিয়েছেন। কলির বার বার মনে হচ্ছে কি যে হচ্ছে, কে জানে! ভোর হওয়ার পরে, কলি ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু নিচের দিকে দেখছে কেউ আসছে কিনা! রান্না করবে কিনা! বুঝতে পারছে না। সেও রাতে কিছুই খায়নি! রান্না ও করেনি। কিন্তু চিন্তায় খেতেও ইচ্ছে করছেনা।
বিকাল চার টার দিকে এক ব্যাবি ট্যাক্সি করে জলিকে নিয়ে বাসায় এলেন রাহেলা বেগম। জলি চার তলায় উঠতে পারছেনা। এক তলায় উঠার পরে, আর কোন ভাবেই পারছেনা। পরে বাড়ীওয়ালা তার কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ার বের করে দিলেন। নাহিদ আর কলি মিলে বোনকে উপরে তুললো।
কলি, বোনের ছেলে কে নিয়ে খুব আদর করছে। শুধু বলছে কেন চাচার নাম্বারে কল দিলেনা! বাইরে কি ফোনের দোকান নেই? সারারাত সারাদিন কত চিন্তা করেছি।
– আমার মুখস্থ নেই নাম্বার, এদিকে মা আর আপাকে রেখে বাসায় আসবো, সেই অবস্থায় ও নেই। দুলাভাইকে কল দিয়েছিলেআর?
– একবার দিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ ধরেনি!
– এখন, আমি দোকানে গিয়ে দিচ্ছি! আর আসতে সময় বাবুর জন্য জামা নিয়ে আসবো।
– মেজ ভাই জানে?
– এখন কল দিব গিয়ে।
কলি বললো, মা ভাইজান কোথায়?
– অফিসে এখন।
– কাল রাতে কতক্ষণ ছিল?
– দশটা পর্যন্ত ছিল, পরে ডাক্তার বললো অবস্থা ভালো ডেলিভারি হয়ে যাবে, এজন্য চলে গিয়েছে।
– ওহ!
– বউ একা বাসায়, আইরিন বাড়ীতে।
– আজকে সকালে একবার এসে দেখে গিয়েছে।
– মা, বিল কত আসছে!
– সরকারি হাসপাতালে আর কত আসবে! ঔষধের টাকা লেগেছে। আল্লাহ, কতবার সুবাহানআল্লাহ পড়ে পড়ে সারা রাস্তা গিয়েছি। যদি সিজার লাগতো! আল্লাহর অশেষ রহমত।
– হ্যা, ঠিকই বলেছো। কি করলেন ভাইজান এটা?
– থাক, যা হওয়ার হয়েছে। তার বিবেচনা যেমন, তেমন কাজ করেছে। তুই গরম পানি দে, গোসল করি, গা ঘিন ঘিন করছে। আল্লাহ, কেউ যেন এই নোংড়া ওয়ার্ডে কাউকে না নেয়।
সন্ধ্যার কিছু পরে বাড়ীওয়ালা একসেট জামা নিয়ে, বাচ্চাকে দেখতে এসেছেন। জলির খুব আনন্দ লাগছে নতুন জামা দেখে। গতরাতে জামা কেনার সময় ছিলনা। আর হাসাপাতাল থেকে আসতে সময়, নাহিদ বলেছে সে বের হয়ে গিয়ে নিয়ে আসবে, এখন গাড়ি থামিয়ে জামা কেনার সরকার নাই। তাই নতুন জামা পেয়ে খুব খুশি জলি।
বাড়ীওয়ালা যাওয়ার পর পরই জলি মাকে বলছে, মা আমার ছেলেকে নতুন জামা পরিয়ে দাও।
– না ধুয়ে?
– সমস্যা নাই, নাহিদ কোন রাতে আসে কে জানে!
– দশটার ভিতরে চলে আসবে, চিন্তা করিস না।
– না, পরিয়ে দাও। আমার যে কি আনন্দ লাগছে, আমার ছেলে হয়েছে।
– দোয়া কর যেন বুদ্ধি বিবেচনার ভালো মানুষ হয়, আমি রান্নাঘরে যাই, তুই একটু চোখ বন্ধ করে থাক।
দরজার কড়ার শব্দে রাহেলা বেগম দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখেন সাঈদ-শারমিন দাঁড়িয়ে আছে।
রাহেলা বেগম বেশ চমকে উঠেছেন কারণ এতো দিন
হয়েছে ঢাকায় এসেছে, একবার ও শারমিন এ বাসায় আসেন নি।
আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। আসো বউমা।
– জি।
শারমিম চারপাশ ভালো করে দেখছে! জলির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শারমিন। কেমন আছ জলি?
– ভালো আছি ভাবী৷ যাক, ভাগ্য ভালো ভাবীর সাথে দেখা হয়ে গেল। আব্বাজান কোথায়?
– ঘুমে, ফুপির কাছে রেখে এসেছি। এই সিনথেটিক জামা কে দিয়েছে?
– বাড়ীওয়ালা আংকেল।
– তুমি কিচ্ছু কিনলেনা কেন?
– আরও দেরী ছিল, বাবু হওয়ার।
– আমার জিহান কে কখনো আমি সুতি ছাড়া কিচ্ছু পরাই না। তা, তোমার জামাই কোথায়?
– খবর পায় নাই।
– এখন ফোন ছাড়া কেউ থাকে!
– জিহান বাবাকে একদিন এখানে নিয়ে এসো ভাবী।
– হ্যা, দেখি! তুমি সুস্থ হলে, একটু ঘুরে এসো।
– আমার ইচ্ছা ছিল, তোমার বাসায় উঠবো, কিন্তু..
– জিহান কি দুষ্টু! ওর পিছনেই সব সময় শেষ।
– হ্যা, তোমার তিন জন মানুষের জন্য বড় বাসা দরকার।
– কি?
– না, বলেছি জিহানের দুষ্টুমির জন্য জায়গা দরকার।
শারমিন গিয়ে ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, সাঈদ আম্মা ফ্রিজ ও কিনেছেন নাকি? নাহিদের ভালো ইবকাম তাহলে!
– হুম।
আম্মা, একটা ভালো বাসা নিতেন, এতো ছোট বাসায় এতো মানুষ থাকেন কেম্নে! ছাদের সাথে বাড়ী!
– আমাদের হয়ে যায় বউমা!
– গাদাগাদি করে?
– যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নয়জন।
এই কলি, একটু গুছিয়ে রাখবে ঘর, তোমার আর কাজ কি!
– আমাদের কি তোমার মতো বড় ঘর! যা আছে তাই আর কি সুন্দর করবো?
– ভালো দুইটা পর্দা লাগিও।
– আচ্ছা!
রাহেলা বেগম সাঈদ কে ডেকে নিয়ে গেলেন, ছাদের কোনায়, বললেন, বাবা একটু এদিকে আসো।
– কি?
– তুমি ফ্রিজ টা নিয়ে যাও। এটা, আমার দরকার নাই।
– চারতলা থেকে নামাতেই অনেক টাকা চায় মিস্ত্রিরা!
– নাহিদ-শাহিদ নামিয়ে দেবে, সমস্যা নাই।
– হুম, হাসপাতালে আর টাকা লেগেছিল।
– আল্লাহর অশেষ রহমত কারো টাকাই লাগেনি। আল্লাহ গরীবের দুঃখ বুঝেন।
– জলির জামাই পুরাই স্টুপিড, কি সুন্দর বউকে অন্যের ঘাড়ে রেখে হাওয়া।
– সে যে টাকা রেখে গিয়েছিল, তাতেই হয়ে গেছে বাবা।
– যদি লাগতো!
– যদি নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই।
– তুমি কে রেগে আছ নাকি?
– আল্লাহ কবেই আমার রাগ সব পানি করেছেন, রাগ ও নাই দুঃখ নাই, আছি আলহামদুলিল্লাহ! ফ্রিজ নিয়ে যেও বাবা। আর কিচ্ছু বলার নাই, এজন্য ডেকেছিলাম।
– বেতন পেয়ে ওকে কিছু দিব, এখন হাত খালি।
– সমস্যা নাই।
রাহেলা বেগমের গতরাতের দুঃখ এখনো যায়নি, কেমন করে টাকার কথা বলেছিল সাঈদ, তা তিনি ভুলতে পারছেন না।
রাতের বেলা নাহিদ দুই সেট জামা, আর কিছু দরকারী জিনিস পত্র নিয়ে এলো ভাগ্নার জন্য। বেতন পায়নি, কিন্তু বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে এনেছে। ভাগ্না কি খালি গায়ে থাকবে নাকি! এনেই সব একটা একটা করে, জলিকে দেখাচ্ছে।
কলি বললো এই নাহিদ বাবুর বড় মামি এসেছিলেন, বলে গিয়েছেন সিনথেটিক কাপড় না পরাতে, কিন্তু তিনি সুতি কিংবা সিনথেটিক কিছুই নিয়ে আসেন নি, এসেছেন শুধু জ্ঞান বিতরণ করতে।
– এছাড়া আর তিনি পারেন কি! দুলাভাইয়ের এই ভাই বাড়ীতে গিয়ে জানাবেন, বলেছেন।
– ফোন ধরেনা কেন এই লোক?
-সে নাকি বাইরে ছিল দুদিন।
– এজন্য ফোন ধরবেনা! অদ্ভুত মানুষ।
পরের দিন কাঁথা বালিশ, কোল বালিশ, মশারি বাচ্চার জামা, শার্ট, দুটি খেলনা, জলির জন্য একটা সুতির লাল শাড়ি, পাঁচ কেজী মিষ্টি নিয়ে হাজির জলির জামাই, সাথে তার মামাতো ভাই রবিন।
এসেই ছেলেকে কোলে নিয়ে শুধু মিটি মিটি হাসছে। কপালে বার বার চুমু দিচ্ছে।
কলি বলছে, দুলাভাই মিষ্টি খাওয়ালে হবেনা, চাইনিজ খেতে চাই।
– ইনশাআল্লাহ
জলি সাথে সাথে বলছে, তোর দুলাভাইয়ের কি সেই অবস্থা আছে! এতো মিষ্টি কেন এনেছে কে জানে।
রাহেলা বেগম হাসছেন, জলি সব সময় সহজ-সরল রয়ে গেল, শালি যে, দুলাভাইয়ের সাথে একটু মজা করছে, সেটা বুঝতে পারছেনা। তবে, জামাই সত্যি তার মেয়েকে ভালবাসে, সামান্য ইনকাম তার মধ্যে থেকে বউয়ের জন্য একটা শাড়িও নিয়ে এসেছে।
জামাই, শ্বাশুড়িকে বলছে আম্মা, আমাকে মাফ করবেন, আমি সময় মতো আসতে পারিনি।
– না বাবা, তুমি তো আর ইচ্ছে করে দেরি করনি।
– খবর পেয়ে হাওয়ার বেগে দৌড়ে এসেছি। ভাইজান কাছে ছিলেন, তাই রক্ষা হয়েছে। আল্লাহ ভাইজান কে হাজার বছর আয়ু দিন। আম্মা, আমার মামাতো ভাই, ব্যবসা করে ঢাকায়। কলিকে দেখাতে নিয়ে এসেছি। কলিকে বলার দরকার নাই। পরে, আমরা আলাপ করবো।
– আচ্ছা।
রাহেলা বেগম চিন্তা করছেন আল্লাহ জোড়া মিলিয়ে দেন, এই জলি যেমন সরল জামাই ও তেমনই সহজ সরল, মামাতো ভাই এক্কেবারে সাথে করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে বিয়ে দেওয়ার কোন চিন্তা নাই। সাঈদের প্রশংসা করছে ভালো কথা, শুধু জলি সব বলে না দিলেই হোক। সাঈদ খারাপ কাজ করেছে সত্য, তবুও বাইরে সম্মান হানি হউক এটা কখনোই চান না, রাহেলা….
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী।
১৩.০২.২০২২