শাহিদ দোকানে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। রাহেলা বেগম একটা বাটি হাতে দাঁড়িয়ে বললেন, বাবা, এখানে রুটি আর সবজি আছে খেয়ে নিস দুপুরে।
– মা, সময় হয়না। আমি একবারে সন্ধ্যায় বের হয়ে দোকানের নিচে খিচুড়ি খেয়ে নিই। আর এই খাবার ততক্ষণে নষ্ট হবে যাবে।
– এক ফাঁক করে দুপুরে খেয়ে নিবি।
– আচ্ছা দাও, দেখি।
শাহিদ বললো কলিপা, আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ বাসায় আসলে দরজা খুলবেনা। আর দরজা খুলে ছাদে বের হওয়ার দরকার নাই। যদিও ছাদে কেউ আসেনা, তবুও কিছু দিন যাক।
– ভাইরে, ভাই। আমি হলে থেকে এসেছি। যা, তুই।
– এটা ঢাকা শহর।
– আচ্ছা।
কলি দরজা লাগাতে লাগাতে বললো মা, শাহিদ মনে করে আমি ছোট্ট শিশু।
– চিন্তা করে, এজন্য বলে।
– বেশি চিন্তা করে।
তিন মিনিট পরেই দরজায় আওয়াজ হচ্ছে দেখে কলি এসে বললো কে?
– আমি!
– আমি কে?
রাহেলা বেগম বললেন দরজা খোলার দরকার নাই। আমি দেখছি।
রাহেলা বেগম বললেন কে?
– মা, আমি সাঈদ।
রাহেলা দরজা খুলেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমার সাঈদ বাবা, কত্তদিন পর, বাসা কেমনে চিনলি বাবা?
– শাহিদ উপরে তুলে দিয়ে গেল, নিচেই পেয়ে গিয়েছিলাম ওকে।
– ওহ। কেমন আছিস বাবা?
– খুব দৌড়ের উপর আছি। গত সপ্তাহে এসেছিলাম ঢাকা। আসতে পারিনি এই দিকে, ঝামেলা ছিল।
– বউমা, নাতি ভালো আছে?
– হ্যা। আমার ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে মা।
– আলহামদুলিল্লাহ।
– ঢাকায় বাসা নিব, শ্বশুর বাড়ী থাকতে ভালো লাগেনা। মায়া কানন জাহানের ফুপির বাসা।
– মায়া কানন কোন দিকে?
– এখান থেকে বেশী দূরে না। উনারা সবাই কানাডা থাকেন, পুরো বাসা ভাড়া দেওয়া, এক ফুপাতো বোন আছেন এখানে। তাই, জাহান এই বাসার এক ফ্লোর ভাড়া নিতে বলছে। বড় বাসা, ভাড়া কম নিবে। ফুপাতো বোন আছে, অফিসে গেলেওবামি চিন্তা মুক্ত।
– ভালো হয়েছে, নেও বাবা।
– হ্যা, তিন বেড রুম, ডাইনিং – ড্রয়িং ও আছে। খোলামেলা বাসা। আর আইরিন ও মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এইখান থেকে যাওয়া আসা করতে পারবে হলে।
– বুঝেছি। যাক ভালো হয়েছে। বাবা, পলির বাসায় গিয়েছিলে?
– মা, সময় কোথায়? আর তুমিও হুট করে ঢাকায় চলে এলে! এই শহরে আমি থেকে গিয়েছি, আমি জানি। কত ঝামেলার শহর, নাহিদ বাচ্চা ছেলে, ও কি বুঝে!
– তিন জন ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করবে, আমি একা বাড়ী থেকে কি করবো?
– কলি কি ভর্তি হয়েছে নাকি?
– না, শাহিদ খোঁজ করেছে, ভর্তি দেরী আছে। খিলগাঁও কলেজে ভর্তির চেষ্টা করবে।
– কি দরকার মা? আর শাহিদ কি পুরোপুরি দোকনেই চাকরি করছে?
– ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে, এখন সেকেন্ড ইয়ারে আছে, পড়ছে, চাকরি ও করছে। বাবা, বসো আমি ভাত বসাই।
– না, মা। আমার এই বাসায় বেশ কিছু কাজ আছে। আমি আগামী মাসে উঠবো, এর আগে তো আসবোই, তখন খাবো। আজ শুধু তোমাকে দেখার জন্যএলাম।
সাঈদ আরও ঘন্টা খানেক বসে চলে গেল। রাহেলা বেগম বলছেন তিন বেড রুমের বাসা, আমার ছেলে চিন্তা করেই নিচ্ছে। কারণ, নাহিদ-শাহিদ এক রুমে, আমি-তুই এক রুমে, বউমা এক রুমে।
– কি যে বলো মা।
– কি বলি?
– ভাইজান কখনোই আমাদের জন্য বাসা নিবেনা।
– চুপ কর, সব সময় বেশি বুঝিস।
আবিদ আজ ছুটিতে এসেছে। পলির কেন যেন রুমে যেতেই খুব লজ্জা লাগছে। এতো দিন যার জন্য অপেক্ষা করছে, আজ সে এসেছে কিন্তু ভীষণ লজ্জা লাগছে।
আবিদ বললো তোমার আজ কি হয়েছে?
– কি হবে?
– লজ্জায় লাল হয়ে আছ কেন?
– না, কিসের লজ্জা। আম্মা ডাকছেন, খেতে আসো।
পলি এই কথা বলেই দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এসে, খাবারের টেবিল ঠিক করছে।
প্রফেসর সাহেব বললেন বউমা আগামী মাসে মাস্টার্সে ভর্তি হবে, সব কাগজপত্র গুছিয়ে রাখবে।
– জি বাবা।
– আবিদ কোথায়?
– রুমে বাবা।
– আমার খাওয়া শেষ, এখন ঘুমাবো। সকালে দেখা হবে।
– জি।
পলি ভাবছে কি রোবটিক এই মানুষ। ছেলে এতো দিন পর আসছে। তবুও ঘুমের সময়ের দেরী হয়ে যাবে, তাই দেখা করছেন না।
পলি আবিদ কে খাওয়ার পর বললো আমাকে এইবার তোমার সাথে নিয়ে যাবে! এক কথায় শেষ।
– পাগল হয়েছ?
– হ্যা হয়েছি। আর মায়ের চিঠি পেয়েছি। তারা ঢাকায় বাসায় নিয়েছেন। যাওয়ার সময় মাকে দেখে যাবো।
– আচ্ছা, মাকে দেখতে যাবো। মাছ বাজার করা বাকি আছে। তুমি কয়েকদিন ঢাকায় থাকবে। পরে নাহিদ তোমাকে বাসায় দিয়ে যাবে।
– আমার এই বাসায় ভালো লাগেনা, বিশ্বাস কর।
– মাস্টার্স পড়বেনা?
– চট্টগ্রাম গিয়ে পড়বো।
– আমি এক রুম নিয়ে মেসে থাকি।
– আমি এই রুমেই থাকবো। কিন্তু, প্লিজ তুমি আমাকে এখানে রেখে যাবেনা।
আবিদ অনেক বোঝানোর পর, পলি রাজী হলো সে এখন তার সাথে যাবেনা, কিন্তু ঢাকা গিয়ে কয়েকদিন থাকবে।
রাতে নাহিদ-শাহিদ কে রাহেলা বেগম সব বললেন।
নাহিদ বললো মা, ভাইজান কখনোই আমাদের জন্য বাসা নিবেনা, এটা আমি শিওর। আর নিলেও আমি থাকবো না।
– আচ্ছা যা এখনো সামনে, তা নিয়ে কথা বলিস না। বড় ভাই বাপের সমান।
– বাপের সমান কিন্তু বাপ না। আমি আর জিহান কখনোই এক হবো না, আর এটা হয় ও না।
– রাত হয়েছে ঘুমা, কথা বেশি বলিস না।
কলি বললো আমিও যাবোনা। এই বললাম।
– তুই আর কথা বলিস না, ছোট ভাইয়ের সাথে ঘুমা।
তিন দিন পর পলি আর আবিদ এসে উপস্থিত হলো বাসায়, আবিদ বড় বড় দুইটা কাতল মাছ নয়ে এসেছে বাসায়।
রাহেলা বেগম বার বার বলছেন, বাবাজী কেন এই খরচ করতে গেলে বাবা? আর বাসাটা এতো ছোট্ট, কষ্ট করে থাকবে একটু।
– সমস্যা নেই আম্মা। আর আমি আজ রাতেই রওনা হবো, পলি থাকবে।
– তুমি থাকবেনা?
– জি না। আমার কাল স্কুল ধরতে হবে গিয়ে।
– আজকের রাত থাক।
– অন্য সময়। এবার আর হবেনা।
পলি আর কলি দুইবোন খুব হাসাহাসি করছে। পলি বলছে, নাহিদ কে আমার পক্ষ থেকে এক হাজার ফুলের শুভেচ্ছা এই ভালো কাজ করার জন্য।
– বাসা অনেক ছোট।
– থাক। ঠিকই আছে। আচ্ছা দেখি আবিদ মাস্টার কি করছে!
আবিদ পলিকে ছাদের এক কোনে নিয়ে বললো, পলি আমি আম্মাকে বলেছি আজ রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম যাবো।
– কেন? তুমি বলেছিলে, কাল দুপুরে যাবে।
– বাসাটা অনেক ছোট, তাছাড়া আজ গেলে, কাল সারাদিন রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যায় টিউশনি গুলিতে যেতে পারবো।
– এটা কোন কথা?
– আগামী মাসে আসবো। কিন্তু তুমি আম্মার সামনে আবার থাকার জন্য বলবেনা।
– হুম।
– মন খারাপ?
– না।
– আমি আগামী মাসে এক সপ্তাহের ছুটিতে আসবো।
– মিথ্যা আশ্বাস এক দম দিবেনা।
পলি সাথে সাথে ঘুরে ঘরের দিকে রওনা হলো, সত্যি এই বাসাটা অনেক ছোট, আবিদ থাকবে কোথায়? কত্তদিন পর সবার সাথে দেখা ভালো লাগছে, আবার আবিদ আজ চলে যাবে, এটা ভেবেই মন প্রচন্ড খারাপ লাগছে।
নাহিদ কে বাড়ীওয়ালা ডেকে বললেন বাবাজী, তোমার বড় ভাই ল্যান্ড লাইনে কল দিয়েছেন, তুমি আসো।
– জি চাচা আসছি।
আসসালামু আলাইকুম ভাইজান
– আগামী কাল, ঢাকায় আসছি, সব কিছু নিয়ে। তুই আর শাহিদ বাসায় থাকিস। ঠিক সকাল আট্টায় মায়াকানন দুই নম্বর গলির ১২ নম্বর বাসার সামনে থাকবি। আমি কাল মালামাল নিয়ে আসছি৷ আগামী এক তারিখ তোর ভাবীকে নিয়ে আসবো। মাকে নিয়ে আসিস, বাসা দেখে যাবে।
– জি ভাইজান।
– সবাই ভালো আছে।
– জি।
– রাখছি, এখন।
রাহেলা বেগম বললেন ঠিকই আমার ছেলে আমাদের সহ বাসা দেখেছে, এজন্য বলেছে আমাকে নিয়ে যেতে।
পলি বললো মা তুমি যা ভাবছো তা সত্য হবেনা। যাই হউক্, থাক সেসব আলোচনা। তোমার জামাইয়ের সামনে ভাইজান মহান আছেন, তাই থাকুন।
নাহিদ জানে, মা শুধু শুধু কষ্ট পাবেন। মা কত্ত দিন ছেলেকে আদর করতে পারেন না, সেজন্য ছেলের কাছাকাছি থাকতে এতো আকুতি, নাতিকে আদর করতে ভালবাসতে মন খুব চায়, কিন্তু দূরে থাকায় পারেন না। কিন্তু ভাইজান ভুলেও সবাইকে নিয়ে বাসায় উঠবেনা। আর সে নিজেও কখনো থাকবেনা, দেখা যাক কাল কি হয়, আপাতত দুলাভাই কে সময় দেওয়া যাক…..
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী।
৩০.০১.২০২২