ভাবীর সংসার (পর্ব-৩১)

Photo of author

By Annama Chowdhury

রাহেলা বেগম সিঁড়ি উঠে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলেন, নাহিদ মাকে ভেতরে নিয়েই, টেবিলে রাখা গ্লাসের শরবত হাতে দিয়ে দিল, এবং বললো, মা খাও।

রাহেলা বেগম, বললেন বাবা আগে একটু বসি, দম নিই। শরবত খাচ্ছি।
– সিঁড়ি উঠতে বেশি কষ্ট হয়ে গিয়েছে?
– বয়স হয়েছে বাবা, এটাই সমস্যা। সিঁড়ির জন্য না। এই কলি, সব ব্যাগ উঠেছে ঠিক মতো?
– হ্যা, মেজ ভাই আছেন, শাহিদ ও আছে সমস্যা নাই, কিরে নাহিদ শরবত আমাকে দিবি না?
– হ্যা, তোর জন্য আছে।

কলি শরবত মুখে দিয়ে বললো কি রে কি দিয়েছিস? এতো তিতা লাগছে কেন?
– তুই শুধু ভুল ধরিস। মা, তুমি বলো শরবত কি তিতা হয়েছে?

রাহেলা বেগম বলছেন, লেবু বেশি চিপলে এরকম তিতা হয়, এটা সমস্যা নাই। তুই বানিয়ে রেখেছিস, তাই ভালো।

রাহেলা বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন, আর বলছেন আমরা পাগলা, কত বড় হয়ে গিয়েছে।
– মা, বাসা তোমার পছন্দ হয়েছে।
– হয়েছে।
– ছাদের উপর দেখে, সমস্যা নাই তো?
– এ জন্যেই পছন্দ। রোদ-বৃষ্টি শরীরে লাগবে তাই শান্তি। আলো বাতাস ও আছে।
– গরম একটু বেশি হবে।
– সমস্যা নাই, ফ্যান তো আছেই।
– যাক, এখন শান্তি।
– নাহিদ, বাড়ীতে থাকতে সাঈদ কে দুই দিন কল দিলাম, অফিসের বাইরে ছিল।
– আমি কল দিব আজকে?
– তুই না, জাহিদ কে কলে দিতে বলবি। আর পলিকেও বাবা একটা কল দিস।
– পলিপার বাসার ল্যান্ড লাইনে কল যাচ্ছেনা। চিঠি লিখে দিব।
– হ্যা, তাই দে।

পলির মন টা ভীষন খারাপ হয়ে থাকে, এতো একলা লাগে সারাদিন! নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। মনে হয় খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করে মন। নতুন বিবাহিত একটা মেয়ের শ্বশুর বাড়ীতে একা মন টিকানো অনেক কষ্ট৷ এছাড়া এই বাসার সব হয় নিয়ম মতো। সকালের ম্যানু টা সেট করা, আলু ভর্তা, ভাত, ডাল। প্রতিদিন ভাত খেতে একদম রুচিতে আসেনা পলির। তার বাড়ীর কারোরই কি তার কথা মনে পড়েনা! এক বারের জন্য কেউ আসেনি! পলির মন ভীষন খারাপ হয়ে আছে। ননদ কে পড়তে দিলেও সে ও তেমন পড়তে আগ্রহ দেখায় না।

পলি রান্না ঘরে গিয়ে বললো আম্মা, আজ আমি রুটি-সবজি করি?
– বউ, মানুষ ১৩ জন, ৩৯ টা রুটি করা লাগবে। এতো সবজি এখন কাটবে কে? এরা উঠতি বয়েসী ছেলে-মেয়ে পেটে ক্ষিদা বেশি।
– খিচুড়ি করি?
– না, থাক। তোমার শ্বশুর পছন্দ করেন না। তোমার মতো আমার ও প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো এই শর্টকাট ম্যানু দেখে, এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
– জি।
– তোমার শ্বশুর বলেন সকালে, ভাত খেলে, নাকি সারাদিনের জন্য পেট ঠান্ডা, পেট ঠান্ডা মানে মাথাও শীতল বরফের মতো ঠান্ডা। তার যুক্তি ভালো, কিন্তু ঘটনা হলো সে হিসেব করে কদম ফেলে মা। এতো গুলি ছেলে-মেয়ের পড়ার খরচ, এই বাড়ীর লোন, তার ও কিচ্ছু করার নেই মা। আবিদ কি চিঠি দিয়েছে আর? ল্যান্ড লাইন টাও নষ্ট।
– না, আম্মা। গত সপ্তাহে দিয়েছিল।
– ছেলে আমার খুবই ভালো। চিন্তার কারণ নেই। যাও তুমি রুমে যাও, আমার আলু সিদ্ধ আর ভাত শেষ। এখন শুধু ভাত বসাবো।
– , আমি আলু ভর্তা করি?
– বললাম তো রান্না সারাজীবনই করতে হবে। এখন আরাম কর, কয় দিন।
– আম্মা করি।
– আচ্ছা আগামী মাসের এক তারিখ থেকে তোমার রান্না শুরু এখন, যাও।

পলির তার শ্বাশুড়ির কথায় মন সব সময় কিঞ্চিৎ হলেও ভালো হয়। কি মায়াভরা কন্ঠ। তবে প্রফেসর সাহেব দারুন হিসাবী মানুষ, দুপুরেও তিনি শর্ট ম্যানু দেন। মাছ /মাংস, সবজি, ভাত। রাতেও একই রকম থাকে। সন্ধ্যায় কোন খাবার নাই। অথচ তার মায়ের এই হতদরিদ্র সংসারে, পড়তে নসার আগে, চিড়া, মুড়ি, খৈ কিংবা বড়া করে দিতেন। পলি খাতা কলম নিয়ে বসলো, মায়ের কাছে আজ সে অনেক লম্বা চিঠি লিখবে!

সাঈদ ফোন ধরেই বললো ওয়ালাইকুম আসসালাম। জাহিদ নাকি?
– জি ভাইজান, কেমন আছেন।
– ভালো আছি। মা কেমন আছেন?
– মা ভালো আছেন। জিহান কেমন আছে?
– নতুন হাঁটা শিখেছে, খুব চঞ্চল হয়েছে। আমিও আছি দৌড়ের উপর।
– নাহিদ মাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছে।
– ছোট খালাম্মার বাসায় নাকি? আমিও আজ রাতে অফিসের কাজে ঢাকা আসছি। ভালো হয়েছে খালাম্মার বাসায় যাবো।
– ভাইজান, নাহিদ আর শাহিদ মিলে বাসা নিয়েছে উত্তর মুগদা।
– কি? বাসা নিয়েছে? এতো বড়লোক হলো কবে? তাহলে ইনকাম ভালোই হচ্ছে। মা তো একবার জানালেন না!
– আপনি অফিসে ছিলেন না। কল দিয়েছিলেন। আপনাকে বাসার লোকেশন দিচ্ছি, উত্তর মুগদা, ২ নম্বর গলির মুখে হাসি ভেরাইটিজ স্টোরের ঠিক উলটা পাশের গলির শেষ মাথায় তিন তলা বাসা। বাসার নম্বর ২৮৯/১
– মুগদা কে যাবে? আমার ট্রেনিং ফার্মগেট। গ্রীনরোড খালাম্মার বাসা। তাই ভেবেছিলাম উঠবো।
– নতুন বাসা দেখে যান।
– নাহ, তোরা এখন বড় হয়েছিস, আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করিস না! ভালো। রাখি রে। আমার ছেলে কান্নাকাটি করছে।

সাঈদ খট করে ফোন রেখে দিলেন। জাহিদের ও আর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। কি এক আজব মানুষ, সব কিছুতেই দোষ ধরেন।

জাহিদ দুটি পাটি, দুটি বেতের মোড়া, এক জোড়া বালিশ, কিছু শুকনো খাবার কিনে নিয়ে বাসায় গেল।

রাহেলা বেগম বললেন কি দরকার বাবা এতো কিছু কেনার। টেবিল নাই, পাটি বিছিয়ে তো ভাত খাবে নাকি! মা, আমি সকালে রওনা হবো, কিছু দরকার লাগলে বলো।
– কিচ্ছু লাগবেনা। সাঈদ কে কল দিয়েছিস?
– দিয়েছি। ভালো আছে। এই শাহিদ তুই পড়শু খিলগাঁও সরকারি কলেজে মাস্টার্স আছে কিনা খোঁজ নিবি।
– মেজ ভাই, আপার যে মার্ক্স তাতে খিলগাও হবে নাকি?
– খোঁজ নিয়ে দেখ। নাহিদ কোথায়?
– কয়েল আনতে নিচে গিয়েছে। মশারী কেনা হয়নি।
– ওহ।

কলি এসে বললো মেজ ভাই মেজাজ এতো চড়া কেন? ভাইজান কিছু বলেছে নাকি?
– আরে না।
– আমি জানি, ভাইজান কখনোই সুন্দর করে কিছু বলবেনা।
– বেশি বুঝার দরকার নাই। দোয়া কর যেন মাস্টার্সে এ চান্স হয় আশপাশে। নয়তো একা একা পারবি এই ঢাকা শহরে চলতে? এখানে পলি ও নাই, রিতা খালাম্মাও নাই। দুনিয়া অনেক কঠিন এখানে। এতো হেসে খেলে জীবন যাবেনা। দোয়া কর, আর বেশি করে পড়।

পলি মুখ কালো করে বসে আছে, জাহিদ কখনোই এরকম কঠিন হয়ে কথা বলেনা। জাহিদের মন খারাপ লাগছে কেন অযথা বকতে গেল! কি করবে ভাইজানের কথায় মন টা খারাপ হয়ে আছে। ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ বদলেছে সে, নয়তো কলি বুঝলে মাকে বলবে, তিনিও কষ্ট পাবেন।

পলি তিন পৃষ্টার চিঠি লিখে শেষ করেছে। শেষ লাইন লিখেছে, যদি আমাকে এসে এই সপ্তাহে কেউ বাড়ীতে না নেয়, আমি একাই রওনা হবো, এই বলে দিলাম…..

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী।
২৭.০১.২০২২