তিন বার কলিং বেল দিল পলি, কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ নেই। কলি ভাবছে, কি হলো বাসায়? কোন সমস্যা হয়নি তো?
পলি আবার কলিংবেল দিল, তখন হঠাৎ খেয়াল হলো বারান্দার গ্রিলে ভেতর থেকে তালা দেওয়া। তবে কি ভাবী বাসায় নেই?
কলি বললো কি রে আপা? আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?
– এতো অস্থির হয়ে যাস কেন?
– দশ মিনিট হবে দাঁড়িয়ে আছি। সেই সকালে এক সিদ্ধ ডিম খেয়ে বেড়িয়েছি। কত টুক এনার্জি থাকে আর?
– আহা! আমিও তো। দাঁড়া ভাবী বোধহয় ঘুমাচ্ছে।
– মারুফা?
এর মধ্যে পাশের বাসার মহিলা বললেন,
পলি শোন, ভাবী আমার কাছে চাবি দিয়ে গিয়েছেন। উনি সম্ভবত খালাম্মার বাসায় গিয়েছেন।
– ওহ। আমিও তাই ভাবছি।
– ধন্যবাদ ভাবী। চাবি টা দেওয়ার জন্য।
পলি তালা খুলে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশ রুমে যাওয়ার সময় দেখলো, ভাবীর রুমে বিশাল তালা দেওয়া। কি অদ্ভুত! পলির মন টা কেমন যেন খচ করে উঠলো। ভাবী এখনো তাদের আপন করতে পারেন নি। তাই বিশ্বাস ও হয়তো করতে পারেন না।
কলি ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরের দিক গেল, ক্ষিদায় কেমন অস্থির লাগছে কলির। ঘড়িতে দুইটার উপরে বাজে।
কলি রান্নাঘর থেকে মন খারাপ করে এসে বললো,
আপা, ভাবী কিচ্ছু রান্না করেনি। আমরা তিন জন কি খাবো এখন?
– কি?
– হুম। আমার সত্যি খুব কান্না পাচ্ছে আপা। আমি বাড়ী চলে যাবো। নুন ভাত খাবো। আমার আর সহ্য হয়না।
– আচ্ছা, আমি ভাত বসিয়ে দিচ্ছি।
– ভাত কি দিয়ে খাবি? ফ্রিজ তালা দেওয়া।
– সমস্যা নাই, আলু ভাজি করছি। পাগলা ও চলে আসবে। তুই রেস্ট নেয়, আমি দিচ্ছি।
– না, আমি আলু কেটে দিব।
– আয়, তাহলে।
কলির দুচোখ বেয়ে পানি পরছে, আচ্ছা আপা আজ যদি আব্বা বেঁচে থাকতেন, কিংবা ভালো কোন চাকরি করতেন। তাহলে কি আমরা এভাবে না খেয়ে কলেজে যেতাম? নাকি এসে এভাবে খালি পাতিল পেতাম!
– যা হয়নি, তা নিয়ে আর চিন্তা করে কি হবে? পড়াশোনা ঠিক মতো কর। যাতে নিজেই নিজের টা করতে পারিস। আচ্ছা দাঁড়া একটু ডাল বসাই।
– ডাল ভাবী নিজের রুমের খাটের নিচে রাখে। তার রুমে বিশাল বড় তালা দেওয়া।
পলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না করছে। ভাই বোন যেন এক্টু ভাত খেতে পারে, তাই, রান্না করছে পলি।
বিকালের শেষ দিকে, শারমিন বাসায় এলেন, সাঈদের বাইকে চেপে। পলির দেখেই রাগ লাগলো।
বাসায় খুব স্বাভাবিক ভাবে ঢুকে, নিজের রুমে গেল শারমিন। পলি পিছনে পিছনে গিয়ে বললো ভাবী তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
– আরে, সকালের পরে, মন টা খুব একা একা লাগছিল। তাই, আম্মার ওই খানে গিয়েছিলাম। আর পরে আমাদের দারোয়ান কে দিয়ে খবর পাঠালাম, আব্বার সাথে যেন তোমার ভাই এসে, আমাদের বাসায় দুপুর খেতে আসে।
– মারুফা?
– আম্মাকে বলেছি, বিকালে পাঠিয়ে দিতে। আমি তোমার ভাইয়ের বাইকে চলে এলাম। হাঁটতে ভালো লাগেনা।
সাঈদ বললেন কি রে? তোর মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?
– এমনি ভাইজান।
কলি পিছন থেকে এসে বললো, ভাইজান আমরা কলেজ থেকে এসে একটু ভাত ও পাইনি। ভাবী কিচ্ছু রান্না করেনি। তাছাড়া সব তালা দেওয়া, কিভাবে রান্না করবো।
সাঈদ বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, জাহান, তুমি রান্না করে গেলে না?
– আমি তো বললাম, আমার ভালো লাগছিল না, তাই আম্মার বাসায় গিয়েছি।
– ওরা কি খাবে? তাহলে?
– আমি এতো কিছু চিন্তা করতে পারিনা, আর কলি তুমি বেশি কথা কেন বলো? ফ্রিজের চাবি ফ্রিজের উপরেই রাখা ছিল, খুঁজলে অবশ্যই পেতে।
পলি বললো, কলি তুই রুমে যা। কথা বলিস কেন? ভাবী সমস্যা নাই। আমি আলু ভাজি করে খেয়েছি। তুমি রেস্ট নাও।
সাঈদ বললেন একদিন একটু কষ্ট কর তোরা, সেতো সারাক্ষণই সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একদিন খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।
– জি ভাইজান।
পলি রুমে এসে কলিকে অনেক বকাবকি করছে, কেন সে পন্ডিতি কথা বলে, কথা শোনে। ভাবী বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি তাদের থাকাটা পছন্দ করছেন না। নয়তো নিজে রান্না করে যান নি, অথচ কত সহজ ভাবে বলে দিলেন! যেন কিছুঅঅ হয়নি।
ইশ কবে শেষ হবে পড়াশোনা!
আজ শারমিনের মা, সাহিদা খানম দুই পাতিল মিষ্টি নিয়ে, বাসায় এলেন। যেহেতু আজ শুক্রবার তাই সাঈদ বাসায়। বিকালের শেষের দিকে সাহিদা খানম ছোট মেয়েকে নিয়ে এই বাসায় এসেছেন।
পলি সামনে এসে সালাম দিয়ে এসেছে। তিনি তেমন গুরুত্ব দেন নি। কারণ তিনি এদের এখানে থাকা পছন্দ করেন না।
সাহিদা খানম বসার ঘরে বসে বললেন, বাবা সাঈদ, আমি তোমার কাছে, একটা কাজে এসেছি।
– জি আম্মা, বলেন।
– আমার জাহান, হচ্ছে আমার দুনিয়া। আমার বড় মেয়ে। এখন পড়শু দিন যে, খুশির সংবাদ শুনেছি। আমার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। আমার ছোট্ট জাহানের বাবু হবে।
– আম্মা, আপনি শুধু দোয়া করবেন। আমি জাহানের কোন ত্রুটি হতে দিব না।
– না বাবা। আমি শুধু দোয়া করলে কিভাবে হবে? আমার মেয়ে, আমারই সব চিন্তা। আমি চাই বাবা, তুমি আর জাহান আমাদের বাসায় থাকো। আমি আমার মেয়েরে চোখে চোখে রাখবো।
– আম্মা, আমি এভাবে যেতে পারিনা। বাসায় আমার তিন ভাই বোন আছে। আর মানুষ কি বলবে!
– তোমার তিন ভাই বোনের সেবা করতে করতেই তো আমার মেয়েটা ক্লান্ত। আমি বাবা কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইনা। আমি আজই আমার জাহান কে বাসায় নিয়ে যাবো।
– আচ্ছা আমি দেখি।
কলি এসে বলছে এই আপা, আমাদের ঘরে বাবু আসবে। আমাদের ভাইজানের বাবু। ইশ আমি কি যে আদর করবো!
– তোকে কে বললো?
– শুনলাম, খালাম্মা বলছেন। আমি বাবু হবে শুনেই দৌড়ে এসেছি। বাকি কথা আর শুনিনি।
– কি যে শুনেছিস, আল্লাহ জানেন। বাবু হলে, ভাবী আমাদের অবশ্যই জানাতেন।
পলি গিয়ে দেখলো শারমিন তার রুমেই বসে আছেন,ছোট বোনের সাথে গল্প করছেন।
ভাবী, আমরা নাকি ফুপু হচ্ছি?
– কে বললো?
– খালাম্মা। ভাইজান কে বলছেন শুনলাম।
– হ্যা। গত পড়শু দিন টেস্ট পজেটিভ আসছে।
– অভিনন্দন ভাবী , আমরা আজ খুব খুশি। বললে না কেন?
– এমনি! আর পরে বলতাম।
– আচ্ছা ভাবী আমি আসি, দেখি খালাম্মার কিছু লাগে কিনা!
– না, থাক। আম্মা নাকি ওর সাথে কি কথা বলবে, এজন্য আমাকে যেতেও নিষেধ করেছে, যেও না।
– আচ্ছা।
পলির খুব আনন্দ লাগছে, ভাইজানের বাবু হবে। এই বংশের প্রথম সন্তান। এই নিয়ে ভাবতেই বেশ আনন্দ লাগছে।
সন্ধ্যার পরে, শারমিন শুধু তার মাকে বলেই যাচ্ছেন, না আমি সাঈদ ছাড়া একা যাবো না।
– জাহান, তুই কি এখানে থেকে একা মরবি?
– আমি কি বলেছি, এখানে থাকবো? সাঈদ সহ যাবো।
সাঈদ বার বার বলছেন, জাহান আমি বলছি তো আমি প্রতিদিন অফিস থেকে আসার সময় ঘুরে আসবো। আর এভাবে তোমাদের বাসায় থাকাটা শোভন হয়না।
– তাহলে, আমি যাচ্ছিনা।
অনেক কথার পর, সাঈদ শ্বাশুড়ি কে বললেন আম্মা, আপনি আমাকে একটা রাত ভাবতে দেন। আমি আপনাকে ভেবে জানাচ্ছি।
– তুমি বাবা নিজের বাচ্চার কথা একটু ভাববে, এই আশা আমি করতে পারি।
– জি আম্মা, অবশ্যই।
পলি আর কলির এসব শুনে মন টা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভাবীর সব যত্ন তারা করবে, পলি ভেবে রেখেছে, এখন থেকে সে রান্না করবে, বাকি কাজ রহিমা বুয়া আর মারুফা তো করেই। তবু ভাবী বাসায় থাকলে ঘর টা পরিপূর্ণ লাগবে, তারা ভাবীর যত্ন ঠিক নিতে পারবে, কেন যে খালাম্মা এমন করছেন! কে জানে।
আবার আরেক চিন্তাও মাথায় ভর করেছে,যদি ভাইজান ভাবীর সাথে সত্যি চলে যান, তবে তাদের কি হবে? তখন কি তিনি তাদের জন্য বাসা রাখবেন? তাদের খরচ কিংবা বাজার এগুলো করবেন? কি হবে তাদের, এই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে তিন ভাই-বোন,কারণ এখন তাদের কত রকম চিন্তা, তাদের এই বিশাল পৃথিবীতে দেখার মতো কেউ নেই, ভাইজানই একমাত্র ছাদ, তিনি সরে গেলে তাদের কি হবে, তারা নিজেই জানেনা…
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী
০৯.১১.২০২১