দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসা, এক রুম সামান্য বড়, আরেক রুম একদম ছোট, শুধু মাত্র একটা সিংগেল খাট, আর একটা পড়ার টেবিল জায়গা হবে কষ্ট করে।এই রুমের সাথেই ছোট্ট একটি বাথরুম। আর রান্নাঘরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রান্না করতে পারবে, কোন মতে।
তিন তলা বাড়ীটির, ছাদের সাথে এই দুটি রুম ভাড়া নিয়েছে নাহিদ। সে বাড়ীওয়ালাকে এক মাসের এডভান্স তিন হাজার টাকা দিয়ে দিল। যদিও উপরে টিনশেড এবং ছাদের সাথে রুম গুলি, গরম বেশি লাগবে, তারপর ও খারাপ না! তাদের জন্য খুব ভালো করে হয়ে যাবে, এই বাড়ীটি।
রহমত সাহেব বললেন, বাবা জি, দয়াকরে পরিবারের নাম করে, ব্যাচেলর থাকবেনা। আর, মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিয়ে দিবে। তোমার ভাই সরকারি চাকরি করে, শিক্ষক মানুষ, তাই বাড়ী টি দিলাম।
– চিন্তা করবেন না, চাচা। আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে আসবো।
– আচ্ছা। এই নাও, চাবি। নতুন তালা এনে, আমার তালা-চাবি ফেরত দিয়ে যাবে।
– জি।
নাহিদ বাড়ী থেকে এসে শুধু তিন দিন বাসা খুঁজেছে, তার বাজেটে বাসা পাওয়া এই শহরে দারুন কষ্টের। যদিও মা এখনো রাজী না। তবুও কিচ্ছু করার নাই, এভাবে একা রাখা তো যায়না।
শাহিদ, আর নাহিদ তাদের মেস থেকে সিংগেল খাট, তাদের পড়ার টেবিল, ফ্যান সব নিয়ে এসেছে।
শাহিদ কড়াই আর ভাতের পাতিল কিনে এনেছে। সেগুলো দিয়ে রান্না বসিয়েছে। ডিম ভাজি, আর ভাত। শাহিদ গুন গুন করে, গান গাইছে, আর রান্না করছে।
নাহিদ ফ্লোরের মধ্যে শুয়ে আছে, ফ্যান ছেড়ে। দারুন এক ধরনের শান্তি লাগছে। মা কাছে থাকবেন, এরচেয়ে শান্তি আর কি হতে পারে!
পলির মন খুবই খারাপ, আবিদ তিন দিন হয়েছে কর্মস্থলে চলে গিয়েছে। কেমন যে, খারাপ লাগছে বোঝানো যাবেনা। নতুন বিবাহ দম্পতি বিয়ের পর পর হঠাৎ আলাদা হলে, কলিজা কত টুকরো হয় শুধু তারাই জানে।
বিয়ের আজ আঠারো দিন, কিন্তু একবারের জন্য কেউ এই বাসায় তাকে দেখতে আসে নি। ভাইজান কেন এতো নিষ্টুর! রিতা আন্টি দুদিন ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। তিনি ও অনেক ব্যস্ত, তাই আসার হয়তো সময় হয়নি।
এতো এতো মানুষ এই বাসায়, কিন্তু কেন যেন প্রচন্ড একা লাগে পলির। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই। পলি নিজের রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এই শহরে তার কেউ নেই। প্রচন্ড কষ্টে ভেতর কুঁকড়ে যাচ্ছে।
বউমা, কি কর?
– জি আম্মা?
– মন খারাপ?
– না।
– তোমার শ্বশুর আমার চাচাতো ভাই ছিল আমার, কত দুষ্টুমি করে বড় হয়েছি। কিন্তু বিয়ের পর, যখন চলে গিয়েছিল কলেজে। হায়, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছে, হায় হায়! এই আলম ভাইয়ের জন্য আমার বুক এমন খালি খালি লাগছে কেন! আগে তো এমন খালি লাগে নাই। এর টানের নামই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। কেউ চিনেনা-জানেনা, তবুও অল্প দিনেই কেমন মায়া হয়, এটা আল্লাহ দুইজনের মনে সৃষ্টি করে দেন বউ। মন খারাপ করবেনা।
– না, আম্মা।
– বউ, আমি ও বউ ছিলাম, বুঝি সবই। যাই হউক, তোমার ছোট ননদকে পড়ানোর দায়িত্ব তুমি নাও, সে প্রচন্ড ফাঁকিবাজ।
– আম্মা, আমি আজ থেকে রান্না করি?
– না। সারাজীবনই চুলার সামনে থাকতে হবে, এখন না। আরও সময় যাক। বউ?
– জি আম্মা?
– মাস্টার্স করবা?
– জি আম্মা, ইচ্ছা আছে।
– আচ্ছা, দেখি, তোমার শ্বশুর কি বলেন।
– জি।
পলির শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে, কিছু সময়ের জন্য মন ভালো হয়েছে। তিনি মানুষ ভালো, কিন্তু এই এতোগুলি ছেলে মেয়ের দায়িত্ব করতে করতে তিনি কথা বলারই সময় খুঁজে পান না। সত্যি আবিদের জন্য তার ভেতর পুড়ছে। কি মায়ায় ফেলেছে তাকে!
মাস্টার্স পড়তে পারবে, ইশ! কি যে ভালো হবে। শ্বশুর কি রাজী হবেন? কি জানি!
জাহিদ আজ লাইব্রেরির সব কিছু নিতে এসেছে, নতুন স্কুলের পাশেই দোকান ভাড়া করেছে সে। নাহিদ ও বাড়ীতে আছে, সে ভাইকে সাহায্য করতে এসেছে। ভোর বেলা, এসে বাড়ীতে পৌছেছে দুই ভাই।
বাড়ীতে আসতে সময় এক জোড়া ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে জাহিদ।
রাহেলা বেগম বললেন, বাবা একটা মাছ জলির বাড়ীতে নিয়ে যাও। তার ইলিশ মাছ খুব পছন্দ।
– মা, আগামী সপ্তাহে আসলে নিয়ে যাবো। আজ সময় হবেনা।
– আচ্ছা। আগামী সপ্তাহে নিয়ে যেও। মা হওয়ার অনেক জ্বালা! মেয়েটা ইলিশ পছন্দ করে, রান্না হবে বাড়ীতে অথচ সে খাবেনা, ভাবতেই খারাপ লাগে। মা হয়ে কি গলা দিয়ে নামবে। আগামী সপ্তাহে নিয়ে এসো।
– অবশ্যই মা, নিয়ে যাবো। চিন্তা করবে না।
নাহিদ পুকুর পাড়ে এসে বললো, মেজ ভাই আমি একটা কাজ করে ফেলেছি।
– কি?
– বাসা ভাড়া নিয়েছি।
– কি বলিস?
– হ্যা, অনেক খুঁজে মুগদার দিকে বাসা পেয়েছি। এদিকে বাসা, কিছু সস্তা।
– বলিস কি,?
– হ্যা, আমি মা আর কলিপা কে নিতে এসেছি।
– ঢাকা শহরে একটি ফ্যামিলি চালিয়ে নেওয়া কি কষ্ট তুই জানিস?
– চেষ্টা করলে, পারবো।
– যা, ভাড়া নিয়ে নিয়েছিস যখন ভালোই করেছিস। আনিও বেতন পেয়ে টাকা নিয়ে যাবো। ডাল-ভাত খেয়ে থাকা যাবে কষ্ট করে।
– এখন তুমি, মাকে রাজী করাতে হবে।
– দেখি, আগামী সপ্তাহে আসি, দেখা যাক।
– না, আগামী সপ্তাহে না। তুমি আজই রাজী করাও, আমি দুই/ তিন দিনের মধ্যে মাকে নিয়ে ঢাকায় যাবো।
– তোর কি মাথা খারাপ? মা কি এতো সহজে রাজী হবে? আর আজ সময় একদম অল্প। আগামী সপ্তাহে আসি, সময় নিয়ে মা কে বুঝিয়ে রাজী করাতে হবে।
– আমার আগামী সপ্তাহে আসা, ঝামেলা হয়ে যাবে। তুমি আজই রাজী করাও, প্লিজ।
– আচ্ছা এক কাজ কর, বাজারে যা। এক জোড়া ইলিশ কিনবি, আর দুই কেজি মিষ্টি, কিনে জলির বাড়ী দিয়ে আসবি।
– কেন? আজ কেন? সময় কম এখন।
– শোন, মা জলিকে খাওয়াতে চেয়েছেন। তাছাড়া ঢাকা যাওয়া ঠিক ঠাক হলে, আগামী সপ্তাহে বাড়ী না এসে ঢাকা যাবো। জলির বাড়ী যাবো কেমনে! তাছাড়া এই মাছ দিলে মায়ের রাজী হওয়ার জন্য এক পয়েন্ট বেশি পাওয়া যাবে। কারণ মা খুশি হবেন।
– আচ্ছা আমি যাচ্ছি।
কলি পুকুর পাড়ে চাল ধুইতে এসেছে। কলি বললো মেজ ভাই এখানে কি করছো?
– না, কিছু না। ট্রাক রেডি, খেয়ে রওনা হবো।
– মাকে রাজী করিয়ে আমাকে হলে দিয়ে দাও, পড়াশোনা টা শেষ করি।
– দেখা যাক, কি করি।
– দেখো, আর রাজী করাও প্লিজ।
,- হুম।
জাহিদ পুকুর পাড় থেকে দেখছে মা মনোযোগ দিয়ে মাছ কাটছেন। কলির গ্রাম একদম ভালো লাগেনা, এবং পড়াশোনার তীব্র ইচ্ছা, তাই সে চলে যেতে চায়। জাহিদ ভাবছে নাহিদ কত বড় হয়েছে, সাহস করে অনেক বড় কাজ করে ফেলেছে। ভালো করেছে, মা, ঢাকায় গেলে কলির ও পড়াশোনা হবে, নাহিদ-শাহিদ ও মায়ের সাথে থাকবে, তার ও চিন্তা কম হবে।
কিন্তু মাকে রাজী করানো, সহজ বিষয় নয়, তিনি অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ! স্বামীর ভিটা ছেড়ে, ইট পাথরের শহরে যেতে সহজে রাজী হওয়ার পাত্রী তিনি নন। কিন্তু, কিভাবে কথা শুরু করলে, তিনি রাজী হবেন, তাই নিয়ে এখন ভাবছে জাহিদ…..
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী।
২১.০১.২০২২