রাহেলা খানম ব্যাংক থেকে, পলির বিয়ের টাকা তুলে, এখন জাহিদ কে নিয়ে স্বর্ণের দোকানে বসে আছেন। এই দোকান হরিধন বাবুর, হরিধন বাবু রাহেলা খানমের অনেক দিনের পরিচিত। হরিধন বাবু ভিতরে কাজ করছেন, তার জন্য অপেক্ষা করছেন।
হরিধন বাবু এসে বললেন, দিদি অনেক দিন পর আমার দোকানে এলেন।
– যা স্বর্ণ ছিল, তা বিক্রি করা শেষ, তাই আসা লাগেনা।
– স্বর্নের চেয়ে দামী, ছেলেরা পেয়েছেন। আর কি লাগে।
– জি, এটা সত্য। মেজ মেয়ের বিয়ে আগামী সপ্তাহে, স্বর্ণ লাগবে।
– বাহ, খুব খুশির সংবাদ।
– ভরি কত করে?
– এখন ভরি ছয় হাজার টাকা।
– কি বলেন দাদা? এতো বেড়ে গিয়েছে?
– জি। হু হু করে বাড়ছে।
– আচ্ছা, একটা নেকলেস, এক জোড়া ঝুমকা, আর একজোড়া বালা দেখান। আর কমান দাদা টাকা।
– দিদি, এই সব নিলে পাঁচ ভরির কম হবেনা, টাকা দেখবো পরে।
– আচ্ছা, দেখান।
রাহেলা খানম মেয়ের জন্য ছয় ভরি স্বর্ণ কিনলেন। জামাইকে দেওয়ার জন্য একটা চেইন। সব মিলিয়ে পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকা গেল। রাহেলা খানম জাহিদ কে বললেন বাবা, খরচ কি বেশি করে ফেলেছি?
– মা, তোমার টাকা তুমি যেভাবে ইচ্ছে খরচ কর। আর পলির শ্বশুড় যেহেতু কিছু নিতে চাইছেন না, তাহলে স্বর্ণ দেওয়াই ভালো। বিপদে কাজে দিবে।
– তাই বাবা। আমি জানি, এই জিনিস আমার কত বিপদে বাঁচিয়ে রেখেছে।
বাকি টাকা নিয়ে, বিয়ের মাত্র তিন দিন আগে রাহেলা ছেলের বাসায় গেলেন। যথারীতি শারমিনের রুম তালা দেওয়া। এক রুমে সবাই বসে আছে। সাঈদ চাবি দিয়ে অফিসে চলে গিয়েছে।
কলি বললো মা, ভাবী কি বিয়ের আগে এই বাসায় আসবেনা?
– বাচ্চা ছোট, কেমনে আসবে।
– মা, অযুহাত দিও না।
– যার বাসা সে না আসলে, কিচ্ছু করার নেই। আচ্ছা শোন, তুই পলির জন্য ভালো দেখে চারটি শাড়ি কিনে দিবি, এক জোড়া ঘরে পড়ার স্যান্ডেল, ওর শ্বাশুড়ির জন্য একটা শাড়ি আর টুকটাক যা লাগে কিনে নিয়ে আয়, আমি টাকা দিচ্ছি।
– মা, আমি কোন কিছু কিনবো না?
– কমিনিউটি সেন্টার আর খাওয়ায় চলে যাচ্ছে চল্লিশ হাজার টাকা। জামাইয়ের কাপড়, ওয়ালিমায় যাওয়ার খরচ নাই? কাপড় কিনবি!
পলি বললো মা, আমার চারটা শাড়ি লাগবেনা একটা নতুন হলে হবে, জলিপা কলি আর ভাবীকে কিনে দাও। আর তিন ভাইকে তিন টা শার্ট। আমার আর কিছু কেনা লাগবেনা।
– তুই চুপ থাক।
জাহিদ বললো এই, পলি আছি রে, এখনো ভাই জীবিত, এতো চিন্তা করিস না। কলি তুই ওকে নিয়ে রেডি হ, আমি তোদের শপিং করে দিচ্ছি। মা, তুমি সাবধানে থাকো। এই টাকা তোমার কাছে রাখো। বাজার সদাই করতে হবে, কাল মেহমান আসবে।
– না, বাবা। তুই খরচ করিস না, বিয়েতে কত খরচ, পরে টাকা লাগবে।
– মা, তুমি চিন্তা করবেনা, শান্ত হয়ে থাকো।
জাহিদের কেন জানি, মন টা আজ খুব খারাপ লাগছে৷ পলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, কেমন যেন ছায়াহীন লাগছে। পলি খুব সুন্দর করে সব কিছু বুঝতে পারতো। বিয়ে হয়ে গেল, বোন গুলি কত দূরে চলে যায়। বিয়ের আগে, যা ইচ্ছে মন ভরে শপিং করুক। কত আত কিনবে, শখ মিটিয়ে যাক। তাই বোন কে নিয়ে শপিং যাচ্ছে জাহিদ।
শারমিনের জন্য একটা মেরুন রঙের কাতান পছন্দ করেছে পলি। চিকন সুতার কাজ করা, চমৎকার শাড়ি। আর কলি আর জলির জন্য কেন্স হয়েছে আকাশী রঙের মিরপুরী কাতান শাড়ি। নিজের জন্য সুতির দুটি শাড়ি কিনেছে পলি। কিন্তু জাহিদের পলির দুটি শাড়ি পছন্দ হয়নি, তাই সে জলি আর কলির মতো একই রকম আরেক টা শাড়ি কিনে দিল। সবচেয়ে দামী শাড়িটা কেনা হলো, শারমিনের জন্য। জাহিদ, চার ভাইয়ের জন্য শার্ট, মায়ের জন্য একটা শাড়ি কিনে নিল। আর ছোট্ট জিহানের জন্য পাঞ্জাবি সেট। পলিকে বার বার বলছে যা ইচ্ছা কিনে নে, কোন সমস্যা নেই।
কলি রাস্তায় এসে বললো, মেজ ভাই তুমি ভাবীর বাপের বাড়ী গিয়ে এসব দিয়ে এসো, আমি ওদের বাসায় যাবো না। আর আপার কাল পরে পড়শু বিয়ে আপা, ও যাবেনা।
– তুই চল, কলি। তুই ছাড়া আমি একা কেমনে যাবো?
– জানিনা। আমি যাবো না।
জাহিদ শেষ পর্যন্ত একাই গেল। কলিং বেল দিতেই আইরিন বের হয়ে এলো, খুব বিরক্ত হয়ে বললেন আপনারা চলে এসেছেন?
– হ্যা৷ আজ সকালে এসেছি।
– বসেন।
– ভাবী কোথায়?
– এই বড়পা, এদিকে আয় একটু….
জাহিদ বসার ঘরে বেশ কিছুক্ষণ বসার পরে, শারমিন এসে বসলেন। কি ব্যাপার জাহিদ, কেমন আছ?
– ভালো আছি ভাবী। আপনি?
– আছি। ভালোই আছি।
– বাসায় যাবেন কবে?
-সত্যি কথা, জিহান বেশি মানুষ দেখলেই ঝামেলা করে। এজন্য বিয়ের আগেরব্দিন রাতেই দেখি যাবো।
– ওহ।
– আপনার জন্য পলি এই শাড়ি পছন্দ করে কিনেছে।
– আমি কি কাতান শাড়ি এই বাচ্চা নিয়ে পরতে পারবো? আর শাড়ি আমার অনেক আছে। আম্মা তো অনেক টাকা পেলেন, মেয়ের জন্য ঠিকই স্বর্ণ কিনেছেন। আর আমার জন্য শাড়ি। একটা আনার স্বর্ণ তো কেউ গিফট দিল না!
– একটু সময় পরে নিয়েন, খুশি হবে সবাই।
– ভাইরে, আমি বাচ্চা সামাল দিব? নাকি শাড়ী? আর, জাহিদ সেন্টারে যখন অনুষ্ঠান জলিকে সেন্টারে আসতেই বলতে।
– ইয়ে, ভাবী। ও আর বড় মামী আম্মা শুধু আগের দিন আসবে, আর কেউ না।
– তাহলে একটা বাসা ভাড়া নিতে? এতো মানুষ যখন আসবে।
– জি ভাবী, ঠিকই বলেছেন। আচ্ছা ভাবী আমি আসি। কিছু দরকারী কাজ আছে।
– হুম। যাও, চা খেয়ে যাও।
– না, না। এখন না।
জাহিদের একদম মেজাজ ধরে গিয়েছে শারমিনের কথা শুনে। অথচ তার মায়ের শেষ সম্বল এক জোড়া বালা, তিনি তার বড় ছেলের বউকে দিয়েছিলেন। ভাইজান দশ ভরি স্বর্ণ নতুন বানিয়ে দিয়েছেন। মায়ের জায়গা বিক্রির পঞ্চাশ হাজার টাকাও ভাইজান কে দেওয়া হলো তবুও ভাবী কত রকম কথা বলছেন। মুখ যখন আছে, বলতে হবে, এজন্য হয়তো বলছেন।
পাশের বাসার তিন জন মহিলা রাহেলা খানম কে সালাম দিয়ে বসার ঘরে ঢুকে বলছেন, খালাম্মা আমরা আপনাদের পাশেই থাকি। বিয়ে শুনলাম তাই দেখতে এলাম।
– খুবই ভালো হয়েছে এসেছো, বসো। আমি মা, গ্রামে থাকি, তাই তোমাদের সাথে পরিচয় নাই।
,- এই বাসা তালা দেওয়াই থাকে, হঠাৎ ভাই এসে পরিষ্কার করে চলে যান। আমরাও আপনাকে আজ প্রথম দেখলাম।
– হ্যা, ছেলের চাকরি দূরে। এজন্য বউমা বাবার বাড়ী থাকেন।
– জি। খালাম্মা, আমাদের সবার ঘরে রুম খালি আছে, মেহমান আসলে পাঠিয়ে দিবেন। একদম আপন মনে করে। আর কিছু লাগলে ডাকবেন।
– আচ্ছা মা, ডাকবো।
– ভাবী কি রান্নাঘরে? ননদের বিয়ে তো, তাই ব্যস্ত বোধহয়। ননদের বিয়েতে সব দায়িত্ব ভাবীর।
– হ্যা, হ্যা। বউমা একটু বাইরে গিয়েছে, কাজে।
– আর হলুদ করতে চাইলে উঠানে করবেন, আমরা সাহায্য করবো সমস্যা নাই।
– অনেক ধন্যবাদ মা, সবাই বিয়েতে আসবে। রাগ করবেনা আবার, এখন দাওয়াত দিচ্ছি বলে, আজই এসেছি বাড়ী থেকে।
– আমরা আছি, আপনি চিন্তা করবেন না। এখন আসি।
কলি সবাই চলে যাওয়ার পর বলছে, দেখেছো পাশের ঘরের মানুষ সাহায্য করতে আসছে। আর আমাদের একমাত্র ভাবীর খবর নাই, আবার রুমেও তালা দিয়ে রেখেছে।
– থাক, শুভ সময়ে অযথা কথা বলার দরকার নাই।
– তোমার নীরবতাই সকল সমস্যা।
– আর, কথা বলিস না তো! যা। কাজে যা!
রাহেলা খানমের নিজেরই কেমন পর পর লাগছে। কিন্তু কি করবেন, কিচ্ছু করার তো নাই।
বিয়ের আগের দিন সকালে জলি তার জামাই, দুই ননদ নিয়ে এসেছে। সাথে বড় মামী, ও তার বড় মেয়ে।
রাহেলা খানমের জলির এই কম বুদ্ধির জন্য সবসময় ভোগেন। কত বার বলেছেন, এই খানে জায়গা কম, তবুও ঠিকই ননদ নিয়ে এসেছে। এরমধ্যে আবার দুইজন। তাদের নিশ্চয়ই জোড় করে নিয়ে এসেছে সে। এখনো শারমিন আসেনি, রুম তালা দেওয়া। কি করবেন তিনি বুঝতে পারছেন না।
নাহিদ-শাহিদ মরিচ বাতি আর গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানোর জন্য ফুল আর কাগজ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।
সবাই গোল হয়ে বসে কাগজ কাটছে, গাদা ফুলের লম্বা লাইন করছে, স্টেজ সাজানোর জন্য। বেশ উৎসব উৎসব লাগছে। জামাইয়ের বাড়ীর কাপড় এসে এখনো পৌছায় নি। এর জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।
পলির খুব আনন্দে লাগছে, তার বিয়েতে মরিচ বাতি জ্বলবে, কিংবা কেউ এতো আগ্রহ নিয়ে কাগজ কেটে স্টেজ করবে, কখনো চিন্তা ও করেনি সে। আগামী কালকের শুভ সূচনা কি শুভ হবে, তাই নিয়ে ভাবছে পলি। সবার মায়াকে ছেড়ে যাবে কেমনে! তা ভাবলেই বুকে ছ্যাৎ করে উঠে তার।
রাহেলা খানম সব দেখছেন, কিন্তু ভাবছেন এতো মানুষের থাকার ব্যবস্থা কেমনে হবে? কেমনে আদর করে দিবেন অতিথিদের। কতশত চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়….
চলবে…
আন্নামা চৌধুরী।
০৫.০১.২০২২