ভাবীর সংসার (পর্ব-১৭)

Photo of author

By Annama Chowdhury

আজ শুক্রবার, পলি সকালে উঠেই এক টাকার শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক দিয়ে ভালো করে চুল শ্যাম্পু করেছে। এখন হলের বারান্দায় বসে চুল শুকাচ্ছে। পলির কোমর পর্যন্ত চুল, ঘন চুল শুকাতে অনেক বেশি সময় লাগে। তাই বারান্দায় বসেছে পলি।

কলি বারান্দায় এসে বললো আপা, তোর গোসল শেষ? তুই তো এতো সকাল গোসলের মানুষ না!
– না, চুল গুলি শুকানোর জন্য।
– তুই চিন্তা করিস না, আপা। দুলাভাই তোকে পছন্দ করবে।
– আমি এমনি শ্যাম্পু করেছি!
– বুঝি সবই।
– বেশি বুঝিস একটু।
– আচ্ছা, শোন ব্যাগে কি এক সেট জামা নিব?
– দুই সেট নে, রাতে ঘুমাতে হবে তো!

রুপা আর হেমা এসে বললো আরে আজ দুই বোন এতো খুশি, খুশি। কোথায় যাচ্ছ?
– আমি আর কলি আমাদের আন্টির বাসায় যাচ্ছি, আজ রাতে ওদের বাসায় থাকবো।

– বাহ, তোমাদের আত্নীয়ের বাসা আছে, আমাদের এইখানে কেউ নেই।

কলি বললো একদিন তোমাদের নিয়ে যাবো। আজ একটা অনুষ্ঠান আছে, তাই আজ বলছিনা।
– না না আজ না, অন্য একদিন যাবো।
– আচ্ছা।

পলি রুমে এসে তার একমাত্র শাড়ি খানা ব্যাগে ভরে নিল, সাথে তার এক ডজন কাঁচের চুড়ি। চুড়ি আস্তে করে ব্যাগে নিল, কলির সামনে কেমন লজ্জা লাগছে, এই মেয়েকে বিশ্বাস নেই, হুট করে বলবে কি রে আপা! এতো সাজগোজ বিষয় কি!

দুই বোন দুপুরে তাড়াতাড়ি খেয়ে ভাবীর বাসায় যাওয়ার জন্য সাড়ে তিন টার দিকে রওনা হয়ে গেল।

পলি রিকশায় উঠে বললেন এই হেমা-রুপাকে যে বললি ওদের নিয়ে যাবি, কি মনে করে বলবি?
– এমনি বলেছি। কি ভাববে যদি না বলি।
– আমাদেরই পছন্দ করেনা ভাবী, আর আমাদের রুম মেইট।
– আরে, মানুষকে কি বুঝানোর দরকার আছে নাকি? তারা এটাই জানুক আমাদের ভাবীর পরিবার খুব ভালো।

পলি হাসছে মিটিমিটি, কলির দিকে তাকিয়ে, যাক মেয়েটার বুদ্ধি ভালো হয়েছে।

জাহিদ ভাবীর বাসায় এসেছে তাদের যাওয়ার কিছুক্ষণ অর। জাহিদ নুডুলস, ডিম, সবজি, দুধ, সেমাই, বিস্কুট, সিংগাড়া, চা-পাতা, চিনি, দুধ, পাপড়, চানাচুর, ফল সব নিয়ে এসেছে যাতে তারা কোন কথা না বলে। রহিমা বুয়াকে সামান্য বখশিশ দিয়েছে জাহিদ, যাতে এই জিনিস গুলো বানিয়ে দেয়।

শারমিন বললেন, তাদের নিয়ে আসরের নামাযের পর তোমাদের ভাই আসবে। এর ভিতরে নাশতা কি কি এনেছো বুয়াকে বুঝিয়ে দাও। আমি আছি রুমে, কিছু লাগলে বলবে।

রিতা খালাও কিছুক্ষণ আগে এসেছেন, কিন্তু তিনি জানেন না যে, আজ পলিকে দেখতে আসবে। এসে শুনে তিনি বলছেন, আমি মেয়েটাকে সাজিয়ে দিব, কেমন মায়াবী মুখ। বরপক্ষ পছন্দ না করে যাবে কই!

তিনি শারমিন কে বললেন এই জাহান পারলে তোর কিছু মেকাপ দে, মেয়েটাকে সাজিয়ে দেই।
– না, না খালা, দরকার নাই। শ্যামলা মেয়ে, তাই দেখে বিয়ে হোক। পরে তুমি মেকাপ করে ফর্সা করবে, বিয়ের পর শ্যামলা দেখে ঝামেলা করবে।
– কি যে বলিস তুই!
– ঠিক খালা, ওরা সাজতে পারে, তোমার চিন্তার কিছু নেই।

রহিমা বুয়া জাহিদ কে বললো ভাই হুনেন, বখশিশ না দিলেও আমি ফলি আফার জইন্য রান্না করতাম। হের মন কত্ত ভালা, আল্লাহ হের জন্য ভালো ফাত্র অবশ্যই রাখছেন।
– দোয়া করবে।
– হ তাতো করি।

আসরের নামায শেষ হওয়ার আগেই রহিমা বুয়া সব নাশতা দিয়ে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে। আসলেই খেতে পারবে, শুধু চা পরে বসাবে।

সাহেদা খানম পলিকে বার-বার বলছেন পলি তোমার ভাগ্য ভালো। দেইখো আবার, কোন ঝামেলা সৃষ্টি করবেনা কিন্তু। চুপ্ন করে রাজি হবে।

আসরের নামাযের পর, সাঈদ খুব মন খারাপ করে বাসায় এলেন, এসেই জাহিদ কে বললেন,

পাত্রপক্ষ আজ আসবেনা, তুই বাড়ী চলে যা।
– কেন? কি হয়েছে?
– তারা নাকি মাস্টার পাশ মেয়ে কিংবা চাকরিজীবি মেয়ে ছাড়া ছেলের বিয়ে দিবেনা। ছেলের এ নিয়ে সমস্যা নেই। কিন্তু ছেলের মায়ের আছে। এজন্য, শুধু এসে সময় নষ্ট করতে চায়না। আমার জুনিয়র অফিসার আমিও আর রিকুয়েষ্ট করিনি।
– ওহ!
– তোকে বেশ কষ্ট দিয়ে দিলাম, ওরা কি এসেছে।
– হ্যা
– শোন, আমি প্রতিমাসে দুইশো করে টাকা দিব, তোর ভাবীর কাছে। তোর টাকা পাঠালে, এক সাথে নিয়ে যাবে। আর এখন ওদের বলার দরকার নাই। টাকা পাওয়ার পর, তখন বলিস।
– আজ কি আমি বাড়ী চলে যাবো?
– হ্যা, তাই ভালো।

আইরিন, আয়মন, তারিন তিন জন টেবিলের নাশতা মজা করে খাচ্ছে। শারমিন ও টুকটাক খাচ্ছে, কিন্তু পলির মন এতো খারাপ হয়েছে, তার খেতে ইচ্ছে করছেনা! পলির জন্য কলির ও মন খারাপ, তার বোন কত্ত স্বপ্ন আশা নিয়ে দেখেছিল, সব এক কথায় শেষ!

জাহিদ মাগরিবের নামায পড়ে বোনেদের সাথে কথা বলে বেরিয়ে গেল। পলি মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছে। শুধু চিন্তা করছে, কেন এমন হয় তাদের সাথে!

কলি দৌড়ে এসে বললো আপা, খালাম্মা জিজ্ঞেস করছে আমরা হলে কখন যাবো? রিকশার জন্য কাউকে পাঠাবেন কিনা!
– এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আমরা দুজন কেমনে হলে যাবো!
– আমরা এখানে থাকি, উনি পছন্দ করছেন না।
– ভাইজান কি বলেন?
-ভাইজান নাকি বাইরে চলে গিয়েছেন কাজে।
– এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে দুইজন মেয়ে কিভাবে যাবো? আর হলে কি এখন ঢুকতে দিবে? আর দিলেও হেমা-রুপাকে কি বড় মুখ করে বলেছি খালার বাসায় থাকবো। এখন?
– জানিনা রে!

সাহেদা ডাকতে ডাকতে এসে বললেন রিতা চলে যাচ্ছে, ওর গাড়ী আসছে, তোমরাও ওর সাথে চলে যাও। তাহলে ঝামেলা নেই। ওকে বলেছি, ও নামিয়ে দিবে।
– জি খালাম্মা!

দুই বোন জিহান কে আদর করে, রিতা খালার সাথে খুব মন খারাপ করে তাদের ব্যাগ নিয়ে উঠে গেল।

কলেজের কাছাকাছি আসার পর রিতা বললেন এই পলি মন খারাপ নাকি?
– জি না খালাম্মা।
– শোনো, আল্লাহ যা করেন সব সময় ভালোর জন্য করেন। তোমার জন্য ভালো পাত্র অবশ্যই আছে।
– জি।

এই ড্রাইভার ওদের কলেজের নিচে নিয়ে গাড়ী রাখবে, ওরা নামবে!

দুই বোন একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। রাত প্রায় আটটা এখন কি হলে ঢুকতে দিবে?

গাড়ী থামার পর পলি-কলি নামতে যাচ্ছে তখন হঠাৎ রিতা বললেন এই কলি ব্যাগে কি?
– কাপড়।
– কিসের? জাহান কিনে দিয়েছে?.
– না, রাতে থাকার জন্য সাথে নিয়েছিলাম।
– তাই নাকি?
– জি।
– এই তোমরা গাড়ী তে থাকো, আজ আমার বাসায় থাকবে। কাপড় যখন সাথে আছেই।
– না, না।
– আরে মেয়েরা চুপ থাকো। ড্রাইভার গাড়ি চালাও। আমার ছেলে মেয়েরা, দেখলে খুব খুশি হবে।

দুই বোন ভিতরে ভিতরে কি পরিমাণ খুশি হয়েছে, যাক হলে যাওয়া থেকে তারা বেঁচে গিয়েছে। আজ রাতে থাকতে দেওয়ার জন্য রিতাকে সারাজীবন মনে রাখবে দুইবোন।

রিতা খালার বাসা কি সুন্দর! সাদা রঙের দুইতলা বাড়ী। চমৎকার করে গোছানো,সম্পূর্ণ বাড়ী। বেতের চেয়ার সারি করে সাজিয়ে রাখা বারান্দায়।

রিতার স্বামী যুবায়ের সাহেব বসারঘরে টিভি দেখছিলেন, রিতা কে দেখেই বললেন, যাক অবশেষে ঘরে এলে! কতক্ষণ হয়েছে, অফিস থেকে এসেছি।
– মেহমান নিয়ে এসেছি, জাহানের ননদ।
– ভাগ্নীরা কেমন আছ? রিতা, ল্যন্ডলাইনে জানালেনা, আমি কিছু স্পেশাল বাজার নিয়ে আসতাম।
– বাজার আছে, তুমি চিন্তা কর না।
– না না। এরা আমার বড় মেহমান।
– সমস্যা নেই, আমি ওদের জন্য স্পেশাল ডিস করবো।
– দ্যাটস গুড, সো ইয়াং লেডি তোমাদের এতো টায়ার্ড লাগছে কেন? যাও ফ্রেশ হও। বাই দ্যা ওয়ে দাবা পারো?
– জি খালু, আমি আপা দুজনে পারি।
– রাতে খেলবো।
– জি।

পলিদের জন্য একটি সুন্দর রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন রিতা, বললেন তোমরা রেস্ট নাও। আমি একটু রান্নাঘরে যাই।

পলি বললো খালা প্লিজ আমাদের জন্য কিচ্ছু এক্সট্রা করবেন না!
– তুমি চুপ করে রেস্ট নাও, একদম চুপ। আর হ্যা, চাকরির জন্য ছেলে পক্ষ আসেনি তো! আমি তোমার খালুকে বলে তোমাদের টাইপিং এবং কম্পিউটারে ভর্তির ব্যবস্থা করছি সরকারি ভাবে। দেখবে শিখলেই পড়া শেষ করার সাথে সাথেই চাকরি পেয়ে যাবে।
– ধন্যবাদ খালা।

রিতা বেগমের মেয়ে শান্তা এসে অনেকক্ষণ বলে গিয়েছে, সে ক্লাস ফোরে পড়ে, সে তার পুতুলের গল্প করেছে। এবং তার বড় বোন ক্সন্তা আর ভাই মুয়াজ স্যারের কাছে পড়ছে এঈ খবর দিয়ে গিয়েছে। কি মিষ্টি দেখতে শান্তা!

কলি বললো দেখেছিস আপা খালু কত্ত বড় চাকরি করে অথচ কোন অহংকার নেই। কত হাসিখুশি। অথচ ভাবীদের কি অবস্থা!
– থাক, সেসব কথা।
– শান্তা ও কত মিশুক।
– হ্যা। অনেক মিষ্টি।
– খালা যা বলেছেন তা হবে তো?
– হবে হবে। খালু যদি আমাদের সরকারি ভাবে এসব কোর্সে ভর্তি করে দেন, তাহলে আমাদের যে কত বড় হেল্প হবে, এটা শুধু আমরাই জানি।
– হ্যা আপা। তাই যেন হয়।

পলি নিজেও ভাবছে সত্যি কি সাহেদা বেগম রিতার বোন একদমই মিলানো যায়না! থাক, সেসব চিন্তা এখন খালু ভর্তি করে দিলেই শান্তি…..

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
১৫.১২.২০২১