ভাবীর সংসার (পর্ব-১৫)

Photo of author

By Annama Chowdhury

সাঈদ হাতে করে এক হালি ডিম, কিছু বিস্কুট, এক প্যাকেট নুডুলস নিয়ে বাসায় ফিরলো কিছুক্ষণ পর।

এসে মায়ের পাশে বসে বললো, খুব ঝামেলায় আছি, বদলির অর্ডার যেকোনো দিন আসবে। এখন কোথায় করবে কে জানে! বাচ্চা ছোট খুব যন্ত্রণায় আছি মা!
তুমি টাকা এনে যে কি ভালো কাজ করেছ, আমি তোমাকে বুঝাতে পারবো না।

রাহেলা খানম বললেন, বাবা শোন আমার কিছু কথা আছে। আর আমি কথা শেষ করার আগে তুমি কিছু বলবে না।
– বলো, বলো।
– কামরুল চট্টগ্রাম বাড়ী কিনছে, তার টাকার দরকার। তাই আমার পাশের জমি টি, আমার সহ বিক্রি করতে হয়েছে। কারণ আমার টা ছাড়া ওর জমি লম্বাটে হয়ে যায়। এখন বিক্রি করে তিন লক্ষ টাকা পেয়েছি। তার মধ্যে দুই লক্ষ টাকা পলি-কলির বিয়ের জন্য রেখেছি। পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে জাহিদ কে বইয়ের লাইব্রেরি করে দিয়েছি। আর বাকি পঞ্চাশ তোমাকে দিচ্ছি। আরো হাজার দশেক পেয়েছিলাম, তাতে কিছু কাজ, দাদুভাইয়ের চেইন কিনতে গিয়েছে। এখন আমার সকল দিক ভাবা লাগে, আমি মা। শুধু তোমাকে দিলে, আমার হবে না! আর জমির সরিষা বিক্রি করে, ঘরে চাল আনি। কেমনে বন্দক দিব বলো?
– আমাকে কি কথা বলার জন্য বলছো?
– বলো।
– আমি আর কি বলবো? আমি কে? মা? তুমি ঠিক আমি তো আর তোমার একা ছেলে না! তবে, কেন আমাকে তোমার তিন তিনটি ছেলে মেয়েকে বহন করতে হলো! কেন ছাত্র থাকা কালীন সারা মাস ডাল-ভাত খেয়ে কাটিয়ে দিতাম, বাড়ী যাওয়ার সময় দুই প্যাকেট নিমকি নিতে পারবো, এই আশায়।
– তোমার বাবার মৃত্যুর পরে, তুমি তো এই পরিবারের অভিবাবক। এখন আমি বড় অসহায় হয়ে গিয়েছি।

– ছোট মামার জন্য জমি বিক্রি করলে, বললে না পর্যন্ত একবার!
– জাহিদ কল দিয়েছিল, তুমি অফিসের বাইরে ছিলে।
– থাক, তোমার জমি, টাকাও তোমার, আমি কে!
– সাঈদ, কেন এভাবে বলছিস বাবা?
– মা, এখন তো আর জাহিদের সমস্যা হবে না। তুমি পলি-,কলিকে হোস্টেলে রেখে যাও, ওদের খরচ জাহিদ দিবে। আমি আর পারবো না মা।
– বাবা, শাহিদ-নাহিদ ঢাকায় একা কেমনে আছে, আল্লাহ জানে। তুমি দেখো, এখনো আমি সবচেয়ে বেশি টাকা তোমাকে দিয়েছি।
– এজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু, আমি ওদের দায়িত্ব নিতে পারবো না। আমার সংসার, বউ, বাচ্চা, বদলির জন্য আলাদা বাসা, খাওয়া-দাওয়ার খরচ। আমার পক্ষে সম্ভব না।জাহিদ কে বলবে, ওদের খরচ জাহানের কাছে পাঠিয়ে দিতে। আমার ট্রান্সফার এই পঞ্চাশ হাজার দিলেও হবে, হয়তো একটু কাছাকাছি হবে। এক লক্ষ টাকা হলে, হয়তো বাসা থেকে অফিস করার সম্ভবনা ছিল। থাক, যা হয়নি তা হয়নি। আর হ্যা, আমি ওদের ভর্তি করে দিব, হোস্টেলে। আর কিছুতে আমি নাই।
– তুমি কষ্ট নিও না বাবা।
– না, আমার কষ্ট কে দেখবে? সকলের প্রয়োজন দেখার দায়িত্ব শুধুই আমার।

সাঈদ হন হন করে ঘরের বাইরে চলে গেল। রাহেলা খানম কি করবেন, তিনি জানেন না। ছেলেকে কি বলবেন! তিনি অপরাগ। জাহিদ কে বুঝিয়ে বললেন, কষ্ট করে রাত টা থাকার জন্য। ওদের ভর্তি করে, হলে তুলে দিয়ে এক সাথে যাবেন মা-ছেলে।

রাতের বেলা, রাহেলা খানম ভাত, আর ডিম ভাজি করে চার জন খেয়ে নিলেন, সাঈদ হয়তো অভিমান করে কোথাও বসে আছে! তিনি ছেলের অপেক্ষায় বার বার বারান্দায় আসছেন,যাচ্ছেন।

পরের দিন সকাল এগারোটায় দুই বোন ভর্তি হলেন মহিলা হোস্টেলে। সাঈদ হোস্টেলের টাকা দিয়ে বললেন, আর আমাকে কিছু বলবিনা, তোদের ব্যবসায়ী ভাই কে বলিস।

লোকাল গার্ডিয়ান হলেন মিসেস সাহেদা খানম। কারণ, সাঈদের ধারনা তিন/চার দিনের মধ্যেই তার অর্ডার আসবে, বদলির।

জাহিদ কলেজের বাইরে দুই বোন কে ডেকে বললো, কিরে তোরা বাড়ী চলে যাবি? নাকি এখানেই থাকবি?

কলি বললো না, বাড়ী গিয়ে ভাড়া নষ্ট করে লাভ নাই। তুমি দু/এক দিন পরে বই খাতা, কাপড় নিয়ে হলে এনে দিয়ে যেও।

জাহিদ দুই বোনের জন্য বালিস কাঁথা চাদর প্লেইট কিনে হলে তুলে দিল। রাহেলা খানম মেয়েদের বার বার বলছেন, ভাইয়ের বদনাম হয়, এমন কাজ করবেনা। আর বউয়ের কাছ থেকে টাকা আনবে গিয়ে, জাহিদ দিবে, নয়তো আমি। আমার মা-ছেলে শাক পাতা দিয়ে খাই সমস্যা নাই কিন্তু তোরা পড়িস।
– কেন, আপার নামে মানি অর্ডার করলেই হয়।
– জাহান তোদের বড় ভাইয়ের বউ, তার কাছ থেকে আনতে লজ্জা কিসের। সাঈদ এখন বেশি কষ্ট পেয়েছে, তাই রাগ করছে, পরে ঠিকই দেখবি, তোদের দেখতে আসবে, চিন্তা করিস না।

জাহিদ আর রাহেলা খানম জিহান ( সাঈদের ছেলে) কে এক নজর দেখে রাতের ট্রেনে উঠলেন।

জানালার পাশে বসেছেন রাহেলা। সাঈদ এক বোতল পানি দিয়ে বললো দোয়া কর তুমি, আমার সত্যি কোথায় বদলি হয় জানিনা!

রাহেলা খানমের ট্রেন ছাড়ার পর থেকে মন খারাপ লাগছে, সাঈদ সত্যি বিপদে, ছেলেটা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু বাকিদের ভাবনা ভাবতে হলে, কিছুই করার নাই তার। মেয়ে দুটিকে অপরিচিত জায়গায় রেখে যেতে মন খুব অশান্ত লাগছে। পড়াশোনা শুরু হচ্ছে, এটা ভাবতে আবার শান্তি লাগছে। কায়া দেখলে মায়া হয়, বার বার নাতির মুখ টা চোখে ভাসছে রাহেলার।

পলি-কলির রুম নাম্বার দুইশো সাত, দুই তলার শেষ রুম টা তাদের। শেষ রুম হওয়ায় ডাইনিং আর টয়লেট বেশ দূরে, তবুও হলে উঠেছে, তাই ভালো লাগছে।

পলি দারোয়ান কে দিয়ে পঞ্চাশ টাকার বিস্কুট, মুড়ি, চানাচুর,চিড়া কিনে আনলো, কারণ পড়তে পড়তে ক্ষিদে লাগবে। জাহিদ যাওয়ার সময় আশি টাকা দিয়ে গিয়েছে। এবং দুই/তিন দিনের মধ্যে আবার আসবে বলেছে। তাই এই টাকা খরচ করেছে পলি।

হলে, দুপুরের পর রাতের খাবার অনেক দেরীতে, মাঝের সময় অনেক লম্বা, তাই বাধ্য হয়েই এই ড্রাই খাবার এনেছে পলি।

রাতে, ডাইনিং থেকে খাবার দেওয়ার সময় বলে দিল, যেন তরকারীর জন্য এবং ডালের জন্য দুটি বাটি, একটি বাটি নিয়ে আসে। কিন্তু পলির কাছে বাটি, চামচ নাই। বাটি কেনার জন্য মার্কেটে যেতেও ত্রিশ টাকা ভাড়া লাগবে। এদিকে বাটি ছাড়া তরকারি দিবেনা। কি করবে পলি ভাবছে, বাটি কিভাবে ম্যানেজ দিবে! জাহিদের হয়তো খেয়াল হয়নি, তাই কিনে দেয়নি।

রুমে এসে দেখলো, রুম মেটের বই নিয়ে কলি খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। পলির খুব ভালো লাগছে যাক শেষ মেষ পড়াশোনা শুরু হবে, তাই শান্তি। কিন্তু তবুও বাটির চিন্তা মাথায় রয়েই গেল…..

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
০৯.১২.২০২১