ভাবীর সংসার (পর্ব-১১)

Photo of author

By Annama Chowdhury

রাহেলা খানম উঠানে বসে বসে সবজি কাটছেন, পলি চুলার পাশে বসে আলু সিদ্ধ করছে, ভর্তার জন্য। ঘড়িতে সকাল এগারো টার কিছু বেশি হবে। কলি বারান্দার শেষ কোনায়, মোড়ায় বসে পাঠ্য বই পড়ছে।

রাহেলা খানমের ছোট ভাই সৈয়দ কামরুল হাসান হাতে এক পাতিল দই আর এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে, রাহেলা খানমের সামনে এসে সালাম দিলেন।

রাহেলা খানম ভাইকে দেখে বেশ চমকে উঠলেন, কারণ তার ভাই অনেক ব্যস্ত, সময় বের করে হঠাৎ উপস্থিত হবেন টের পান নি রাহেলা।

সাথে সাথে হাত পানিতে ধুয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, কামরুল কেমন আছিস ভাই?
– ভালো আছি বুজি। তুমি কেমন আছ?
– আল্লাহর শুকরিয়া ভালো আছি। সুমি আর ভাতিজা, ভাতিজি ভালো আছে?
– আছে বুজি ভালো। সুমি ব্যাংকের চাকরি নিয়ে খুব ব্যস্ত, ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা নিয়ে, এজন্য সাথে আনতে পারিনি।
– আয় ঘরে আয়।

রাহেলা খানম ভাইকে ঘরে বসিয়ে রেখে এসে বললেন পলি, জলির জামাইয়ের জন্য যে মোরগ রেখেছিলাম, তা ধরার জন্য দৌড় দে, তোর চাচী আম্মার কাছে কালিজিরার চাল পাবি, চালের জন্য কলিকে পাঠিয়ে দে। আর তার আগে শরবত করে নিয়ে আসতে বল কলিকে।
– আচ্ছা।

রাহেলা খানম পিছনে না তাকিয়ে আবার ঘরের দিকে দৌড় দিলেন। পলি দেখছে, তার খুব ভালো লাগছে।

কলি এসে বললো দেখেছিস আপা, মামা কত বড় অফিসার কিন্তু মা কে কত ভালবাসে। প্রতি বছর ঠিকই মাকে দেখতে আসে।
– হুম। যা শরবত দে, আমি আমাদের লালু মিয়ারে ধরি।
– আপা, এটা না দুলাভাই এর জন্য মা রাখলেন।
– এখন লালু মিয়া, মামার পেটে যাবে। তুই দোয়া কর, যেন ঘন্টা খানেকের মধ্যে লালু মিয়ারে কাবু করতে পারি।

কলি হাসছে যাও যাও পারবে।

কামরুল হাসান বললেন বুজি আমি চট্টগ্রামে একটা বাড়ী কিনবো, তাই বাড়ীর কিছু জায়গা বিক্রি করতে এসেছি৷

বাড়িরসম্পত্তি গুলো এখন ভাগ বাটোয়ারা করে আমার ভাগ বিক্রি করবো।
– চট্টগ্রামে কেন বাড়ী কিনবি?
– ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে, সারাজীবন চাকরি করেছি এখানে, এখন ফ্ল্যাট নিয়েছিলাম, সুমি একটা তিনতলা বাড়ী পছন্দ করেছে। এজন্য ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিচ্ছি, সুমি লোন নিবে, তারপরেও আরও ১২ লক্ষ টাকা লাগে। তাছাড়া বছর সাতেক পরে রিটায়ার্ড করবো,ইনকাম বের করা দরকার। এজন্য গ্রামের জায়গা বিক্রি করবো ভাবছি, এখন এখানে বাটোয়ারা করে দেখা গিয়েছে, আব্বা তোমার নামের যে জায়গা দিয়েছেন, তার দুই শতক সহ দাম হচ্ছে। কিন্তু এই দুই শতক না হলে জায়গা লম্বাটে হওয়ায় কেউ কিনতে চায়না। তুমি যদি দুই শতক লিখে দাও, আমি তোমাকে টাকা দিয়ে দিব।
– দুই শতকের দাম কত টাকা আসে?
– এখানে শতক দেড় লক্ষ টাকা, তুমি তিন লক্ষ পাবে। তুমি কি দিবে আপা? তুমি হয়তো ভাববে, আমার জন্য হয়তো তোমার জায়গা চাইছি।
– আরে না, ভাই, আমার টাকার দরকার থাকলেও মেজ ভাইজান, কিংবা বড় ভাইজান কে বলিনি। কারণ জায়গা এখনো বিক্রি শুরু হয়নি। আর বাপের সম্পত্তি ভাইয়েরা না দিলে, আমি কখনো দাবী করবো না।
– তা ঠিক, ভাইজান বললেন তুমি দিলে বিক্রি করে ফেলতে। কারণ বাড়ী টা কিনলে মাসে ষাট হাজার টাকা ভাড়াও আসবে।
– তোর কাজে যদি লাগে বিক্রি করবি কর, আর তুই টাকা না দিলে সাঈদ কে ভার্সিটিতে পড়ানো কষ্ট হয়ে যেতো।
– ভাগ্না মানুষ করার অর্থ হচ্ছে আমার বোন ভালো থাকবে। ভাবতেই ভালো লাগে বড় ভাগ্না বিসিএস ক্যাডার। এখন এজন্য আর এতো দেই না কারণ সাঈদ ভালো ইনকাম করে। আর এদিকে আমার ছেলে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে খরচের উপরে খরচ।
– না, না। তোর দুলাভাই শিক্ষক মানুষ, সাঈদের পড়াশোনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় পড়তেন, তুই উদ্ধার না করলে…..
– বুজি এসব বলবেনা, সাঈদ মানুষ হয়েছে তাই শান্তি।বাড়ীঘর পাকা কর এখন, মেয়েদের বিয়ে শাদি আছে, সাঈদ ভালো আছে?
– নাতি হয়েছে।
– মাশাল্লাহ।

কলি মামাকে লেবুর শরবত দিল।

কি রে কলি কেমন আছিস?
– ভালো আছি ছোট মামা।
– খুব পড়ছিস দেখলাম, তাই ডাকিনি।
– পড়া চলছে কোন মতে!
– কেন?
– অনেক দিন বাড়িতে আছি, কলেজ যাইনা। ভাইজান চিঠি দিলে যাবো।

সাথে সাথে রাহেলা খানম বললেন পরীক্ষা হয়েছে,আমিও জলির বিয়ের পর একা, এজন্য ক দিন রেখে দিয়েছি।
– না, না পড়া নষ্ট করে বেড়ানোর দরকার নাই।

রাহেলা খানম চোখ গরম করে তাকালেন, যেন কলি আর কিছু না বলে। কারণ তিনি কখনোই সাঈদ ছোট হোক কিংবা ঘরের ঝামেলা বাইরে কেউ জানুক, তা পছন্দ করেন না। কিন্তু মামা সাঈদের জন্য অনেক করেছেন তার গুনধর ভাগিনার কথা জানাতে চেয়েছিল কলি।

কলি বাইরে এসে দেখলো, পলি এখনো দৌড়াচ্ছে কিন্তু লালুমিয়া দৌড়াচ্ছে আরও দ্রুত গতিতে।

শেষ পর্যন্ত দুই বোনের চেষ্টায় লালু মিয়া ধরা খেয়ে জবেহ হয়েছেন।

মোরগ কাটতে কাটতে কলি বললো আপা, মা সব সময় ভাইজানের প্রশংসা করেন, আমি ছোট মামাকে কিছু বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু মা যেভাবে তাকালেন, বাপরে!
– তিন পুত্র মরে যাওয়ার পরে ভাইজান কে পেয়েছেন। এজন্য আদর একটু বেশি।

রাহেলা খানম মোরগের ঝোল করেছেন, পোলাও, কদু শাক দিয়ে পাতুরী, মাছের তরকারি, পাতলা ডাল। আর ভাইয়ের পছন্দের পিয়াঁজ বেরেস্থা।

জাহিদ দুপুরের সময় মাছ নিয়ে এসে দেখে ছোট মামা এসেছেন, হাতে রুই মাছ ছিল। এটা সাথে সাথে রান্না করেছেন রাহেলা।

কামরুল খাওয়া দাওয়ার সময় বললেন, বুজি তুমি রান্না করলে আম্মার রান্নার স্বাদ পাই। আম্মা মরে যাওয়ার প্রায় বারো বছর হয়ে যায়।
– আম্মার রান্না কত ভালো ছিল!

জাহিদ কি করছিস, বিসিএস দে, ভাইয়ের মতো পজিশনে যা। তোদের নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন
– জি মামা।

যাওয়ার সময় কামরুল বললেন, বুজি আমি আগামী পড়শু দিন এসে তোমাকে নিয়ে যাবো, আর সেদিন বায়নার তিন লক্ষ পাবো, তোমাকে সম্পূর্ণ দিয়ে দিব।
– না, বিক্রি হলেই দিস।
– না না। দিয়ে দিলে, আমিও শান্তি। আর এই ব্যাগে সুমি, কলি-পলির জন্য জামা দিয়েছেন দিও, আর এক হাজার টাকা রাখো, খরচ করবে।
– না, থাক। লাগবেনা।
– বুজি, তুমি কত আদর করেছো, এখন ঝামেলায় পরে আসতে পারিনা, জলির বিয়ের চিঠি পেয়েছি কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে আসার সুযোগ হয়নি। আর এই এক হাজার জলিরে দিবে, ছোট মামার উপহার।
– থাক, আর লাগবেনা।
– বুজি, আবারও জিজ্ঞেস করছি, তুমি খুশি হয়ে লিখে দিবে তো? তোমার ইচ্ছা না থাকলে আমি জোড় করবো না।
– আরে না, আমার ও দিলে উপকার হয়।
– আচ্ছা, যাই।

কামরুল যাওয়ার পর রাহেলা জাহিদ কে বললেন তিন লক্ষ টাকা এখন পেলে, আমার যে কি উপকার হবে বাবা। তোদের লেখা পড়ায় আর ঝামেলা হবেনা, বাড়ী ঘর ঠিকঠাক করতে পারবো, আল্লাহ এতো দিন আমার দিকে মুখ তুলে তাকালেন। আমার মরহুম আব্বা, ও মরহুম আম্মাকে আল্লাহ বেহেশত নসিব করুন। আমার আব্বা যদি আমাদের তিন বোনের জন্য জায়গা, লিখে না দিতেন, আমরা কিছুই পেতাম না।
– নানাভাই সম্পদ শালী কিন্তু বিচারী মানুষও ছিলেন।
– হ্যা বাবা। কিন্তু আব্বা জমি বিক্রি করা পছন্দ করতেন না তাই তোর বড় দুই মামা কখনোই জমি বিক্রি করেন নি। অনেক সময় কষ্ট করে চলেছেন। তাই আমিও কখনো বলিনি। আব্বার ইচ্ছা সবার আগে, এখন কামরুলের দরকার আমারও ভালো হয়, তাই বিক্রি করছি।
– ভালো হয়েছে। যাক, একটু শান্তি পাওয়া যাবে।
– আল্লাহ যদি দেন, বাবা সাঈদ কে একটা কল দিও আজ সন্ধ্যায় বাজার থেকে। পরে আবার রাগ করবে, না জানালে।

কলি বললো কেন রাগ করবে, সে কি আমাদের রাগ অভিমান কষ্টের দিকে খেয়াল রাখে?
– বিয়ে হউক বুঝবে যন্ত্রণা, যাই হউক জাহিদ তুই কল দিস।
– সকালে, ভাইজানের অফিসে কল দিমু, এখন আর বাইরে যাচ্ছিনা।
– আচ্ছা।

রাহেলা খানমের আজ অনেক দিন পর খুব শান্তি লাগছে, তাছাড়া কামরুলের কাজে লাগবে টাকা, এটা শুনেও ভালো লাগছে। এই ভাই, তার সব সময় খেয়াল রেখেছে। সাঈদ নিশ্চয়ই খুশি হবে জানলে, তার মাথা থেকে কিছু ঝামেলা নামবে….

চলবে…

আন্নামা চৌধুরী
২৯.১১.২০২১