আমি তখন ৫ম শ্রেনীতে পড়ি। একটা কো-এজুকেশন স্কুলে পড়েছি ১ম থেকে ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত। আমি মেয়েদের ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। আর অন্য দিকে ছেলেদের ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিল মফজল নামের একটা ছেলে। একদিন স্কুলে গিয়েছি, ক্লাসে স্যার আসবে তার ঠিক ৩/৪ মিনিট আগে মফজল আমার হাতে একটা ভাজ করা কাগজ দিয়ে বলল, জীনাত নাও। এটা পড়। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই স্যার এসে ক্লাসে ঢুকলো। আমার এখনো মনে পড়ে আয়ুব আলী স্যারের লম্বা লম্বা কাল সাদা দাঁড়ি। সাদা কাবলী সেট পড়তেন স্যার সবসময়। ভীষণ রাগি ছিলেন। তবে আমাকে খুব আদর করতেন। ভাল ছাত্রী ছিলাম বলে নয়। আমি কখনোই তেমন ভাল ছাত্রী ছিলাম না। মোটামুটি এক থেক দশের মধ্যে থাকতাম। আমার আব্বার খুব আদরের মেয়ে ছিলাম তাই আমাকে সবাই আদর করতেন। এবং আমার আব্বার ভাল একটা নাম ডাক ছিলো তাই সে স্কুলে আমি থাকতামও একটা ভাব সাব নিয়ে। কেউ আমাকে কিছু বললেই কানতে কানতে সেদিন আমার স্কুলের বারটা। আমার আগে আমার সাত ভাই বোন ওই স্কুলে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছেন। সুতরাং তাই আমাকে সব স্যারই চিনতেন ও আদর করতেন।
স্যার আসার পর আমরা উঠে দাঁড়িয়েছি। এর মধ্যেই আমি কাগজটা খুলে দেখে ফেলেছি। আর দেখেই ভ্যাঁ করে কান্না জুড়ে দিলাম। মফজল তাড়াতাড়ি আমাকে ফিস ফিস করে বলছিল, জীনাত লুকাও লুকাও। এতে স্যারের মনে সন্দেহের উদয় হলো। স্যারের কি সন্দেহ হবে, আমার কান্না দেখে পুরা ক্লাসের সব হা করে তাকিয়ে আছে। স্যার আমার কাছে জানতে চাইলো, কি রে কি হয়েছে? তুই কাঁদিস কেন? ওই কাগজে কি আছে? স্যারের কথা শুনে আমি আরো জোরে কান্না শুরু করে দিলাম। এদিকে মফজল পাশ থেকে বার বার বলছিল, জীনাত কাগজটা লুকাও; কাগজটা লুকাও। স্যার সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, কি হয়েছে তোরা কেউ জানিস? সবাই চুপ। স্যারের হাতে বিরাট এক ঘোড়া মারার বেত। বেতটা টেবিলে জোরে বাড়ি মেরে জিজ্ঞেস করলো কেউ কিছু বলে না কেন?
স্যার আমাকে ডাকলো, এদিকে আয় ওই কাগজ নিয়ে৷ দেখি আমি ওই কাগজে কান্দার কি আছে আমি একটু দেখি। স্যারের বেত নাড়া চাড়া দেখে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ভেবেছি স্যার আমাকেই হয়তো মারবে। তবুও ভয়ে ভয়ে স্যারের কাছে গেলাম। স্যার বলে, কি লেখা আছে পড়। আমার কান্নার গতি বেড়েই চলেছে। আমার হাত থেকে কাগজটা হাতে নিয়ে এবার স্যার জোরে জোরে পড়তে শুরু করলোঃ
ফ্রীরিয় জীন্নাত
ভালবাসা নিও। তোমাকে আমার খুব ভাল লাগে৷ কারন তুমি খুব সুন্দর। তোমার নাচও খুব সুন্দর৷ তোমাকে আমি সব সময় আইস্ক্রীম দিবো৷ তুমি কোন পয়সা দেয়া লাগবে না৷ আমি সব সময় তোমারে আইসক্রিম দেই৷ তুমি কেন নাও না৷ তুমি বুঝি বুঝনা আমি তোমারে ভালবেসে আইসক্রিম দেই চুরি করে এনে৷ আমি তোমারে অনেক অনেক ভালবাসি৷ তুমি আমার ভালবাসা৷ তুমি কেন বুঝনা৷
ইতি
তোমার মফজল৷
বিঃ দ্রঃ এটা আমাদের ভালবাসার চিঠি। কাউরে দেখাইও না। আমার চিঠির উত্তর দিও।
স্যার যখন চিঠিটা পড়ছিলেন তখন খুব টেনে টেনে ব্যঙ্গ করে করে পড়ছিলেন৷ মাঝখানে আবার টেনে টেনে বলছিলেন ভালবাসাবাসি!!!! আইচ্ছা!!! কেলাস ফাইভে ভালবাসাবাসি!!! ফেরেম পত্র!!! আইচ্ছায়ায়ায়া।
তারপর স্যার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আর কখনো দিয়েছিল নাকি এমন চিঠি? আমি বললাম না। আমাকে স্যার জিজ্ঞেস করলেন এখন ওরে কি কইত্তাম। মারি? আমি চট করে বললাম মারেন স্যার। বেশী করে মারেন।
স্লো মোসানে স্যার একটা চিৎকার করে বললেন, মফজইল্ল্যা এদিকে আয়৷ বললেন, তোর হাত দে। বেচারা হাত মেলে দিল। স্যারের মাইর শুরু। ইশশশ কি মারা যে মারলো। মারে আর বলে, আর জীবনে ফ্রেমের চিডি লেখবি? মফজল বলে না স্যার। আর আইসক্রিম খাওইবি? মফজল বলে না স্যার।
অনেক মেরেছে স্যার মফজলকে। মারতে মারতে দুই হাত শেষ। তারপর মারলো পাছায়। হাতে পায়ে রক্ত বের হয়ে গেলো। এখন মনে হলে খুব কষ্ট হয়।
মফজলের বাবার আইসক্রিম ফেক্টরী ছিল। আমাদের স্কুলের পিছনেই। মফজল তার বাবার পালক পুত্র ছিলো। কিন্তু অনেক আদরের ছিলো। দেখতে আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে অসুন্দর ছেলে ছিলো। কিন্তু প্রচুর টাকা ছিলো তাদের। তারপরে কি হয়েছিল, কিছুই মনে নেই।
সৌভাগ্যবসত বছর চারেক আগে আমি যখন ফেনী যাই। আমার অন্য এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমি আসবো জেনে সে আমাদের ক্লাসের ৬/৭ জন ছেলে বন্ধুকেও দাওয়াত দেয় এবং সাথে মফজলকেও। সেদিন আমাকে দেখে মফজল খুব খুশী হয়েছিল। আর ওকে দেখে আমি খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। কারন তার আগের সে অবস্থা আর নেই। সে এখন ইয়োলো ক্যাব চালায়। বাবা মারা যাওয়ার পর চাচারা তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়। তারপর তার অনেক কষ্টের জীবন শুরু। এখনো খুব কষ্টে আছে। আমাকে দেখে সে আমার সামনে বসতেই চাইছিলো না। আমি ওকে পাশে বসতে বলাতে সে একটা মোড়া টেনে আমার পায়ের কাছে বসলো। আমি ওকে ডেকে পাশে বসালাম। ওর কাছে মাফ চাইলাম। আশ্চর্য!!! ওই কথা বা ওসব কোন কথাই তার মনে নেই। অনেক নরম গলায় বলল, তোমার ফোন নম্বরটা দেবে প্লিজ।