Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • সহোদরা – পর্ব১

    সহোদরা – পর্ব১

    অনেক বছর আগের ঘটনা; আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। পরের দিন ক্যালকুলাস পরীক্ষা, অ্যাডভানস ডিফারেন্সিয়াল ইকুয়েশনগুলো মাথায় ঢুকছিল না। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছিলাম। তার উপর লেগেছে খিদা। রান্নাঘরে গিয়ে এক প্যাকেট চানাচুর খুঁজে পেলাম। চানাচুর চিবাতে চিবাতে রুমে ফিরে আমার পড়ায় মনোযোগ দিতে চেষ্টা করছি, তখন হঠাৎ শুনলাম, ‘বড়ভাই কী কর?’

    তাকিয়ে দেখলাম ‘ইতি’, আমার ছোটবোন। ইতির বয়স তখনও পাঁচ বছর হয়নি। বয়সে সে আমাদের ভাইবোনদের সবার ছোটো। আমি সবার বড়ো, আর আমার ছোটো তিন বোন। আমার বোনদের নাম প্রীতি, গীতি এবং ইতি; কী সুন্দর সব কাব্যিক নাম! কিন্তু আমার নামে কাব্যের কোনও ছিটেফোঁটা নেই; আমার নাম ‘আবুল খায়ের’, ডাক নাম খায়ের। সারা জীবন স্কুলের ছেলেরা ‘আবুইল্যা’ ‘আবুইল্যা’ বলে টিটকারি করত। এই জন্য বাবার উপর খুব মেজাজ খারাপ হতো আমার। কেন যে আমাকে এই রকম একটা নাম দিয়েছিলেন! একবার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কেন আমার এই নাম রাখা হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, ‘আরে, চক-বাজার জামে মসজিদের ইমাম সাহেব এই নাম রাখছে, তোর নামের অর্থ হচ্ছে যে সবার মঙ্গল করে; খুবই সুন্দর নাম।’ মনে মনে বললাম, ‘হ্যাঁ, আপনি আইসা আমার স্কুলের পোলাপানগো এইটা বুঝান, কেমন খেত খেত একটা নাম রাখছেন!’

    ইতিকে বললাম, ‘পড়াশুনা করছি, তুই কী কিছু বলবি?’

    ‘হ্যাঁ, বড়ভাই, আমার মহা-বিপদ, সাংঘাতিক বিপদ।’

    হেসে দিয়ে বললাম, ‘তোর আবার কী মহা-বিপদ?’

    ইতি আমার কাছে এসে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর আমার মুখে হাত দিয়ে বলল, ‘তোমার দাড়িগুলা দেখতে ভালো হয় নাই বড়ভাই; দেখতে কেমন ঝাড়ুর মতো লাগে।’

    ‘ঝাড়ুর মতো লাগে! কী বলিস!’

    ‘হ্যাঁ, নিলুফা খালার ঝাড়ুর মতো লাগে তোমার দাড়ি।’

    নিলুফা খালা সকাল-বিকাল আমার মাকে ঘরের কাজে সাহায্য করেন। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় ইতি দেখেছে হয়ত। বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘তুই এইটা বলতে আসছিস?’

    ‘না বড়ভাই।’

    একটু বলে রাখি, আমার অন্য দুবোন আমাকে ভাইয়া ডাকে, কিন্তু ইতি কেন যেন আমাকে ডাকে ‘বড়ভাই’। একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘কিরে, আমি তো তোর একমাত্র ভাই, আমাকে ভাইয়া ডাকলেই তো হয়।’ ইতি উত্তর দিয়েছিল, ‘কিন্তু তুমি তো সবার বড়ো, এই জন্য তুমি বড়ভাই।’

    ইতিকে বললাম, ‘ঠিক আছে, কী বলবি বল।’

    ‘বড়ভাই তুমি কী খাও?’

    ‘চানাচুর খাচ্ছি, খিদা লাগছে।’

    ‘আমাকে একটু দিবা?’

    ‘তোরে না মা একটু আগে খাওয়াইছে। তোর কি এখন আবার খিদা লাগছে?’

    ইতি আমার মুখের দিকে তাকাল, ‘না খিদা লাগে নাই। দাঁড়াও, আমি আসতেছি’, বলে সে দৌড়ে চলে গেল। ফিরল এক মিনিট পর; হাতে একটা পুতুল।

    ‘কিরে কী নিয়া আসলি?’

    ‘এইটা আমার বার্বি’, পুতুলটাকে দেখিয়ে ইতি বলল, ‘দেখো ওর মুখটা কী শুকনা! ওর অনেক খিদা লাগছে, ও চানাচুর খাইতে খুব পছন্দ করে। ওরে একটু দিবা?’

    বুঝতে পারলাম তার উদ্দেশ্যটা কী। চানাচুরের প্যাকেটটা হাতে দিয়ে বললাম, ‘নে ধর, তুই খা। আমার আর খাইতে হবে না। এখন যা এখান থেকে, কাল আমার ক্লাস-টেস্ট। পড়তে হবে।’

    ‘কিন্তু বড়ভাই, আমার যে মহা-বিপদ। জীবন-মরণ সমস্যা।’

    আবারও হাসি আসলো পিচ্চি মেয়ের মুখের জীবন-মরণ সমস্যার কথা শুনে। বললাম, ‘ঠিক আছে, বলবি তো কী সেই সমস্যা।’

    ‘আমার পাঁচশ টাকা লাগবে।’

    ‘পাঁচশ টাকার মহা-বিপদ। কী করবি পাঁচশ টাকা দিয়ে।’

    ‘আমি প্রেম করব; এই জন্য পাঁচশ টাকা লাগবে।’

    বোকা হয়ে গেলাম, বলে কী পিচ্চি! কৌতূহলও হলো, ‘প্রেম করবি? কার সাথে? কীভাবে?’

    ‘ওই যে ছোটাপা যেভাবে প্রেম করে।’

    ‘কী! গীতি প্রেম করে নাকি? কীভাবে প্রেম করে?’

    ‘ওই যে, যখন ফোন পিং-পিং করে তখন দৌড় দিয়া গিয়া ফোন ধরে, আর ফোনে কথা বলার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢাইকা রাখে।’

    ‘তাতে কি হইছে? বন্ধুদের সাথেও তো কথা বলতে পারে।’

    ‘না আমি জানি, প্রেম করে; নিলুফা খালা বলছে। ছোটাপা বালিশে শুয়ে, দুই পা খাটের রেলিং-এ তুলে একবার ফোনটা এই কানে নেয় আবার ওই কানে নেয়। আর আমি কাছে গেলে ছোটাপা খালি বলে – ভাগ, ভাগ এখান থেকে। আমাকে খালি ভাগায়া দেয়। আমার জীবনটা একদম শেষ করে ফেলছে, একদম তামা তামা করে ফেলছে।’

    কষ্ট করে হাসি চেপে রাখলাম। বুঝলাম এই নিলুফা খালাই হচ্ছে সব নষ্টের মূল।

    বললাম, ‘ঠিক আছে প্রেম করবি, কিন্তু পাঁচশ টাকা দিয়ে কী করবি?’

    ‘পাঁচশ টাকা দিয়ে একটা মোবাইল কিনব, তারপর ওইটা দিয়ে প্রেম করব।’

    এতক্ষণে বুঝতে পারলাম বিষয়টা; পাঁচশ টাকা দিয়ে যে মোবাইল কেনা যায় না, সেটা তার জানার কথা নয়। আর এও বুঝতে পারলাম ইতির এই সমস্যা সমাধান না করলে আমার আর ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস করা হবে না।

    ইতিকে বললাম, ‘শোন, এক কাজ করি, চল আমরা একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি। ঘুরতে ঘুরতে আলোচনা করা যাবে কীভাবে তোর সমস্যাটার সমাধান করা যায়। যাবি? কী বলিস?’

    ‘ঠিক আছে বড়ভাই’, ইতি সম্মতি দিলো ঘাড় নেড়ে।

    বললাম, ‘দেখ ড্রাইভার কাকু কোথায় আছে, আজ আমরা গাড়ি দিয়ে ঘুরব।’

    ছুটির দিন, রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করার পর ইতিকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কিরে কিছু খাবি? এখনো খিদা লাগে নাই?’

    ‘হ্যাঁ বড়ভাই, বার্গার খাব। বার্গার খেয়ে শেষ করে তারপর আইসক্রিম খাব।’

    ‘ঠিক আছে’, ড্রাইভার কাকু বললাম, ‘কাকু একটা ফার্স্ট-ফুডের দোকানে চলনে তো।’

    দোকানে বসে ভাই বোন দুজনে দুইটা বার্গার অর্ডার করলাম। বার্গার অর্ধেকটা খেয়ে ইতি বলল, ‘সে আর খাবে না, পেট ভরে গেছে।’

    ‘পেট ভরে গেছে! তাহলে আইসক্রিম খাবি কী করে?’

    ‘না না বড়ভাই, আইসক্রিমের জন্য পেটের পাশে একটু জায়গা খালি আছে।’

    আমি মুখ টিপে হেসে বললাম, ‘ঠিক আছে, কোনটা খাবি? চকলেট, না ভ্যানিলা, না কি স্ট্রবেরি?’

    ‘চকলেট’, ইতি বলল।

    ইতি খুব মজা করে চকলেট আইসক্রিম খাচ্ছিল। আমি বললাম, ‘আইসক্রিম কেমন?’

    ‘মিষ্টি মিষ্টি, খুব মজা।’

    ‘কিন্তু আইসক্রিম খেয়ে তো আমার সব পাঁচশ টাকা শেষ হয়ে গেছে। এখন তোর জীবন-মরণ সমস্যার কী হবে?’

    ইতি গম্ভীর মুখে আইসক্রিম খেতে খেতে বলল, ‘প্রেম করার দরকার নেই। আইসক্রিম খাওয়াই ভালো।’

    ‘একদম ঠিক বলেছিস। এরপর থেকে যখনই তোর প্রেম করতে ইচ্ছা করবে, তখনই আমরা আইসক্রিম খাব। ঠিক আছে?’

    ইতি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

    ফেরার পথে গাড়িতে ইতি বার্বি কোলে নিয়ে আমার গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও নড়াচড়া না করে সোজা হয়ে বসে রইলাম যাতে ওর ঘুম না ভাঙে। বাসায় এসে ঘুমন্ত ইতিকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে খেয়াল করলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। আগামী কাল আমার পরীক্ষা; এতক্ষণে আমার অ্যাডভানস ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস শেখার বারোটা বেজে গেছে। তবে আমি অবাক হলাম পরের দিন; পরীক্ষা যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলাম, পরীক্ষা তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ হয়েছিল।

    এতদিনের পুরনো এই কথাগুলো আজ দুপুরে মনে পড়লো ইতির ঘরে যাওয়ার পর। ইতি এখন বড়ো হয়েছে; বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু করেছে কদিন আগে। মনে হলো আজ বাসায় কিছু একটা হচ্ছে, কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব। বউকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বাসায় কী হচ্ছে বলত? কোনো অনুষ্ঠান? আমি তো কিছু জানি না।’

    বউ মুচকি হেসে বলল, ‘ইতির ঘরে যাও, নিজেই দেখে আস, কী কেরামতি চলতেছে।’

    চলবে…

    ২২ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রি., আটলান্টা, জর্জিয়া

  • সাদা পিরিচ -পর্ব৪

    সাদা পিরিচ -পর্ব৪

  • সাদা পিরিচ – পর্ব৩

    সাদা পিরিচ – পর্ব৩

  • সাদা পিরিচ – পর্ব২

    সাদা পিরিচ – পর্ব২

  • প্রেম ও প্রতিহিংসা – শেষপর্ব৭

    প্রেম ও প্রতিহিংসা – শেষপর্ব৭

  • প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৬

    প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৬

  • প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৫

    প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৫

  • প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৪

    প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৪

  • সাদা পিরিচ – পর্ব১

    সাদা পিরিচ – পর্ব১

  • প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৩

    প্রেম ও প্রতিহিংসা – পর্ব৩