শহরটা ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়েছে।
বহু আলো জ্বলা জানালার ভেতর থেকে নিভু নিভু আলো ঠিকরে পড়ছে।
শুধু একতলা বাড়িটার বারান্দায় বসে আছে জায়েদ।
বয়স তার এখন ষাট ছুঁই ছুঁই।
কিন্তু চোখ দুটোয় এখনও তরুণ বয়সের উষ্ণতা।
যেখানে একরাশ স্মৃতি, কিছু অভিমান আর
একটা নাম অদৃশ্য আঁকড়ে রেখেছে।
কত বছর হয়ে গেল, কেউ আর তাকে নামে ডাকে না।
আগে ছিল মা-বাবার ডাক,
বন্ধুদের হাসি-ঠাট্টা।
সব এখন স্মৃতির পাতায়।
জায়েদ বারান্দার চেয়ারটা একটু সরিয়ে বসল।
উঠোনের ধারে শিউলি গাছটা আজও দাঁড়িয়ে আছে।
যেন সেও অপেক্ষা করছে কারও জন্য।
হঠাৎ একটা পোকা ডানায় ঝাঁপ দিল বাতাসে।
জায়েদ তার চোখ বন্ধ করল।
মনে মনে নিজেকে বলল, —
সব নাম মুছে যায়, বিস্মৃত হয়।
বন্ধুদের নাম, পুরনো সহপাঠীদের নাম, এমনকি আত্মীয়স্বজনও।
কারো নাম মনে পড়ে না।
শুধু একটা নাম…
না, নাম নয়… একটা ডাক।
ভুলিনি নিজের নাম, আর বউ ডাক।
জায়েদের বউ — রুবি।
অবাক করা ব্যাপার হলো, রুবির আসল নাম ছিল রুবিনা।
কিন্তু বিয়ের দিনই হাসিমুখে বলেছিল,—
“শোনো, আমার নাম দিয়ে ডাকবেন না। শুধু ‘বউ’ বলবেন। এই ডাকে ভালোবাসা বেশি থাকে।”
জায়েদ হেসে বলেছিল,—
“বউ… শুনছো বউ?”
আর সেই থেকে শুরু…
জায়েদ ভাবে — বউ হারিয়ে গেছে এইতো বছর হয়ে গেলো।
দীর্ঘদিনের ক্যান্সারের কাছে হার মেনেছিল সে।
শেষদিন পর্যন্ত হাসপাতালের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থেকেছিল।
তারপর সেদিন —
এক গভীর রাতে হাসপাতালের বিছানায় রুবি বলেছিল,
“বাতাসের কানে কানে ফিসফিস করে বলো — বউ… শুনছো বউ?”
জায়েদ বুক-ভরা কান্নায় ভাসিয়েছিলো বুক।
রুবির চোখের কোণে জমেছিল পানি,
তারপর গিয়েছিল থেমে বাতাস, নিঃশ্বাস !
এরপর থেকে প্রতিদিন রাতে জায়েদ বারান্দায় বসে।
শুধু সেই ডাক —
বউ… শুনছো বউ
শিউলি গাছের পাতায় যখন বাতাস হালকা করে দোল খায়,
জায়েদ ভাবে — এই বুঝি উত্তর চলে এলো।
বছর ঘুরছে…
পাড়া-পড়শি কেউ আর আগের মতো ডাক দেয় না।
কেউ বলে না “জায়েদ ভাই”,
কেউ বলে না “চাচা”।
বয়স হয়ে গেছে বলে সবাই দূরে থাকে।
শুধু তার বুকের গভীরে একটা ডাক আজও ধুকপুক করে বাজে।
সবাই বলে — সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়।
কিন্তু জায়েদ জানে,
সব নাম মুছে যায়, বিস্মৃত হয়।
তবু একটি ডাক কখনো মরে না।
আজও মাঝরাতে বাতাসের কানে কানে সে বলে —
“বউ… শুনছো বউ?”
দুলে ওঠে শিউলি পাতাগুলো।
জায়েদের চোখ ভিজে যায়।
বুকের ভেতরে কান্নার ঢেউ উঠলেও মুখে ছোট্ট হাসি।
কারণ সে জানে —
প্রতি রাতে কেউ একজন সত্যিই শুনে।
অদেখা কোথাও থেকে উত্তর আসে।
ভোরের হালকা আলো ফুটতেই জায়েদ জানে,
আরেকটা রাত অপেক্ষা করবে।
আবার সে বলবে —
“বউ… শুনছো বউ?”