লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব-৩)

Photo of author

By Zeenat Alam

সকাল ৭ টার দিকে ফুয়াদের ঘুম ভেঙে যায়৷ পাশে তাকিয়ে দেখে স্নেহা বিছানায় নাই৷ স্নেহাকে না দেখে ফুয়াদ চিন্তিত হয়ে পড়লো৷ নীচে গিয়ে দেখে স্নেহা রান্না ঘরে নাস্তা বানাচ্ছে আর গুন গুন করে গান গাইছে৷ ফুয়াদ খুব খুশী হয়ে গেলো, অনেক দিন পর স্নেহার স্বাভাবিক আচরণ দেখে৷ যদিও স্নেহা আগে কখনও গান গাইতো না৷ বরং গান শুনতে খুব পছন্দ করতো৷ ঘুম থেকে উঠে নামাজ শেষ করে কোরান শরীফ পড়ে তারপর নাস্তা বানাতো নিজ হাতে৷ ডাইনিং টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে গান বাজিয়ে ফুয়াদ সহ গান শুনতো আর নাস্তা করতো৷ তারপর ফুয়াদকে গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিতো৷ স্নেহার এ স্বভাবটা ফুয়াদের খুব পছন্দ ছিলো৷ কিন্তু গত তিন মাস আগে গ্রীস বেড়াতে গিয়েছিলো তারা৷ গ্রীস থেকে আসার পর থেকেই স্নেহার আচরণ পাল্টে গেলো৷ তারপর একটার পর একটা দূর্ঘটনা ঘটেই চলেছে৷ আজ স্নেহা আগের রুটিনে ফিরে এসেছে দেখে ফুয়াদ বেশ সস্তি পেলো৷ আজ স্নেহা ঠিক আগের মতো ফুয়াদকে গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিলো৷

তারপর সে তার ঘরে ফিরে এলো৷ অনেকদিন পর আজ তার খুব হালকা লাগছে৷ রাতে ঘুমও বেশ ভালো হয়েছে৷ সে ভাবলো সেই কবে গ্রীস থেকে এসেছে৷ অথচ বন্ধুদের জন্য যে গিফট গুলো এনেছিলো, তা দেয়াও হয় নি৷ সে প্যাকেট করে সব ক্লজেটে রেখেছে৷ আজ সে সেই গিফটগুলো বের করলো৷ রুমের টেবিলের উপর সব সাজিয়ে রেখে ভাবছে কোনটা কাকে দেবে৷

বাসার জন্যও সে কিছু ডেকোরেশন পিস এনেছে৷ সেগুলোর মধ্যে ছিলো একটা রাজ প্রাশাদ, রাজা, একটা রানী, রাজকন্যা, তাদের সিংহাসন, তার পাশে একটা সুড়ঙ্গ, একটা জলকুপ, (যা ডেকোরেশনের সময় পানি দিয়ে রাখতে হয়), একটা অন্ধ বুড়ী লাঠি নিয়ে বসে৷ সব মিলিয়ে কোনো একটা কাহিনী তাতে আছে৷ যে দোকান থেকে কিনেছে সেখানে বসে সে এই কারেক্টার গুলোর ভয়ানক একটা গল্প শুনেছিলো৷ শুনতে শুনতে ভয়ে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো৷ ভয়ের হলেও গল্পটা তার খুব ভালো লেগেছিলো৷ তাই সে কাহিনীর পুরো সেটই কিনেছিলো৷ সে জিনিসটাই সে বন্ধুদের জন্য একটা একটা করে কিনেছিলো৷ সে ভেবেছিলো দেশে এসে বন্ধুদের ইনভাইট করে গল্পটাও বলবে গিফট গুলোও দেবে৷ কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়ায় তা আর হয়ে উঠেনি৷

এরই মধ্যে তার একটা ফোন আসলো, তার পাশের বাসার ভাবী বললো একসাথে মার্কেটে শপিং এ যেতে৷ সে ফুয়াদকে কল করে বললো, আমি একটু মার্কেটে যাচ্ছি৷

ফুয়াদ বললো আচ্ছা যাও৷ সাবধানে যেও। তোমার শরীর খারাপ কোরোনা। কোন সমস্যা হলে আমাকে কল দিও৷ আজ আমি মোটামুটি ঝামেলা মুক্তই থাকবো৷

যাওয়ার সময় পাশের বাসার ভাবীর জন্য নিয়ে আসা একটা গিফট সে একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে নিলো৷ ভাবীর সাথে শপিং শেষে বাসায় ফিরে আসার সময় গিফটটা ভাবীর হাতে দিতেই প্যাকেটের গিফটটা পাউডার হয়ে গেলো৷ (গিফটটা ছিলো পাথরের তৈরী একটা সুড়ঙ্গ)। এ ঘটনায় দুজনেরই মন খুব খারাপ হলো৷ সে বললো, ভাবী আমি অন্য একটা আপনাকে দিবো এটা আমি নিয়ে যাই৷ প্যাকেটটা এনে সে অন্য গিফট গুলোর সাথে টেবিলেই রেখে হাত মুখ ধুয়ে কাপড় চেঞ্জ করে টায়ার্ড হয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লো৷ তার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেলো৷ তখন বাজে বিকেল চারটে৷

সন্ধ্যায় ফুয়াদ বাসায় এসে দেখে স্নেহা ঘুমাচ্ছে৷ লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে ফুয়াদ বললো তুমি এখনও ঘুমাচ্ছো কেনো স্নেহা? তোমার কি শরীর খারাপ করেছে? স্নেহা ঘুম থেকে উঠে বসে খুব রাগান্বিত কন্ঠে ফুয়াদকে বললো, ওফফফ তুমি কেনো আমাকে এতো জোরে আঘাত করলে??? আমি অনেক কষ্ট করে এতদূর পথ পার হলাম৷ আমি প্রায় শেষ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলাম। তুমি কেনো আমাকে এতো জোরে বাড়ী দিলে? (যা তার স্বভাবের বাইরে ছিলো)৷ ফুয়াদ বুঝতে পেরে বললো আচ্ছা আচ্ছা তুমি ঘুমাও৷ তুমি বোধ হয় কোনো স্বপ্ন দেখছিলে। আমি অন্য ঘরে যাচ্ছি৷ ঠিক তখনই স্নেহার নজর পড়লো টেবিলের সে প্যাকেটের দিকে৷ দৌড়ে উঠে গিয়ে সে প্যাকেটের পাউডার হয়ে যাওয়া সুড়ঙ্গ টা বের করতে গিয়ে দেখে জোড়া লেগে একেবারে ঠিক হয়ে গেলো৷ এখন হঠাৎ তার মনে হলো সে ফুয়াদের সামনে৷ সে সঙ্গে সঙ্গে ফুয়াদকে বললো, তুমি কখন এলে? ফুয়াদতো অবাক। সে বলে উঠলো কি হয়েছে তোমার স্নেহা? প্লিজ স্নেহা তুমি আমাকে বলো কি হয়েছে তোমার৷ আজকাল তুমি হঠাৎ হঠাৎ কেমন যেন করো৷ আমি বুঝে উঠতে পারছি না তোমাকে নিয়ে আমি কি করবো। স্নেহা বলে আমিও কিছু বুঝতে পারছি না৷ (অথচ প্রতিদিন সে যখনই ঘুমায়, সে স্বপ্নে দেখে ওই রাজ প্রাসাদ থেকে কে যেনো কেঁদে কেঁদে তাকে ডাকছে৷ কিন্তু একটা অন্ধ বুড়ী তাকে কোনো ভাবেই যেতে দেয় না৷ শুধু লাঠি দিয়ে বাড়ী দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেয়৷ কিন্তু সে ফুয়াদকে কিছু বলে না৷ কারন ফুয়াদ ভয় পাবে৷ আর ভাবে নিজে নিজে সব ঠিক করে ফেলবে৷) রাতে খাওয়া দাওয়া করে তারা দুজন বেশ গল্প করলো৷ গান শুনলো। নিজেদের মধ্যে বেশ অন্তরঙ্গ কিছু সময় কাটালো৷ তারপর গল্প করতে করতে তারা দুজন ঘুমিয়ে পড়লো৷

মাঝ রাতে কুকুরের চিতকার শুনে ফুয়াদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। পাশে তাকিয়ে দেখে স্নেহা বিছানায় নেই৷ উঠে গিয়ে সারা ঘরে চেক করে দেখে স্নেহা কোথাও নেই৷ ডাকাডাকি করে বুয়াদের জাগালো৷ ফুয়াদের মাথা খারাপ হয়ে গেলো৷ সে ভেবে কুল পাচ্ছে না কি করবে৷ ফুয়াদ ভীষণ নার্ভাস প্রকৃতির লোক৷ সে তার বন্ধু ফায়সলকে ফোন করে আসতে বললো৷ ফয়সল আসার পরে সে এ কয়েকদিনের সব ঘটনা খুলে বললো৷ সব শুনে ফয়সল বললো, দোস্ত এটাতো অন্যরকম কেস৷ ফয়সলের কথা শুনে ফুয়াদ আরও ঘাবড়ে গেলো৷

হঠাৎ রুবিনা এসে বললো স্যার একটু ছাদে গিয়ে চেক করলে ভালো হয়৷ ভয়ে ভয়ে তারা সবাই ছাদে গেলো৷ রাত তখন তিনটা বাজে৷ সারা ছাদে খুঁজে পাওয়া গেলো না স্নেহাকে৷ সবাই ছাদে দাঁড়িয়ে আছে৷
হঠাৎ রুবিনা শুনতে পেলো ডুকরে ডুকরে কে যেনো কাঁদছে। তাদের ছাদের নীচের দিকে একটা বড় ফলস ছাদ আছে৷ সেখানে বসে সাদা শাড়ী পরে উসকো খুশকো চুলে কে যেনো দুলছে আর কাঁদছে, আবার বিড় বিড় করে কি যেনো বলছে৷

রুবিনা বললো স্যার ঐ যে আমাগো মেডাম৷

ফুয়াদ বলে উঠলো ধুর….ওখানে তোমাদের মেডাম কেমন করে যাবে? সে ছাদে যেতে হলে মই দিয়ে যেতে হয়৷ তবে সে সেখানে কেমন করে গেলো? তারপর আবার সেখানে অন্ধকার। তুমি কি পাগল?

কিন্তু রুবিনা কিছুতেই মানছে না৷ সে বুঝতে পেরেছে এটা তার মেডাম৷ কিন্তু কেউ সাহস পাচ্ছে না সেখানে যেতে৷ দারোয়ানকে ডাকা হলো৷ দারোয়ান টর্চ লাইট দিয়ে দেখে চিতকার করে বলে উঠলো… ওরে বাবারে… এটাতো ভুত বা পেতনি৷ আমি যাই, আমি নাই, আমি যাই, বলে সে ভাগবে ভাগবে এমন করছে৷

কিন্তু রুবিনা কোনো মতেই দারোয়ান কে যেতে দেবে না৷ পাশের বাসার কুকুরটা জোরে জোরে চিতকার করেই চলেছে। আশপাশের দারোয়ান কয়েকজন জড়ো হয়ে গেলো৷ তিন চার জন মিলে মই দিয়ে স্নেহাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে ঘরে আনলো৷

তখন স্নেহার কোনো জ্ঞান ছিলো না৷ ঘরে এনে মাথা ধোয়ানোর পর তার জ্ঞান ফিরলো৷ খাদিজা বুয়া আর রুবিনা মিলে তার কাপড় বদলে দিলো৷ সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। খাদিজা বুয়ার হাত ধরে স্নেহা বললো, বুয়া প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না৷ আমায় একটু ঘুমাতে দাও৷ আমি আর পারছি না৷

রুবিনা এসে ফুয়াদ আর ফয়সল দুইজনকে বললো,
স্যার বেয়াদপি নিয়েন না৷ মেডামরে ভুতে ধরছে৷ আমগো বাইত অলি মিঞার কাছে নওন লাগবো৷ হ্যেয় সব ঠিক কইরা ফালাইবো৷ স্যার আমি ছুডু মানুষ অইলেও অইতে ফারি৷ কিন্তু আমার কতাখান চিন্তা কইরা দেইক্ষেন৷ মেডামের যে অবস্থা, আর দেরি করলে উনারে বাচাইতে ফারতেন না৷

কাঁদতে কাঁদতে সে বলছে…
আহারে আমাগো এত্তো বালা মেডামডার কি অইলো…

চলবে…