লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব-১)

Photo of author

By Zeenat Alam

আজকাল স্নেহা প্রায়ই অসুস্থ্য থাকে৷ সন্ধ্যা হতেই মাথাটা ধরে আসে তার৷ সপ্তাহ দুয়েক আগে সে রাতে খুব ভয় পেয়েছিলো৷ জানালায় গিয়ে তার হাত কেটে গিয়ে রক্তারক্তি হয়ে গিয়েছিলো। অথচ সে জানেই না কেন এমন হয়েছে৷

সেদিনের পর থেকে তার একটা নতুন জিনিস বাসার সবাই লক্ষ্য করছিলো, সন্ধ্যা হলেই সে খুব সাজগোজ করে৷ গান গায় গুনগুন করে৷ বিকেল তিনটা চারটার দিকে ছাদ বাগানে চুল ছেড়ে হাঁটাহাটি করে৷ আগে কখনও তাকে এ ভাবে চুল ছেড়ে হাঁটাহাটি করতে কেউ দেখেনি৷ আরেকটা নতুন জিনিস সবাই লক্ষ করেছে, সে একেবারেই চুলার কাছে যায় না৷ চুলার কাছে গেলেই সে অস্থির অস্থির হয়ে কিছুক্ষনের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে৷ অথচ আগে প্রতি শুক্রবারে নিজে বাজার করে এনে সবার জন্য রান্না করতো৷ সবাই ভেবেছিলো হয়তো, সেদিনের কারনে সে একটু অসুস্থ্য হয়ে পড়েছে তাই এমন করছিলো।

আজ স্নেহা একেবারে অন্যরকম কিছু করছে৷ লাল শাড়ি পরেছে৷ লাল টিপ পরেছে৷ হাত ভরে কাঁচের চুড়ি পরেছে। খুব সেজেছে৷ গুনগুন করে গান গাইছে৷ ফুয়াদ অফিস থেকে এসে দেখেতো অবাক৷

কি ব্যাপার কোথাও যাবে নাকি তুমি স্নেহা?

কেন? তুমি না কাল রাতে আমায় বললে ডিনারে নিয়ে যাবে আমায়? তুমি বললে লাল শাড়ি পরতে৷ টিপ পরতে। কাঁচের চুড়ি পরতে৷ তাইতো পরলাম এসব৷

ফুয়াদ বলে, আমি আবার কখন বললাম?

স্নেহা হঠাৎ খুব রেগে মেগে চিতকার চেচামেচি শুরু করে দিলো, যা কখনই সে করেনি। আশেপাশে বেশ কয়েকটি কাচের জিনিস সে ভেঙে ফেললো৷ ফুয়াদ বুঝে উঠতে পারছিলো না তার এখন কি করা উচিৎ। সে বললোঃ
আচ্ছা চলো৷ আমরা ডিনারে যাবো৷

স্নেহা চেচামেচি করেই চললো। বলছিলো, না আমি এখন আর যাবো না৷ বলতে বলতে হঠাৎ সে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলো৷ ফুয়াদ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে স্নেহার দিকে৷ আর ভাবছে এটা কি হচ্ছে স্নেহার সাথে!!! বুঝে উঠতে পারছে না সে কি বলবে এখন৷ এবার স্নেহা কাঁপতে শুরু করলো। কাঁপতে কাঁপতে এক পর্যায়ে সে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলো৷ ফুয়াদ তাড়াতাড়ি তাকে ঠিক মতো শুইয়ে দিলো। কাজের বুয়া রুবিনাকে ডেকে সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষন হাতে পায়ে তেল মালিশ করে মাথায় পানি দিলে পরে তার জ্ঞান ফিরলো৷ জ্ঞান ফিরার পর তাকে যখন ফুয়াদ জিজ্ঞেস করলো কেন সে অমন করেছিলো, সে অবাক। সে জানেই না সে কি করেছে৷ সে বলে অসম্ভব আমি কেন এমন করবো? উলটো সে নিজেই প্রশ্ন করে বসলো, ওমা!!!! এসব আমাকে কে পরালো? বিছানা সোজা আয়নাতে নিজেকে দেখে সে বারবার ফুয়াদকে বলছিলো, বলোনা, কে আমাকে এমন করে সাজালো? এখন ফুয়াদের মনে একটা ভয় কাজ করতে লাগলো৷ সে ভেবেই নিয়েছে, স্নেহাকে নিয়ে সিঙ্গাপুরে ডাক্তার দেখাতে যাবে৷ স্নেহার নিশ্চয় কোন মানসিক সমস্যা হয়েছে৷

স্নেহা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লো। বাইরে আর গেলো না তারা৷ রাতে ডিনার শেষে সবাই শুয়ে পড়লো৷ স্নেহাও শুয়ে পড়লো৷ ঘুমিয়ে পড়েছে স্নেহা। বেশ কিছুক্ষন ফুয়াদ স্নেহাকে দেখলো। ফুয়াদের চোখের ঘুম পালিয়েছে৷ সে ভাবছে তার এতো সুখের সংসার, এতো ভালো লক্ষি বউ। কি হলো হঠাৎ তার৷ ভাবতে ভাবতে একসময়ে ফুয়াদ ঘুমিয়ে পড়লো।

রাত প্রায় তিনটা৷ পুরো ঘর জুড়ে নীরবতা৷ স্নেহা আস্তে করে উঠে দরজা খুলে বের হলো৷ তার খুব পিপাসা পেয়েছে৷ সে ফ্রিজ খুলে পানি খেলো৷ তারপর ফ্রীজ থেকে মিষ্টির প্যাকেট বের করলো। প্রায় এক কেজির মতো মিষ্টি ছিলো বক্সে৷ বক্সটা নিয়ে আস্তে করে লিভিং রুমে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসলো৷ তারপর কার সাথে বসে খুব গল্প শুরু করলো৷ খুব হাঁসছে হা হা করে আর সমানে রাখা মিষ্টি গুলো খেয়ে যাচ্ছে।

স্নেহা যখন ফ্রীজ খুলে পানি নিচ্ছিলো, শব্দ শুনে কাজের বুয়া রুবিনা উঠে এসেছিলো৷ সে চুপিচুপি স্নেহাকে ফলো করলো। সে গ্লাসের দরজায় একপাশ থেকে সব দেখছিলো৷

স্নেহা বেশ হেঁসে হেঁসে কার সাথে গল্প করছে আর সব মিষ্টি গুলো খেয়ে শেষ করে ফেলছে। দেখে রুবিনা ভাবলো খালাম্মা এতো ডায়টিং করে৷

যেই মানুষ কত কষ্ট কইরা ডাইটিং করে, অহন এত্তগুলান মিষ্টি খাইতাছে৷ আমি যাই, মানা করমু অহন৷ নয়তো সক্কালে আমারে কইবো মানা করিনাই ক্যান৷

লিভিং রুমের দরজার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই লিভিং রুম থেকে বড় একটা কাঁচের ফুলের টব এসে পড়লো রুবিনার মাথায়৷ রুবিনা ও খালু….গো….. বলে চিৎকার করে মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। রুবিনার চিৎকারে ফুয়াদের ঘুম ভেঙে গেলো৷ ঘুম ভেঙে দেখে স্নেহা পাশে শুয়ে আছে৷ স্নেহা স্নেহা বলে কয়েকবার ডেকে দেখলো, বেচারা গভীর ঘুমে মগ্ন। তাই কিছুক্ষন চুপ করে আর কোন শব্দ হয় কিনা অবজার্ব করতে করতে ফুয়াদ আবার ঘুমিয়ে পড়লো৷

সকালে খাদিজা বুয়া ঘুম থেকে উঠে ননদিনী রুবিনাকে খুঁজে না পেয়ে ঘরের দিকে আসতেই সে চিতকার ও খালাম্মা ও খালু দেইক্ষা যান!!! আয় হায় হায় কি সর্বনাশ অইয়া গেছে!!!

সে রীতিমতো বিলাপ করেই যাচ্ছে৷
আমার অহন কি অইবো…
আমার হউড়ির বহুত আদরের মাইয়ারে আমি কইয়া বইল্লা লইয়া আনছিলাম…
অহন হ্যায় মইরা গেছে…
ও খালুজান…
ও খালাম্মা…
রক্তের সাগর অইয়া যাইতাছে৷ আফনেরা তত্তরি আহেন৷

চিৎকার চেচামেচি শুনে স্নেহা আর ফুয়াদের ঘুম ভেঙে গেলো৷ তাড়াতাড়ি নীচে নেমে এসে দেখে রুবিনা মাটিতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে৷ তার কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে৷ তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে ডেকে গাড়ি বের করিয়ে রুবিনাকে নিয়ে গেলেন স্কয়ার হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে৷ ডাক্তাররা বললেন মনে হয় ওর মাথা ফেটে গেছে৷ সিটি স্ক্যান করতে হবে৷ এখন ডাক্তারের প্রশ্ন কি দিয়ে মাথা ফেটেছে৷ কেউ কিছু বলতে পারছে না৷ এ ঘটনা দেখে তখন ডাক্তার বললেন এটাতো পুলিশ কেস৷ আমি কোন চিকিৎসা করতে পারবো না৷ লেগে গেলো ঝামেলা৷ থানায় জানানো হলো৷ হয়ে গেলো পুলিশ কেস৷

এদিকে রুবিনার চিকিৎসার পর যখন তার জ্ঞান ফিরেছে। চোখ খুলতেই সে দেখে পুলিশ তার সামনে৷ পুলিশের পাশেই স্নেহা দাঁড়িয়ে। স্নেহাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার গত রাতের সব ঘটনা মনে পড়ে গেলো৷ পুলিশ বললো, আপনারা সবাই বাইরে যান৷ রোগীর সাথে আমি কথা বলবো৷ তারপর আপনারা আসবেন৷

পুলিশ রুবিনাকে জিজ্ঞেস করা শুরু করলো, তোমার মেডাম স্যার কেমন মানুষ?

ও স্যার খালাম্মা খালু খুব ভালা মানুষ। তেনাগো মতো মানুষ অয় না৷ তয় খালাম্মার শরীরডা বালা না কয়দিন ধইরা৷ আমারে তত্তরি ছাইড়া দেন৷ খালাম্মার লইয়া আমাগো গেরামে ওলিদ মোল্লার কাছে নিতো অইবো৷ আমারে ছাইড়া দেন৷ আমার খালাম্মার লগে আমার কতা কওন লাগবো৷

পুলিশ স্নেহাকে ভেতরে ডাকলো৷ স্নেহাকে দেখে রুবিনা একটু ও ভয় পেলো না৷ সে ততক্ষণে বুঝে ফেলেছিলো স্নেহার কি হয়েছে৷ সে স্নেহাকে বললো,
খালাম্মা আফনে কিমন আছইন? স্নেহা বললো ভালো৷ বলেই সে রুবিনাকে জড়িয়ে ধরে বললো, কিন্তু তোমার কি হয়েছিলো রুবিনা? মাথা ফাটালে কি করে৷ রাত বিরাতে কে তোমার মাথা ফাটালো? এখন ভয়ে আর রুবিনার মুখ থেকে কোন কথা হচ্ছে না৷ সে জানে৷ পুলিশের সামনে কাল রাতের কথা বললে স্নেহাকে পুলিশ এরেস্ট করে নিয়ে যাবে৷ স্নেহা আর রুবিনার কথা বার্তা দেখে পুলিশ বের হয়ে চলে গেলো৷

তারপর রুবিনাকে রিলিজ করে নিয়ে ওরা বাসায় ফিরলো৷

চলবে…