ফুয়াদের ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে যেতে হবে এ সপ্তাহে৷ উপায়ান্তর না দেখে বন্ধু ফয়সালকে কল দিয়ে বললো – দোস্ত, যে ভাবেই হোক আতর আলীকে আনার ব্যাবস্থা কর৷ আমি আর পারছি না৷
হসপিটালে থাকা কালীন শারীরিক অসুস্থতা ছাড়া স্নেহার সাথে ভয় জনিত আর কোনো ঘটনাই ঘটেনি৷ চার পাঁচটা দিন বেশ ভালোই কাটিয়েছে স্নেহা৷ এ চার পাঁচ দিনে স্নেহা পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠেছে৷ স্নেহাকে বাসায় নিয়ে আসা হোলো৷
এদিকে ফুয়াদের কথা অনুযায়ী সেই অজপাড়া গাঁও কোদাল কান্দি থেকে আতর আলীকে নিয়ে আসলো ফয়সাল৷ আতর আলীর কাঁধে সবসময় একটা কোদাল থাকে৷ আর সে পরে বড় এক আলখাল্লা৷ সে আলখাল্লার পকেটে থাকে কয়েক রকমের সুগন্ধি আতর৷ এই কারনেই তার গ্রামের নাম কোদাল কান্দি। আর তার নাম আতর আলী৷ সে অনেক মানুষের অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছে৷ তার গ্রামে তার বেশ সুনাম।
আতর আলী এসেই বাসার সামনে কোদাল দিয়ে বড় একটা গর্ত করলো। স্নেহা হসপিটাল থেকে এসেই বাসার সামনে গর্ত দেখে খুব রাগ হয়ে গেলো৷ রীতিমত চিল্লাচিল্লি শুরু করলো।
আতর আলী বললো – মনু, ও মনু, চিল্লাইয়া কাম নাইককা৷ হগলডিরে গর্তে ভরমু মুই৷ বহুত কয়ডি ভিত্রে বইয়া রইছে আফনের অফেক্কায়৷ আহেন আহেন৷ আতর আলীর লগে বাটফারি? ছলবো না এসব বাটফারি৷ এত্ত সাহস কারোর নাইক্কা৷
আতর আলীর কথার ধরন স্নেহার মোটেই পছন্দ হলোনা৷ সে ফুয়াদকে বললো, এই লোকটাকে এক্ষুনি ঘর থেকে বের করো৷ আমার গায়ে ভীষণ জ্বালা করছে৷
গায়ে জ্বালা করার কারন কিন্তু অন্য৷ আতর আলী এসেছে দুদিন হয়েছে৷ স্নেহা তা জানেনা৷ এরই মধ্যে আতরয়ালী তার কাজ কিছুটা শুরু করে দিয়েছে৷
স্নেহার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ শ্বাস নিতে পারছে না৷ বার বার পানি খাচ্ছে৷ আবার বমিও করছে৷ সমস্ত শরীর তার জ্বালা করছে৷ সে রীতিমতো ছটফট করছে। সে ঘুমাতে চাইছে, কিন্তু ঘুমাতে পারছে না৷ ডাক্তার বলেছে স্নেহাকে কোনো রকম টেনশন দেয়া যাবে না৷ সে অসম্ভব রকম দূর্বল হয়ে গেছে৷
ফুয়াদের বোন ফারা স্নেহাকে এবং ফুয়াদকে ভীষণ আদর করে৷ স্নেহা ফারাকে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলো, আপা আমার গা এমন জ্বালা করছে কেনো? কখনও এমনটা হয়নি আমার৷ আপা ওই লোকটা কে? ওই লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে৷
স্নেহার কষ্ট তার কোনো ভাবেই সহ্য হচ্ছে না৷ সে বললো, স্নেহা তুমি ঘুমাও৷ আমি তোমার পাশেই আছি৷ একটুও নড়বো না৷ কিছুক্ষনের মধ্যে স্নেহা ঘুমিয়ে পড়লো৷ বেলা তখন তিনটা৷
এদিকে আতর আলী সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করছে। স্নেহাদের বাসার কয়েকটা বাসা পরে একটা কবস্থান আছে৷ সেখানে ৭/৮ জনের কবর আছে৷ সেটা কারোর পারিবারিক কবরস্থান৷ আগে থেকে তাদের অনুরোধ করে সে কবরস্থানে একটা আসন তৈরী করা হলো আতর আলীর জন্য৷ আজ রাতে আতর আলী স্নেহার কাছ থেকে সব কথা বের করবে৷ তারপর সারারাত ওই কবরস্থানে গিয়ে বাকী কাজ করবে৷ তবে গত দু-দিনও আতর আলী ওই কবরস্থানেই রাত কাটিয়েছে৷ এমনিতেই আতর আলী বেশীর ভাগ সময় কবরস্থানেই থাকে৷
আতর আলী বললো, মগ্রিবের আযান ফড়নের লগে লগে আফনেরা হগলতে মেডামরে একা থুইয়া নীচের ছুডো ঘরে গিয়া বইবেন৷ বাকী কাম আমি সামলামু৷ আর ফিরিজের মইধ্যে কিছু মিষ্টি আইননা থুইয়েন৷ আতর আলীর কথা অনুযায়ী তিনটা ছাগল আর ৪০ গজ লাল শালু কাপড় কিনে গর্তে বিছিয়ে রাখা হয়েছে৷
ফারা বললো, হুজুর স্নেহার শরীরের কোন ক্ষতি হবে না তো?
আতর আলী ফারার গায়ে আতর ছিটিয়ে দিয়ে বললো, হোনেন। মনে করেন মেডাম আমার নিজে মাইয়ার লাহান৷ কোনো চিন্তা কইরেন না৷
মাগ্রীবের আযানের সঙ্গে সঙ্গে আতর আলীর কথা অনুযায়ী সবাই গেস্ট রুমে চলে গেলো৷ দোয়া কালাম পড়ছে৷ কিন্তু রুবিনা মেডামের মায়ায় পড়ে সে রুমেই চুপ করে এক কোনায় বসে রইলো৷ আর চুপি চুপি দেখছে স্নেহা কি কি করছে৷
স্নেহার ঘুম ভাঙলো৷ সে কার সাথে যেন কথা বলছিলো৷ তারপর উঠে সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ একটা লাল শাড়ী আগে থেকেই আতর আলীর কথা অনুযায়ী রুমের চেয়ারে রাখা ছিলো৷ স্নেহা সেই শাড়ী পরলো৷ গুনগুন করে গান গাইছে৷ আর কার সাথে যেন ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে খুব সুন্দর করে সাজলো৷ এদিকে মেডামের এসব কান্ড দেখে ভয়ে রুবিনা কাঁপছে৷ স্নেহা আস্তে করে দরজা খুলতেই পেছন ফিরে হাতটাকে লম্বা করে চিপায় রুবিনাকে মাথার উপর একটা লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে নীচে লিভিং রুমের দিকে গেলো৷ ঢুকেই সে দেখলো আতর আলী লাল পাগড়ী পরে সোফায় পা তুলে বসে আছে৷ স্নেহা লিভিং রুমে ঢুকতেই আতর আলী তার গায়ে আতর ছিটিয়ে বললো, আমার সামনে এইখানে বস৷ স্নেহা চুপচাপ বসে পড়লো৷
এবার আতর আলী বললো – তুই কে?
স্নেহা কিছু বলে না৷
আতর আলী কোদাল দিয়ে ফ্লোরে একটা কোঁপের মতো দিতেই স্নেহা বলে উঠলো – আমি রাজকুমারী লুইয়ান।
এখানে কি করিস তুই?
আমি আমার প্রিয়তম জায়ানকে উদ্ধার করতে এসেছি।
কিভাবে উদ্ধার করবি তুই? এখানে কোথায় পাবি তুই তোর জায়ানকে?
স্নেহা অনেক চেষ্টা করছে মনে করতে৷ কিন্তু কোনো ভাবেই পারছে না৷ সে হাউ মাউ কারে কাঁদছে।
আতর আলী আবারও আতর ছিটালো৷
এবার স্নেহা চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, আমি তার নাম আর বলবো না৷ তার নাম বললে আমার পিতা তাকে মেরে ফেলবে৷ আমি আগে আমার পিতাকে খুন করতে চাই৷ আপনি আমার পিতাকে খুন করেন৷ খুন করেন৷ বলে স্নেহা অজ্ঞান হয়ে পড়লো৷
আতর আলী আতর ছিটিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারলো না৷ ফুয়াদকে ডাকলো৷
ফুয়াদ আর ফারা এসে স্নেহার মাথায় পানি দিলো৷ আধ ঘন্টার মধ্যে স্নেহার জ্ঞান ফিরলো৷
আতর আলী আবার আতর ছিটালো খুব ভালো করে৷ আর চুপ করে বসে দেখতে লাগলো৷ ফুয়াদ আর ফারাও একটু দূরে বসে দেখতে লাগলো।
লিভিং রুমের এক কর্ণারে ওই ডেকোরেশন পিস গুলো সাজানো ছিলো৷ স্নেহা আস্তে করে গিয়ে কুয়ার মুখের সিন্দুকের ঢাকনা খুলে দিলো৷
এবার স্নেহা বলতে শুরু করলো, ঘরে মেহমান এসেছে৷ মিষ্টি কই? মিষ্টি আনো। কেউ কিছু দেখতে পেলো না৷ শুধু দেখলো, লিভিং রুমের টেবিলে একে একে মিষ্টি সাজানো হয়ে গেলো৷ একে একে পাঁচ কেজি মিষ্টি শেষও হয়ে গেলো৷ কিন্তু শুধু স্নেহাকে সবাই খেতে দেখেছে। অন্য মিষ্টি কে খেলো, কিভাবে খেলো কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না৷
এবার স্নেহা গান শুরু করলো, একটা ইংরেজি গান। আর খুব হাঁসছে৷ এ ভাবে বেশ কিছুক্ষন সময় পার হয়ে গেলো৷
আতর আলীর এত বছরের জীবনে এমন ঘটনা কখনোও দেখেনি৷
এশার আযান পড়ছে। স্নেহা কান্না শুরু করলো৷ খুব কাঁদছে৷
আতর আলী আতর ছিটিয়ে এবার স্নেহাকে সে আবার প্রশ্ন করলো, আমি যদি তোর বাপকে খুন করি তবে তুই খুশী হবি?
লুইয়ান বললো, শুধু আমার বাপ নয়৷ যে আমার প্রিয়কে বন্ধী করেছে তাকে খুন করতে হবে৷
আতর আলী বললো আচ্ছা করবো৷ তারপর তুই কি দিবি আমাকে?
লুইয়ান বললো, তুই যা চাস তাই দেবো৷
আতর আলী বললো, কিছু দিতে হবে না৷ শুধু এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবি৷ আর কোনোদিন এ বাড়ীর আশপাশেও আসবি না৷
লুইয়ান বললো – না, আমাকে আমার রাজ্যে পৌঁছে দিতে হবে৷
আতর আলী বললো, এটা সম্ভব নয়৷
লুইয়ান তখন বললো, আমাকে একটা নীরব জায়গায় রেখে আসতে পারবি?
আতর আলী জবাব দিলো হ্যাঁ।
এবার লুইয়ান বললো আমার বাপকে আমি খুন করবো৷
আতর আলী বললো – না, আমি খুন করবো৷
লুইয়ান বললো, এক কোপে খুন করতে পারবে?
আতর আলী বললো, হ্যাঁ পারবো৷ পারবো৷ তোর সামনে এক কোপে খুন করবো৷
আতর আলী স্নেহাকে নিয়ে তার বাসার সামনে যে গর্ত করেছে সে গর্তের সামনে নিয়ে গেলো। তারপর একটা ছাগলকে এনে কোদাল দিয়ে এক কোপে কেটে ফেললো৷
এটা দেখে স্নেহা অজ্ঞান আবার৷ ফুয়াদ আর ফারা এসে স্নেহাকে ধরে রাখলো। আতর আলী বললো, মেডামরে এইখানেই রাহেন৷ হ্যেরে দেখতে দেন৷ হ্যেয় সব দেখতাছে৷
তার পরপর বাকী দুইটা ছাগলকেও এক কোপে এক কোপে করে কেটে ফেললো কোদাল দিয়ে। চল্লিশ গজ লালশালু কাপড়ে পেঁচিয়ে তিনটা ছাগল নিয়ে ফয়সাল আতর আলীকে নিয়ে কবরস্থানের দিকে রওয়ানা হলো৷ সাথে নিয়ে গেলো গ্রীস থেকে নিয়ে আসা সে ডেকোরেশনের জিনিস গুলো।
এদিকে কোনোভাবেই স্নেহার জ্ঞান ফিরছে না৷ খাদিজা বুয়া ফারা আর ফুয়াদ মিলে স্নেহাকে তার রুমে নিয়ে আসলো৷ এদিকে সবাই এসে দেখে রুবিনা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে৷ গাড়ী পাঠানো হলো ডাক্তারকে৷ ডাক্তার আসার পর স্নেহাকে কিছু চেকাপ করে বললো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্নেহাকে নিয়ে যেনো বিদেশে চলে যায়৷ খাদিজা বুয়া রুবিনার মাথায় পানি ঢেলে তাকে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো৷
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী স্নেহার জ্ঞান ফিরে আসার আগেই ঘরের সব আলামত ঠিক করে ফেলা হলো। স্নেহার কাপড়ও বদলে দেয়া হলো।
ঘন্টা খানেক পরে স্নেহার জ্ঞান ফিরলো৷
জ্ঞান ফিরার পরে স্নেহা ফারাকে দেখে বললো, আপা আপনি কখন এলেন? ওমা ফুয়াদ তুমি আমাকে বলনি কেন যে আপা আসবেন৷ এই দু মাসে স্নেহার সাথে কি কি ঘটেছে তার কিছুই মনে নেই৷
এক সপ্তাহের মধ্যে স্নেহাকে নিয়ে ফুয়াদ আর ফারা সিঙ্গাপুরে চলে গেলো। এই পুরো নয় মাস স্নেহা আর ফারা সিঙ্গাপুরেই ছিলো৷ ফুয়াদ আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলো৷ এর মধ্যে ফুয়াদ গুলশানে একটা বাড়ী কিনে সাজিয়ে নিলো৷
নয় মাস পর জমজ বাচ্চাদের নিয়ে স্নেহা দেশে ফিরলো৷ তাদের মধ্যে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। গুলশানের বাসার সামনে গাড়ী পার্ক করতে দেখে স্নেহা বললো, ফুয়াদ এ কার বাসায় তুমি আমাদের নিয়ে এলে?
ফুয়াদ বললো, স্নেহা আমাকে তুমি একটা রাজকুমার আর রাজকুমারী উপহার দিয়েছো। আর আমি তোমায় এ বাড়ী উপহার দিলাম৷
ফুয়াদের কথায় স্নেহার হঠাৎই মনে পড়লো। ফুয়াদ, আমার এক মেয়ের নাম রাখবো লুইয়ান। আর ছেলের নাম কিন্তু তুমি রাখবে৷ ফুয়াদ বললো, আচ্ছা, ছেলের নাম জায়ান৷