স্মৃতিকথার কিছু অংশ

Photo of author

By Fatema Hossain

বসন্তের এত্তো সুন্দর এই দিনের শুরুতেই আজ আমার মনে শুধুই শৈশবের মজার মজার স্মৃতিভেসে উঠছে। কাঁসারিপাড়ার বাড়িটা ছিল ছোট্ট মফস্বল শহরে র মাঝ খানে।’বাড়ির ছিল দুটো দরজা। সদর দরজা ছিল পুরনো হিন্দুদের বাড়ির মত কাঠের খিল দিয়ে আটকানো।ওটা রাতে সবাই ঘরে ফেরার পর ছিটকিনি আটকে দেয়া হত। আর ভোর বেলায় মা নামাজ পড়ে গিয়ে খুলে দিতেন। কেনন সকাল হলেই ভিখিরি অথবা পাড়ার অনেকে আসতো। সারাদিন খোলা থাকতো।সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে ই বামপাশে একটা বড়ো বাতাবি লেবু গাছ ছিল। লেবুগাছ টা ফেলে মাঝারি উঠান পেরিয়ে ভিতর বাড়িতে ঢুকতে হত।ভিতরের উঠান টা অনেক বড়ো ছিল। অনেক গুলো সম্ভবত নয় টা নারিকেল গাছ, একটা বরই গাছ, আর গোসলখানার সাথে একটা বিরাট পেয়ারা গাছ ছিল। পেয়ারা গাছের তলায় একটা ছোটো গেট দিয়ে খালেক ভাইয়ের কাঠের দোকান দিয়ে মেইন রোড এ উঠা যেত।আর গেট টার সাথে হিরক ভাইদের বাড়িতে যাবার একটা দরজা ছিল।উনারা ওই দরজা দিয়ে আমাদের উঠান পেরিয়ে এ বাড়ির আরেকটা দরজা (যা মোল্লা বাড়িতে যাবার দিকে)হাকিম ভাইদের উঠান পেরিয়ে মোল্লা বাড়ি আর পাড়ায় যাওয়া যেত। হিরোক ভাইয়ের আম্মা, বোনেরা এই দরজা ইউজ করতেন ওনার বড়ো চাচার বাড়ি যেতেন।কত মধুর ছিল সেইসব দিন। আর মানুষ গুলো ছিল সোনার মানুষ।

বাড়িটার ঘরে উঠার জন্য দুই দিকেই ছিল দুটো করে পৈঠা। বেশ উঁচু।দু দিকেই বারান্দা। বেশ চওড়া।সদরের দিকে সিঁড়ি ঘর আর দোতলায় একটি ঘর একটি বারান্দা আর সামনে খোলা ছাদ।পিছনের বারান্দাটা বেশ বড়ো হলেও খোলা ছিল। মা একপাশে কাঠের চুলায় রান্না করতেন। আরেক পাশে সকাল বেলায় পাটি বিছিয়ে আমরা তিন ভাইবোন জোরে জোরে পড়তাম। কেননা ভিতরে চেয়ার টেবিলে পড়লে ফাঁকি দিতে পারি আর মায়ের সামনে পড়লে মা ভুল সংশোধন করে দিতেন তাই।বাড়িতে ইলেক্ট্রিসিটি ছিলো না।গরমের সময় আমরা মশারী টাংগিয়ে এখানেই ঘুমাতাম আবার ছাদেও ঘুমাতামকোনো দিন কোনো অঘটন ঘটেনি।কত শান্তির ছিল সেসব দিন।বিকাল হলেই প্রতিবেশী সমবয়সী বন্ধু বান্ধবী রা আসতো আমরা সবাই মিলে গোল্লাছুট চি বুড়ি খোলামকুচি খেলতাম।ডাংগুলি ও খেলা হতো। কখনো কখনো আসাদ কবিরাজ খালুর বিশাল বাগান বাড়িতে খেলতাম। উনার মেয়ে, দিলারা গুলশান আরা, ওদিকে উল্কা,মঞ্জু,টুনটুনি আফসন, ছেলেরাও ছিল। আজ আর সবার কথা মনে নেই। কখনো সিও সাহেবের বাড়িতে।

একটা জিনিস খেয়াল করি সেসময় না কোনো উঁচু নীচু ভেদাভেদ ছিল না। রমজান রিক্সা ওয়ালার মেয়েও আমাদের সাথে খেলতো।আমাদের বাড়িতে কাজে সাহায্য করতো যারা তারা ও তাদের ছেলেমেয়েরা অনায়াসে সবাই সবার বাড়ি যেত।

সদর দরজা দিয়ে বের হলে ডানে মেইন রোড আর বামে ভৈরব নদ তার আগে কাউসার মিয়ার বিশাল বাগান। ঐ বাগানে ঝড়ের দিনে আমরা সবাই আম কুঁড়োতে যেতাম।আমাকে আমার ভাইয়েরা নিতে চাইতো না তারপর ও নিয়ে যেত।শীতের শেষে এই রকম সময়ে ভৈরব এ পানি শুকিয়ে গেলে মাছ ধরার হিড়িক পড়ে যেত।কোন ভোরে উঠে মেজ ভাই আব্দুর রহমান তার বন্ধু দের নিয়ে মাছ ধরতে চলে যেতেন। একটু আলো ফুটলে সেজভাইয়া মিজান আর ছোট ভাইয়া মুস্তাক ও চলে যেত।মাঝে মাঝে বায়না ধরে আমিও যেতাম ওদের সাথে।মাছের খলুই ধরে রাখতাম।

এরকমই একদিন আমার পায়ে জোঁক লেগে গেল আমি তো সাপ মনেকরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলাম। এই দেখে ভাই এরা কি করবে বুঝতে পারছিল না এমন সময় আঞ্জু আপার বোন রানু আপা এসে ওর সাথে রাখা গামছা দিয়ে টেনে জোক টাকে ছাড়িয়ে দিল।গলগল করে রক্ত পড়া শুরু করলে তার গামছা ছিড়ে বেধে দিয়েছিল।এরপর ভাইয়েরা আমাকে কাঁধে করে নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল।

বাড়ির সদর দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে রাজপথ। সেখান দিয়ে রিকশা যাতায়াত করতো। এই বাড়ির মালিকের রাস্তার সাথে ই আরেকটি বাড়ি আর কতকগুলান দোকান ছিল।বাড়িটি সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার এর পরিবারের থাকার জন্য ব্যাংক ভাড়ায় নিয়ে রেখেছিল। যেহেতু আমাদের টার সাথে যুক্ত ছিল তাই অনেক গুলো ম্যানেজার পরিবারের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ হয়েছিল। তাদের স্ত্রী কন্যা পুত্রেরা অনায়াসে আমাদের সাথে মিশে চলতো।সামনে র দোকান গুলোর মধ্যে একটা মাইকের দোকান ছিল। সেখানে সকাল থেকে শুরু হয়ে সারাদিন গান বাজ তো।বিশেষ করে গার্লস স্কুলের মেয়েরা যখন দলবেঁধে স্কুলে যেত আর ফিরতো তখন বেশি বেশি বাজাতো। বলে রাখা ভাল। ওই সময় গরীব বড়ো লোক সবার মেয়েরা বেশির ভাগ ই পায়ে হেটে স্কুলে যাওয়া আসা করতো।

গান গুলো সব ভারতের হিন্দি আর বাংলা।বাচুপান কা দিন, মার ঝাড়ুমার, বড়োলোকের বেটি লো ইত্যাদি ইত্যাদি। আব্দুল জব্বারের সালাম সালাম ও বাজতো।আবার শাহনাজ রহতুল্লাহ,সাবিনা ইয়াসমিন এর দেশের গানও বাজাতো।

প্রতিদিন বিকালে সন্ধ্যা য় ওখানকার এলিট শ্রেণীর মানুষের বউ মেয়েরা রাস্তায় হাটাহাটি করতো।হুদাসাহেব তার স্ত্রী, আহমেদ সাহেবের স্ত্রী ও বোন তাদের দুই মেয়ে ওরকম আরও অনেকেই সান্ধ্য কালীন ভ্রমণে বেরোতেন।পথে দেখা হলে মুচকি হাসি কুশল বিনিময় হতো।মেহেরপুর এর মেইন রোড টা আমার খুব প্রিয় ছিল।শান্ত, মিউনিসিপালিটি র রাস্তায় কদম গাছ ছিল। গার্লস স্কুল, পার্ক অথবা মিউনিসিপালিটি র সামনে মাঝে মাঝে সাপের খেলা,বানরের খেলা দেখাতো।আমরা নিজ কাজ ভুলে খেলা দেখায় মেতে উঠতাম। এটা আমার সেজ ভাই মিজান বেশি করতো। হয়তো তাকে বাজারে পাঠানো হয়েছে সে তখন তা ভুলে গিয়ে খেলা দেখায় মত্ত হয়ে যেত। আর তার জন্য দেরি করে ফিরলেই মার খেতো। বড়ো বাজারের দোকান পাট খুব ভালো লাগতো।মাঝে মধ্যে লুকিয়ে বন্ধুদের সাথে গড়ে গোসল করতে যেতাম। বাড়িতে ধরা খেলে বকুনি শুনতে হতো। লিজ্জু ভাইদের বাড়িতে একটা খুব সুন্দর পুকুর ছিলো। ওনার বোন জলি মিনি আমার বন্ধু ছিল। অনেকদিন ওখানে ও গোসল করেছি সাতার কেটেছি।

লিজ্জু ভাইদের বাড়িতে যেতে আমার খুব ভালো লাগতো।ওনাদের দুই মা, আর অনেক গুলো ভাইবোন ছিলো। কিন্তু কি মজার ব্যাপার। দুই মায়ের ছেলে মেয়েরা কি সুন্দর একসাথে বন্ধুর মতো মিলেমিশে থাকতো। বাইরের বন্ধুর দরকার হতোনা তাদের।
বাবু ভাই ছিল মেজভাই রহমানের বন্ধু।লিজ্জু ভাই এর বউ কে আমার আপা ডাকতাম।অসম্ভব সুন্দরী রতু আপা আমার বড়ো বোন মহসীনা বু র কলিজার বন্ধু।

খুব ই অমায়িক ব্যাবহার। লুলু আপা তিথি আপা আমার খালাতো বোনের বান্ধবী ছিলেন।তারা আমারদের বাড়ি প্রায় ই আসতেন।কি মিস্টি ভাষি ছিলেন তারা।আমি মুগ্ধ হয়ে তাদের কথা শুনতাম।

রাস্তার উপর রুটি ওয়ালা চাচার বেকারি ছিল। তার পাশে বুঁচাদের বাড়ি। এরা হিন্দু পরিবার বুঁচারা অনেক গুলো ভাইবোন ছিলো। ওর মা কে আমরা যশো’দি বলে ডাকতাম। সকাল হলেই মা ব্যাগ আর চার আনা আট আনা পয়সা দিয়ে যশোদির কাছে পাঠাতেন বেগুন আনতে।উনি গৃহ কর্মে ব্যাস্ত থাকতেন তাই আমরা ই গাছ থে টাটকা বেগুন তুলে নিয়ে আসলে উনি মেপে দিতেন আমরা পয়সা দিয়ে নিয়ে আসতাম।

ফাতেমা হোসেন
১০/৫//২০২১