একজন নারী। পাঁচ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত অনেক আদরের। যখন আট নয় এ পা দিল মা বলল, এভাবে দাঁড়াবেনা
এভাবে হাঁটবে না। ওভাবে কথা বলবে না। এভাবে খাবে, ওভাবে নয়। যদি সে জানতে চায়, কেন? মা বলতো, তুমি মেয়ে মানুষ। তোমাকে জীবনের অনেক কঠিন কঠিন সময় পার করতে হবে। সবাইকে খুশী রাখতে হবে। সে বলে, কেন মা? তাহলে আমি কিভাবে খুশী থাকবো? মা বলেন, তুমি মেয়ে মানুষ। নিজের খুশীর কথা চিন্তা করা মেয়ে মানুষের কাজ নয়। সে বলতো কেন মা? মা বলতেন তোমার বিয়ে হবে৷ একদিন পরের বাড়ী যেতে হবে। সবাইকে তোমার খুশী রাখতে হবে। সবাইকে খুশী রাখতে পারলে তুমিও খুশী থাকবে। আর এটাই মেয়েদের জীবন।
সে ভাবতো আরেকটু বড় হয়ে নেই। বিয়ের পরে হয়তো আমি সবাইকে খুশী করে ফেলবো। নিজের একটা সংসার হবে। বাহঃ কি মজা৷ তার বিয়ে হবে৷ স্বামী হবে তার বন্ধু। আর বন্ধু থাকবে মানেইতো মজা। দুজন মিলে সিনেমা দেখবো শপিং… ইশশশ কি মজা। কত স্বপ্ন, কত্ত কত স্বপ্ন।
সময় এলো। বিয়ে হল। মা শিখিয়েছেন, খুশী রাখতে। চেষ্টায় নেমে পড়লো সে… দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। দেখে এতো আরও কঠিন জীবন! কেউ খুশী হয় না বা হলেও তা কেউ বলে না৷ আর তাই সেও খুশী নেই। এখন তো স্বামী, শশুর, শাশুড়ী, ননদ, ভাশুর আরও কত সম্পর্কে জড়িয়ে গেল সে। সবার খুশীর খেয়াল রাখতে হয় তাকে৷ সে তখন ভাবে, সবার খুশীর মাঝে আমার খুশী বুঝি একেবারেই তুচ্ছ। এখন তার মনে প্রশ্ন… খুশী? হুমহ্… সে আবার কি?
মায়ের শিক্ষা অনুযায়ী সম্ভ্রাম্ত পরিবারের মেয়েরা সংসারকে টিকিয়ে রাখতে শিখে।
তাই তখন তাকে নিজের শুধু খুশী নয়,
হাসি মুখে দুঃখকেও বরণ করে নিতে হয়।
তার মা তাকে শিখিয়ে দেয় তোমার কোন কষ্ট হলেও তুমি কাউকে তা বুঝতে দিও না৷ কোন ভাবেই সংসার ভাঙা যাবে না৷ নিজের মাকে দেখে সে মা হবার স্বপ্নও দেখতো৷ মা হতে গিয়ে যে কত কষ্ট তা ও সে দেখেছে৷ আর তাই মায়ের কথা মত তখন চলে তার শুধু টিকে থাকার লড়াই।
কারন হয়তো ততদিনে সে মা হয়ে গেছে। পিছে রেখে এসেছে, তার স্বজন। পরিবারের চাপে তাকে মেনে নিতে হয় সব অন্যায় শাসন। পিছে ফিরে তাকানোর কোন পথ নেই। নেই কোন সময়। বাবার বাড়ী থেকে নিয়ে এসেছে যেন বড় একটা দায়িত্বের বোঝা। সে দায়িত্ব পালন করতে হবে পুংখানু পুংখ ভাবে। কারোর মনে কষ্ট দেয়া যাবে না। নিজে কষ্ট পেলেও কোন ভাবে কারোর মনে আঘাত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। এটা তার মায়ের শিক্ষা।
আস্তে আস্তে পরিবার বড় হতে চলল।
ভারী হতে লাগল তার দায়িত্বের বোঝাটি। কোন আদর ভালবাসা পাওয়ার চিন্তাও তখন সে আর করতে পারেনা। এখন তাকে বেঁচে থাকতে হবে। তার স্বামী আর সন্তানদের জন্য। চলে শুধু বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই।
সে নারী
মেয়ে থেকে বৌ, বৌ থেকে আরও কত কি সম্পর্কে জড়িয়ে তারপর মা। আবার আশায় বুক বাঁধে। সন্তান বড় হয়ে তাকে তেমন করে ভালবাসবে। যেমন করে সে তার সন্তানকে ভালবেসে আঁকড়ে রেখেছে।
রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে তাকে আদরে আদরে ঘুম পাড়িয়েছে। তার অসুস্থতায় রাতের পর রাত জেগে সেবা করেছে, যেমনটি শিখেছে সে তার মাকে দেখে৷ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কত আদরে যত্নে নিজ হাতে সন্তানদের বড় করেছে।
এখন বড় হয়েছে সন্তান। মায়ের দায়িত্ব পালনে কোন রকম ত্রুটি না রাখা মা.. সে নারী হয়ে ভাবে এবার বুঝি কেউ তাকে ভালবাসবে। তার চাওয়া গুলো আর ইচ্ছা অনিচ্ছা গুলো বুঝবে। মা অসুস্থ্য হলে সন্তানরা অস্থির হয়ে যাবে, যেমন করে সে নিজে তার মায়ের জন্য অস্থির হয়ে যেতো৷ যেমন করে সে তার মায়ের সেবা করতো, তারা তেমন করে সেবা করবে ডাঃ এর কাছে ছুটোছুটি করবে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, যুগ পালটে গেছে৷ আর তাই হয়তো তার সে স্বপ্নও ধূলিস্বাৎ হয়ে যায়। তার জীবনে সেই সুন্দর সময়টি আর আসে না৷
নারীর দ্বায়িত্বের কোন শেষ নেই৷
আর তাই তাঁকে আবার আরেকটা দায়িত্বে পড়ে যেতে হয়…
যা হয়তো আবারও অন্য কারোর
চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব…
শত দায়িত্ব পালন করলেও তাকে বার বার পরিবরের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়৷ তা সবার কথায় বা কাজে তারা প্রমাণ করে দেয়… এমনকি কখনো তারা ভাবে এই নারীতো কোন কিছুই করেনি, করেছে সারাজীবন শুধুই রান্না বা ঘরের কাজ। আর এটাইতো নারীদেরই কাজ৷ তারা ভাবে শুধু কিছু টাকা ব্যয় করলেইতো এসব সুবিধা গুলো পাওয়া যেতে পারতো। আরও কত কি। আবার সে নারী যদি কর্মজীবিও হয়, তবুও সব ঘরের দায়িত্ব থেকে শুরু করে সন্তানদের লালন পালন সবই শুধু তাকেই পালন করতে হয়৷ তবুও সে নারী তার মায়ের উত্তম শিক্ষার সন্মান রেখে নিজের শত ব্যাথা ভুলে গিয়ে আবারও খুশী রাখার কাজে লেগে পড়ে। ততদিনে অবশ্য তা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়৷
তারপর সে নারী আবার আরেকটা নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তখন এ সম্পর্কটা তার কাছে জীবনের সব চাইতে দামী সম্পর্ক হয়ে যায়। সন্তানদের সন্তান। আর এ সম্পর্কের কাছে সে নারীর কোনই চাহিদা থাকেনা। সে শুধু বেঁচে থাকতে চায়। সে সম্পর্ককে ভালবাসা দিয়ে আগলে ধরে রাখবার জন্য। তখন সে নারী তার সে ভালবাসা দেবার জন্য পেছনের শত কষ্টকেও বুকে পাথর চাপা দিয়ে দেয়। সে শুধু অপেক্ষায় থাকে কখন সেই মুখ গুলো তার সামনে পাবে। তাদের ছুঁয়ে দেখবে। প্রাণ ভরে আদর ভালবাসা দেবে।
আচ্ছা…
কেউ কি কখনো জানতে চেয়েছে?
হে নারী তুমি এজীবনে কি কি পেয়েছো?
আর কি কি হারিয়েছো?
কেউকি জানতে চেয়েছে, এতটা বছর পার করেছো কিভাবে?
তোমার জীবন গল্পটা কি হে নারী?
জেনে কি হবে???
সে একজন নারী, তার আবার কি জীবন গল্প?
তার আবার এত ভালবাসা পাবার কি আছে?
তার আবার নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের কি আছে?
না… না কেউ জানতে চায় নি৷
চাইবেও না৷
সে শুধুমাত্র একজন নারী।
তার ভালোবাসা পাবার কোনই প্রয়োজন নেই৷
অনেক প্রতিভা আছে।
কিন্তু বিকাশে বাধ্যবাধকতা আছে বা
নেই প্রকাশের সুযোগ।
কখনো তার স্বামীর বাঁধা, কখনো তার শশুর কূলের, কখনো সন্তানদের,
কখনো সমাজের…
তার ভালো লাগা আর ইচ্ছে গুলো শুধু অন্যের ভাল লাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। তার নিজস্ব কোন সত্বা ইচ্ছে বা পরিচিতি থাকতে নেই।
আর কি প্রয়োজন আছে বলার???
কেন? কিসের অপরাধে?
কেউ কি বলতে পারবে?
যে নারী সয়ে গেছে সব জ্বালা
সব ব্যাথা, সে কি শুধু নীরবে
সবার আড়ালে চোখের অশ্রু মোছন করবে???
এ কেমন সমাজ?
এ কেমন ত্যাগ?
কেউকি বলতে পারবে???
এর শেষ কবে হবে???
হ্যাঁ, যুগের অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ তবে সব নারী না হলেও বেশীর ভাগ নারীই অকোপটে কিছু না কিছু অন্যায়ের সন্মূখীন হয়েছে বা হচ্ছে৷ আর তাই হয়তো নারী দিবস বলে একটা দিন ধার্য্য হয়েছে৷ তবে এ দিবসের কারণে সেইসব নারীদের জীবনে কোন পরিবর্তন না আসলেও ভবিষ্যৎ প্রযন্ম হয়তো নারীদের কিছুটা হলেও সন্মান দিতে শিখছে বা শিখবে।
পৃথিবীর সব নারীদের উৎসর্গ করলাম আমার এ লিখাটি৷
৩১শে অক্টোবর ২০২০
রাত ২:৩০