রবিউল সোফায় বসে ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারছে না। অস্বস্তি দুর করার জন্য সুষমা বলল, ‘আমি বরং তোমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে আসি।’
রান্নাঘর থেকে চা এনে রবির সামনে রাখল সুষমা; রবি তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না; সুষমা বসল তার সামনের চেয়ারে, ঘরে নিস্তব্ধতা।
অনেকক্ষণ পর, এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে রবি বলল,
‘আমার একটা মেয়ে আছে, ‘ঝুনঝুন’, ভাল নাম ‘নিশাত রুবি’। ওর হার্টের অসুখ ধরা পড়েছে; অপারেশন করাতে হবে খুব দ্রুত।’
সুষমার ভ্রূ কুঁচকে গেল, একটু বক্র কষ্টের হাসি দিয়ে বলল,
‘মেয়ে? রবি তুমি মেয়ের বাবা হয়েছ, আমি জানিও না!’
রবি চুপ করে আরও কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল,
‘হ্যাঁ, তবে আমি ঝুনঝুনের জন্মদাতা নই। ও আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর আগের ঘরের সন্তান। কিন্তু আমি ওকে নিজের মেয়ে বলেই ভাবি সবসময়। জন্ম না দিলে কী হবে, আমি তো ওকে মানুষ করেছি।’
এবার সুষমার গলা শুকিয়ে এলো, ‘আর তোমার স্ত্রী?’
রবিউল সুষমার দিকে তাকিয়ে, নিচু স্বরে বলল,
‘ও চলে গেছে। বছর-খানেক হলো। কানাডায়, টাকার জন্য, ‘বেটার লাইফ’-এর জন্য। বলেছিল, আমি আর ঝুনঝুন, দুজনেই নাকি তার জন্য বোঝা। চলে যাওয়ার আগে ঝুনঝুনকে রেখে গেছে; তারপর একবারও খোঁজ নেয়নি।’
ঘরে কিছুক্ষণ জন্য নিস্তব্ধতা নেমে এলো। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে বাজছে ঠিকই, অথচ সময় যেন স্থির হয়ে আছে।
রবি আবার বলল, ‘ওর চিকিৎসা করাতে গেলে কয়েক লাখ টাকা লাগবে। তোমার সাথে দেহভিন্ন হওয়ার পর আর কেরিয়ারে মন দিতে পারিনি। চাকরিবাকরি আর তেমনটা করা হয়নি আমার। বাবার রেখে যাওয়া ফ্ল্যাট দুটো থেকে বাসা-ভাড়া যা পাই, তাতে একসাথে এমন খরচ আর টানতে পারছি না।’
সুষমা চমকে উঠল। ডিভোর্স শব্দের বাংলা কি ‘দেহভিন্ন’ হয়! এটা সে আগে কখনো শুনেনি। তার মানে কি তাদের শুধু দেহ আলাদা হয়েছে; রবি কি এখনো ভাবে তাদের দুজনের মন এক সাথে আছে! আসলে কি তাই!
‘ভেবেছিলাম কারো কাছে হাত পাতব না, কিন্তু ঝুনঝুনকে বাঁচাতে না পারলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। আমার এই মাথা-খারাপ অবস্থায় তুমি ছাড়া আর কারো কথাই মনে করতে পারছিলাম না’, রবি বলল।
এই কথা শুনে সুষমা একটু ইতস্তত করে বলল,
‘রবি, আমি একটা কথা জিজ্ঞেস করতে চাই, তুমি যদি কিছু মনে না করো। ঝুনঝুনের আসল বাবা কে? তার সাথে যোগাযোগ করনি কেন?’
রবি একবার চোখ তুলে তাকাল, তারপর আবার নিচু করে ফেলল। তার কণ্ঠটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেছে,
‘জানি না সু, আসলে ওর মা নিজেও ঠিক জানত না। ওর আগের জীবনে কয়েকটা জটিল সম্পর্ক ছিল, সে সময় ঝুনঝুনের জন্ম হয়, ও নিজেই আমাকে বলেছিল,‘আমি নিশ্চিত নই’। এরপর ধীরে ধীরে এই প্রশ্ন আর ওঠেনি। আমি তখন শুধু একটা শিশুকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেছিলাম, রক্তের হিসাব তখন আমার কাছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি।’
সুষমা তাকিয়ে ছিল রবির দিকে, নির্বাক, স্থির, আর একরকম হতভম্বের মতো। যেন তার ভিতরে কিছু একটা গলে যাচ্ছে। বাইরে থেকে তার মুখ শক্ত, কিন্তু ভিতরে চলছিল এক অদ্ভুত টানাপোড়েন।
রবি খালি দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর চোখ নামিয়ে বলল,
‘তুমি জানো, ও আমাকে বাবা বলে ডাকে না কখনো। শুধু বলে, ‘রবি’। তবু আমি ওর স্কুলের নোটবুকের পেছনে আমার নাম লিখি, ‘নিশাত রুবি, পিতা: রবিউল ইসলাম চৌধুরি’। ভাবি যদি কোনোদিন এটা দেখে সত্যিই ও আমাকে বাবা বলে ডাকে; এই নামটা যেন মুছে দিতে না হয়।’
সুষমা রবির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, যে মানুষটা তার সামনে বসে আছে, সে আর আগের সেই রবি নয়। এই রবি অনেক ধাক্কা খেয়েছে, অনেক কিছু শিখেছে, হারিয়েছে, তবু হারায়নি তার জেদ আর ভালোবাসা। তাকে একটু বাজিয়ে দেখার ইচ্ছা হলো সুষমার। গভীর দৃষ্টিতে রবির দিকে তাকিয়ে ধীরে কিন্তু নির্ভুলভাবে প্রশ্ন করল,
‘ঝুনঝুন তো তোমার মেয়ে নয়, রবি। তবে ওর জন্য কতটুকু করবে?’
রবি মাথা তুলে চাইল। তার চোখে যেন জ্বলে উঠল ক্লান্তিতে চেপে রাখা অভিমান। কণ্ঠে রাগ, কষ্ট আর ক্ষোভ মিলেমিশে এক তীব্র বিস্ফোরণ হলো।
‘না, সু! কী বলছ তুমি! ঝুনঝুন আমার মেয়ে! শুধু জন্ম দিলেই কেউ বাবা হয় না! বাবা হতে হয় প্রতিদিন, ওর পাশে থেকে, ওর ভয়ের সময় বুক দিয়ে আগলে রেখে, ওর কান্নার সময় জড়িয়ে ধরে, ওর আনন্দে চোখে সুখের অশ্রু ঝরিয়ে। বাবা হওয়া অর্জন করে নিতে হয়, দায় নিয়ে, ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়ে। আমি সেটা করেছি, আমিই ওর বাবা।’
ঘরের ভেতর আবার নেমে এলো নিস্তব্ধতা। শুধু রবি আর সুষমার মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইল সেই অদৃশ্য সত্য, যে কেউ এক শিশুর জন্ম দিতে পারে, কিন্তু তাকে হৃদয়ে ধারণ করে দায়িত্ব নিতে পারে শুধু একজন প্রকৃত মানুষ। সুষমার চোখ ঝাপসা হয়ে এলো, শুধু চেয়ে রইল সামনের মানুষটার দিকে, যাকে একদিন তার ছেড়ে যেতে হয়েছিল। জীবন যে তাকে এই রকম ত্রিমুখী রাস্তার মোড়ে ছেড়ে পরীক্ষা নেবে এটা তার ধারণাতীত ছিল। কী করবে সে; অনেক চেষ্টা করেও তার সূক্ষ্ম অনুভূতি গুলো স্পর্শ করতে পারছে না সুষমা।
চলবে…
৮ই আগস্ট, ২০২৫ খ্রি., আটলান্টা, জর্জিয়া