সবারই যেন একই প্রশ্ন—
‘বাচ্চাকাচ্চা হবে কবে?’
‘সব ঠিক আছে তো?’
প্রতিদিনের পরিচিত মুখগুলোর হাসির আড়ালে জমে থাকা কিছু অব্যক্ত প্রশ্ন তীক্ষ্ণ হয়ে বিঁধতে থাকে রবি ও সুষমার মনে। শুরুতে এসব কথায় হেসে উড়িয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে, যখন সংসার নিয়ে কথা উঠত, তখন সুষমার মনে হতো তার নিঃশব্দ কোনো দোষ সবার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছে। রবিউলের মা তো রীতিমতো নিয়ম করে বলতেন,
‘তোমাদের সংসারটা শূন্য শূন্য লাগে রে বাবা। একটা বাচ্চা হলে সব ঠিক হয়ে যেত। আমার তো এখনো নাতি-নাতনির মুখ দেখা হলো না। মরার আগে এইটুকু দেখতে ইচ্ছে করে!’
শুরুতে রবি এসব নিয়ে মজা করত।
‘মা, মরা এতো সোজা না, যে তুমি চাইলেই হবে? তোমারে আমি মরতে দিলে তো!’
তবে একসময় এই কথাগুলোতে আর হাসির খোরাক থাকত না; বিরক্তি জমতে লাগল রবির ভেতরেও।
‘মা, এসব নিয়ে আর বাড়াবাড়ি কোরো না। সময়মত সব হবে।’
কিন্তু সময় যেন কেবল চলতেই থাকে—সমাধান দেয় না। রবির মায়ের কথার সুরেও পরিবর্তন আসে—স্নেহের বদলে আসে কৌতূহল, কৌতূহলের নিচে চাপা ব্যঙ্গ, একরাশ হতাশা আর গোপন কান্না জমে উঠত। সুষমার মনজুড়ে একটা অপরাধ-বোধ জমে উঠতে থাকে। সে ভাবত, কোথাও একটা ‘দোষ’ নিশ্চয় তারই। হয়ত তার জন্যই সংসারটা পূর্ণতা পাচ্ছে না। রাতে একা বসে কখনো কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে প্রশ্ন করত, ‘আমি কি অপূর্ণ একজন মানুষ?’
একদিন রবি বাসায় ফিরতেই, সুষমা তাকে বলল,
‘আমি ফার্টিলিটি টেস্ট করাতে চাই। বুঝতে চাই সমস্যা কোথায়।’
রবি অবাক হয়ে বলল,
‘কেন এসব নিয়ে ভাবছো এত? আমরা কি খুব খারাপ আছি? আল্লাহ যখন চাইবেন, তখন হবে। অস্থির হয়ো না।’
‘না রবি, এসব শুনতে চাই না। আমি টেস্ট করাবোই। এটা আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।’
শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয় দুজনেই ফার্টিলিটি টেস্ট করাবে।
হাসপাতালের নিঃশব্দ করিডোরে পাশাপাশি বসে ছিল তারা। কেউ কোনো কথা বলছিল না।
একসাথে টেস্টের স্যাম্পল জমা দিয়ে আসে। দিন দশেক পর রিপোর্ট আসে হাতে।
রবিউল সেদিন অফিস থেকে ফিরে বারান্দায় বসে রিপোর্ট খুলে পড়ে। তার হাতটা হঠাৎ জমে গেল কারণ রিপোর্টে লেখা ছিল—
Patient: Mrs. Sushama R. Chowdhury; Diagnosis: Congenital Uterine Anomaly. Natural conception unlikely. অর্থাৎ সুষমা কখনো মা হতে পারবে না। সে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে নিশ্বাস নেয়। রিপোর্টটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিয়ে চোখের কোনে জমে থাকা জলটুকু হাতের পিঠে মুছে নেয়।
সেই রাতে সুষমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কি গো, রিপোর্টে কী বলেছে?’
রবির মুখে একটা আলতো হাসি ছিল।
সে শুধু বলল, ‘আমার স্পার্ম কাউন্ট কম। চিকিৎসা করা যাবে। দুশ্চিন্তা কোরো না।’
সুষমা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী! তোমার সমস্যা! ফালতু কথা, তুমি একদম সুস্থ!’
রবি বলল, ‘দেখো, বাচ্চা না থাকাটা আমাদের সম্পর্ক কেড়ে নিতে পারে না। তুমি আর আমি, একসাথে আছি এই সংসারের, এটাই আসল সত্য। বাকি চাওয়াগুলো পাওয়া হলে হবে, না হলেও দোষ নেই।’
সুষমা চোখ ভিজিয়ে ফেলেছিল সেদিন। রবিকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিল সেই রাতে।
কিন্তু সমাজ তো থেমে থাকে না; কথা চালাচালি চলতেই থাকে। রবির মা একদিন তো রীতিমতো সুষমাকে অপমান করে বলে বসেন, ‘তোমার জন্যই আমার ছেলের ঘর ফাঁকা। একটা বাচ্চা জন্ম দিতে পারো না—কী রকম মেয়ে তুমি? সংসার করতে এসেছো, না ভাঙতে?’
সেই রাতেই সুষমা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিল বিছানায়। তারপর ধীরে ধীরে রবিকে বলেছিল, ‘তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও রবি।’
রবি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, ‘তুমি এসব বলছ কেন?’
‘কারণ আমি জানি… আসল সত্যিটা। আমি বুঝি, তুমি আমাকে রক্ষা করার জন্য নিজেকে দায়ী করেছিলে। বাচ্চা না হওয়ার শারীরিক অসুবিধাটা আমার, তোমার নয়। তুমি লুকিয়েছ, কিন্তু এইটা আমি জানি। আর আমার অস্তিত্ব যে তোমার উপর বোঝা হয়ে দাঁডিয়েছে, সেটা আমি মেনে নিতে পারছি না।’
‘কী যা তা বলছ! বললাম না, আমার স্পার্ম কাউন্ট কম। আর তুমি আমার বোঝা নও। তুমি আমার সবচেয়ে নির্ভরতার জায়গা।’
‘রবি, আমি তোমাকে জলের মতো পড়তে পারি। তুমি সব সময় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো। ওইদিন যখন তুমি ফার্টিলিটি টেস্ট-এর রেজাল্ট বলছিলে, তুমি আমার চোখের দিকে তাকাওনি, আর তখনই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, যে সমস্যাটা আমার। সত্যিটা স্বীকার করো, রবি। আমাদের জীবন আর আগের মতো সহজ নয়। আমি চাই না, তোমার জীবনে আমার অপূর্ণতার ছায়া হয়ে থাকুক। তুমি সব কিছু আবার শুরু করো। আমি কালই বাবার বাসায় চলে যাচ্ছি’
রবি আর কথা বলেনি। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল যেন সুষমা তার চোখের পানি দেখতে না পায়।
কিছুদিন পর, এক সন্ধ্যায়, ডাকপিয়ন একটা খাম দিয়ে যায়; সুষমা বাবার বাসা থেকে পাঠিয়েছে তালাকনামায় স্বাক্ষর করা কাগজ। সাদা খামে, ভেতরে এক লাইনের একটা চিঠি, লেখা শুধু একটি লাইন—’ভালো থেকো, রবি।’ রবি চুপচাপ খামটা রাখে টেবিলের ওপর। তার প্রচণ্ড পানির তৃষ্ণা পাচ্ছিল, এক গ্লাস পানির জন্য, সাদা পিরিচে উপর রাখা এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানির জন্য।
তারপর, গত এতটা বছর রবি কখনোই সুষমার সাথে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেনি। সুষমা কার থেকে যেন শুনেছিল, রবি আবার বিয়ে করেছে, একটা মেয়েও আছে তার। এর বেশি কিছু সে জানত না বা জানতে চেষ্টাও করেনি । তাহলে এতদিন পর রবির তার কাছে আসার কারণ কী! সুষমার বুকের মধ্যে কেমন যেন এক অচেনা শঙ্কা ছড়িয়ে পড়ল। ঘরটা হঠাৎ খুব ভারী মনে হলো তার কাছে। খানিকক্ষণ নীরবতা বজায় রেখে ধীরে বলল, ‘কী রকম সাহায্য দরকার তোমার?’
চলবে…