রবি আর সুষমার বিয়েটা হয়েছিল হঠাৎ করে। প্রচণ্ড আত্মমর্যাদাশীল, নিজের আপন জীবন-বৃত্ত গড়ার সংকল্প ছিল সুষমার। প্রেম-ভালোবাসার দিকে খেয়াল করেনি সে কখনো। তখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী। সেই সময় একদিন, তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মাধ্যমে রবিউলের প্রস্তাব আসে। রবিউল তখন সদ্য কানাডা থেকে মাস্টার্স করে ফিরেছে, নামী এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়েছে। সুশিক্ষিত, ভদ্র—সব মিলিয়ে ‘একজন ভালো ছেলে’ হিসেবে পরিবারের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে চলে আসে রবিঊল। সুষমার পরিবার খুশি, পাত্রপক্ষের আগমনে প্রস্তুত হয়ে যায়—কিন্তু সুষমা ছিল দ্বিধায়।
একদিন ভার্সিটি থেকে ফেরার পর ভাবি হাসিমুখে সুষমাকে বলল,
‘আপু আসছেন! আপনার তো ঘণ্টা বাজে গেছে!’
‘ঘণ্টা বেজে গেছে মানে? কিসের ঘণ্টা?’
‘আপনার বারোটা বেজে গেছে, সেই ঘণ্টা।’
‘দূর ভাবি, দুষ্টামি না করে বলো, কী হইছে?’
‘আরে, তোমার বিয়ের ঘণ্টা বাজে গেছে, কাল তোমারে দেখতে আসবে।’
সুষমা কেমন যেন চমকে উঠল, ‘কাল? এত তাড়াতাড়ি?’
‘হ্যাঁ, কানাডা ফেরত রাজ-পুত্তুর। এখন যাও, ড্রয়িংরুমে—বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।’
বাবাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল সুষমা।
‘বাবা, আমি এখনো পড়ছি, ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবছি। এখন বিয়ের কথা ভাবছি না,’ বলেছিল সে বাবাকে।
সুষমার বাবা ফরিদ সাহেব খুবই শান্ত, ধীর-স্থির মানুষ। উনি বলেছিলেন, ‘দেখ মা, বিয়ে তো তোকে একদিন করতেই হবে। যতদূর শুনেছি ছেলেটা ভালো। কাল ওরা আসবে, দেখার পর ভালো না লাগলে বা তুই বিয়ে করতে না চাইলে নিষেধ করে দিবি। কেউ তো তোকে জোর করবে না।’
সুষমা চুপ করে ছিল, বাবার কথার কোনো উত্তর দেয়নি।
দিনটি ছিল গ্রীষ্মের এক প্রচণ্ড গরম দিন—রোদের ভিতরে যেন জ্বলে যাচ্ছিল আকাশটাও। সমস্ত বাড়ি ঝকঝকে পরিপাটি করে সাজানো হয়েছিল। ঘরজুড়ে ছিল মায়ের উৎকণ্ঠা, বাবার ব্যস্ততা, আর আতিথেয়তার গন্ধ।
রবিউল ও তার পরিবার সুষমাকে দেখতে এসেছিল। সুষমার মন ছিল বিরক্ত, ক্লান্ত, আর অস্থির।
‘আমি এখনো মাস্টার্স করছি, এসব ঝামেলায় যেতে চাই না,’ মায়ের কানের কাছে গিয়ে বলেছিল সে।
‘দেখা করলেই তো আর বিয়ে করতে হবে না। দেখতে দোষ কী?’ মা বলেছিলেন।
ভাবি সুষমার সাজগোজ ঠিক করে দিচ্ছিলেন। সবকিছুর শেষে কপালের মাঝে ছোট্ট একটা লাল টিপ বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এইবার হইছে! ওই ব্যাটার সর্বনাশ কইরা দিলাম, খালি তোমারে একবার দেখলেই হইছে,’ বলে খিলখিল করে হাসছিলেন।
অবশেষে, দুরুদুরু বক্ষে ধীরে পা টেনে টেনে ড্রয়িংরুমে ঢুকল সুষমা। চোখ তুলে তাকাতেই রবিকে প্রথম দেখল। রবিকে দেখার সাথে সাথে একটা বিরাট ধাক্কা খেল সে। রবি যে এতটা সুদর্শন পুরুষ হতে পারে, এটা সে ভাবেনি। গায়ের রং তেমন ফর্সা নয়, তবে জামাকাপড় বেশ ফ্যাশনেবল, এবং রবির মধ্যে একটা আত্মবিশ্বাস, একটা সৌম্যতা ছড়িয়ে ছিল—যা অন্য কারো মধ্যে সে আগে দেখেনি।
রবি অন্য সবার মতো চুপচাপ বসে ছিল না। বরং একটা ছোট্ট বই হাতে নিয়ে পাতা উল্টে দেখছিল। মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তি, চোখে মায়া ভরা আলো।
চোখে চোখ পড়তেই রবির ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল। বলল না কিছু, শুধু একটু মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানাল।
সুষমা ভাবল, এমন পুরুষ কি সে কখনো স্বপ্নে দেখেছিল—যে কাছে থাকলেই মন ভালো হয়ে যায়!
আলোচনার এক পর্যায়ে রবির মা জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমার কি একটু আলাদা করে কথা বলতে চাও, মা?’
সুষমা ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও সম্মতির ভান করল।
সুষমার মা বললেন, ‘তোরা ছাদ থেকে ঘুরে আয়, ওখানে বসার জায়গাও আছে।’
ছাদে টবে কিছু ফুলগাছ থাকায় ছাদটা বেশ সুন্দর লাগছিল। ভ্যাপসা গরম ছাপিয়ে হালকা বাতাস বইছিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর রবিই প্রথম বলল,
‘তোমার চোখে আমি স্পষ্ট দেখছি, তুমি এই “দেখা”-র ব্যাপারে আগ্রহী না।’
সুষমা একটু থমকে গিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, মোটেও না। আপনি বুঝলেন কীভাবে?’
রবি মৃদু হাসল, ‘তাও রাজি হয়েছ দেখা করতে—এটাও একটা সাহসের ব্যাপার।’
সুষমা একটু কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার কি খুব আগ্রহ এই বিয়েতে?’
‘না। আমি শুধু চাই একজন বন্ধু, যার সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায়, যার পাশে বসে থাকা যায় কোনো কারণ ছাড়া, আর যার নীরবতাও বোঝা যায়—সে কী বলছে।’
এই উত্তরটা সুষমাকে কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়েছিল। এত সংযত, অথচ গভীর কথা সে খুব কম শুনেছিল জীবনে। তাদের কথা চলল খুবই সংক্ষিপ্তভাবে। কিন্তু সেই সংক্ষিপ্ত সময়েই সুষমা অনুভব করল—এই মানুষটি কেমন যেন অন্যরকম।
সেদিন রাতে মা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেমন লাগল তোর রবিউলকে?’
সুষমা চুপ করে ছিল কিছুক্ষণ, তারপর ধীরে বলেছিল,
‘বিয়ে করতে চাই না… কিন্তু ছেলেটা—ছেলেটা যেন কেমন মনে লেগে গেছে।’
মা হেসে বলেছিল, ‘মনে লেগে গেলে বুঝতে হবে, এই না চাওয়ার মধ্যেই তোর আসল চাওয়া লুকিয়ে আছে।’
মা রুম থেকে বেরুতেই ভাবি ঢুকে বললেন,
‘কইছিলাম না, রবিউল ব্যাটার সর্বনাশ করমু আমি! তোমার কপালে টিপ দেওয়ার সময় দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়া দিছিলাম। দেখ, কাম হইছে। ওরাও তোমারে পছন্দ করছে।’
‘দূর ভাবি, খালি ফাজলামি করো,’ সুষমা বলেছিল।
বিয়ের পর রবি ঠিক সেই মানুষটিই ছিল—নীরব, সহনশীল, আর ভরসার, একটি শান্ত নদীর মতো, যার পাশে দাঁড়ালে আর কোনো উত্তাল ঢেউ সুষমাকে স্পর্শ করতে পারত না। তারা হাসতে হাসতে ঘর সাজিয়েছিল, একসাথে বাজার করতে বেরোত, বইমেলায় যেত, ছাদে বসে চা খেত, রাতে একসাথে বসে টিভি দেখত। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোতেই জীবন হয়ে উঠেছিল পরিপূর্ণ। দেখতে দেখতে ওদের বিবাহিত জীবনের তিনটি বছর কেটে যায়। এই তিনটি বছর ছিল তাদের জীবনের সুন্দরতম সময়, এক অদ্ভুত প্রাপ্তির দিনলিপি।
কিন্তু সময় বদলায়। একসময় সংসারের সবার কাছ থেকে আসতে শুরু করে বিভিন্ন রকম কথাবার্তা, নানা কৌতূহল, কানাঘুষা—কখনো সরাসরি, কখনো বা তির্যক ইঙ্গিত প্রশ্নে…
চলবে…