দরজা খুলে রবিউলকে দেখে প্রচণ্ড অবাক হলো সুষমা। কয়েক সেকেন্ড লাগল তার রবিউলকে চিনতে। ছুটির দিনে অফিসে যেতে হয় না বলে সুষমা একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠে। তাই কলিং বেল বাজায় সে খুব বিরক্ত হয়েছিল। ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে দরজা খোলে সুষমা। বাইরে দাঁড়ানো লোকটিকে দেখে প্রথমে মনে হলো, তার পরিচিত কেউ। কিন্তু সে ঠিক চিনতে পারছিল না। ঘাড় কাত করে রবিউল যখন জিজ্ঞেস করল, ‘কী কর?’ সুষমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল—এ তো রবি! তার এক্স-হাজবেন্ড।
তাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে প্রায় সাত বছর আগে। রবি কখনো তাকে ‘কেমন আছ?’ জিজ্ঞেস করত না; সে বলত ‘কী কর?’ কেন বলত—কে জানে! তবে সে এই কথাটা বলত মাথা ঝুঁকিয়ে ঘাড় কাত করে। সেই ভঙ্গিটা এখনো সুষমার চোখে লেগে আছে। তাই রবিউল কথাটি বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে ওকে চিনতে পারল।
কিন্তু কী অবস্থা রবির! কেমন যেন জবুথবু, অনেক বয়স্ক মনে হচ্ছে তাকে। রবি সব সময় ক্লিন-সেভড থাকত; স্টাইলিশ জামা-কাপড় পরত, চুল থাকত পরিপাটি। কিন্তু আজ—উসকোখুসকো চুল, গালভরা দাড়ি, অতি সাধারণ জামা-কাপড়ে রবিকে দেখে সুষমা হিসাব মেলাতে পারছিল না। হতভম্ব সুষমা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না সে রবিকে ভিতরে আসতে বলবে, না কি দরজায় দাঁড়িয়েই তার সাথে কথা বলবে। কী যেন সাত-পাঁচ ভেবে সুষমা বলল, ‘আস, ভিতরে আস।’
রবিউল ভিতরে এসে সোফায় বসল; কেমন যেন অস্বস্তি কাজ করছে তার মধ্যে; সুষমার দিকে তাকাচ্ছে না, ঘরের মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।
সুষমা জিজ্ঞাসা করল, ‘কেমন আছ?’
রবিউল উত্তর দিল, ‘আছি মোটামুটি। বাসায় আর কেউ নেই?’
‘আর কে থাকবে! আমি থাকি আর কাজের বুয়াটা এখনো আসেনি,’ বলল সুষম।
‘ও আচ্ছা।’
রবিউল চুপ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। ঘটনার আকস্মিকতায় সুষমার প্রায় দম-বন্ধ অবস্থা, বুক ধড়ফড় করছে।
‘আচ্ছা তুমি একটু বসো, আমি ঘুম থেকে উঠে এখনো ফ্রেশ হইনি। একটু ফ্রেশ হয়ে আসছি,’ বলে সুষমা উঠে চলে গেল।
আসলে সে একটু সময় চাইছিল নিজেকে সামলানোর জন্য। রবি যে কোনোদিন এভাবে তার সামনে উপস্থিত হবে, এটা সুষমা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি। রবির সামনে কী বলবে বা কী করবে কিছুই সে বুঝে উঠতে পারছিল না।
সুষমা ফিরল মিনিট বিশেক পর; হাতে সাদা পিরিচে রাখা এক গ্লাস পানি। পানির গ্লাসটি রবিউলের সামনে টেবিলে রাখল সে। রবিউল তখনও মাথা নিচু করে বসে আছে। পানির গ্লাসের দিকে চোখ পড়তেই সে মুখ তুলে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল সুষমার দিকে।
তারা যখন বিবাহিত ছিল, রবিউল যখনই ঘরে ফিরত, সুষমা এভাবে রবিউলকে পানি দিত—সাদা পিরিচে করে। রবিউল প্রায়ই বিরক্ত হতো, বলত, ‘পানি দাও গ্লাসে সেটা ঠিক আছে, কিন্তু সাথে সাদা পিরিচ দাও কেন অযথা? এটা কী কাজে লাগে?’
সুষমা সব সময় মুখ টিপে হেসে উত্তর দিত, ‘গ্লাসটা হচ্ছে তৃষ্ণার জল; আর সাদা পিরিচটা হচ্ছে তোমার জন্য আমার ভালোবাসা।’
কথাটা মনে হতে রবিউল একবার সাদা পিরিচটার দিকে তাকাল আবার মুখ তুলে সুষমার চোখের দিকে তাকাল। তারপর গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে শেষ করল; মনে হলো সে সারা জনমের তৃষ্ণা নিবারণ করছে।
‘তোমার কি কোনো জরুরি দরকার আছে আমার কাছে?’ সুষমা জিজ্ঞাসা করল রবিউলকে।
রবিউল আঙুল তুলে তাকের উপরে রাখা অ্যালার্ম ঘড়িটার দিকে ইশারা করে বলল, ‘ওটাই?’
সুষমা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল, ‘ও হ্যাঁ, সেটাই তো। এখন আর কাজ করে না—ব্যাটারি বদল করা হয় না অনেক দিন।’
এই অ্যালার্ম-ঘড়ি নিয়ে প্রতিদিন তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। সুষমা সকালে অ্যালার্ম বাজার পর দশ মিনিটের জন্য অফ করে আবার ঘুমাত, আবার অ্যালার্ম বাজলে আবার অফ করত। কয়েকবার এমন করার পর সে বিছানা থেকে উঠত। এই কাজটি ছিল রবিউলের কাছে প্রচণ্ড বিরক্তিকর। সে বলত, ‘আরে বাবা, অ্যালার্ম আধা-ঘণ্টা পরে সেট করলেই তো হয়, বারবার অন-অফ করার দরকার কী? যখন বাজবে তখন উঠে যাবে।’
কিন্তু কে শুনে কার কথা! সুষমা রবিউলের কথায় কখনো কানের মাছিটিও নাড়তো না। সে রুটিন মাফিক প্রতিদিন একই কাজ করত। রবিউলের দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকলো ঘড়িটার উপর।
‘নাস্তা করেছ? চা খাবে?’ সুষমা জিজ্ঞাসা করল।
রবিউল একরাশ জড়তা এবং ভয় মেশানো চোখে সুষমার দিকে তাকাল; তারপর বলল, ‘তোমার কাছে একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। এক রকম সাহায্য চাইতে এসেছিও বলতে পারো। আর কার কাছে যাব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।’
চলবে…
২১শে জুলাই, ২০২৫ খ্রি., আটলান্টা, জর্জিয়া