( এই গল্পটি ২০ আগস্ট ২০২০- এ পোস্ট করা হয়েছিল।)
কী আশ্চর্য!
সালমা বেগমের কান্না দেখে জহীর সাহেবের একটুও খারাপ লাগছে না। বরং এক ধরনের সুখানুভূতি হচ্ছে।
এটাই কি স্যাডিজম? ধর্ষকামীতা? একজনকে কষ্ট দিয়ে বা একজনের কষ্ট দেখে আনন্দ পাওয়া!
এটাও তো এক ধরনের মানসিক বিকৃতি।
জহীর সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন, কবে সালমা বেগম শেষ বারের মতো কেঁদেছে।
যতোদূর মনে পড়ে, সর্বশেষ কেঁদেছিল ছোট মেয়ের বিয়ের দিন।
কান্নাটা এতোই তীব্র ছিলো যে, জহীর সাহেব সালমা বেগমকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলেছিলেন, ‘ছিঃ, এমন করে কাঁদছো, লোকে কী বলবে? ভাববে মেয়েকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছো… জামাই পছন্দ হয়নি।‘
তাও তো সেটা প্রায় ছ’ বছর হয়ে গেল।
ছোট মেয়ে জামাই সহ অস্ট্রেলিয়াতে যেদিন চলে গেল, সেদিন মন খারাপ করেছিলো সারাদিনই।
চোখ ছল ছল করেছিলো। আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদেওছিল। কিন্তু হাউমাউ করে কান্না আর কাঁদেনি।
এই সাত বছরের মধ্যে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কান্নাটা চোখে পড়েনি।
আজ রীতিমতো বিছানায় উবু হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে সালমা বেগম।
তাঁর ছাই রঙের চুল পিঠের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোমর পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। জহীর সাহেব খুব ধীরে ধীরে স্ত্রীর পাশে বসলেন। মৃদু ভাবে পিঠের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলের ওপর হাত বুলাতে লাগলেন। কান্নার দমকে সালমা বেগমের সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
কতোদিন এতো মৃদুভাবে, এতো আদর করে স্ত্রীকে স্পর্শ করেননি। আগের মতো ঝগড়া বিবাদ, মান-অভিমান আর নেই।
জহীর সাহেবের ছেষট্টি, সালমা বেগমের ষাট।
আর সাতদিন পরেই সালমার জন্মদিন।
এই দিনটা জহীর সাহেবই সব সময় মনে করেন।
কোথা থেকে বেলিফুলের মালা জোগাড় করেন, তারপর সালমার হাতে দিতে দিতে হাসি হাসি মুখে বলেন, ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর…’।
সব কিছু খ্রিষ্টাব্দে গণনা করলেও সালমার জন্ম দিন পাঁচ ভাদ্র বঙ্গাব্দেই করেন।
সালমা ‘কী যে করো না এই বুড়ো বয়সে’ বললেও মনে মনে খুশির জোয়ারে ভাসতে থাকে। প্রতিদানে সালমা বেগমও এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে একটা চুমুও দিয়ে দেন জহীরকে।
সালমা বেগম কট্টর না হলেও বেশ রক্ষণশীল।
আগেও নামায রোযা সহ ধর্মীয় সব আচার অনুষ্ঠানই পালন করতো। কিন্তু, যতো বয়স বেড়েছে, ততোই যেন পরিবর্তিত হয়েছে সালমা বেগম।
একদিন তো হিজাব আর বুরকা দেখে জহীর সাহেব অবাক। এতোটাই অবাক হয়েছেন, যে নীরব প্রশ্ন ভরা চোখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন।
সালমা বুঝতে পেরে হাসতে হাসতে বললো, ‘কী করবো বলো, পুরুষ মানুষ যতোদিন মানুষ না হচ্ছে ততোদিন এই ব্যবস্থা…’।
জহীর বললো, ‘তুমি বুরকা হিজাব পড়বে…!’
অবশ্য তিনি আপত্তিও করেননি।
একবার সালমা অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তার পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিলো, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছেন, ঠিক আছে। কিন্তু রাত জেগে বেতের তাহাজ্জুদ পড়ার দরকার নাই। এই ইবাদত হাইপারটেনশনের রুগীর জন্য নয়…।‘
কিন্তু, গভীর রাতে নামায পড়া সালমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে পরিবর্তনটা বেশ মোটা দাগেই চোখে পড়তে শুরু করলো।
জহিরের বন্ধুরা এলে আগের মতো আর সপ্রতিভভাবে সালমা সামনে আসে না। চা-নাস্তা তৈরি করে ভেতর থেকে ডাক দেয়, ‘একটু শুনে যাও…’।
জহির বন্ধুদের কাছ থেকে উঠে আসে। জহীরকে অবাক করে দিয়ে সালমা বলে, ‘চা হয়ে গেছে। নিয়ে যাও।‘
জহির খানিকক্ষণ সালমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কেন, তুমি যাবে না? আসো, কথা বলো…ওরা সব আমার অফিস কলিগ…’
-না, আমার ভালো লাগছে না।‘ বলে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে চলে যায় সালমা।
জহির বেশ বুঝতে পারছে সালমা ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে।
শুধু যে চিন্তাভাবনায়, তা নয়, আবেগের দিক থেকেও অনেকটাই রক্ষণশীল সালমা। নিজে নিজেই হেসে ওঠেন জহীর। আবেগ আবার রক্ষণশীল হয় কেমন করে?
আবার নিজেই নিজেকে সমর্থন জানান বেশ জোরালো ভাবে। হয়, হয়! আবেগও রক্ষণশীল হয়।
তা না হলে ত্রিশ বছর ধরে মেয়েদের স্মৃতি ধরে রেখেছেন যে ভাবে, সেটা খুব অনুভূতিপ্রবণ রক্ষণশীল মানুষ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
সেই ছোট বেলায় যূথী আর বীথি, দুই মেয়ের জন্য যতো পুতুল কিনেছিলেন, তার অনেকগুলোই এখনো সংরক্ষণ করছে গভীর আবেগে।
যূথী আর বীথি পিঠোপিঠি দুই বোন, সালমা বেগমের দুই কন্যা।
সালমার এক ডাক্তার খালাম্মা বলেছিলেন, ‘বাচ্চা নিলে দেরী করিস না। আর নিলে প্রথমটার তিন-চার বছর পরে দ্বিতীয়টাও নিস। ছোট থাকা অবস্থায় দুটোই মানুষ হয়ে যাবে একসাথে। আর বাচ্চা দুটোও সঙ্গী পাবে।‘
সত্যি সত্যি তাই হয়েছে। ওদের লালন পালন করতে সুবিধাই হয়েছে।
বড়টার জামা ছোটটার ওপর চালিয়ে দিয়েছে।
দুই মেয়ের কাঁথা কাপড় একসাথে ধোয়া হয়ে গেছে।
একজনের জন্য খেলনা কিনে এনে যূথীকে বলেছে, ‘তুমি তো বড়। ও দেখো কতো ছোট। কথা বলতে শিখলেই তোমাকে আপু বলবে। আপুরা ছোটদের নিজের জিনিস দিয়ে দেয়…।‘
সাড়ে তিন বছরের যূথী নিজেকে বড় ভেবে খুব খুশী হতো। সদ্যোজাত ছোট বোনটাকে ওর সব কিছুই দিতে চাইতো।
পরে অবশ্য দুই বোন আরেকটু বড় হয়ে গেলে এই সুবিধাটা পাওয়া যেতো না।
বীথি নুতন পুরাতনের পার্থক্য বুঝে গিয়েছিলো। যূথীও নিজের ভোগ্য জিনিসের মায়া সহজে ছাড়তে চাইতো না।
তখন, কোনো কিছু কিনতে গেলে একসাথে দুজনের জন্যই কিনতে হয়েছে।
সেই চাবি দেওয়া নাচুনে রাজকন্যা, টেডি বিয়ার, ডলফিন, এমনকি বান্দরবানে বেড়াতে গিয়ে এক মার্মা শিল্পীর তৈরী কাঠের ‘উপজাতীয় রমণী’ দুটা কিনতে হয়েছিলো। ছিলো একটা। শেষ পর্যন্ত অর্ডার দিয়ে, বান্দরবানে আরো তিনদিন অবস্থান বাড়িয়ে আরেকটা কাঠের ওপর খোদাই করা পিঠে ঝুড়ি বাঁধা স্বাস্থ্যবতী ‘উপজাতীয় রমনী’ নিয়ে আসতে হয়েছিলো।
সেই মেয়েরা এখন নেই। একজন স্বামীর সাথে কানাডায়, আরেকজন অস্ট্রেলিয়ায়।
কিন্তু, তাদের খেলনা পুতুলগুলো সালমা পরম যত্নে রেখে দিয়েছে।
দু’তিনদিন পর পর কাপড় দিয়ে মোছে। কী সব ‘ফার্নিচার ক্লিনার’ কিনে আনে। সে সব দিয়ে কাঠের পুতুলগুলো মোছে। বেশ চক চক করে। বোঝা যায় না জিনিসগুলো এতো পুরনো!
ছোট্ট বসার ঘরটাতে দুই মেয়ের ছোটবেলার খেলনা সামগ্রী সব সাজিয়ে রেখেছে। দুটো শোকেসে জায়গা হয়নি, তাই কিছু দেয়ালে, এমন কি দরজায় পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে।
মাঝে মাঝে জহীর সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেছে, ‘আরে, তুমি ঘরটাকে কী বানালে? পুতুলের মিউজিয়াম নাকি দোকান?‘
সালমাও গলায় বেশ ঝাঁজ নিয়ে বলেছে, ‘কেন মিউজিয়াম কি খারাপ জিনিস? নিষিদ্ধ কিছু? আর যদি দোকান বলো, তো দোকানই…! তবে, টাকা দিয়ে এসব কেনার সামর্থ্য কারো হবে না। এসব বিক্রি হয় না। ’
জহীর এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি। সালমার মধ্যে একধরনের শিশুসুলভ সরলতা আছে যা তাকে মুগ্ধ করে।
কিন্তু, আজ কী এমন হলো যে সালমা বেগম ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন?
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজের মুখটাকে সালমার ডান কানে ছোঁয়ালেন জহীর সাহেব।
এক সময় সালমাকে আদর করে মাঝের ‘ল’ বাদ দিয়ে ‘শামা’ বলে ডাকতো।
ফিস ফিস করে সেই পুরনো স্বরে বললেন,‘শামা, লক্ষ্মীটি, কী হয়েছে বলবে? আমি কি কোনো ভাবে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি…?’
মতিন, জহীরের স্কুলবন্ধু, গতকাল হঠাৎ এসে হাজির। কার কাছ থেকে যেনো ঠিকানা জোগাড় করেছে।
বহু বছর বাদে দুই বন্ধুর দেখা।
প্রথমে তো মতিনকে চিনতেই পারেনি জহীর।
মতিনের মাথা ভরা শুভ্র চুল, মুখ ভরা শুভ্র দাড়ি, পরনে পায়ের গোড়ালি ছোঁয়া জোব্বা।
জহির বসার ঘর থেকেই ডেকে উঠলো, ‘সালমা, দেখে যাও, কে এসেছে…’।
সালমা এলো না। কিন্তু দুই বন্ধুর গল্পে কোনো ভাঁটা পড়লো না। আলাপের এক পর্যায়ে মতিন বলে উঠলো, ‘আরে জহীর, এ তুই কী করেছিস?’
-কেন? কী করেছি?’ জহীরের প্রশ্নে বিস্ময়।
-আরে, সারা ঘরে মানুষ-পাখি-মাছের মূর্তি! এ ঘরে তো নামায হবে না রে…! তোর এখানে তো নামায পড়া যাবে না…’
জহীর তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে মতিনের যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করলো। কিন্তু, মতীন কোরান ও হাদিস থেকে বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করতে থাকলো যে, একটু পরেই সে চুপ হয়ে গেল।
অসহায়ের মতো স্কুল বন্ধুর কথা নি:শব্দে শুনে যেতে থাকলো, ‘এসব একেবারেই নাযায়েজ। হারাম। এ ঘরে তো ফেরেশতা আসবে না। আরে জহীর, তুই নামায পড়িস কেমন করে? তওবা করে এসব ফেলে দে… ‘ ।
জহীর জানে, আমাদের দেশের মানুষের কথা বলার সময় মাত্রা জ্ঞান, স্থান-কাল-পাত্র বোধ থাকে না। তার বিশ্বাস থেকে অনর্গল কথা বলে যায়। এতে কেউ মানসিকভাবে আহত হচ্ছে কি না, তা বিবেচনায় রাখে না। সে যেটুকু জানে, সেটাই চূড়ান্ত, সেটাই শেষ জানা মনে করে। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যক্তি বিশেষের নির্দোষ আবেগ অনুভূতির কোনো কানা কড়ি মূল্যও ওদের কাছে নেই।
কান্না ভেজা মুখটা সালমা তুললো।
চোখের জলে সারা মুখে কাঁচা পাকা চুলগুলো লেপ্টে আছে।
মতিনের কথাগুলোই কি অনেকদিন বাদে সালমাকে কাঁদালো?
জহির স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে সালমার কান্নার কারণটা বোঝার চেষ্টা করছে।