ছোটবেলায় বায়স্কোপ বলিয়া একটি শব্দ ও বিনোদনের উপকরণ বড়ই কৌতুহল উদ্দীপক ও মজাদার ছিলো। সিনেমা বা বায়স্কোপ যাহাই বলি না কেন ইহা যে নাচে-গানে, হর্ষে-বিষাদে, রঙ্গ-রসে ভরপুর হইবে ইহা বিলক্ষণ বুঝিতাম। কৈশোরে সিনেমাহলে গিয়া সিনেমা দেখা সাবালকত্বের লক্ষ্মণ বলিয়া অতি শাসনের কবলে পড়িত। শিশুতোষ সিনেমা হইলে ভিন্নকথা। তবে কিশোরদের সিনেমা দর্শন মোটা দাগে শুধু অপছন্দনীয়ই নয় গুরুতর অপরাধ বলিয়া গন্য হইত। ইহার বিকল্প হিসাবে বায়স্কোপ নামধারী একটি বাক্স রঙ্গীলা বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম হইয়া উঠিলো। ইহার বাহক এই বাক্স লইয়া গ্রাম-গ্রামান্তরে, শহরের অলিতে-গলিতে, বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে, হাটে-ঘাটে, খেলার মাঠে-মেলার মাঠে ঘাঁটি গাড়িত। সকল বয়সী মানবের ইহাতে সমান কৌতুহল ও আগ্রহ ছিলো। সেই বাক্সে বড় বড় ফোকড় থাকিত। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেই ফোকড়ে চোখ মেলিয়া ভিতরে চলমান বাদ্য সহবতে রঙ্গীন বিনোদন চিত্রে বুঁদ হইত।
আজকাল ইহাদের আর দেখা যায় না বলিলেই চলে। বোধকরি মোবাইলের সর্বগ্রাসী ভূমিকায় এখনকার কিশোররাও ইহাতে আর আকুল-ব্যাকুল হইবেনা। আরো সত্যি করিয়া বলিলে ইহারা এই বায়স্কোপ বাক্সটিকে যাদুর বাক্স বলিয়াই ভ্রম করিবে। আর বয়ষ্করা মোবাইলে ইহার চাইতে ঢের বেশি রকমারি লাইভ শো দেখা যায় বলিয়া মোটেই আগ্রহী হইবেনা। তাই আগেকার সেই বায়স্কোপ বাক্স এখন আর মোটেই সহজলভ্য নয়।
সিনেমার অবস্থাও তদ্রুপ। অরুচি, কুরুচি, বস্তাপচা কাহিনী নির্ভর এবং গলা ছিলা মোরগের মত ভাঁড় টাইপের ভাঁড়ামিতে ভরপুর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের শব্দ ও চিত্র প্রক্ষেপন যন্ত্রের অত্যাচারে আক্রান্ত হইতে এখন আর কেহ হলমুখী হয়না। একদার এই রঙ্গীলা দুনিয়ায় ধ্বস নামিয়াছে। কিন্তু ইহাদের অবর্তমানে বিনোদন প্রিয় পাবলিকের কিন্তু কোনই ক্ষতি হয়নাই। বরং গাঁটের ট্যাকা খরচ করিয়া অখাদ্য গলাধঃকরণের যন্ত্রণা হইতে মুক্তি পাইয়াছে। বিনিময়ে দেশময় ওপেন স্কয়ারে পয়সা ছাড়াই নিত্য নতুন লাইভ রঙ্গ দেখিয়া বেশুমার আনন্দ পাইতেছে। বায়স্কোপ বাক্সের সূত্রাধারের বলার ঢংয়েই বলি। দেখুন তো রঙ্গীলা চিত্রগুলো স্পষ্ট দেখা যাইতেছে কি-না?
এই যে দেখুন কি সুন্দর, নাচিতেছে একদল বান্দর। আজব চেয়ারে আজ শিপুণ তো কাল সায়েদ, চলিতেছে খেলা নিরন্তর। এই যে দেখুন পরীর মত পরী, ভেতরে তার জমাট আঁধার, বাইরে তার রুপের বাহার, বড়ই চমৎকার। রঙ্গে ভরা রঙ্গ দেখিয়া, পাবলিক দেখুন মুখ বাকাইয়া, রসনার চোখ ঠাটায়, বুদ্ধিজীবী মন রাঙ্গায়, সাংবাদিকেরা গন্ধ ছড়ায়।
কার বৌ কে কব্জা করে, লাইভে এসে কে কান্না করে, কার গর্ভে কার ভ্রুণ, এই তর্কে সাংবাদিকদের হচ্ছেনা ঘুম। আত্মহত্যার হিড়িক বাড়ছে। কথায় কথায় রশি নিচ্ছে, নিজের মাথায় বুলেট ছুড়ছে, লাইভে এসে নাটক করছে, আত্মহত্যার প্রসার হচ্ছে, পত্রিকাগুলো ছবিসহ ক্যাপশন দিচ্ছে।
করোনাকালে সব অচল, বানিজ্য মেলা কত প্রবল, বই মেলায় সবাই সচল ! সব কিছুই চলছে ভালো, শিক্ষায়তনে নাই আলো। বিয়ে-শাদী, পার্টি-আড্ডা, ক্লাব-পাব রমরমা। এরি মাঝে সাকিব ভেলকি, বিসিবিও কম কি? খেললো কিছুক্ষণ টি-টুয়েন্টি। শেষে এসে হাসিমুখের সন্ধি-চুক্তি।
এর মাঝে খবর এলো, ঘাপটি মেরে হারিস ছিলো, মাহমুদুর নাম নিয়ে ছিলো, এই নামে এন আই ডিও ছিলো, এগারো বছর দেশেই ছিলো, রাজধানীতেই তার কবর হলো। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সচল ছিলো, সবাই খুব ব্যস্ত ছিলো, নিচ্ছিদ্র সব ব্যবস্থা ছিলো, এখন শুনি অনেকের সেখানে যাতায়াতও ছিলো। কি থেকে যে কি হলো? খবর শুনে সবাই যেন উঠে বসলো।
এরিমধ্যে ঢেউ এলো, বাজার সেরকম গরম হলো। এই যে দেখেন তেলেসমাতি কায়কারবার, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, তারাই আবার মিটিং বসায়। তত্ত্ব-তালাশে কমিটি বানায়। সেই কমিটি যুক্তি দেখায়। কর্তারা সবাই সাফাই গায়। ক্রয় ক্ষমতার ইনডেক্স দেখায়। তাইনা দেখে শাক-সব্জী দেমাগ দেখায়। সোয়াবিন তেলও চোখ পাকায়। টিসিবির ট্রাক ভীড় বাড়ায়।
মিটিং বসে উপায় খুঁজতে, সবাই পৌছে ঐক্যমতে, যা হবার হয়ে গেছে, বাড়বেনা দাম আর রমযান মাসে। ব্যবসা যা হবার হয়ে গেছে, যুক্তি তো একটা সামনেই আছে। দেখছেন না রাশিয়া ফাল পাড়ছে? ইউক্রেন কেমন চিপায় পড়েছে, বাইডেন এখন ইউটার্ন নিয়েছে? দূরে দাঁড়িয়ে শিং পেন কেমন মুচকি হাসছে?
এবার দেশে সানি এলো, তাবত সাংবাদিক হুমড়ি খেলো, তলে তলে সবাই গেলো, কেউ বললো জাত গেলো, কর্তা বললো কেমনে এলো? ইমিগ্রেশন এলার্ট ছিলো, লায়নি এসে পোস্ট দিলো, তার সাথে অনেকেই ছিলো, দেশের দিঘী-পুকুর সব যোগ দিলো। নাচ হলো, গানও হলো, খানাপিনা, মৌজ-মাস্তি সবই হলো।
সরকারি ভ্যাট বিযুক্ত হলো। সোয়াবিন স্বস্তি পেলো। সব্জী বাজার উঁচুই রইলো। সব কিছু আড়াল হলো। রঙ্গ ভরা দুনিয়াতে, চলছে সার্কাস অবিরত।
কথার কথা বাজে কথা, সেই কথাটিও ফুরালো, নটে গাছটিও মুরালো।