প্রবাস জীবন (পর্ব-৭)

Photo of author

By Shahnaz Parveen

পালমার্সটন নর্থ আগমন আর বন্ধুত্ব

সময় বয়ে যায় নদীর স্রোতের মতন আর তাতে হাজার লক্ষ কোটি ঢেউ তুল্য মূহুর্ত তৈরী হয়। প্রতিটি মুহূর্ত একসময় মূল্যবান স্মৃতি হয়ে মনের পাতায় আঁকা হয়ে যায়। যে কেউ যখন খুশী তা সাদা কাগজে এঁকে দিতে পারে এবং তা দেখতে হবে অনিন্দ সুন্দর- আমি হলফ করে বলে দিতে পারি। আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যাবার পরে নিতে এসেছেন প্রমার বাবার দুই বন্ধু মোখলেস ভাই আর শরীফ ভাই বুলস শহরের কাছাকাছি একটি গ্রাম থেকে। আমি আর প্রমা পূর্বপরিচিত মোখলেস ওরফে মুকুল ভাইয়ের গাড়িতে উঠেছি।বুঝতে পারলাম উনি সাংঘাতিক সাবধানি চালক।মোটরওয়েতে একশো কিলোমিটর বাঁধা থাকলে উনার গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা নিরানব্বই এ থাকে। অতঃপর অবশ্য বেশ রাতে নয়টা সাড়ে নয়টায় উনার বাসায় পৌঁছি। উনার বউ কামরুন আবার বন্ধু সিলেট মেডিক্যাল কলেজের ব্যাচমেট। অকল্যানডে ওরা থাকতে আমাদের তাই বেশ যাতায়াত ছিল। ক্ষুধার্ত আমরা কামরুনের হাতের সুস্বাদু রান্না গোগ্রসে গিলে ফেললাম। তারপর ডেসার্ট খেতে খেতে প্রমার বাবার আরেক ঢাকা কলেজের বন্ধু শরীফ ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম। অমায়িক ভদ্রলোক তখন পালমার্সটন নর্থ ইউনিভার্সিটির এসিসট্যানট প্রফেসর। আমরা খাবার দাবার শেষে আমাদের জন্যে বরাদ্দ করা বাসায় গিয়ে উঠলাম।

ঐ শহরে তখন আমাদের মেডিক্যাল কলেজেরই বড়ভাই জামিল ভাই কাজ করতেন আর অদূরে পরিবারসহ থাকতেন। মাসখানেক পরেই চাকুরী সুবাদে একই মেডিক্যালের মহিউদ্দিন ভাই পরিবারসহ এসে উপস্তিত হলেন। অবশ্য আমাদের থাকার শেষের দিতে ঢাকা মেডিক্যালের আলী ভাই আর আরেফীন ভাই মিলি আপারাও এসেছিলেন। শহরটি তখন মোটামুটি ঢাকা মেডিক্যাল এলামনাই হয়ে গেলো। আমাদের তখন ছিল স্বর্ণযুগ। অবশ্য তখন সেই সুখের উপর একটা ছায়া পড়ে থাকতো আমার পরীক্ষাগুলোর চিন্তা আর চাকুরীতে ঢুকা। প্রমার বাবা পালনার্সটন নর্থ হাসপাতালে কাজ শুরু করবার পর সুনাম অর্জনের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন করা শুরু করলো। হাসপাতালে কাজের পরেও থেকে যাওয়া, নিখুঁতভাবে কাজ শেষ করা এসবের পরে তাকে মাস দু’য়েকর মধ্যেই প্রমোশন দিয়ে রেজিস্ট্রার বানানো হলো। স্বাভাবিকভাই কাজের চাপ তখন আরও বাড়লো এবং সে কাজের পরে লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করলো ফেলোশীপ পরীক্ষা দেবার আকাঙ্খায়। আমার আশা প্রত্যাশাগুলো আমি বুকের মাঝেতে লুকিয়ে জীবন উপভোগ করা শুরু করলাম। তবে সকল সাংসারিক সামাজিক কাজের মধ্যেও আমি পড়াশুনা চালিয়ে গেছি।

সবার প্রথম চাকুরী আর আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে স্বামীরা এবং ভাবীরাও বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকতেন। বিকেলে আমরা মেয়েরা লোপা ভাবী, লাকী ভাবী, কামরুন আর আমি হাঁটতে বের হতাম। আর আমাদের বাচ্চারাও একসাথে খেলাধূলা করতো। তখনই ঠিক হয়ে যেতো সেই রাতে কার বাসায় আমরা সবাই রাতের আহার সারবো। কোনো কোনো দিন এমন হয়েছে যে আমরা শুধু আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়েই উদোর পুর্তি করেছি। ভাবী বা আমি হয়তো সেটুকু করবার সময়ই পেয়েছি কিন্তু ওগুলো আমাদের কাছে অমৃত মনে হতো আর আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয়।গল্পে গল্পে হাসিতে আনন্দে সন্ধ্যা রাত কাটিয়ে দিতাম । ওই সময় ঠিক করে নিতাম আমরা কে কে এবং কোন সপ্তাহানতে কাছের কোন শহরে বেড়াতে যাব। দলবেঁধে বেড়াতে যাবার আনন্দ অপরিসীম। একসাথে যাত্রা, চা জলপানি খাওয়া, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা আবার হঠাৎ হঠাৎ অন্য শহরে পরিচিত বন্ধু ডাক্তার পরিবারে হামলা দেয়া। আমাদের বাচ্চাগুলোও খুব মজা করতো একমাত্র মুকুল ভাই কামরুন এর ছেলে তাহমীদ ছাড়া। ওর বয়স মাত্র তখন দেড় দুই বৎসর আর ওর মা ওর খাবার নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকতো। আর তাহমিদের জিদও তখন অনেকটা কলা কেনো ছিললে বুঁজে দাও এমনটাই ছিল। আমরা অবশ্য সবাই মুকুল ভাই কাজে থাকলে কামরুনকে সাহায্য করবার চেষ্টা করতাম। আজ ও ইনজিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে, বাকী বাচ্চাগুলোর বেশীর ভাগেরই বিয় আর বাচ্চা কাচচা ও হয়ে গেছে- কি আশ্চর্য। মন থেকে সব বাচ্চাগুলোর জন্যে অনেক দোয়া আসে, ভালো থেকো তোমরা সবাই।

আমরা আশেপাশের সব শহরে মোটামুটি ঘুরতাম, নিউ প্লি মাউথ, ওয়েলিংটন, ওয়াঙগানুই এদের মধ্যে অন্যতম। ওযাঙগানুই শহরে আমাদের খুব প্রিয় বড়ভাই শহীদ ভাই ভাবী তাদের দুই কন্যা নিয়ে থাকতেন হাসপাতালে কাজের সুবাদে। শহীদ ভাই মানুষ হিসেবে ছিলেন অতুলনীয় – ধার্মিক বন্ধুবৎসল আর অমায়িক। উনাদের ওখানে হামলা দিতাম প্রায়শই আর ভাবী আমাদের মজাদার ইরানি কুইজিন খাওয়াতেন খুব যত্ন করে। পরে অবশ্য অকল্যানড থাকাকালীন উনাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছিল। উনার ছোট মেয়ে সুমাইয়া আমার প্রমার সমবয়সী আর বন্ধুত্বও ছিল ওদের মধ্যে। কয়েক বৎসর আগে ভাই আর ভাবী মেয়েদেরকে অকল্যানড রেখে ওমরাহ করতে গেলেন। ওমরাহ সুন্দর ভাবে শেষ করবার পরে ওনারা এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার জন্য মরক্কোতে গেলেন। ওখানে হোটেলে রাতে ভাবীর হঠাৎ মৃত্যু হলো। কোনো রকম অসুস্থতা ছাড়াই উনার আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা সবাই হতভমভ হয়ে গেলাম। ভাইকে সূদুর মরক্কোতেই একা একা শোক বহন করতে হলো আর ভাবীর পোস্টমর্টেম সহ লাশ নিয়ে দেশে ফিরাও একা করতে হলো। আল্লাহ এমনই পরীক্ষার মধ্যে মানুষকে ফেলে দেন যা শুনে বিশবাস করাও মাঝে মধ্যে কঠিন। শুনেছি বড় মেয়ে সাদিয়ার বিয়ে হয়েছে। আল্লাহ ওকে অনেক অনেক সুখী রাখুন। আর আমার মনের পর্দায় ভাবীর হাস্যোজজবল সুন্দর মুখচছবি আজীবন থাকুক যাতে আমি দোয়া করতে পারি আল্লাহ তায়ালা তাকে চির শান্তিতে রেখেছেন।

মানুষের জীবন আনন্দের আর তার মাঝেই কষ্ট লুকিয়ে থাকে নাকি ঠিক তার উল্টোটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

চলবে…