প্রবাস জীবন (পর্ব-২)

Photo of author

By Shahnaz Parveen

অকল্যানড পৌঁছানো এবং প্রথম রান্না

নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণা অতটা স্বচ্ছ ছিলনা। জানতাম দেশটি ভেড়া,গরু সমৃদ্ধ এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাবারের জন্য বিখ্যাত। তবে ভুল ধারণা একটা ছিল যেটা হলো ডাক্তার হিসেবে চাকুরী সহজে মিলবার- কত যে ভুল সে ধারণা পরে সেটা বুঝেছি। আমার বড়ভাই তখন মাত্র মাস দুয়েক হলো সেখানে গিয়েছে। তার পরামর্শেই অবশ্য আমাদের ওখানকার ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করা। সেসময় সে এবং তার কয়েকজন ব্যাচেলর বন্ধু মিলে মেস এর মতন করে থাকতো। নিজেরাই রান্না বাননা সংসার করতো, পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে অড জবও করতে হতো তাদের।মোটামুটি সবাই পূর্বপরিচিত আমার মেডিক্যালেরই, দুই একজন অন্য মেডিক্যাল কলেজের কিন্তু সকলেই আমার এক বৎসরের সিনিয়র এবং বড় ভাইয়ের ব্যাচমেট। যাবার আগেই আমরা সায়েক ভাইয়ের রান্না বিশেষ করে গরুর মাংস রান্নার সুখ্যাতির খবর জেনে গিয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে সেই অতীব সুস্বাদু মাংস খাবার সৌভাগ্যও হয়েছিল।

আমরা লম্বা ভ্রমণের পর প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে দুপুরবেলা অকল্যানড এয়ারপোর্টে পৌঁছুলাম। প্রমা শান্ত ছিল বলে বাঁচা তবে খারাপ লাগছিল ওকে দেখে, অনেকটাই বিভ্রান্ত আর আমাদের কোল ছাড়ছিল না।ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস পার হতে মোটেই সময় লাগল না।ছোট্ট এয়ারপোর্ট দেখে যদিও আশাহত হয়েছিলাম, বড়ভাই কাওসার আর সায়েক ভাইয়ের হাসিমুখ উঁকি দিতে দেখে বেশ আশ্বস্ত বোধ করলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সায়েক ভাইয়ের বড়বোন লাভলী আপার বাসায় মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য। উনি অনেক কিছু আয়োজন করেছিলেন আর হাসিমুখে আপ্যায়ন আর অনেক যত্ন করে খাইয়েছিলেন। সেটা ছিল আমাদের নিউজিল্যান্ডর প্রথম খাবার, জীবনে কোনোদিন ভুলবার নয়।আপনাদের জন্যে সবসময় মন থেকে দোয়া।

এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো গ্রোসারী শপিং এ অর্থাৎ ঘর সংসারে এই মূহুর্তে যা যা প্রয়োজন আর পরদিন থেকে খাবার রান্না আয়োজনের জন্য কি কি জরুরী তা কিনবার জন্য। সবথেকে প্রয়োজনীয় ছিল প্রমার খাবার, ন্যাপী এগুলো কিনে নেয়া। আমরা সেগুলো সারার পর আমাদের জন্যে ভাড়া করা সাময়িক বাসস্থানে পৌঁছে দিলেন ভাইয়া আর সায়েক ভাই। ওটা কবীর লোজ নামে পরিচিত ছিল আর মোটামুটি সব বাঙালীরাই অকল্যানড আসলে নাকি সেখানেই অস্থায়ী ভাবে ভাড়া থাকতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজ নিজ বাসস্থান ঠিক করে নেন। বিশাল এক পুরোনো ধাঁচের বাড়িতে ঢুকলেও আমাকে দেখানো হলো স্টোর রুমের চাইতে সামান্য বড় একটা রুম। আমাদের তিনজনের জন্যে মেঝের উপর মেট্রেস পেতে বিছানা করা। পাশে দিয়ে জায়গা নেই বললেই চলে আর বেশ উপরে ছোট্ট একটা জানালা। আমার কেমন যেনো গুদাম ঘর মনে হতে থাকলো আর দম আটকে আসতে থাকলো।

কবীর ভাবী হাসিমুখে এগিয়ে আসলেন, বললেন অন্য একটি পরিবার বড় রুমটাতে আছেন বলে আমাদের এখানেই আয়োজন করেছেন আর আমার যখন যা প্রয়োজন বা বুঝতে পারব না তা যেন উনাকে জিজ্ঞেস করতে পিছপা না হই। উনার বেহেস্তী হাসিমুখ দেখে আমি অনেকটাই আশ্বস্ত হলাম যেন বড় বোন যা আমার কোনোদিন ছিল না। আজ লজ্জা বোধ হচ্ছে উনার নামটা বলতে পারছি না বলে যেহেতু আমরা সবাই নিজ পরিচয়ের চাইতে হাসব্যানডের পরিচয়ে পরিচিত থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বেধ করি। উনার দুই ছেলে সামি আর সাদী আর উনি প্রমাকে ভীষণ আদর করতেন। উনি প্রমাকে দেখলেই আদর করে জিজ্ঞেস করতেন কি খাবে? প্রমা তড়িৎ উত্তর দিত শসা খাব আর উনি হেসে কুটিকুটি হতেন। আর সামি সাদীর বয়স সম্ভবত তের চৌদ্দ ছিল। ওরাও প্রমাকে খুব আদর করতো আর বেশ ক’দিনেই আমার অনুরাগী হয়ে পড়লো।প্রমাকে ধরে, স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে আমার কিছু জিনিষ এনে দিয়ে আমার উপকার করতো অনেক। আমি রান্না করলে তাকিয়ে থাকতো- বলতো “মা দেখো আনটি কিভাবে পেঁয়াজ কাটছে, একেবারে সেফের মতন।” কবীর ভাবী আবার হেসে কুটিকুটি হতেন আর বলতেন “যে ছুরি ধরতেই পারে না সে আবার সেফের মতন পেঁয়াজ কাটে কেমন করে?” আমাকে আড়াল করে বলতেন “ওরা দু’জনই তোমার ফ্যান বুঝলে, খুব পছন্দ করে তোমাকে।”

প্রথম দিন বিকেলেই উনি রান্না ঘরের সবকিছু আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। উনার হাঁড়ি বাসন কোথায় থাকে, লবন চিনি কোথায় থাকে এবং ব্যবহারের অনুমতি দিতে ভুললেন না। অবশ্য সে রাতে উনি উনার রান্না করা খাবার আমাদের যত্ন করে খাইয়েছিলেন। আমি উনাকে কোনোদিনই ভুলব না, আরও যত্ন করে অনেক অনেক দোয়া করব।শুনেছি সাদী ডেনটিসট আর সামি ইনজিনিয়ার হয়েছে। নিশ্চিত বিয়ে সাদী করেছে, ওদের জন্যেও মন থেকে অনেক দোয়া চলে আসে।

সেই বিকেলে আমি প্রমার জন্যে দুধসুজি রান্না করে খাওয়ালাম, বিদেশে এই প্রথম।খেতে একদম চাচ্ছিল না, কান্না করছিল কিন্তু ওই যে আমার জোর করা স্বভাব তাই ছাড়ছিলাম না। আর কোনোদিন এমনকি দাওয়াতে গেলেও ওকে না খাইয়ে আমি খেতাম না। সবাই বলতো “আপনি কেনো ঠান্ডা খাবার খান? আগে নিজে খান তারপর ওকে খাওয়ান।” আমার তা সইতো না আর তাছাড়া মনে হতো ওর ক্ষুধা জেনে আমি কেমন করে খাই? যাই হোক খাবার পুরোটা না শেষ হতেই সে বমি করে দিল। আমার চোখ দিয়ে সমানে জল গড়াচ্ছিল-কার্পেট পরিষ্কার করব,নাকি খাবার আবার রেঁধে খাওয়াব। কার্পেটে যদি দাগ পড়ে যায়! কবীর ভাবী হঠাৎ হাজির, বললেন চিন্তা কোরোনা পুরোনো কার্পেট দাগ পড়লে অসুবিধা নেই, পরে পরিষ্কার করলেও চলবে। অতঃপর সুজি মুখে দিয়ে চোখ বড় বড় করে হেসে ফেলে বললেন “ তুমি তো দেখি সুজিতে চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছো। ভাগ্যিস প্রমা বমি করেছে নইলে তো বিপদ হতে পারতো!”

চলবে…