প্রবাস জীবন (পর্ব-১)

Photo of author

By Shahnaz Parveen

আমাদের নিউজিল্যান্ড যাত্রা

জীবন অতীব সুন্দর, বেঁচে থাকাটাই আজকাল চরম ভাগ্যের ব্যপার। দুঃখ কষ্ট হাসি আনন্দ নিয়েই জীবন তবে আনন্দ পেতে যদিও মানুষ ভালবাসে তা মস্তিষ্কে বহুদিন ধরে ধারণ করে রাখতে পারে না। ‌অনেক সময় অতীতে চোখ বুলালে সুখময় দিনগুলো সহজে নজরে আসে না। কিন্তু কষ্টের মধ্যে পড়লে অতঃপর মনে হয় আহা, কি সুন্দরই না অতীতের দিনগুলি ছিলো। উল্টোদিকে দুঃখ-কষ্ট মননে,মগজে প্রচন্ড আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। মানুষ ওসব সহজে ভুলতে পারে না এবং সংগত কারণেই।প্রতিটি দুঃখ কষ্ট মানুষকে জীবন সম্পর্কে দারুন সব শিক্ষা দিয়ে যায় যা প্ররবর্তী জীবনে পথ চলাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। জানিনা জীবনের গল্প আনন্দে বা কষ্টে থাকার সময় বলা ভালো তবে এটা সত্যি মানুষ আনন্দে থাকলে স্মৃতি রোমন্থন করবার সময় সহসা পায় না।

বড়কন্যা রাতের খাবারের সময় জিজ্ঞেস করলো তোমরা যখন প্রথম দেশ ছাড়লে মানে নিউজিল্যান্ড গেলে তার গল্প করো। অবশ্য আমাকে বলেনি তবু আমার মনে কত কিছু যে নাড়া দিলো। কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় শেষ?! আমার বয়স কম, মাত্র মা হয়েছি। দেশে থাকতে মা হবার আনন্দ অপার আর কাজ অত্যন্ত কম। বড়কন্যাকে মূলত দেখাশুনা করতো আমার মা মানে তার নানী, উপরন্তু নানাভাই ও কম যেতো না, সাথে খালা মামা। দাদা দাদী ফুপুদের থেকেও সে আদর কাড়তে পারতো নিঃসন্দেহে তবে আমাদের বাড়িতে প্রমা ছিলো প্রথম নাতনী। তার রাজত্ব ছিলো সর্বক্ষেত্রে আর প্রমার বাবার পোস্টগ্রেজুয়েশন পড়ালিখায় যাতে ব্যঘাত না ঘটে সে কারণে আমাকে বাচ্চা হবার সময় এবং তারপরও মাস ছয়েক বাবার বাড়িতেই থাকতে হয়েছিল। বড় নাতি বিধায় নানা নানুর ভালবাসা ছিল অপরিসীম আর প্রমারও টান নির্দিধায় বোধগম্য হতো।

প্রমার জন্মের সময় আমরা ইমিগ্রেশন পেলেও প্রায় এক বৎসর দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটিয়ে দিলাম। কারণ ছিল প্রমার বাবার সরকারী চাকুরী। অবশেষ যখন সিদ্ধান্তে আসলাম যে যাব তখন খেয়াল করলাম আমাদের হাতে পয়সাকড়ি একেবারেই কম। আমি মাত্রই ইনটার্নশীপ শেষ করেছি আর প্রমার বাবা কয়েক বৎসর ইউনিয়ন জেলায় কাজ করবার পর ঢাকা মেডিক্যালে সি এ এবং রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করেছে। সংসার চালিয়ে সঞ্চয় করবার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনোটাই তখন আমাদের ছিল না। কিছুটা অপরিপক্ক মানসিকতা নিয়ে কিভাবে যেনো মাত্র ১৪০০ ইউ এস ডলার হাতে নিয়েই আর পরিবার পরিজন সবাইকে ছেড়ে ছোট্ট এক বৎসরের প্রমাকে কোলে করে ভাঙ্গা মন নিয়ে ১৯৯৬ সনের অক্টোবর মাসে আমরা নিউজিল্যান্ডের বড় শহর অকল্যানডের উদ্দেশে রওনা করলাম। যদিও সেদিন চোখের জল মুছেছিলাম নিজের অজান্তেই কিন্তু বুকে আশারও কোনো কমতি ছিল না ভবিষ্যত সম্পর্কে। একটা কথা না বললেই নয় যে যাবার পূর্বে প্রস্তুতি স্বরুপ আমার লম্বা চুলগুলো কেটে ছোটো করে ফেললাম যাতে যত্ন নিতে কষ্ট না হয়। দেশের বাইরে সংসারের সব কাজ করে নিজের চুলের যত্ন নেবার সময় পাওয়া যাবে না এটা যেনো কিভাবে তখন মাথায় এসেছিল।

আমাদের বিদায় দিতে আমার বাবা মায়ের যতটা কষ্ট হয়েছিল সেদিন, আমি নিশ্চিত প্রমাকে ছাড়তে তাদের ঢের বেশী কষ্ট হয়েছিল। প্রমা কথা শিখেছিল খুব তাড়াতাড়ি এবং তখন সে পুরোপুরি বাক্য সহকারে বাংলা বলতো। আমি বোধকরি খাওয়া নিয়ে বেশী জোরাজুরি করতাম বিধায় ওর প্রথম কয়েকটি বাক্যের মধ্যা একটি ছিল “ আর দিও না।” কি খাবে জিজ্ঞেস করলে বলতো” শশা খাব।” সে চৌদ্দ ঘন্টার পুরো পথই নানা নানু আর খালাকে খুঁজে কাটিয়ে দিলো। কোনো সাদা চুলের বয়ষক ভদ্রলোক দেখলেই চিৎকার করে ডাক দিতে থাকলো “নানাভাই?!!”

চলবে…