পোস্টাফিসের সেই বাক্সটা

Photo of author

By Anwar Hakim

পোস্টাফিসের সেই বাক্সটা।
আনোয়ার হাকিম।

আমাদের কৈশোরে, পোস্টম্যান ছিলো এক অপার বিস্ময়। ঝোলা হাতে বাড়ী বাড়ী চিঠি, মানি অর্ডার, পার্সেল ইত্যাদি পৌছে দেয়াই ছিলো তার কাজ। বাড়ীতে পোস্টম্যান এলে সাড়া পড়ে যেত। কখনো সেই চিঠিতে খুশীর বার্তা থাকতো। কখনো বিষাদের খবর। চিঠি অথবা টাকা দিয়েই সে চলে যেত। গুরুজনদের দেখেছি খুশীর খবর পেয়ে বা প্রয়োজনের সময় হাতে টাকা পেয়ে খুশী হয়ে সেই পোস্টম্যানকে যাইহোক জলযোগ করাতেন। কখনো কখনো হয়ত কিছু দক্ষিণাও দিতেন।

রুগ্ন, উস্কোখুস্কো, আটপৌরে কাপড় পড়া সেই পোস্টম্যান সলাজ বদনে সেই সামান্য আতিথেয়তাকে সম্মানও করতো। আজকাল সেই পোস্টম্যান আর দেখিনা। পোস্ট অফিসে যাওয়াই হয়না আজ প্রায় এক যুগ হয়ে গেল। রাস্তার মোড়ের সেই লাল কালো রঙ এর পোস্টবক্সও এখন আর দেখিনা । ছোটবেলায় তারাশংকরের ডাকহরকরা পড়েছিলাম। রাতের ঘুট ঘুটে অন্ধকারে ঝড়, বাদলা আর বিজলি উপেক্ষা করে মফস্বলের ডাকহরকরা ছুটে চলেছে লন্ঠন হাতে লাঠিকে সম্বল করে দূরের রেল স্টেশনে ডাক ধরাতে। পরে আরেকটু বড় হয়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠে শুনেছি সুকান্তের রানারের ছুটে চলার কাহিনী। সব কিছুই স্বপ্নের মত স্নিগ্ধ আর আন্তরিকতায় ভরপুর মনে হত তখন। মোটকথা পোস্ট অফিসের প্রতি এক নষ্টালজিক অনুভূতি তখন থেকেই মগজে গেঁথে গিয়েছিলো। আজো আছে। রবীঠাকুরের পোস্ট মাস্টার পড়ে জীবনে প্রথম ধাক্কা খেতে শিখেছি। সেই প্রথম জেনেছি, শহুরে শিক্ষিত বাবুদের অনেক ভাল কিছুর সাথে চতুরতা আর গা ঝাড়া দিয়ে শরীরের পানি সাফ সুতরো করার অনুষংগও থাকে। ছোট ছিলাম তাই বালিকা রতনের সাথে পোস্টমাস্টারের বিদায়ের শেষ ফয়সালা মেনে নিতে পারিনি। এই দৃশ্য কল্পনা করে কত রাত যে বালিশ ভিজিয়েছি তার হিসেব দিতে পারবো না। বড় হয়ে অবশ্য নাগরিক অনেক উপাদানের মত মেনে নিয়েছি, সত্যিই তো “পৃথিবীতে কে কাহার”? মানি আর না মানি এ বিশ্ব চরাচরে যন্ত্র আর যান্ত্রিকতার যন্ত্রনাকে উপেক্ষা করার শক্তি কারো নেই। মানুষগুলো ‘মানুষ’ই আছে। তবে রোবটের মত আগে থেকে ইংজেক্ট করা প্রোগ্রামিংয়ের দাস হয়ে।

পরিবর্তনের স্রোতে সমাজ ছুটে চলেছে। জনমানুষের রুচি, পছন্দ, অভ্যেস, চাহিদার যেমন দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে তেমনি দ্বিমুখী, ত্রিমুখী, বহুমুখীও হচ্ছে হরহামেশাই। যাযাবর দৃষ্টিপাতে বলেছেন, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। সেই বেগের দ্রুতযানে চড়ে আমরা তেপান্তর পারি দিচ্ছি নিমিষেই। আবেগ প্রকাশে নিচ্ছি বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্য। ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোন শুধু খেলনাপাতির মত করায়ত্তই হয়নি এর কল্যাণে ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ট্যুইটার, ইন্সটাগ্রামসহ আরো আরো বাতায়ন আবেগ গ্রহণ ও প্রক্ষেপণের একান্ত আপনার মাধ্যম হিসেবে নিত্য সহচর হয়ে উঠেছে। এখন যোগাযোগ বলতেই এইসব। পোস্টাফিসের সেই হলুদ খাম, পোস্টকার্ড আর দেখা যায় না। নেই সেই লাল কালো পোস্টবক্স। নেই পোস্টম্যানের হাকডাক। এখন সময়টাই হলো একাকীর। কোথাও কোন হাকডাক নেই। পাশাপাশি অবস্থান হলেও যে যার মত দূরের বৃত্ত তৈরি করে উদ্বেগ, আবেগ, আলাপ, বিলাপ বিনিময়ে ব্যস্ত। আজকালের কিশোর, যুবারা এতেই সিদ্ধহস্ত, তুষ্ট। আবেগ, বিরহ, উল্লাস, আনন্দ, বেদনা, যাতনা, হর্ষ, বিষাদ প্রকাশে এর চেয়ে আর কোন বিকল্প মাধ্যম এখন অবধি আবিষ্কৃত হয়নি। বাণিজ্যে লক্ষ্মীর বসতি। সেই বাণিজ্য ঢেউয়ে পোস্টাফিসের আটপৌরে ভঙ্গুর দশা আজ অনেকটাই প্লাস্টার উঠা চুন সুড়কির অট্টালিকা সদৃশ। এই সুযোগে বেসরকারি বণিকালয় ‘ক্যুরিয়ার সার্ভিস’র নামে অসম প্রতিযোগী হয়ে দাঁড়ায়। এর চমকে, ঠমকে পোস্টাফিসের তাবৎ ভগ্নদশা আরো প্রকট হয়ে উঠলো। ভেতরের লোকজনের উদাসীনতা, দায়িত্বে নিদারুণ অবহেলা আর প্রকারান্তরে বণিকালয়ের দক্ষিণা-আনুকূল্য পেয়ে এতকালের প্রাণের ডাকঘর তাসের ঘরের মত নিজেকে সমর্পণ করে বসলো। প্রাইভেটাইজেশনের যুগে এর দায় কার তা নির্ধারণ করা কর্তাদের কাজ। তবে পোস্টাফিসের সেই পরিত্যক্ত বাক্স মুখ উঁচিয়ে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি কখনো। লোহার বাক্সে মরিচার আস্তরণ এতই জমেছে যে ঘুণে খাওয়ার মত ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। রংয়ের প্রলেপ উঠে যাওয়ায় তা এখন ছাল উঠা সারমেয় সদৃশ হয়ে পড়েছে। না পোস্টম্যান, না আমজনতা কেউই আর একে স্পর্শ পর্যন্ত করেনা এখন। বলাবাহুল্য, নগরীতেও এই বাক্সের অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায়না। এর জন্য কোন হারানো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়নি। তার জন্য কোথাও কোন বিলাপ নেই। যদিও পোস্টাফিস আজো টিকে আছে। তবে তা নাক অবধি পানিতে দাঁড়িয়ে কেবল শ্বাস টুকু নিচ্ছে বিভিন্ন সরকারি ইন্সট্রুমেন্টের বদান্যতায়। হলুদ খাম আর পোস্টকার্ড থেকে এই বিমুখতা কি বাণিজ্য ঢেউয়ের কারণে, নাকি বেগের তাড়নায়? আগে, এই কয়েক বছর আগেও, ঈদে-পার্বণে কার্ড বিনিময় উৎসবের আমেজকে শতগুণে বাড়িয়ে দিত। প্রেমিক-প্রেমিকার মাঝে শুভেচ্ছাদূতের কাজ করত এই কার্ড। বন্ধুতা জিইয়ে রাখার আরেকটি মাধ্যমও ছিল এই কার্ড। আজকাল আমরা সবাই সেই কার্ড থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। ছোট্ট এসএমএস এখন সেই স্থানে অপ্রতিরোধ্য চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠেছে। হলুদ খামে রুল টানা কাগজে যাও পাখি বলো তারে সে যেন ভুলে না মোরে জাতীয় একান্ত ব্যাক্তিগত কথামালা আর উৎকীর্ণ হয়না। এখন আর নষ্টালজিয়ায় ভুগার সময় নাই। গিভ এন্ড টেক এর এ যুগে ধরো, মারো, করো, ভরো, ছাড়োতেই তুষ্ট সবাই।

একাল সেকালের এরুপ চিত্র চিত্রণে রজনী শেষ হলেও তুল্যচিত্রের শেষ হবেনা। তবে দিন শেষে মানুষ তো মানুষই। যন্ত্র তাকে যতই যান্ত্রিক বানিয়ে ফেলুক তার ভেতরের স্বত্বা যেমন বিপ্রতীপ কোণের আরাধ্যকে আপনার করে পাওয়ার জন্য একান্ত কোণ চায়, তেমনি দূরের কাউকে নিজের অন্তর্গত উজ্জ্বল বিষাদের কথা, স্বপ্নের কথা, মগ্ন চৈতন্যে শীষের কথা জানাতে চিরকুট বিনিময় করতে চায়। তাই এই পোস্ট বক্স, পোস্টম্যান, হলুদ খাম, পোস্টকার্ড নিয়ে নতুন করে চিন্তার সুযোগ এখনো শেষ হয়ে যায় নি। সরকারি প্রতিষ্ঠান সেবামূলক। সরকার জনকল্যাণমুখী। এর বেশির ভাগই চলে জনগণের ট্যাক্সের অর্থে। অন্য অর্থে জনপ্রিয় ‘ভর্তুকি’ শব্দটি যেন সরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক, কলকারখানার সাথে সমার্থক হয়ে গেছে। সেদিক বিবেচনায় পোস্টাফিসের শতবর্ষী চিত্র অক্ষুন্ন রাখতে সেই লাল কালো পোস্টবক্স ফিরিয়ে আনা যায় কিনা তা ভেবে দেখা যেতে পারে। সেই পোস্টকার্ডে ক্ষুদে বার্তা বা উন্মুক্ত বার্তা বিনিময়ের সুযোগ আকর্ষণীয় ঢংয়ে ও মূল্যে পুনঃ প্রবর্তন করা যায় কিনা? আর একান্ত আপনার কথাগুচ্ছকে মনের মাধুরী মিশিয়ে হলুদ খামে অপর প্রান্তে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা তাও ভেবে দেখা যেতে পারে।

বিজ্ঞান আমাদেরকে বেগ দিয়েছে, আমরা এর সুফলভোগী। আবেগ বহুলাংশে কেড়ে নিয়েছে, আমরা এর শেষটুকু নিঃশ্বেস হতে দিতে চাইনা। নির্মলেন্দু গুণের আক্ষেপ ছিল, “ আমি বলছিনা ভালবাসতেই হবে/ আমি চাই কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক/ শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য/বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত—”। এই কেউ একজন শুধু প্রেমিক বা প্রেমিকাই হবে এমন নয়। পরানের বন্ধু, সহচর বা দূরের কোন বাতিঘরও হতে পারে। ভেতর থেকে দরোজ খোলার এই আয়োজন নেই আজ। সব কিছুই চাছাছোলা। ডাইরেক্ট একশন নির্ভর হয়ে গেছে আজ। মনের সুকুমারবৃত্তির উন্মেষের প্লাটফর্ম কই? আবেগ যথার্থভাবে বিনিময়ের সেই ভেতর দরোজা কই? এমসিকিউ টাইপের প্রশ্নোত্তরে যেন আমরা আজকাল বড় বেশি মাতোয়ারা। আমাদের সেই অতি প্রিয় পোস্টাফিসকে আসুন আমরা মনের রঙ্গে আবারো রাঙ্গাই। একে আরো চিত্তাকর্ষক করে তুলি। সম্ভারে সাজাই এর প্রতিটি সেবা। জনমুখী করি এর সকল দরোজা, জানালা। খালি সাসটেনেবিলিটি আর ব্যবসা-বাণিজ্যের সুদকষা, লাভ ক্ষতির হিসাব কষে নয়। রংধনুর বে নি আ স হ ক লা দিয়ে। আবার জনরবে ভরে উঠুক পোস্টাফিস। ফিরে পাক সেই আদি ও অকৃত্রিম অনুভূতি। আমাদের গেছে যে দিন/ একেবারেই কি গেছে/ কিছুই কি নেই বাকী? রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। এই যদি সত্য হয় তবে ঘুড়ে দাঁড়াবার আয়োজন একটিবারের জন্য। লেট দেয়ার বি লাইট।