পরমা – আমার মা

Photo of author

By Alam M

কয়েকদিন আগে আমি একটা লেখা লিখেছিলাম “মেঘলা আকাশ” শিরোনামে। এখনের লেখা ঘটনাটির চুড়ান্ত ফলাফল প্রায় একই, তবে উপস্থাপন ছিলো ভিন্ন।

আমার তখন ফেসবুক ফ্রেন্ডের তালিকা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ইয়ারমেটদের গ্রুপে জয়েন করার পর থেকেই বাড়ছে। আগে আমার ফেসবুক বন্ধু ছিলো মাত্র শ’খানেক। খুব পরিচিতরাই এই লিস্টে ছিলো। আমার ফেসবুক প্রোফাইল লকড ছিলো। এবার আমি পাবলিক করে দিলাম। পাবলিক করে দেবার পর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্টের পরিমান বাড়তে থাকে। আমিও খুশি খুশি এক্সেপ্ট করতে থাকি। ফেবু বন্ধুর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেলো।

অনেক ইয়ারমেট বন্ধুদের সাথে মেসেঞ্জারে কথা হতে থাকে। হঠাত একদিন একটা মেয়ের মেসেজ। বাংলায় লেখা নাম, ‘পরমা রহমান’। কবে কখন আমার ফেবু ফ্রেন্ড লিস্টে স্থান করে নিয়েছে আমি মনে করতে পারলাম না। প্রোফাইল চেক করে তেমন কিছু জানতে পারলাম না। প্রোফাইল ফাঁকাই বলা চলে। প্রোফাইল পিকচারে নেট থেকে নেয়া বোরকায় মুখ ঢাকা ছবি দেয়া। ব্যানার পিকচার হিসেবে কোনো গোধূলি বা উষার ছবি। যাই হোক, আমি তার সালামের জবাব দিলাম,—

–ওয়ালাইকুম আসসালাম।

এরপর আর কোনো উত্তর নেই। কয়েকদিন পর আবার মেসেজ।

–আসসালামু আলাইকুম। শুভ সকাল। কেমন আছেন?

আমি ভাবছি, উত্তর দেবো কি দেবো না। শেষ পর্যন্ত সালামের উত্তর দিলাম।

–ওয়ালাইকুম আসসালাম। শুভ সকাল। আলহামদুলিল্লাহ্‌, ভালো। তুমি?

আমি ইচ্ছে করেই তুমি সম্বোধন করলাম। মনে হলো ছোট্ট মেয়ে। তুমি করে বলা যায়।

–আমিও ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ্‌।

আমি ভাবছি, কথা বাড়াবো নাকি বাড়াবো না। মন বললো, দেখিনা কি আর কি বলে। আমি মেসেজ দিলাম,–

–তোমার প্রোফাইলে তো কিছুই নেই। আমি বুঝবো কি করে তুমি কে? তুমি কি করো?

–আমি প্রোফাইলে আমার ছবি দেইনা। অনেকেই বিরক্ত করে। আমি কলেজে পড়ি। থাকি রংপুরে। আপনি কোথায় থাকেন?

–বুঝলাম, তোমায় বিরক্ত করবে বলে তুমি তোমার প্রোফাইলে নিজের ছবি দাওনা। আমার ধারনা, আমি তোমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট দেইনি। তুমিই দিয়েছিলে, কেনো? আর হ্যাঁ, আমি ঢাকায় থাকি।

কিছুক্ষণ পর দেখি একটা ছবি ইনবক্স করেছে। অসম্ভব মিষ্টি একটা মেয়ে। অল্প বয়েস। আমি ভাবতে লাগলাম, এমন একটা যদি আমার মেয়ে থাকতো! উত্তর দিলাম,—

–তুমি তো বেশ মিষ্টি মেয়ে, যেনো আমার মা।

আমি মা বলে সম্বোধন করলাম। মা বলেই ডাকা যায়। এ তো আমার মেয়ের বয়েসেই। আরও বললাম,–

–তোকে আমি এখন থেকে মা বলে ডাকবো।

এবার তুই সম্বোধন করে বললাম। টুক করে আরেকটা ছবি ইনবক্সে চলে এলো। সাথে মেসেজ,—

–এই দেখো বাবা, তোমার মেয়ে বান্ধবীদের সাথে কলেজে যাচ্ছে।

আমার এক ছেলে। অনেক বড় হয়ে গেছে। কোনো মেয়ে নেই। কেনো জানি মেয়ে পেয়ে অনেক খুশি হয়ে গেলাম। আমি একটা ছবি দিলাম। মেসেজে লিখলাম,—

–এই দেখ আমি, তোর মা, আর তোর ভাইয়া। আমি এখন একটু কাজে বের হবো। পরে কথা হবে, মা। ভালো থাকিস। ফি আমানিল্লাহ।

–তুমিও ভালো থেকো, বাবা। খোদা হাফেজ।

–আল্লাহ হাফিজ।

এভাবেই দিনের পর দিন চলতে লাগলো বাবা মেয়ের যোগাযোগ। যখনই সময় পায় মেয়েটা বাবার খোঁজ নেয়। বাবাও মেয়ের খোঁজ নেই। মেয়েটা প্রতিদিন একটা করে ছবি দেয়, আর বলে এই দেখো আজকের তোমার মেয়ে। বাবা খুশি হয়ে যায়। কেমন জানি একটা ভালোলাগা ভালোবাসার জন্ম নিতে থাকে মেয়েটির জন্যে। একদিন বললাম, তোর সাথে কথা বলতে চাই। তোর নাম্বারটা দে। আর না হয় তুই মেসেঞ্জারে কল দে। উত্তরে জানায়, আমি তো বেশিরভাগ সময় ফ্রি ফেসবুক চালাই। তাই মেসেঞ্জারে কল হয়না। আর আমার মোবাইল নেই। আমি আমার মায়ের মোবাইলে ফেসবুক চালাই। ডাটা কিনতে পারিনা। আমি বললাম, তোর মায়ের নাম্বারটাই দে, আমি ডাটা কিনে দেই। অনেক ভেবে চিন্তে একটা নাম্বার দিয়ে বললো, বাবা তুমি এখানে কখনও কল দিও না। তবে অনেক ঝামেলায় পড়বো। আমি বললাম, ঠিক আছে রে মা। আমি একটু পরে তোকে ডাটা কিনে দিচ্ছি। মেয়েটা বলে, বাবা তুমি এতো ভালো কেনো। আমি যদি সত্যি সত্যিই তোমার মেয়ে হতাম! এমন কথা শুনে মনটা আমার ভরে যায়। আমি এখন এক মেয়েরও বাবা।

কিছুক্ষণ পর আমি ঐ নাম্বারে ডাটা কিনে দিলাম, আর কথা বলার জন্যে আরও কিছু টাকা রিচার্য করিয়ে দিলাম। তারপর মেসেজ দিয়ে জানতে চাইলাম, ডাটা আর রিচার্য পেয়েছে কিনা। উত্তরে জানায়, হ্যাঁ বাবা পেয়েছি। তুমি কখনোই কল দিওনা। আমিই সময় সুযোগ মতো কল দেবো। এভাবেই প্রতিদিন কথা হয়। একটা করে মায়ের ছবি পেয়ে দিন শুরু হয় আমার।

আমি প্রায়ই মেয়েকে ডাটা কিনে কিনে দিতে লাগলাম। ফোনে কথা বলার জন্যে রিচার্যও করিয়ে দিতাম। মেয়েটাও নিজে থেকে মাঝেমধ্যে আবদার করতো। আমি কথা ফেলতে পারতাম না। শত হলেও তো আমার মেয়ে। মেয়ে তো! মেয়ে হতে গেলে কি শুধু ঔরশজাত হতে হয়? ভাবতেই আমার মনটা অন্যরকম ভালো হয়ে যায়।

আমি প্রায়ই কথা বলার কথা বলতাম। কিন্তু মেয়ে আমার এটা সেটা বলে এড়িয়ে যায়। আজ বলে এই সমস্যা, কাল বলে ঐ সমস্যা। আমি মেনে নেই। সমস্যা তো থাকতেই পারে। এভাবে চলতে চলতে মা আমার একদিন সেই মহেন্দ্র ক্ষণের কথা জানালো। বললো, কয়েকদিন পর আমি আমার খালার বাড়িতে বেড়াতে যাব। সেখানে গিয়ে আমি আমার খালাতো বোনের ফোন থেকে তোমার সাথে কথা বলবো। আমি খুশি হয়ে গেলাম। প্রতিদিনের মতো বাবা মেয়ের খুনসুটি চলতেই থাকলো। এ যেনো এক স্বর্গীয় অনুভুতি।

কয়েকদিন পর আমার ফোনে একটা কল আসে। আমি রিসিভ করতেই ওপ্রান্ত থেকে বলে,—

–বাবা, আমি পরমা। তুমি এই নাম্বারে কল দাও।

আমি কল ব্যাক দিলাম। এতোদিন পর আমি আমার মায়ের কন্ঠ শুনছি। আমি আমার খুশি ধরে রাখতে পারছিলাম না। প্রায় ১০ মিনিট কথা হলো। আমি ঠিকানা চাইলাম। বললাম, তোর জন্যে একটা গিফট পাঠাবো। এমন আরও অনেক কথা…

১৫ মিনিট পর। অন্য একটা অজানা নাম্বার থেকে কল। ফোনটা ধরতেই বললো,—

–বাবা, তুমি এতো বোকা কেনো?

–কি হয়েছে রে মা?

–আমি পরমা না বাবা। আমি আনিসা। পরমা বলে কেউ নেই। কথা বলার সময় তোমার নাম্বারটা আমি অনেক কষ্টে মুখস্ত করেছি। আমরা অনেক গরীব, বাবা। আমার মনে হলো তোমাকে সব খুলে বলা দরকার। আমি যখন পরমা হয়ে তোমার সাথে কথা বলছিলাম, তখন মনে হয়েছে সত্যিই তুমি আমার বাবা। আমার বাবাকে কেউ ঠাকাক তা আমি চাইনা, বাবা।

–আমাকে খুলে বলতো রে মা। তুই কিছু ভাবিস না।

–তোমার সাথে আমার চাচাতো ভাই পরমা হয়ে মেসেঞ্জারে কথা বলতো। ওরা এভাবে অনেকের সাথে কথা বলে। সবার কাছ থেকে টাকা নেয়। তুমি পরমা’কে মা বলে ডাকায় ওরা আস্তে আস্তে তোমার বিশ্বাস অর্জন করে আরও বেশি টাকা নেবার ধান্দা করছিলো। তুমি যখন আমাকে মা মা করে কথা বলেছো তখনই আমার মনে হয়েছে, আমি আমার বাবাকে ঠাকাতে পারবো না। তুমি বাবা আমায় মাপ করে দিও।

–না রে মা, তোর তো কোনো ভুল নেই। তুইই না হয় আমার মা। তোর কোনো কিছু দরকার হলে আমাকে বলিস।

–না বাবা, আমার কিছুই লাগবে না। শুধু দোয়া কোরো তোমার এই গরীব মেয়েটা যেনো শ্বশুর বাড়িতে একটু শান্তি পায়। ওরা আমায় শুধু কথা শোনায়। মাঝে মাঝে মারেও। আমার বাবা মা নেই। আমি এতিম। এই এতিম মেয়ের জন্য শুধু দোয়া একটু দোয়া কোরো বাবা। আর কোনোদিন কথা হবেনা তোমার সাথে। এই নাম্বারে কখনও কল দিওনা। ওরা কেউ বুঝলে আমার হয়তো আর সংসার করা হবেনা। বাবা, আমায় মাপ করে দিও।

ফোনটা রেখে দিলাম। আমি কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না। এভাবে আমার মেয়ে মিথ্যে হয়ে যেতে পারেনা। আমি কি সত্যিই বোকা? আমি তো একটা মেয়েই চেয়েছিলাম। আমার মা। একটা মিথ্যে সামনে নিয়ে এলো আরেক মা, আনিসা। যার সাথে এর আগে কোনোদিন কথা হয়নি। অথচ আজ প্রথম কথা বলেই সে আমায় তার মনে বাবার আসন দিয়েছে।

আমি এখনও মাঝে মাঝে পরমা মায়ের মেসেঞ্জার খুলে ছবিগুলো দেখি, আর মনের অজান্তেই বলে উঠি, কেমন আছিস রে মা?

মা হারায় না। মা ফিরে আসে…

লেখাটা উৎসর্গ করলাম আমার সেই মূহুর্তের মা হয়ে আসা আনিসা’কে, যার সাথে আর কখনও কোনোদিন কথা হয়নি। জানিনা, কেমন আছে। জানিনা এখনও সংসারে নিগৃহিত হচ্ছে কিনা। আমি যে কিছুই করতে পারলাম না তোর জন্যে মা।