পাপ

Photo of author

By Fatema Hossain

আলমগীর এর মা আজ সকালে কাজ করতে এসে বেশ গম্ভীর হয়ে আছে। তার বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট দুটো কেমন জানি বেশ শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে।মনে হয় আরেক টা বিড়ি খেতে পারলে তার মেজাজ টা বসে আসতো। কিন্তু এইবাসা থেকে না বেরোলে আরেক টা বিড়ি ধরাতে পারবে না।

‘দূর অ কেন যে আইলাম কামে!”‘ভিতরে ভিতরে স্বগোক্তি করে সে।

“নাহ তাড়াতাড়ি কাম সাইরা যদি তাড়াতাড়ি বাইর হইতে পারি তাইলে ঘরে গিয়া মনের সুখে একটা বিড়ি খাইতে পারুম।’

কি যে অনাসৃষ্টি চলতাছে কলোনি ডায় চোখ বুইজা আর সওন ঠিক হইব না।’
“আলমগীর এর মা তোমার কি কিছু হয়েছে, শরীর টা কি খারাপ? “আপা জিগ্যেস করেন।
উত্তর না পেয়ে তিনি আবার ও জিজ্ঞেস করলে
বেশ কড়া গলায় সে উত্তর দেয়, “আমগো ভালা-মন্দ দিয়া আপ্নেগো কি কাম আফা। “
“আমগো ভালাতেই কি আর মন্দতেই কি আপ্নের কাম তো করতাছি “

তার এরকম রুক্ষ ব্যাবহারে নীলয় এর আম্মু খুব অবাক হন।তার কোলে বছর খানেক এর ছোটো বাচ্চা। নীলয় স্কুলে পড়ে। একা একা কাজ করতে অসুবিধা হয় তারপর ও, যাকে দিয়ে কাজ করান তারও তো শরীর খারাপ হতে পারে। তার অসুবিধা হলে তিনি তাকে আজকের মতো ছুটি দিয়ে দেবেন বলেই কথাটা জিগ্যেস করেছিলেন। কিন্তু আলমগীরের মা এভাবে উত্তর দিবে তিনি তা মোটেও ভাবেন নি।তিনি তখন নরম সুরে বল্লেন, “

“তুমি এভাবে কেন বলছো বুয়া?আমার সাহায্যের জন্য তোমাকে রাখা, তাই তোমার কুশল মংগল আমার জানা দরকার মনে করেই আমি বলেছি, তুমি যদি অসুস্থ বোধ কর তাহলে আমি তোমাকে আজ ছুটি দেব তাই।”

আলমগীর এর মা সেই কত্তো বছর আগে অকালে স্বামী হারিয়ে দুই শিশু সন্তান কে নিয়ে প্রথমে ফেরি করে আলতা স্নো বিক্রি করে সংসার চালাতো।তারপর হিমসিম খেতে খেতে একসময় মানুষের বাড়ি কাজ করা ধরেছে।সেই থেকে আজ অবধি কেউ তার সাথে এমন অদ্ভুত কথা বলে নাই।তার মন টা হঠাৎ নরম হয়ে চোখ ভরে পানি এসে গেল।

“তুমি কান্দছো কেন আলমগীর এর মা?বলনা গো!”

এইবার সে চোখ মুছে বলে, আপা আমি কোনো দিন এই রকম কথা শুনিনাই, উল্টা সব্বাই শুধু কাম করনের কথাই কয়।একদিন ও বিশ্রাম দেয় না গো।”

আম্নের নামে কলোনির মাইনসে কত্তো বুরাভালা কতা কইছে,কাম না নেওনের কতা বলছে।আম্নে নাকি কিপটা তাই মানুষ রাখেন না।এই সব।অহন তো দেখি কামডা না লইলে আমিই পস্তাই তাম।”

“আরে কতজন কতো কথা বলে, তাতে কি! আমি আসলে নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করি বলে বুয়া রাখিনি। মানুষ কি করে জানবে বল?

যাক বাদ দাও, এখন যদি মন চায় তাহলে বাসায় চলে যাও,গিয়ে বিশ্রাম নাও। আজ আর কাজ করতে হবে না।
“না আফা আসছিই যখন তখন কামডা সাইরাই যাই, নাইলে ছুডো ভাইয়া কে নিয়া আপনের কস্ট হইয়া যাইবো! আর আফা কয়েক দিন ধইরা আমি একটা দুঃসচিন্তা নিয়া ঘুরতাছি, আর কয়ডা দিন দেইখ্যা লই তারপর কমুনে।”
“দেখ কিন্তু, তুমি পারবে তো?কোনো অসুবিধা হবেনা বল?”

“না আফা কিচ্ছু হইবো না, আমি পারুম নে। আপ্নে যান গিয়া বিশ্রাম লন।”

এই বলে আলমগীর এর মা ফুলজান বেওয়া নিজ কাজে মন দিল।রুমানা তখন ভাবনায় পড়ে গেল। তার নিজের থেকে কোনো ভুল হলো না তো!

আগ্রাবাদের এই পাড়াটায় কাজের মানুষ পাওয়া খুব ই মুসকিল। এলাকায় ছোটো বড়ো অনেক গুলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আর কাঁচাবাজার থাকায় এখানের বস্তি ও বাসাবাড়ি গুলোতে মেস এর মতো করে গার্মেন্টস কর্মী, কাঁচা বাজারের শ্রমিক আর রিক্সাও ট্যাক্সিওয়ালারা থাকে। রাস্তার ধারে অফিস ও স্কুলের যাতায়াত ব্যাবস্থা সুবিধা হওয়ায় নায়লা রা এখানে বাসা নিয়ে বছর সাতেক ধরে আছে।এতোদিনে এলাকার সবার সাথে চেনাজানাও হয়ে গেছে। সে যখন বড়ো ছেলে কে নিয়ে স্কুলে যায় তখন প্রায় দিন ই ছোটুকে প্রতিবেশী দের কাছে রেখে যায়।তারাও সানন্দে তাকে রেখে দেয়।কখনো মুখ কালো করেনা।

তিনমাস আগে ছোটুর একবছরের জন্মদিন হয়ে গেলে আগের মেয়েটি স্বামীর ইচ্ছেয় বাসাবাড়ির কাজ ছেড়ে গার্মেন্টসে চাকরি নিয়ে চলে গেছে। তারপর ওর ই প্রতিবেশি এই মহিলা টিকে অনেক বলে কয়ে কাজে রাজি করিয়েছে নায়লা । তাই খুব টেনসনে পড়ে গেল সে।

এই পড়াটিতে খুব ই ঘনবসতি। পাঁচসাতটা বাড়ি পাশাপাশি চিকন সরু গলি দিয়ে মেইন রোডে যাতায়াত করতে হয়।আর বাড়ির মালিকেরা স্থানীয় হওয়ায় অন্যান্য আত্মীয় স্বজন একজন আরেক জনকে এতোটুকুও ছাড় দিতে নারাজ। সেজন্য প্ল্যান মাফিক ঘরবাড়ি হয়নি, ফলে পিছনে দুটো ফাঁকা জমি রাস্তা না পাওয়ায় অযথা পড়ে আছে। তার ই একটা তে দুই লাইনে নয়টা ঘরে নয়টি পরিবার বাস করে দুই আড়াই ফিট চিপা গলি দিয়ে তারা বাঁকা হয়ে যাতায়াত করে।

এই নয় পরিবারের সবাই গার্মেন্টস কর্মী অথবা ভ্যান বা রিক্সাচালক।হাতে গোনা দু’এক জন বয়স্ক মহিলা গৃহকর্মি হিসেবে কাজ করে।

এখানে ই শিরিনা মেয়েটি তার ছোটো বাচ্চা আর রিক্সাচালক স্বামীকে নিয়ে থাকে। লায়লাদের রান্নাঘর বরাবর তার ঘর।সাথে তের চৌদ্দ বছর বয়সী মা মরা ছোটো বোন নাসিমাও থাকে। ও যখন নায়লার বাসায় কাজ ছেড়ে দেয় তখন কারণ হিসেবে বলেছিল ওর স্বামী চাইনা তার বউকে কেউ কামের বেটি বা বুয়া বলুক।

নায়লা বলে, “তোমার বোনকে তাহলে দাও।” না তার স্বামী নাকি বলে, “মা মরা বোনের ইনকাম খাবি তোর লজ্জা করে না।”

তাই শিরিনা নিজেই গার্মেন্টস এ কাজ নেয়।শুনে নায়লার ভালোই লাগে। ভাবে শিরিনার বর টা গরীব হলেও অনেক মানবিক।

আজ আবার আলমগীর এর মা কাজে আসে মেজাজ গরম করে। নায়লা জিগ্যেস করায় বলে আফা কলোনিতে পাপ হইতাছে একটা বিধি ব্যাবস্থা করন লাগবো। এমন কইরা কলোনিতে সবার লগে থাকন যাইব না।”
কেন বুয়া কি হয়েছে? নায়লা জিগ্যেস করে।

আরে আফা আপ্নে কি আন্ধা নি,বারান্দায় খাড়ান না? খাড়াইলেই দ্যাখতেন কি হইতাছে।”
” বুয়া আমি তো সময় পাইনা। তাছাড়া আমার অন্যের কাজে তাক-ঝাক করার অভ্যাসও নেই ! তুমিই বলনা কি হয়েছে!”

“আফা শিরিনায় গার্মেন্টসে কাম ডা লইয়া ভালা করে নাই গো।হগগলতে যহন কামে বাইরাইয়া যায় তহন হ্যার জামাই কচি শালিডা লইয়া দরজা দেয়। আপ্নে চাইয়েন আফা।আপনি ও দ্যাখতে পাইবেন। “

“মাইয়াডার প্যাটে ছয় সাত মাসের বাচ্চা, হেই বমি করে। চুকা খায়। প্যাট ব্যাথা কইয়া শুইয়া থাহে।”

সর্বনাশ! কি বলো বুয়া?

“হ আফা খ্যা’ল কইরেন,আমি যখন ভোরের বাসাত কাম সাইরা আপ্নের বাসাত আহি তহন বাসাত গিয়া বাথরুম সারি আর একখান বিড়ি খাইয়া আহি।হেই সুমাত মনে করেন হক্কলতে গার্মেন্টস এর কামে বাইরাইয়া যায়। কলোনিত কেউই থাহেনা। তহন হ্যারা এই কাম করে।আমার নজরে আগে আসছে। হেরপর একজন দুইজন কইরা সবাই ট্যার পাইছে।

খালি শিরিনা বলদি এ ট্যার পাইছে না।”

“আমরা শালিস বয়ামু ভাবতাছি। দু একদিনের মধ্যেই। “

এইরহম তো চলতে দেওন যায় না। আশেপাশে ঘরে পোলামাইয়া আছে হেরাও তো বদ হইয়া যাইবো “কাজ করতে করতে একনাগাড়ে গজ গজ করে চলে আলমগীর এর মা।

তার কয়েকদিন পর একদিন ছুটির দিনে সন্ধ্যায় শালিশ বসে। তুমুল হৈচৈ শুরু হয়।শিরিনা কি করবে ভেবে পাইনা। ঘর ছাড়ার নির্দেশ দিয়ে শালিস এর ব্যক্তিরা চলে যায়।

শিরিনা তখন ও বিশ্বাস করে উঠতে পারে না তার ফেরেস্তার মতো স্বামী এই রকম জঘন্য কাজ করতে পারে।
তাই সে বোন কে নিয়ে আলাদা ঘরে যায়।দরজা বন্ধ করে জানতে চায় সব কিছু।অনেক ক্ষণ পরে ভোরের দিকে ঘর থেকে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে আসে বটি নিয়ে দৌঁড়ে কোঁপাতে যায় তার স্বামীকে। লোকজন তাকে ধরে ফেলে। সে তখন বিলাপ করতে থাকে, “মা মরা বোইন ডা কে আমি সন্তানের মতো দেইখা রাখছি।আগলাইয়া রাখছি নিজের কলিজার মধ্যে। নিজে কস্ট করতাছি হেরে একটুও ফুলের আঁচড় পড়তে দেই নাই। শয়তান ডা রে বাপের মতোন বিশ্বাস কইরা রাইখা গেছি। হারামজাদায় করলো ডা কি। রক্ষক হইয়া ভক্ষণ করছে।”

অখন আমি কি করমু,মরণের পর আম্মারে কি জবাব দিমু!”

বলতে বলতে সে ফিট হয়ে যায়।প্রতিবেশিরা এসে তার জ্ঞান ফিরায়।তার নালায়েক স্বামী পালিয়ে যায়।

এই ঘটনার কয়েকদিন পর রাতের আঁধারে নিজের বাচ্চা আর সন্তান সম্ভবা কন্যাসম বোন টিকে নিয়ে সে অজানার পথে পাড়ি জমায়!

ফাতেমা-হোসেন
১১/১২/২১
সন্ধ্যা ৫,১৫ মিনিট।
(১৩-১৪/১১/২১)