সময়টা ছিলো চৈত্রের মাঝামাঝি। মার্চ শেষ হতে মাত্র তিন কি চারটে দিন বাকী। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে উজ্জীবিত হয় ২১’শে বইমেলা। তবে সে বছর করোনা থাকায় মার্চের মধ্যভাগ হতে শুরু হয়েছিলো। কখনো ভাবিনি সে বছরের বইমেলাটা আমার সারা জীবনের মুগ্ধতা হয়ে উঠবে। ভালোবাসা, ভালোলাগা অনুভূতি গুলো হয়তো ক্ষনে ক্ষনে কারোও না কারোও প্রতি জন্ম নেয়।তবে আমার ক্ষেত্রে ভালোলাগা,ভালোবাসা নয় মুগ্ধতা জন্মে ছিলো। যা আর কারোও প্রতি জন্মেনি। ভালোবাসা, ভালোলাগা একটা সময় হয়তো ফুরিয়ে যায়, শেষ হয়ে যায়। তবে মুগ্ধতা কখনো শেষ হয় না আর না কখনো ফুরাবে। আমার এ মুগ্ধতা হয়তো সারা জীবন থেকে যাবে সে মানুষটাকে হয়তো খুঁজে পাব না, হয়তো দেখা হবে চিনতে পারব না। তবুও মুগ্ধতা রয়ে যাবে আজীবন।
সালটা ছিলো ২০২১। মার্চের শেষ দিক। ফাগুনের ছোঁয়ায় সদ্য জন্ম নেয়া প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে। নব্য পাতা,গাছে গাছে নানা বাহারি ফুলের বাহার ডালে ডালে। মাটি ভেদ করে জন্মাচ্ছে সতেজ সবুজ ঘাসেরা। উফ! এত সুন্দর কেনো প্রকৃতি? চোখের পলকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। চিৎকার কারে বলতে ইচ্ছে করছে,
“ওহে প্রকৃতি রাজ আমায় মিলিয়ে দেও, মিশিয়ে নেও তোমার প্রবৃদ্ধ স্নিগ্ধ প্রকৃতির অন্তরালে। খোয়াতে চাই, বিলাতে চাই তোমার অন্তিমকালে।”
ফাগুনের সৌন্দর্যের আহাজারিতে চৈত্রও মেতে উঠেছে।
দিনটি ছিলো নাতিশীতোষ্ণ। বইমেলায় ঘুরবার উত্তম দিন ছিলো। যদিও বই প্রেমি ছিলাম না তখন। তবুও প্রতি বছর বই না কিনে চক্কর দিতাম সেখানে। কেনো জেনো খুব প্রশান্তি লাগতো, ভালো লাগা কাজ করত। আর মনে করতাম বইমেলায় গেলে সবাই আমায় বই পাগল ভাববে, আর খুব জ্ঞানী মনে করবে। আ হা হা! ভাবতেই কি প্রশান্তি অনুভব করতাম। বিশেষ করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওই লেকটা আমার ভীষণ পছন্দের ছিলো। বইমেলা ছাড়া কখনো যাওয়া হয়ে উঠত না ব্যস্ততায়। তাই সুযোগটা প্রতি বছর কাজে লাগাতাম। তবে ২০২১ শের বইমেলাটা আমার জন্য একদম ভিন্ন প্রমানিত হয়েছিলো। সেবার আম্মুর বন্ধুর প্রথম কাব্যগ্রন্হ প্রকাশিত হয়েছিলো। তার বিশেষ উপলক্ষেই সেখানে যাওয়া। আর সেদিনই দেখা হয় সে মুগ্ধকর যুবকের সাথে।
সারাদিন প্রচুর ঘুরাঘুরি করে ক্লান্ত হয়ে লেকের পাশে এসে বসি। আমার সাথে আম্মু তার বন্ধুমহল এবং তাদের পরিবারের কিছু লোকও উপস্থিত ছিলো। আমি ছিলাম তাদের মাঝে আসহায় এক এতিম বাচ্চা। না ছিলো সমবয়সী কেউ, না ছিলো কোনো সঙ্গী। তদের থেকে খানিক দূরেই বসেছিলাম আমি। একা একা বসে বসে চারদিকের মানুষ গুলোকে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। যে যার মত ব্যস্ত। কেউ ছবি তুলছে, তো কেউ আড্ডা দিচ্ছে, তো কেউ বা আবার গিটারে সুর তুলে গানের আসর জমাচ্ছে। এই সব সাধারনের মাঝেই আমার চোখের দৃষ্টি স্থির হয় অসাধারণ কিছুতে।
একজন প্রৌঢ় নারী মাটির ঘাসের উপর মাদুর বিছিয়ে কয়েকটা বেলি ফুলের মালা গাথছে। তার পাশে বসে আছে ছোট্ট একটি শিশু। বয়স সাত কি আট হবে এর বেশি না।
তার ঠিক পাশেই দাঁড়ানো এক যুবক। সে নিচে ঝুঁকে ঝুঁকে বেলি ফুলের মালা গুলো একটা একটা করে গাছের ভাঙ্গা ডালের অভ্যন্তরে তুলে নিচ্ছে। ডালটা দেখে মনে হচ্ছে স্যারের মারের হাত থেকে বাঁচার জন্য স্যারের বিখ্যাত ঔষধটা চুরি করে কেউ কেটে ছোট করে শ্রেষ্ঠ কাজে ব্যবহৃর করছে। যা দেখে আমার মনে হচ্ছে এত দিন শুধু শুধু অকাজে ব্যবহৃর হচ্ছিলো এখন ঠিক আছে।
ছেলেটি মোটোও মালা বিক্রেতা নয় তা তার পোশাক দেখে বোঝা যাচ্ছে। নেহাতই সাহায্য করছে মহিলার। তাই তাকে আজ মালা বিক্রেতা হতে হয়েছে। সে নিরদ্বিধায় মালা গুলো বিক্রি করছে। তার মাঝে সঙ্কোচ, অস্তিত কিছুই চোখে পরলো না আমার। ছেলেটা মালা গুলো ডালে সাজিয়ে সবার সামনে ধরে জিজ্ঞেস করছে,
“মালা নিবেন?”
ইশ! কন্ঠে যেনো মাধুর্য্য ঢেলে দিয়েছে দৃষ্টি কর্তা।এত সুন্দর মধুমাখা কন্ঠ বুঝি কারো হয়।
তবে আফসোস তার মিষ্টি কন্ঠ শ্রবনেও কেউ মালা নিচ্ছে না। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত। তার কথা বা কাজে কেউ কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। ছেলেটিকে দেখে যে কেউ নিসন্দেহে বলে দিবে ভদ্র ঘরের সে।
চিকন শরীরে ঢিলে ঢালা পাঞ্জাবি, চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা, এক হাতে ঘরি অন্য হাতে বেলি ফুলের গজরা। একদম বাঙ্গালী সাজ। কথা গুলো কি সুন্দর করেই না বলছে। কি মিষ্টি কন্ঠ, চাহনিতে এক রাশ সম্মান, শ্রদ্ধা ফুটে ওঠেছে, অধরে ফুটে আছে নিঃস্বার্থ স্নিগ্ধ তৃপ্তির হাসি। বিরক্তিকর শব্দটা যেন তার জীবনের শব্দ ভান্ডারে নেই। যেনো কেউ হারিকেন দিয়েও খুঁজে পাবে না। তার মুখশ্রী অত সুদর্শনও নয়। তবে সেদিন একটা কথা খুব ভালো করে বুঝেছি সুদর্শন হলেই মুগ্ধ হওয়া যায় না। সুদর্শন পুরুষের প্রেমে পরা যায় তবে মুগ্ধ হয়তো হওয়া যায় না। আর যার প্রতি মুগ্ধ হওয়া যায় তার প্রতি অনায়াসে ভালোবাসা জন্মে যায়। তবে তাকে দেখে প্রেমে না পরলেও যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। যেমনটা আমি হয়েছিলাম। মুগ্ধ!
ছেলেটিকে দূর থেকেই এক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। সে সবাইকে মালা নিবে কি না জিজ্ঞেস করতে করতে আমাদের দিকেই আসছে। আমি তখনও তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। আর মনে মনে অঙ্ক কসছি বয়স কত হবে এর? মনে তো হচ্ছে না বেশি। দেখতে সদ্য কিশোর পরিবর্ত যুবক বলে মনে হচ্ছে। মুখশ্রীতে হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়িও আছে যা মুখমুখি এলেই ঠিক বোঝা যায়। বয়স ২১ কি ২২ হবে। সেদিনের কথা মনে পরলে বিখ্যাত দুটি লাইন মনে পরে যায়,
“তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়, আমি তখন অষ্টাদশীর বেলায়।”
তবে আমি তখন অষ্টাদশী ছিলাম না। পঞ্চদশী কিশোরী।
তার বয়স সীমা অনুমান করার মাঝেই সে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। তার হাতের বেলি ফুলের কি মিষ্টি সুবাস। ইশ! মাতার করার জন্য যথেষ্ট। সেদিন প্রথম বেলি ফেলের ঘ্রানটা আমার কাছে শ’রা’ব ন্যায় মনে হচ্ছিলো। আমি মুগ্ধ নয়নে তার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছি। অতঃপর সে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
“মালা নিবেন?”
ইশ! এইটুকু কথাই যথেষ্ট ছিলো আরও মুগ্ধ করার জন্য। তার প্রতি মুগ্ধতা কয়েকশ গুন বেরে গেলো। ইশ! এত ভদ্র আর ইনোসেন্ট কি করে হয়? তার ওষ্ঠে তখনও সেই মুগ্ধকর হাসি ফুটে আছে। আমি নির্বাক হয়ে মুগ্ধ নয়নে শুধু তাকিয়ে ছিলাম। সে আমায় কিছু বলতে না দেখে সেই হাসি ওষ্ঠে ঝুলিয়ে হাটা দিলো নতুন ক্রেতার কাছে। আমি তখনো তাকি আছি তার যাওয়ার পানে। সে খানিকটা দূরে যাওয়ার পর আচমকা মনে হলে “আমি গজরাটা নিলাম না কেনো?” মনে মনে নিজেকে হাজার বার বকা দিচ্ছি। কেনো করলাম এমন? যদি নিতাম তাহলে তার সাথে একটু হলেও কথা হতো এবং ওই মহিলাটিরও সহায়তা করা হতো।
অতঃপর সিধান্ত নিলাম আমি নিজে গিয়ে তার কাছ থেকে গজরাটা কিনবো। ঠিক তখনই আম্মু আমাকে ডেকে বলে,
“চলো এখানে আর বসবো না অন্য দিকে হাঁটব সবাই।”
আমি কেনো জেনো আর পিছনে ফিরে তাকাইনি। চলে এসেছি। জানি না কেনো ফিরে তাকাইনি? হয়তো ইচ্ছে হয়নি, হয়তো মুগ্ধতা তখন প্রকাশ করতে পারিনি, হয়তো প্রকাশ করতে চাইনি। হয়তো অযথা, ফালতু চিন্তা ভাবনায় নিজেকে বিলাতে চাইনি। হয়তো! ঠিক বুঝিনি কেনো?
সে বছরের জন্য মুছে গেলো চৈত্রের ১২ তম দিনটির কথা। বাসায় ফিরে আর মনে পরেনি সে কথা। মুগ্ধ হয়েছিলাম কারও প্রতি তাও ভুলে গেলাম।
ব্যস্ততায় চলে গেলো আবারও একটি বছর।
চলে এসেছে নতুন বছর ২০২২। এবার বইমেলা ফেব্রুয়ারীর মধ্যভাগ থেকে শুরু হয়। আমি যেদিন গেলাম সেদিনটি ছিলো চৈত্রের প্রথম দিন। এখন আশ্চর্য হই খুব। এই চৈত্র মাসেই তো দেখা হয়েছিলো মুগ্ধ যুবকের সাথে। তবে এবার আমি দেরি করে ফেলি। দিনের শেষপ্রহরে আমার আগমন ঘটে সোহরাওয়ার্দী উদ্যাণে। সন্ধ্যা নেমে এসেছে চারদিকে। এবারও আম্মুর বন্ধু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এবারও সে বিশেষ উপলক্ষেই যাওয়া। সবার সাথে সাক্ষাৎ শেষে আমি আমার ছোট ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পরলাম বই প্রদর্শন করতে। পুরো বইমেলা ঘুরলাম। একটাও বই না কিনতে পেরে দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আম্মুর কাছে ফিরছিলাম।
তবে ভাগ্যক্রমে অনাকাঙ্ক্ষিত সাক্ষাৎ ঘটে। আবার আমার সেই গজারা হাতে থাকা ছেলেটার সাথে। তবে তাকে আমি চিনতে পারিনি। তাকে দেখা মাত্র হাটার গতি কমে এসেছিলো। মনে করার চেষ্টা করছিলাম কোথায় দেখেছি। তার মুখটা ছিলো উল্টো পাশে যা আমি দেখতে অক্ষম হই। অতঃপর সে খানিক পিছনে মোড় নিলো আর আমিও হাঁটতে হাঁটতে আবার তার পিছনে চলে এসেছি। তাবুও তার হাতে আবারও সেই বেলি ফুলের গজরা দেখতে পাই একই রকম ভাবে। তাও মনে করতে পারছিলাম না। ভাবতে ভাবতে আনমনে খানিক দূর চলে এসে পরি। হঠাৎ মনে পরে গত বছরের চৈত্রের ১২ তম দিনের কথা। আমি তড়িৎ বেগে পিছনে ঘুরে সে পথে হাটা দেই। খানিক দুরেই চলে এসেছি। তাই পেছনে ফিরে তাকে দেখিনি।
যেখানে দেখে গেছিলাম সেখানে আর তাকে দেখলাম না। যেই ভাবলাম আর একটু সামনে গিয়ে দেখি তার আগেই আমার ভাই আমার হাতটা ধরে টেনে আনতে আনতে বলে,
“চল তারাতাড়ি আম্মু খুঁজবে। “
অতঃপর আমি আর কিছু বলিনি তার সাথে হাটা শুরু করি।
মনের মধ্যে আফসোস, হতাশ, বিরক্ত, রাগ, ক্ষোভ সব প্রতিক্রিয়া চলতে থাকে। আজও ঠিক সেই জায়গায় দেখায় হয়েছিলো যেখানে সেই প্রথম দেখা হয়। ততক্ষণে চিনতে বড্ড দেরি করে ফেলি। তবে এবারও কাকতালীয় ভাবে একই সাজে ছিলো। বাঙ্গালী সাজ যাকে বলে। পাঞ্জাবি, চশমা, ঘরি, গজরা সবই একই ছিলো। তবে আফসোস এবারও তার সাথে আমার দেখাটা ছিলো ক্ষনিকের।
তবে একটা কারনে খুব আফসোসও হয়। ইশ! যদি আমিও বাঙালী সাজে সেজে যেতাম হয়তো গজরাটা কিনে নিতাম, বাধতাম খোঁপায়। আর কথা হতো মুগ্ধ যুবকের সাথে।
গল্পটা আজ দারিয়েছে পেয়েও হারিয়ে ফেলায়।
অতঃপর সেই সাথেও বাড়ি আসার পর আমি আবারও ভুলে গেলাম সেই চৈত্রের প্রথম তম দিনের কথা। হঠাৎ পুরোনো একটি বই সামনে পরে। বইয়ের প্রথম পাতায় লেখকের অটোগ্রাফ আর সেখানে তারিখও আছে। তারিখটা দেখে হঠাৎ মনে পরে মুগ্ধ যুবকের কথা।