অদ্ভুত সে-ই বয়স্ক মানুষটি

Photo of author

By Syed Mohammad Abu Daud

ঢাকা যাচ্ছি। তূর্ণা নিশিথায়। ট্রেনটির কূপে একটি সীট রিজার্ভ করা আছে। তাতে উঠে বসে সহযাত্রী দেখে মন খারাপ হয়ে গেলো। থুত্থুরে এক বুড়ো। মার্চের গরমেও গায়ে শাল দিয়ে উবু হয়ে সামনের সীটে বসে আছেন। পাশে ঠোঙা ভর্তি পান। মেজাজটাই বিগড়ে গেলো। অভিজ্ঞতা থেকে জানি এ বয়সের মানুষের বাড়িতেই ঠিকমতো ঘুম হয় না, ট্রেনে তো তা দূর অস্ত। এরা সারারাত খকখক কেশে রাত পার করেন আর পাশে যে থাকে তার ঘুমের বারোটা বাজান। তার উপর তাঁর মুখ থেকে ভেসে আসছে কড়া জর্দার গন্ধ। রেলের বদ্ধ এসি রুমে এধরনের গন্ধ যে কী ভয়ংকর তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। তার উপর এসি ঠিক মতো কাজ করছে না। আমি কোনো রকমে নাকমুখ চেপে বসে আছি, ট্রেন ছাড়লেই শুয়ে পড়বো, কিন্তু তা ছাড়ার নাম নেই।

ট্রেন নির্জন, শুধু বাতাসে জর্দার কটু গন্ধ। তিনিই সে নির্জনতা ভেঙে বললেন, আপনি খুব বিরক্ত হচ্ছেন তাই না?

আমি খুব লজ্জা পেলাম, বয়স্ক একজন মুরুব্বি আমার বিরক্তি ধরে ফেলেছেন, এটা আমাদের সামাজিক ভদ্রতার সাথে যায় না। আমি কথা খুঁজে না পেয়ে আমতা আমতা করতে লাগলাম। তিনি হেসে বললেন, বুড়োদের দেখলে সবাই বিরক্ত হয়, কিন্তু একবারও ভাবে না যে প্রত্যেক বুড়োই আসলে একজন বীর৷ ইফ দেয়ার ইজ অ্যান ওল্ড ম্যান, দেয়ার ইজ আ হিরো।

আমি অবাক হয়ে বললাম, মানে?

তিনি জর্দা খাওয়া খয়েরি দাঁত বের করে হেসে বললেন, আমার বয়স নব্বই, তার মানে তরুণ কিংবা পৌঢ়ত্বে আমি মৃত্যুকে জয় করেছি। মৃত্যুর মতো অজেয় শক্তিকে পরাজিত করে নব্বইয়ে কজন পৌঁছাতে পারে ইয়াং ম্যান? তাই প্রতিটি বুড়োই মৃত্যুঞ্জয়ী বীর, হাহাহাহাহা।

আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, কথাটা ঠিক তো! এভাবে তো চিন্তা করিনি!

আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি যেন মজা পেয়েছেন, হাসি ধরে রেখে বললেন, তবে মাঝে মাঝে তারুণ্যকে খুব হিংসে হয়, আহা! কী অমিত শক্তি তাদের, কিন্তু হিংসে করি না।

কেন করেন না? একটু বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। চিরকাল জেনে এসেছি বয়স্কদের ধর্মই হচ্ছে তারুণ্যের প্রতি ঈর্ষা।

তিনি নতুন একটি পান মুখে পুরে তা চিবুতে কিছু সময় নিলেন, তারপর বললেন, মহাকালের বিবেচনায় মানবজীবন একটি মুহূর্ত মাত্র। এ অতি ছোট্ট জীবনে হিংসা করার মতো সময় আমার নেই। কারো থাকা উচিত নয়।

তাঁর কথাগুলো অদ্ভুত রকমের সত্য, যা আমরা জানি কিন্তু খেয়াল করি না। এবার নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, এ দীর্ঘ জীবন আপনার কেমন কেটেছে? কোনো আফসোস আছে?

গায়ে শালটা আরো ভালোভাবে মুড়িয়ে তিনি বললেন, আফসোস তো সুখের অপর পিঠ। এক পিঠের মুদ্রা হয় কখনো? তারপর আর কিছুক্ষণ পান চিবিয়ে বললেন, অবশ্যই আফসোস আছে। জীবন সব সময় সুবিবেচনা করে না; কিন্তু তারপরও তা সুন্দর, জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কিছু নেই।

তাঁর প্রতি আমার আগ্রহ বেড়ে যাচ্ছে, পান খেয়ে দাঁত লাল করা অতি সাধারণ মানুষটি একদম সরল ভাষায় কঠিন সব সত্য বলে যাচ্ছেন।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, মানুষের সবচে বড়ো ভুলগুলো কী কী?

তিনি আবার হাসলেন, ‘ ইয়াং ম্যান, আপনি আমাকে জ্ঞানী ভাবছেন, আমি কিন্তু তা না, ম্যাট্রিক পাশ মাত্র, হাহাহাহা।’

‘আমি শিক্ষা নয় আপনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে বলছি।’

‘মানুষের সবচে বড়ো ভুল চরম বেদনার সময় একা কাঁদা- এসময় খুব প্রিয় একজন মানুষকে সাথে নিয়ে কাঁদলে কষ্ট অনেক কমে যায়।

এরপরের ভুল হচ্ছে, সন্তানদের কাছে চোখের পানি লুকানো।’

‘বাচ্চাদের সামনে কাঁদতে হবে কেন?’ আমি রীতিমতো হতবাক।

‘ইয়াং ম্যান, বাচ্চাদের সামনে কান্না লুকাবেন না, কারণ তাদের জানা দরকার কখন মা-বাবা কাঁদেন।’
ট্রেন লম্বা হুইসেল দিচ্ছে, যাত্রা শুরুর সংকেত। তিনি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আমি আগ বাড়িয়ে বললাম, কোনো হেল্প লাগবে?

‘না, এ সামান্য কাজে আপনার সাহায্য নেওয়া মানে নব্বই বছর বয়সেও শরীর শক্ত রেখে খোদা যে দয়া দেখিয়েছেন তাকে অবজ্ঞা করা।’ বলতে বলতে তিনি বিছানা গুছাতে লাগলেন।

আমি দ্রুত কণ্ঠে বললাম, ঘুমানোর আগে কি আমাকে কিছু একটা বলতে পারেন? যা আমি ফলো করবো।

তিনি কাৎ হয়ে শুতে শুতে বললেন, ম্যাট্রিক পাশের আবার উপদেশ! আচ্ছা, যান, শুধু একটা কথা মনে রাখবেন, কখনোই অন্যের জীবনের সাথে নিজের জীবনের তুলনা করবেন না, আপনি আসলে জানেন না তিনি কিসের ভেতর যাচ্ছেন।

তারপর মাথাটা শাল দিয়ে ঢাকতে ঢাকতে বললেন,
ও আরেকটা কথা আছে, চাকরি চাকরি করে জান দেবেন না, হাসপাতালে ভর্তি হলে মাথার পাশে চাকরি বসে থাকবে না, সেখানে বসে থাকবে পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব – তাই চাকরির পাশাপাশি এদেরও যত্ন নেবেন।

কথা শেষ করেই তিনি বিড়বিড় করতে লাগলেন,
‘আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়া আহইয়া।’

ঘুমানোর আগের দোয়া।
দোয়াটি আমার বাবা সব সময় পড়তেন- ‘হে আল্লাহ! আপনারই নামে মরে যাই আবার আপনারই নামে জীবন লাভ করি।’