অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৫)

Photo of author

By নবনিতা শেখ

ভর সন্ধ্যেতে এই উৎসবমুখর পরিবেশে চারিপাশে শুধু একটাই নাম ভেসে আসছে। “তৃষ্ণা!”

এতক্ষণ গানটিতে এতটাই ডুবে গিয়েছিলাম যে আর খেয়াল আসেনি গানটি কোত্থেকে আসছে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি, আমার সামনের সবগুলো ঘোর লাগানো নয়নে আমার পেছনে দেখছে। দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকালাম। স্টেজের উপর ব্ল্যাক শার্ট আর জিন্স পরা এক যুবক। কি সুন্দর দেখতে!

হঠাৎ সামনের এই যুবকটির দৃষ্টির সাথে আমার দৃষ্টির মিলন ঘটলো। মাদকতায় ভরা নীলাভ চক্ষুদ্বয়। আমি সেখান থেকে তৎক্ষনাৎ প্রস্থান ঘটালাম।

কিছুদুর এগোতেই রুশী আর অয়নকে চোখে পড়লো ওদের কাছেই এগিয়ে গেলাম। আমি যেতেই রুশী আমাকে বললো,“চল, ফুচকা খাবো।”

“আমি খাবো না রে।”

“প্লিজ…”

রুশীর এমন ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলাম না। অয়ন নাক সিটকালো। এসব অয়নের পছন্দ না। বিরক্তির সহিত বললো,“তোরা মেয়ে জাত কি এসব উল্টা-পাল্টা খাওয়া ছাড়া শান্তিতে বাঁচতে পারিস না?”

রুশী চেঁতে উঠলো। হাজার হোক, ফুচকা ভীষণ প্রিয় ওর। এই নিয়ে খোটা বাক্য শুনতে নারাজ। হালকা তেজ মিশ্রিত কন্ঠে বললো,“এই তোকে জোর করেছি আমি? আসতে ইচ্ছে হলে আয়, নয়তো ভাগ। তবুও উল্টা পাল্টা বকবি না।”

অয়ন মুহুর্তেই নিভে গেলো। আমাদের ছাড়তে পারবে না, অগত্যা কথা বন্ধ করে

চুপ হয়ে আমাদের সাথেই এলো।

তিনজন চললাম ফুচকার স্টলে। যেতেই রুশী ফুচকা মামাকে উদ্দেশ্য করে বললো, “মামা! দুই প্লেট ফুচকা দিন তো। দুটোতেই প্রচুর ঝাল দেবেন।”

মামা মৃদু হেসে “আইচ্ছা আম্মা” বলে ফুচকা বানানোতে মনোযোগ দিলো। আমি ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকালাম। অয়নের একটা কল আসায় একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। ও রুশীর ঝাল নেওয়ার কাহিনী শোনেনি। শুনলে হয়তো খেতে দিতো না। রুশী আমাকে নিয়ে পাশের বেঞ্চিতে বসতেই আমি বলে উঠলাম,“এতো ঝাল খাবি তুই? তুই না বেশি ঝাল সহ্য করতে পারিস না?”

রুশী ডান হাতটি মুখের সামনে এনে হেসে দিলো। অয়ন তন্মধ্যে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে। রুশীর হাসির সাথে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজটা সোজা গিয়ে বিঁধলো, পাশে দাড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটির বুকে। জীবনের সেরা সৌন্দর্যপূর্ন দৃশ্য উপভোগ করছে সে। আঁখি পল্লব ফেলতে ভুলে গিয়েছে। স্থির দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে এই মোহময়ী নারীকে। রুশী ওষ্ঠদ্বয়ে হাসির রেখা বজায় রেখেই বললো, “বা রে! ফুচকা খাবো, ঝাল ছাড়া? তা হয় নাকি?”

আমি কিছু বলতে যাবো, তার আগেই মামা দুটো ফুচকার প্লেট এগিয়ে দিলো আমাদের দিকে। প্লেট দুটো হাতে তুলে নিলাম। অয়নের এসবে বড্ড সমস্যা, তাই সে খাবে না। রুশী তাও ওকে একবার সাধলো। নাকচ করতেই রুশী মুখ বাঁকালো। আমার ঝাল পছন্দ খুব, সইতেও পারি ঝাল। তাই সমস্যা নেই।

রুশী মুখ বড় করে পুরো একটা ফুচকা মুখে পুরে নিলো। কিন্তু, মনে হচ্ছে ঝালটা একটু বেশিই লেগে গিয়েছে। আমি আস্তে করে বললাম,“সমস্যা হলে খাস না কিন্তু।”

রুশী জোরপূর্বক এক হাসি দিলো। তার ফর্সা মুখমণ্ডল লাল হয়ে গিয়েছে। পুনরায় ফুচকা মুখে দিলো। অয়ন আমাদের থেকে কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো তার দেখার ঘোর এখনও কাটেনি। দ্বিতীয়বার ফুচকা মুখে দিতেই রুশীর চোখ ভিজে এলো। ঝালে আর খেতে না পেরে গলায় আটকে গেলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে প্রায়। নিশ্বাস নেওয়ার চেষ্টায় মুখটা “হা” আকৃতির করে ফেলেছে। আমি ফুচকা ফেলে ওর দিকে তাকালাম। ধুক করে উঠলো আমার বুক, মুহূর্তেই কি অবস্থা করে ফেলেছে নিজের। ইতিমধ্যে অয়ন আমাদের সামনে এসে হাজির। রুশীর এই অবস্থা ওর মনে কি প্রভাব ফেলছে তা আমার বোধগম্য নয় অস্থির হয়ে আছে সে। যেনো রুশীর নিশ্বাসের সাথে তার নিজের দমও আটকে আছে। হাঁটু মুড়ে বসে রুশীর গালে হালকা থাপড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছে,“এএই! ক’কী হয়েছে তোর? ওমন করছিস কেনো?”

আমি অয়নকে উদ্দেশ্য করে বললাম,“পানি নিয়ে আয় ফাস্ট!”

অয়ন উঠে ফুচকার স্টলে গেলো। মামাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো, পানি তো ফুরিয়ে গিয়েছে। অয়নের অবস্থা রুশীর চেয়েও নাজেহাল। দৌড়িয়ে গেলো কোথাও একটা। মিনিট দুইয়েকের মধ্যেই পানি নিয়ে হাজির। সাথে আইস্ক্রিম। রুশীকে পানি খাওয়ালাম। এখন শ্বাস নেওয়ার গতি স্বাভাবিক হয়েছে তবে ঝাল কমেনি। অয়ন রুশীর হাতে আইস্ক্রিম দিলো। রুশী খেতে খেতে খানিকটা স্বাভাবিক হলো। অয়নের দিকে তাকালাম আমি। চোখ মুখের কি অবস্থা! পুরো চোখ রক্তলাল হয়ে আছে। ফর্সা মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। চুলগুলো এলোমেলো। কি বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে!

রুশীর পুরোপুরি ঠিক হতেই ওকে নিয়ে দাঁড় করলো। পাশের গাছটির সাথে ধাক্কা দিয়ে বাহুতে চেপে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলো,“তুই ঝাল খেয়েছিস কোন সাহসে?”

রুশী অয়নের এই ক্রোধের সাথে পূর্বপরিচিত। জানে এখন কি হতে যাচ্ছে। তবুও তুতলিয়ে বললো, “য’যা হ’ হবার হয়েছে, ক’ কিছু বলিস না প্লিজ।”

রাগের তেজ বেড়ে গিয়েছে অয়নের। ছেড়ে দিলো রুশীকে। পাশের বেঞ্চিতে একটা লাথি দিলো। বড় বড় পা ফেলে চলে গেলো সেখান থেকে। রুশী ওখানেই দাঁড়িয়ে দম ফেলছে। অয়ন খুবই শান্ত ও চঞ্চল প্রকৃতির ছেলে। কিন্তু রেগে গেলে পুরো উল্টে যায় ও। আমি রুশীর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। রুশী ভয় পাচ্ছে। অয়ন এতো রেগে আছে। কোথাও কোনো গন্ডগোল পাঁচটি কাবে না তো?

আমি রুশীকে নিয়ে ভার্সিটির পেছনের দিকটায় গেলাম। একজনের তীক্ষ্ণ নজর যে আমারই উপর অবলোকন করছে, তা হতে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত আমি।

________________________

“স্যার! আপনাকে এতো বার কল করি করছিলাম।”

রুদ্রের বলা কথার প্রেক্ষিতে আরহান বললো, “আ’ওয়াজ আউট অফ কভারেজ..”

রুদ্র অস্থির ভঙ্গিতে বললো, “অনেক বড় এক ঘটনা ঘটে গিয়েছে এদিকে স্যার।”

“হোয়াট! কী হয়েছে? ইজ শি ওকে?”

“স্যার, ম্যাম তো ঠিক আছে। তবে..”

“ক্লিয়ারলি বলো কি হয়েছে।”

“তৃষ্ণার খোঁজ পাওয়া গিয়েছে।

“দ্যাট’স আ গুড থিং..”

রুদ্র জিভ দিয়ে ঠোঁট খানিকটা ভিজিয়ে বললো,“স্যার ঘটনা এটা না। ঘটনা হচ্ছে, তৃষ্ণা ম্যাম এর ভার্সিটিতে আছে।”

আরহান চিল্লিয়ে বলে উঠলো,“হোয়াট? ওখানে কি করছে?”

আরহানের চিল্লানো স্বরে রুদ্রের ভয় বেড়ে গেলো। এরপরের কথাটা বললে কি যে হবে! কিন্তু বলতে তো হবেই।

“আজ ম্যাম এর ভার্সিটিতে নবীন বরণ অনুষ্ঠান ছিলো। সেখানেই স্পেশাল গেস্ট হয়ে এসেছে।”

আরহান বুঝলো সেখানে তৃষ্ণার আসার কারণটা। এতক্ষণ দমটা আটকে এসেছিলো, একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। যাক! তার শুকতারার খবর পায়নি তৃষ্ণা।

রুদ্র ফটাফট একটা শ্বাস নিয়ে চোখ বুজে একটানে বলে ফেললো,“তৃষ্ণা, ম্যাম এর দিকে তাকিয়ে আছে প্রায় ঘন্টা খানেক।”

আরহান চুপ মেরে গেলো। যা করার জলদি করতে হবে তাকে। রুদ্রকে “ওকে,স্টে উইথ ইউর ম্যাম..” বলেই আরহান কল কেটে দিলো। তার মাথায় এখন অন্য কিছু ঘুরছে। এতো চেষ্টা করে তার শুকতারা থেকে নিজেকে আলাদা রেখে কি লাভ হলো? যার থেকে বাঁচানোর জন্য গভীর রাতে গিয়ে তার শুকতারাকে দেখে চক্ষু তৃষ্ণা মেটাতো, আজ তারই নেশাক্ত নজর থেকে বাঁচাতে অক্ষম আরহান। এখন একটাই উপায়..

_________________

ক্যাম্পাসের একদম পেছনের দিকটায় রয়েছে একটা বকুল ফুল গাছ। সেখানেই মুখশ্রী গম্ভীর ভাব করে বসে আছে রুশী। ঠিক পাশেই আমিও আছি। ভীষণ চিন্তিত আমরা। আমাদের দুজনেরই ভাবনার মূল কারণ অয়ন। সেই যে গেলো, আর খুঁজে পেলাম না। কল ও দেওয়া হয়েছে বেশ কয়েকবার। প্রতিবারই ওপাশ থেকে একটা মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে আসে,“দুঃখিত! কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।”

রুশী খুবই নরম ও মিশুক প্রকৃতির হওয়া সত্বেও এই মুহূর্তে তার খুব করে ইচ্ছে হচ্ছে, ফোনের ওপাশের ঐ মেয়েটিকে ধরে দু’চারটে গালি শুনিয়ে দিতে। কিন্তু ওর ডিকশনারিতে তো গালি নেই। রুশী এবার মাথা উঁচু করে আমার দিকে তাকালো। চোখ দুটো ছলছল করছে। ঠোঁট চেপে রেখেছে। হয়তো কান্না হজম করার ব্যার্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু ও পারলো না। কার্নিশ বেয়ে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আমি তড়িঘড়ি করে রুশীর দু’গালে নিজের হাত রাখলাম। অতি সন্তর্পনে অশ্রুকণা মুছে দিয়ে মৃদু আওয়াজে বলে উঠলাম,“পাগলী কাঁদছিস কেনো?”

রুশী কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠলো,“তার ক্রোধে আমার সহস্র ক্ষতি মানতে রাজি আছি। তবে সে হীনা, তার অবহেলা মরণ যন্ত্রণা সম..”

।“এতো ভালবাসিস?”

কান্না থেমে গেলো। স্থির নয়নে আমার দিকে তাকালো। চোখ দুটোতে অবিশ্বাস। হয়তো বিস্ময়।

“এটা বুঝি ভালোবাসা?”

“হুঁ”

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আকাশের দিকে চোখ তুলে বললো,“ওকে ভালোবাসি কিনা জানা নেই। তবে ওর জন্য বুকটা খুব পোড়ে আমার।”

“অয়নকে বলবি না এই ব্যাপারটা?”

“যেদিন এই ভালোবাসার সম্পূর্ণ অনুভূতির সাথে পরিচিত হবো, সেদিন অবশ্যই বলবো।”

“দেখিস! দেরি যেনো না হয়ে যায়।”

রুশীর আর কিছু বলার আগেই আমার ফোন বেজে উঠলো। আমাদের একটা ফ্রেন্ডের নম্বর। নেহা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নেহার অস্থির কন্ঠে শোনা গেলো,“তোরা কোথায়?”

“ক্যাম্পাসেই আছি। কেনো কি হয়েছে?”

“স্টেজের এদিকে আয়, ফাস্ট। ঝামেলা হচ্ছে খুব।”

আমি “আচ্ছা আসছি” বলেই কল কেটে দিলাম। রুশীকে নিয়ে স্টেজের দিকে এগোলাম। জানিনা কি হচ্ছে। তবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছি। গিয়ে দেখি অয়ন একটা ছেলেকে বেধড়ক পেটাচ্ছে। অয়নও মার খাচ্ছে। ইতিমধ্যে অয়নের সাদা পাঞ্জাবি রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। রুশী অয়নকে এই অবস্থায় দেখে স্থির হয়ে গিয়েছে। অয়ন এমন না। আমি রুশীকে ডাকলাম। ও আর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে এগিয়ে গেলো। অয়নকে ছাড়িয়ে আনতে যেতেই অয়ন রুশীকে আক্রমণ করতে যায়। কিন্তু কিছু করার আগেই থেমে যায়। মুখ দিয়ে অস্ফুটস্বরে বুলি আওড়াচ্ছে,“ওর সাহস কি করে হয়? কোন সাহসে ও আমার জানকে নিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলে? আমার কলিজায় হাত দেওয়ার সাহস কে দিয়েছে ওকে? আজ তো ওকে আমি..”

কথাটি শেষ করেই পুনরায় মারতে যায় ছেলেটিকে। আমি আর রুশী মিলে ধরে ফেলি। পুরো ক্যাম্পাসের নজর এখন আমাদের দিকেই। অয়নকে নিয়ে পাশের এক ফার্মেসিতে যাই। অনেকটা জোর খাটিয়েই আনতে হয়েছে। অয়ন এখনও রাগে ফুসছে। ওর সামনে এখন কিছু বলা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। রুশী চুপিসারে অশ্রুপাত করছে। আমিও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে ব্যাস্ত।

শুরু থেকে এই অবধি কারো গভীর নজর আমার উপর ছিলো। সে তৃষ্ণার্ত নয়নে তাকিয়ে বলছে,“প্রথম দেখায় আমার অস্থির নয়ন যাকে দেখে থমকে গেলো, প্রহর ভুলে গেলো, এক আসক্তির সন্ধ্যান পেলো সে নিশ্চয়ই আমার নয়নের তারা। আমার নয়নতারা।”

পকেট থেকে ফোন বের করে একটা নম্বর ডায়াল করে কল লাগালো। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই বললো,“একটা ছবি পাঠাচ্ছি, এ টু জেড ইনফরমেশন চাই আমার।”

“ওকে বস।”

কল কেটে দিলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা হাসলো।

___________________

ভর সন্ধ্যে, সূর্য ঢলে পড়েছে বেশক্ষানিক আগেই। বাড়ির রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছি আমি। রুশী আসতে চেয়েছিলো, কিন্তু আমি মানা করে দিয়েছি। ভার্সিটি থেকে ওর বাড়ি, আমার বাড়ির ঠিক উল্টো রাস্তায়। আমাকে ড্রপ করতে এলে ওর বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যেতো। এই রাস্তাটা ঠিক হয়েছে কয়েকদিন আগেই। মানুষজনের যাতায়াত কম না। কিছুটা এগোতেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখলাম। ভীষণ পছন্দ এই গাছটি আমার। মাঝে সাঝেই এখানে বসা হয়। এগিয়ে গেলাম। পাশেই একটা বেঞ্চ আছে। বসে পড়লাম সেখানে। হালকা বাতাস আর মাথার উপর কৃষ্ণচূড়া ফুলের আবরণ। ব্যাপারটা দারুন! মাথাটা খানিক উঁচু করে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ঐ দূর আকাশপানে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে প্রকৃতির এই সৌন্দর্য দেখে গেলাম। মিনিট দশেক যেতেই চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললাম। প্রকৃতি সবাইকে একই সাথে দুটো উপহার দেয়। একটা ভালো, অন্যটা খারাপ। হয়তো সবসময় খারাপটা সামনে থাকে আর ভালোটা আড়ালে। সবাই আত্মবিশ্বাসী নয়। তাই আগে থেকেই ভেবে নেয়, তার সাথে খারাপটাই হবে। গ্রহণ করে যন্ত্রণার কাগজে মুড়ে রাখা একটা কষ্ট নামক উপহার। আর ভালোটা? সে তো পড়ে থাকে মস্তিষ্কের এক কোণে। ভাবলেই না আসবে! ভাবেটা কে? যেটুকু সময় আফসোস করে বেড়াই আমরা, সেটুকুকে কাজে লাগিয়ে জীবনে সুখ খুঁজলেও অনেক আগেই পেয়ে যেতাম।

আমি আমার এটুকু জীবনে বাস্তবতা অনেক ভালো করে জেনেছি, বুঝেছি। জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি সেদিন, যেদিন ছোটমা আমার নামে বাবার কাছে মিথ্যে বললো, আর আমার বাবা আমাকে ভুল বুঝলো। নিজেকে এক্সপ্লেইন করেছিলাম, বাবা আমাকে অবিশ্বাস করলো। এতো ছোট বয়সে মাথার উপর কারো ভরসার হাত পাইনি, সেদিন থেকে দুনিয়াদারি শিখে নিয়েছি। প্রতিটি মানুষের যে দুটো মুখোশ থাকে, একটা দুনিয়াকে দেখায়, একটা কিছু মানুষের সামনে, আর নিজের চেহারা গোপন রাখে, তা জেনে নিয়েছি। তবুও থেকে গিয়েছি এখানেই, হাজার হোক, এরাই যে আমার আপনজন। আত্মার না হোক, রক্তের তো।

পরপর দুটো গভীর নিঃশ্বাস ফেললাম। বুকটা অনেক ভার হয়ে আছে। নিশ্বাস এতো ভারী লাগছে কেনো? কষ্টের পরিমাণ কি খুব বেশি হয়ে গেলো? শুনেছি মাত্রাধিক কষ্টে মরণ ঘনিয়ে আসে। আমারও কি তাই হবে? কিন্তু আমি তো বাঁচতে চাই। ভীষণ বাঁচতে ইচ্ছে করে আমার।

হঠাৎ একটা কালো গাড়ি এসে থামলো আমার সামনে। কোনো কিছু ঠাহর করার আগেই কিছু একটা স্প্রে করলো। আর আমি ঢলে পড়লাম কারো বাহুর বন্ধনে। অনুভব করলাম খুব চেনা স্পর্শ। লোকটির দিকে ঠিক মতো তাকাতে পারলাম না। সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো বুজে এলো।

_____________________

পিটপিট করে চোখ মেলাতেই সকালের মৃদু আলো চোখে পড়ছে। পুরোপুরি ভাবে তাকাতেই নিজেকে সম্পূর্ণ এক নতুন জায়গায় আবিষ্কার করলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে বসে চারিপাশটা একবার পরখ করে নিলাম। মানতেই হবে! যে এখানে থাকে, তার রুচি ভীষণ সুন্দর এবং শালীন। কিন্তু আমি এখানে কি করে এলাম? কাল রাতে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচেই তো ছিলাম। তবে এখানে কি করে? আর ভাবতে পারছি না আমি মাথা ভার হয়ে আছে ভীষণ। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলাম। মিনিট দুয়েক বাদে উঠে দাঁড়ালাম। উদ্দেশ্য একটাই। জলদি পালাতে হবে এখান থেকে। যে আমাকে এখানে কিডন্যাপ করে এনেছে, সে নিশ্চয় ভালো কিছু করবে বলে আনেনি। ব্যালকনিতে চলে গেলাম। দোতলায় আছি আমি। লাফানো যাবে না। কিন্তু কিভাবে যাবো?

এসব ভাবনায় ছিলাম আমি। হুট করে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে চকিতে আওয়াজের উৎসের দিকে তাকালাম। অ্যাশ টি-শার্ট পরা এক পুরুষ। সুদর্শন পুরুষ বলা যায়।

“উঠে পড়েছো তবে?”

ভয় জেঁকে ধরলো। কে উনি? চিনিনা আমি। কোনোদিন দেখিনি। হাতের ট্রে টা বেড সাইড টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকালো। আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “ক’ কে আআপনি?”

লোকটি হালকা হাসলো। বড্ড ভয়ংকর এই হাসিটা। কে জানে, হয়তো এই হাসিতেই খুন হয়েছে অজস্র নারী।

“তোমার চাঁদ।”

লোকটির কথায় বিস্মিত হলাম। কে উনি? উনি আবারও বললেন,“সব ভাবনা পরে হবে। এখন ফ্রেশ হয়ে এসো। ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”

আর কিছু বলতে পারলাম না আমি। বলে লাভ হতো না বলেই বলতে পারলাম না। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি লোকটি এখানেই বসে আছে। আমাকে এসে পাশে বসতে বললো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। উনি পুনরায় মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসলেন। কয়েক সেকেন্ড বাদেই উনি আমার দিকে তাকালেন। চোখাচোখি হয়ে গেলো। যেনো থমকে গেলো এই দুনিয়া। আছে শুধু এই চাঁদ আর আমি, আমি কি?

“তোমার কোনো ক্ষতি করার হলে আগেই করে নিতাম। এখন খেয়ে ধন্য করুন মহারানী। নয়তো পালানোর শক্তিটাও পাবেন না।”

কথায় কেমন যেনো একটা নেশা আছে। কথায় নাকি আওয়াজে জানা নেই। কাল রাত থেকে না খেয়ে আছি। তাই আর না করিনি। বেডে গিয়ে বসলাম। লোকটি আমার থেকে একটু দূরেই বসে আছে। খাবারের প্লেটটা আমার হাতে দিলো। আমি নিঃশব্দে নিয়ে খাওয়া শুরু করলাম। অনেকটা খাওয়া হয়েছে। আর পারছি না। খাওয়া থামিয়ে উনার দিকে তাকালাম। মৃদু হেসে “আচ্ছা” বলে প্লেটটি নিলো। আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম, হাত ধুতে। ভাবনায় একটাই কথা, এখান থেকে পালাতে হবে। লোকটাকে খারাপ মনে হলো না। কিন্তু ভালো হলে কি আর তুলে আনতে পারতো?

ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই আমার চোখ কুঁচকে এলো। লোকটি আমার এঁটো খাবার খাচ্ছে! একবার চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। যেনো কিছুই হয়নি। নিঃশব্দে খাওয়া শেষ করে প্লেটটি নিয়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। যাওয়ার আগে মিষ্টি হেসে বলে গেলেন,“পালানোর চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।”

লোকটি চলে যেতেই আমি বিছানায় গিয়ে বসলাম। যা হচ্ছে, সবটাই মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা বাড়ির সবাই ঠিক আছে তো? রাতে তো রান্না করিনি। কি খেয়েছে ওরা? টেনশন হচ্ছে ওদের জন্য।

আমার এই টেনশনের মাঝেই আবারও লোকটির আগমন ঘটলো। হাতে একটা প্যাকেট। রুমে ঢুকে প্যাকেটটি আমার হাতে দিয়েই বললো,“ফটাফট রেডি হয়ে নাও।”

আমি প্যাকেট খুললাম। ভেতরে একটা লাল বেনারসি আর কিছু অর্নামেন্টস দেখতেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো। ভীষণ অবাক হলাম। কি চাচ্ছেন উনি?

শাড়ীটা হাতে নিয়ে উনার দিকে অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করতেই উনি বললেন,“একটু বাদেই আমাদের বিয়ে। নিজে থেকে রেডি হয়ে যাও। নয়তো তোমাকে প্রস্তুত কিভাবে করতে হয় তা খুব ভালো করেই জানি আমি।”

চলবে…