চারিদিকে নিরবতা বিরাজ করছে। কেউ কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে আরহানের মুখে ডাকটা শুনে বিরক্তিতে রুদ্রের কপাল কুঁচকে এলো। বিরক্তিবোধটা আরহানের ও হচ্ছে। আরহান মেয়েদেরকে এড়িয়ে চলে যথাসম্ভব। কিন্তু এটাকে চাইলেও এড়াতে পারে না। অনেকটা ঘাড়ে চড়ে বসেছে টাইপের।
রূপ উল্লাসিত কন্ঠে বলে উঠলো, “কতোদিন তোমাকে দেখিনি বেইবি। তাই চলে এলাম। খুশি হওনি?”
আরহান মনে মনে ভাবছে,পেত্নী ঘাড়ে চাপলে বুঝি কেউ খুশি হয়!
তবে সামনে বললো,“এসেছো, ঠিক আছে। কিন্তু নেক্সট টাইম থেকে নক করে আসবে। ইট’স ম্যানার্স।”
রূপ অপমানিত বোধ করলো।
“আচ্ছা আমি তাহলে পরে আসি।” —কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলো রূপ। মিটিং হচ্ছে বিধায় বেরিয়ে গেলো, আরহান একা থাকলে শত অপমানেও যেতো না। রূপ যেতেই আরহান ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেললো। রুপ্তি আরহানের চাচাতো বোন। ছোট করে সবাই রূপ বলে ডাকে। চাচা পরিবারসহ লন্ডন থাকে। আরহানের বাবার দেশের বাইরের বিজনেস বর্তমানে তার দায়িত্বে। রুপের একটি ছোট বোন আছে। নাম মাহী। ভীষণ শান্ত প্রকৃতির।
আরহানের বাবার মৃত্যু লন্ডনেই হয়েছিলো। এরপর চাচা একা বিজনেস সামলাতে হিমশিম খাবে বলে, ঐ দেশটিতে থেকে গিয়েছিলো চার বছর। এই চার বছরে সবচেয়ে বেশি বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রূপ। মেয়েটি গায়ে পড়া টাইপের। আরহানের এসব সহ্য হয়না। এজন্যই তো যতো তাড়াতাড়ি পেরেছে, সব কিছু গুছিয়ে দেশে ফিরে এসেছে। এখান থেকেই সব সামলাচ্ছে আরহান। আজ দুবছর পর রূপকে দেখে বিরক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো সে।
_____________________
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়া রক্তিম সূর্যরশ্মি দেখা যাচ্ছে। বাদবাকি পুরো আকাশ ধূসর রঙ্গা হয়ে আছে। প্রকৃতি নিস্তেজ। পাখিরা সব নিজ নিজ নীড়ে ফিরে গিয়েছে। আর আমি ব্যালকনিতে দাড়িয়ে ঐ আকাশের পানে তাকিয়ে আছি। সন্ধ্যার আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল এক তারা দেখা যাচ্ছে। শুকতারা! চাঁদের পাশে কি সুন্দর জ্বলজ্বল করছে! মনের মাঝে এক ইচ্ছে জেগে এলো। ইশ! যদি আমি নিজের একান্ত ব্যক্তিগত চাঁদ পেতাম, তবে আমি তার শুকতারা হতে চাইতাম। মনের ইচ্ছে মনেই রয়ে গেলো। তীব্র আকাঙ্খা নিষিদ্ধ বস্তু, আমার জন্য।
দুপুরে মীরা আপুকে খাবার খাইয়ে দিয়ে, ঔষধ দিয়ে, ঘুমোতে বলে চলে এসেছি। সারা বিকেল আমার কাটলো আকাশের দিকে তাকিয়ে। ভাবনায় ছিলো, সেই ছায়ামানবের কথা। ভাবনায় আরো এলো, এই দুদিনের ঘটনা। রাস্তার ঐ লোকটির নির্মম মৃত্যু, ছোটমার ছাদ থেকে পড়ে যাওয়া, মীরা আপুর এই অবস্থা। সবটা এক সুতোয় গাঁথা। ধোঁয়াসে এক রহস্য। এই ছায়ামানবকে আমি গত এক মাস ধরে অনুভব করছি। অনুভব করছি ঘণ্টার পর ঘন্টা তার তাকিয়ে থাকা। তবে আমি এতো কিছু অনুভব করা সত্ত্বেও চোখ মেলতে পারছিলাম না। গতকাল কেনো পারলাম? প্রথম কয়েকদিন আমি স্বপ্ন ভেবেছি। ভয় পেয়েছি। ছোটমাকে বলায় উনি বলেছিলেন,“যতসব ঢং আর আদিক্ষেতা। নিশ্চয় সারাদিন ছেলে মানুষের সাথে লেগে থাকিস। এজন্যেই স্বপ্নে এসব দেখিস।” এরপরও স্বপ্ন ভেবে অবজ্ঞা করে এসেছি। তবে কাল সকালে গলার এই দাগে নিশ্চিত হয়েছি, এটা স্বপ্ন না। বাস্তবে কারো স্পর্শ পাচ্ছি, প্রতিটি রাতে। কিন্তু সে রাতেই বা আসছে কেনো? আর এভাবে স্পর্শ কেনো করছে? লোকটা কি খারাপ? তবে স্পর্শগুলো ভালোবাসাময় ছিলো কেনো?
আর ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না। বেশি চিন্তা করলে মাথায় ব্যাথা হয় আমার। এই যেমনটা এখন হচ্ছে। রুমে চলে এলাম। ছোট মায়ের জন্য টেনশন হচ্ছে। কি অবস্থায় যে আছে! দুপুরে একবার বাবাকে কল দিয়েছিলাম। রিসিভ করেননি। তাদের মীরা আপুর কথাও জানানো হয়নি।
কিচেনে চলে এলাম। উদ্দেশ্য রাতের খাবার তৈরি।
_____________________
মিটিং শেষ করে মাত্রই আরহান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেছে। বড্ড চিন্তিত সে। মাথায় বিশাল এক ঝামেলা। কবে যে শেষ হবে এই ঝামেলা! কবে যে ধরতে পারবে, পুরনো শত্রুর সেই গুপ্তচরকে! কবে যে শেষ করতে পারবে তাকে! তবেই না নিজের প্রিয়তমাকে নিজের কাছে আনতে পারবে।
“আরহান বেইবী! চলে এসছি।”—কথাটি রুপের। আরহানের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। আরহান উপরে না তাকিয়েই ভ্রু কুচকে ফেললো। হাতের দুটো আঙ্গুল চালালো কপালে। আবার এসে গিয়েছে!
কিছুক্ষণ পর আরহান রুপের দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, “এখানে কি?”
রুপের উজ্জ্বল মুখশ্রীতে ঘন কালো মেঘ নেমে এলো। কণ্ঠস্বর আলতো করে বললো, “তুমি চলে এসেছো দুবছর আগে, তোমাকে ছাড়া ভালো লাগে না। চলে এলাম। কজ আই….”
“স্টপ..”
বাক্য সম্পূর্ণ করার আগেই রূপকে থামিয়ে দিলো আরহান। কেননা সে জানে, রূপ এখন কি বলবে। প্রায় শতাধিক বার বলে এসেছে এই কথাটা। কিন্তু সে তো তার প্রিয়তমা ছাড়া কাউকে ভাবে না। সে এসব কেয়ার করেনা।
রূপ চুপ হয়ে গেলো। নিরবতা ভেঙ্গে ফেললো মিনিট তিনেক সময় নিয়েই। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠলো, “তুমি বার বার আমাকে রিজেক্ট করো কেনো? কি নেই আমার? লন্ডনে ছেলেরা আমার হাত ধরার জন্য লাইন ধরে আছে, সেখানে আমি নিজেই তোমার কাছে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাচ্ছি। আর তুমি পাত্তাই দিচ্ছো না।”
“কজ আ’ম নট লাইক আদার্স”—কথাটি বলে আরহান চেয়ার থেকে নিজের ব্লেজার এক হাতে নিয়ে চলে গেলো। রূপ সেখানেই ঠায় দাড়িয়ে রইলো।
আরহান বাইরে যেতেই রুদ্র তার পাশে এলো। আরহানের সাথে হাঁটতে হাঁটতে অফিসের বাইরে চলে এলো। আরহান গাড়ির ফ্রন্ট সিটে ও রুদ্র ড্রাইভিং সিটে বসে পরলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই বললো,“স্যার! এইটা কেনো এসেছে?”
আরহানের দৃষ্টি জানালার বাইরে গিয়ে পড়লো। রাস্তার পাশে বসে থাকা একজোড়া কপোত কপোতীকে দেখে মৃদু হাসলো। আওয়াজের ভঙ্গিমা অন্য সময়ের তুলনায় অনেকটা পাল্টে গেলো। বললো,“ভালোবেসে..”
আসলে, ভালোবাসার অন্য একটা শক্তি আছে। পাথরকেও গলাতে সক্ষম এটা। এখানে আরহানতো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। এজন্যই ভালোবাসার নাম নিতেই ঠোঁট প্রসারিত হয়ে এলো। হয়তো সত্যিকারের ভালোবাসার উপলব্ধি তারও আছে।
আরহানের এই একটি শব্দের মানে রুদ্রর জানা আছে। তবে এটা জানা নেই, তার স্যার কেনো এই মেয়েটিকে গ্রহণ করে না। চেহারায় রয়েছে এক রাজ্য সৌন্দর্য আর মনে রয়েছে আরহানের জন্য অগাধ ভালোবাসা। তবে ফিরিয়ে দেওয়ার কারণ কি? রুদ্র জিজ্ঞেস করে বসলো,“তাহলে স্যার, মেয়েটিকে বিয়ে করতেই তো পারেন। একদিন না একদিন বিয়ে করতেই হবে। সেটা একে করলেই তো হয়।”
আরহান রুদ্রের দিকে তাকালো। চোখে রয়েছে কারো জন্য এক সমুদ্র ভালোবাসা। যেকোনো নারী এই চোখের গভীরে ডুবে মরতে বাধ্য। তাইতো রূপ মরেছে। হ্যাঁ! মরণ হয়েছে তার, এই গম্ভীর চক্ষুজোড়ার মাঝে।
আরহানের ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠলো। কম্পনরত ঠোঁট দ্বারা উচ্চারিত হলো,“সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় কি?”
রুদ্র দমে গেলো। এই বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন তোলার সাহস নেই। কারণ সে নিজেও এমন একজনকে ভালোবেসে বসে আছে, যাকে পাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। আরহানের “সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায় কি?”—কথাটির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত সে নিজেই।
কিছু দূর এগোতেই আরহানের ফোনের মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। হাতে নিলো ফোন। মেসেজটা পড়ে বাঁকা হাসলো। যেনো এটা অনেক বড় কোনো প্রাপ্তি। রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বলল,“পুরনো গোডাউনে চলো।”
রুদ্র গাড়ি ঘোরালো। ওদের ফ্যাক্টরির পুরাতন গোডাউনটা খালি পড়ে আছে। প্রায়শই আরহান নিজের গোপন কিছু কাজ করে এখানে। যেমনটা এখন করতে যাচ্ছে।
__________________
অন্ধকার একটা রুম। উপরে একটা লাইট জ্বলছে। আলোর তেজ খুব একটা না। তীব্র এই অন্ধকারে এই লাইটটি দ্বারা শুধু মাঝের দুটো চেয়ার দেখা যাচ্ছে। একটিতে বসেছে আরহান এবং অপরটিতে একটা লোক। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে লোকটিকে। শরীরে ক্ষতের চিহ্ন স্পষ্ট। মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। বেধোরক মারা হয়েছে লোকটিকে। আরহান মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“তৃষ্ণা কোথায়?”
লোকটি কোনো পাত্তা দিলো না। আরহান রুদ্রের উদ্দেশ্যে বললো,“এর ফোন কোথায়?”
রুদ্র তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,“আবদুলের কাছে।” তার স্যারের এই শান্ত কণ্ঠের মানে জানে সে। খুবই ভয়াবহ কিছু হবে। পাশে সিরিয়ালে দাড়িয়ে থাকা আরহানের লোকগুলোর মাঝে, আবদুল নামের লোকটি মাথা নিচু করে এগিয়ে এলো আরহানের কাছে। আবদুল ফোন এগিয়ে দিতেই, সে ফোন হাতে তুলে নিলো। লক করা না থাকায় বাঁকা হাসলো। কল লগে থাকা “বস” নামটা দেখেই রুদ্রকে ইশারা করলো। আরহানের ইশারা করে মাত্রই রুদ্র ফোন নিয়ে প্রস্থান করলো।
আরহান চেয়ারে বেঁধে রাখা লোকটির দিকে একপলক তাকিয়ে পুনরায় বাঁকা হাসলো। পাশে থেকে ছুরি উঠিয়ে, সোজা লোকটির শ্বাসনালী বরাবর চালিয়ে দিলো। এক ছুরিকাঘাতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো লাশ। রক্ত ছিটকে এলো আরহানের চোখ-মুখে। হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছুরির রক্ত মুছে বললো,“তোমাকে পাবার আরো ধাপ কমে গেলো শুকতারা..”
চলবে…