অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৭)

Photo of author

By নবনিতা শেখ

“আপনাকে ক্ষমা করার একটা সুযোগ দিলেন না বাবা?”

কথাটি বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আরহান এতো মানুষের ভীড়েও আমার মুখখানি তার বুকের মাঝে আগলে ধরলেন। আমাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে উনার বলা আশ্বাস বাক্য,“হুশ! কেঁদো না। উনার হায়াত এটুকুই ছিলো। এটা তোমাকে মানতেই হবে।”

আমি কান্না থামিয়ে দিলাম। আরহানের দিকে আশা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,“বাবাকে ফেরানোর আর কোনো উপায় নেই?”

পরপর আমার গলা কেঁপে উঠলো। কণ্ঠ ভিজে এলো। কান্না ভেজা স্বরে মায়ের দিকে আঙুল তুলে বললাম,“মা কি তবে সব পেয়েও হারিয়ে ফেললো? দেখেন না! কিভাবে নির্বাক বসে আছে?”

আমি মার কাছে এগিয়ে গেলাম। উৎকন্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “ও মা! মা! তুমি কাঁদছো না কেনো?”

মায়ের নিষ্প্রাণ নয়ন আমার পানে এসে ঠেকলো। বুক কেঁপে উঠলো আমার। আমি কিছু বলতে পারলাম না আর। যেনো সে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা আমাকে চুপ করিয়ে দিলো।

আজ সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই মীরা আপুর কল এলো। এই একটা কলে যেনো আমার দুনিয়া থমকে গেলো। মীরা আপুর কল দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মীরা আপুর কান্না ভেজা স্বরে বলা,“আব্বু আর নেই” কথাটি যেনো আমার দম আটকে দিলো। এসে শুনলাম, কালকের অতিরিক্ত স্ট্রেসে বাবা রাতেই স্ট্রোক করেছেন। সকালে অফিসে যায়নি দেখে মীরা আপু বাবাকে ডাকতে এসেছিলো। কিন্তু বাবা আর উঠেনি।

নিজেকে ভীষণ দায়ী মনে হচ্ছে আমার। আজ আমি চাইলেই সব ঠিক রাখতে পারতাম। কাল যদি বাবার সাথে একটু কথা বলতাম! যদি বাবার চিন্তার বোঝাটা একটু কমাতে পারতাম! কান্নারা সব আজ আমার সাথে সখ্যতা করতে এসেছে। এতকালের না পাওয়া সব একসাথে পেয়ে যাওয়াতে আমার খুশি উপচে পড়ছিলো গতকাল। ভাগ্য বড্ড নিষ্ঠুর। এই আমাকে সব ফিরিয়ে দিলো, তো এক নিমিষেই সব ধূলিসাৎ করে দিলো। আশা, কল্পনা সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলো।

আমার বাবার সাথে আমার সখ্যতা ছিলো সেই ছোট্টবেলায়। এরপর! এরপরের কথা নাইবা বললাম। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে আমার জন্য নিষিদ্ধ, তা পুনরায় প্রমাণিত হলো। হ্যাঁ, আমার জীবনের আঠারোটি বছর আমার বাবার জন্য নষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু, একসময় যার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল ধরে চলতে চলতে, সর্বশেষে আমি এই ধরার বুকে স্বকীয় কদম একাকী রাখতে শিখেছি, তার অবর্তমানতা কী করে মেনে নেবো? মানতে পারছি না।

একবার চোখ তুলে মায়ের পাশে বসে থাকা দীপ্তিকে দেখলাম। মনে পড়ে গেলো কালকের দিনটা। দীপ্তি যখন বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথম ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করেছিলো! তখন ওর চোখ দুটি ছলছল করে উঠেছিলো। একটা মেয়ের তার বাবার সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি থাকে। আমি পেয়েছিলাম এমন কিছু স্মৃতি, যা ভুলতে চাইতাম বারবার। অন্যদিকে আমার বোনটার স্মৃতি তৈরির আগেই সব শেষ হয়ে গেলো।

মুহূর্তেই বুকটা অনেক ভারী অনুভূত হলো। চিনচিন এক ব্যাথা হচ্ছে। আমার ডান পাশে আরহান দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি নিশ্চুপ হয়ে আছেন। হয়তো আমাকে সান্তনা দেবার আর কোনো ভাষা উনার জানা নেই। আবারও বিছানায় আমার বাবার মৃত দেহকে দেখে নিলাম। পাশে মা আর দীপ্তি বসে। মীরা আপুও কান্না করছে না। কেমন ‘থ’ মেরে বসে আছে। কষ্ট লাগছে আপুর জন্য। সে কাল নিজের মাকে হারালো, আজ বাবাকে।

___________________

যোহরের ওয়াক্তে বাবার দাফন কার্য সম্পন্ন হবে। বাড়ির সামনে খাটিয়ায় বাবার লাশ রাখা আছে। সাধারণত মরা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। কিন্তু এই বাড়িতে কেউ কাঁদছে না। সব যেনো পাথর বনে গিয়েছে। এদিকে মা! সে তো এক দৃষ্টিতে বাবাকে দেখেই যাচ্ছে।

পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ। মামারাও এসেছে। মামা যখন মাকে দেখলো! সে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। পরমুহুর্তে আরহান তাকে সবটা বুঝিয়ে বলেছে।

আমি শক্ত করে আরহানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বুক ভারী করার মতো কিছু অনুভূতি অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করে ফেলছে আমাকে। মাথা তুলে আরহানের দিকে তাকালাম। উচ্চতায় আমি আরহানের কাঁধ অবদি। চোখাচোখির জন্য দৃষ্টি উঁচুতে রাখা আবশ্যক।

উপরোক্ত পন্থা অনুসরণ করে আমি আরহানের দিকে তাকালাম। আরহান আমার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলাম,“সব উল্টে পাল্টে গেলো। এবার কী হবে?”

আরহান নম্র কণ্ঠে বললেন,“সৃষ্টিকর্তা সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী।”

আমি আর কিছু বলতে যাবো তখনই আরহান আমার হাত ধরে দ্রুত গতিতে আমাকে সরিয়ে দিলেন। ততক্ষণে আমি খেয়াল করলাম, আমার পেছনের কাঁচের জানালার কিছুটা অংশ ভেঙ্গে গিয়েছে। শব্দে ইতিমধ্যে এখানকার সবার দৃষ্টি এদিকেই। আরহান আমাকে “আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে থাকো” বলেই সোজা বরাবর রাস্তায় ছুটলেন। ততক্ষণে কালো মুখোশ পরিহিত লোকটা দৃষ্টিগোচর হয়ে গিয়েছে।

আরহান ফিরে এলেন। আকস্মিক ঘটনায় আমি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই আমার অবুঝ মস্তিষ্কে ঠেকছে না। আরহান আমার নিকটবর্তী হলেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হলো এটা?”

আরহান পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন, “সাম ওয়ান ওয়ান্টেড টু শুট ইউ…”

ফোনে রুদ্রকে কল দিয়ে বললেন,“অ্যারেঞ্জ টাইট সিকিউরিটি হেয়ার, কুইকলি।”

মস্তিষ্কে পুরনো ঘটনা চলে এলো। নতুন না। প্রায়শই হয় এটা। কেউ আমাকে মারতে চায়। এবার বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন পুলিশের সাথে আগমন ঘটলো ছোট মায়ের। একদিনেই চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে তার। পরনে সাদা শাড়ি। মীরা আপু ছোটমাকে দেখেই হামলে পড়লো তার উপর। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আ’আম্মু! আমি একা হয়ে গেলাম তো! তুমিও নেই। আব্বুও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে।”

মীরা আপু বাবার সন্তান না হলেও, প্রচুর আদর পেয়েছে। শুরুতেই একবার বলেছিলাম না! নিজ বাড়িতে আমি চাকরানীর মতো ছিলাম। রাজ করতো সৎবোন। বাবা অনেক আদর করতেন আপুকে।

এদিকে আমার শাশুড়ি মা ও নিশাও এসে গিয়েছে। কিছুক্ষন বাদে রুদ্র ও এলো। রুদ্র এসেই আরহানের কাছে এগিয়ে এলো। মুখ ফুটে “স্যার!” বলতেই আরহান থামিয়ে দিলেন। নিশাকে ডেকে বললেন, “স্টে উইথ ইউর সিস্টার-ইন-ল”

এরপর রুদ্রকে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। নিশা আমার কাছে এসে শান্তনা দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না। হচ্ছে না ওর দ্বারা। কিছু মানুষ আছে, যারা অল্পতেই কেঁদে দেয়। কারো কান্না দেখলেই কেঁদে ফেলে। কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারে না। নিশা ঐ ধরনের মানুষ। আমাকে কী শান্তনা দেবে! উল্টো নিজে কান্না করে বসেছে।

শাশুড়ি মা এগিয়ে গিয়ে আমার মায়ের কাছে গেলেন। মাকে সান্তনা দিতে লাগলেন। তখন সেখানে আগমন ঘটলো তৃষ্ণার। আমার সামনে দিয়ে সোজা মায়ের কাছে চলে গেলো। কোথাও খেয়াল নেই তার। আশেপাশের কিচ্ছুটি ভাবছে না। মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।

খানিক সময় বাদে বললো,“সে তোমাকে একসময় প্রচুর ভালো বেসেছিলো। হয়তো সময়ের সাথে সেই ভালোবাসায় দূরত্ব বেড়েছিলো। কিন্তু তুমি তো জানোই, সে তোমাকে কতো ভালো বেসেছে! আর কিছু না হোক, সেই ভালোবাসা টুকু মনে রেখো। এতকালের সব দূরত্ব চুকিয়ে শেষ বারের মতো কেঁদে নাও মামনি। সে তোমাকে ভালোবাসতো, বিশ্বাস করো খুব ভালোবাসতো।”

তৃষ্ণার কথা টুকু শেষ হতেই মা শব্দ করে কেঁদে ফেললো। ঠোঁট উল্টে কান্না থামানোর প্রচেষ্টা করে বললো, “ও আমাকে ভালোবাসতো?”

তৃষ্ণার নীরস উত্তর,“হু।”

মা আবারও কেঁদে দিয়ে বললো,“তাহলে কেনো ছেড়ে গেলো? আমি কী খুব খারাপ? আগেও তো রাগ করতাম আমি। ও আমাকে মানানোর জন্য কতো কিছু করতো! আজ কেনো করলো না?”

মা আর কিছু বলতে পারছে না। কথাগুলো গলায় আটকে গিয়েছে। কিছুটা সময় নিয়ে আবারও বলা শুরু করলো, “মানলাম আমার এবারের রাগটা অনেক বেশি ছিলো। কিন্তু ও একটু চেষ্টা করলেই তো এই রাগ গলে যেতো। আমি তো শুধু ওকে একটু শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম।”

তৃষ্ণা বড় একটা শ্বাস নিয়ে বললো,“সবসময় জীবন আমাদের পরিকল্পনা মাফিক চলে না মামনি।”

মা হাউমাউ করে কেঁদে বললো,“তাই বলে উল্টো আমাকেই শাস্তি দিলো? এতটা সেলফিশ ও? নিজে এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না বলে, নিজেরটার সাথে এক্সট্রা কষ্ট আমাকে দিয়ে চলে গেলো। একবারও আমার কথা ভাবলো না? আমি এই কষ্ট নিতে পারবো কী পারবো না?”

“কেউ তার সহ্যের অতিরিক্ত কষ্ট পায়না। নিজেকে সামলে নাও। তোমার সেই একটি মানুষ ছাড়াও দীপ্তি আর আমি আছি। তোমার আরো একটা মেয়ে আছে।”

তৃষ্ণার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে আমার শাশুড়ি মা বলে উঠলো, “তৃষ!”

তৃষ্ণা মাথা ঘুরিয়ে ডাক অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। নীলাভ নয়ন জোড়া দেখেই শাশুড়ি মা আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো। এদিকে তৃষ্ণাও।

কিছুক্ষণ বাদে মা, তৃষ্ণাকে ছেড়ে বললেন,“কই ছিলি তুই? তোকে কতো খুঁজেছি জানিস? হঠাৎ সেদিন কলেজ থেকে ফিরে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলি? তোকে আর পেলাম না কেনো?”

তৃষ্ণা মিষ্টি হেসে বললো,“সিলেট চলে গিয়েছিলাম আন্টি। কয়েকমাস আগেই ফিরেছি।”

“আরহানের সাথে দেখা করেছিস?”

“ওর সাথে দেখা না করে থাকতে পারবো? করেছি।”

_________________

দাফনের কাজ শেষ। সবাই বাড়িতে অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছি। কারো মুখে শব্দ নেই। ছোটমাকেও পুলিশ পুনরায় নিয়ে গিয়েছে। মীরা আপু সেন্সলেস হয়ে আছে। দীপ্তি, মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি এক কোনায় আরহানের পাশে বসে আছি।

নিস্তব্ধ বাড়ির মাঝে হুট করেই আরহানের ফোন বিকট শব্দ করে বেজে উঠে। আমি তাকালাম আরহানের দিকে। হোয়াটস অ্যাপে কল এসেছে। স্ক্রিনে ‘রূপ’ নামটা ভেসে উঠেছে। এই কয়েক মাসে রূপ আপুর কোনো কল আসেনি। আজ হঠাৎ! আরহান রিসিভ করতে যাবে, তখনই কেটে গেলো। হয়তো জরুরি, এটা মনে করে আরহান কল ব্যাক করলো। ঢুকলো না। অতঃপর নাম্বারে কল দিলো, নট রিচেবল এলো। কপাল কুঁচকে ফেললো আরহান। এই না কল দিলো!

আরহানের মা আমাকে, দীপ্তিকে, তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“তোরা খেয়ে নে। এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবি তো।”

পুনরায় নিশা,রুদ্র আর আরহানকেও বললেন,“তোরাও আয়।”

কারো খাবার পরিস্থিতি নেই। তবুও জোর করেই খেতে গেলাম। মায়ের দিকে তাকালাম একবার। সে এখনও কেঁদে যাচ্ছে। প্লেটে খাবার বেড়ে, মায়ের কাছে গেলাম।

মা আমার উপস্থিতি পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“খাবে না?”

“ইচ্ছে করছে না।”

“আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

___________________________

রাতেই এই বাড়িতে ফিরেছি। মা আমাকে আরহানের সাথেই পাঠিয়ে দিলো। আজ মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এই পরিস্থিতিতে আরহান ছাড়া আর কেউ সামলাতে পারবে না দেখে পাঠিয়ে দিলো। উদাস মন নিয়ে চলে এলাম। পুরোটা রাস্তা থেমে থেমে কেঁদে এসেছি।

রাতে আরহান অনেক জোর করেই খাইয়ে দিয়েছেন। পুরোটা রাত আমার নির্ঘুম কাটলো। শেষ হতে চাচ্ছে না এই রাত। আর ঘুমও আসছে না। রাতের শেষ ভাগে আরহানের ফোন বেজে উঠলো। নির্ঘুম আমিটার সাথে জেগে ছিলেন আরহানও। পাশ হাতড়িয়ে ফোন রিসিভ করে কানে তুলতেই আরহান মুখশ্রীর ভাব পাল্টে গেলো। অনেক বাজে কোনো খবর পেয়েছে, এমন।

পুরো ঘটনার আগা গোড়া না বুঝে আমি আরহানকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

“রূপ সুইসাইড করেছে।”

চলবে…