দেখতে দেখতে আরো দুই সপ্তাহ কেটে গেলো। এই দুটো সপ্তাহ, আরহানের ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে। আর আমার কেটেছে আরহানের খেয়ালে ডুবে। দিবারাত্রি উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। দিনগুলো কেমন করে যেনো এগোচ্ছে। খুবই দ্রুত।
আর সাথে হাজারো অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছি। আরহান পাশে থাকলে আমার হৃদ পিন্ডের স্পন্দন গতি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ঠিক তেমনই দূরে থাকলে নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হয়। তখন বুকের বা পাশের হৃদযন্ত্রের উপস্থিতি বোঝা দায় হয়ে যায়।
হুট করেই কয়েক মাস আগের কথা মনে পড়লো। কতটা ভয় পেতাম উনাকে! আর এখন! এখনকার আরহানের কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে ভালো লাগার মিষ্টি এক হাসি চলে আসে।
সকালের নিষ্প্রভ রোদ খোলা জানালা দিয়ে মুখে এসে লাগতেই চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালাম। আরহান আমার এক হাত নিজের বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন। হাসলাম আমি। উনার বন্ধন থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আরহান নড়েচড়ে উঠলেন। পুনরায় আবার ঘুমে মগ্ন হলেন। আরহানের চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। হাত এগিয়ে উনার এলোমেলো চুলগুলো আরো খানিকটা অগোছালো করে দিলাম।
আরহান চোখে বুজে অধর যুগল প্রসারিত করে মিষ্টি হেসে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে উঠলেন,“সুপ্রভাত শুকতারা।”
“শুভ সকাল…”
কিছুক্ষণ বাদে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার?”
“কী! কিছুনা।”
“কিছুনা তো?”
“না।”
“আচ্ছা তবে আবার ঘুমোও।”—বলেই আরহান পূর্ব ভঙ্গিতে আমার হাত জড়িয়ে চোখ বুজলেন। মুহূর্তেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেন।
আমি হাসছি। এই লোকটার ভালোবাসা সত্যিই আমার ভাগ্যে ছিলো!
______________________
সকালের ব্রেক ফাস্ট শেষে রুমে ঢুকেই দেখি আরহান রেডি হয়ে আছেন এবং কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। না চেয়েও উনার কথা কানে এলো।
আরহান বলছেন,“বলেছিলাম না! খুব শীঘ্রই দেখা হবে। সব প্রমাণ জোগাড় করা হয়ে গিয়েছে। আর স্বয়ং আপনিও আছেন এখন। সব অপেক্ষার অবসান হবে আজ”।
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। আরহানকে প্রশ্ন করলাম, “কী হবে আজ?”
আরহান পিছু ঘুরে দরজার কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে নম্র কণ্ঠে বললেন,“আমি একটু বাদেই ওকে নিয়ে আসছি। আপনি রেডি থাকুন।”
উনি ফোন রাখলেন। আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে বলুন তো! কোনো সমস্যা?”
আরহান আমার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিলেন। মৃদু কন্ঠে বললেন,“আজ তোমার লাইফে যেমন একটা খুশির খবর পাবে, তেমনই কষ্টেরও। ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং শুকতারা।”
“কী হবে আজ?”
“গেলেই দেখতে পাবে। রেডি হয়ে নিচে এসো।”
আরহান প্রস্থান করলেন। হাজার প্রশ্ন মনে নিয়ে আমিও রেডি হতে শুরু করলাম। আমি কষ্ট পাবো, এমন কোনো খবর আমাকে কেনো দেবেন উনি? যতদ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে নিচে গেলাম।
গেটের বাইরে আরহানের গাড়ি দেখে এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে বসলাম। আমার বসার সাথে সাথেই আরহান গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
কিছুদূর অতিক্রম করার পর আমি আরহানকে বললাম,“আমার না টেনশন হচ্ছে। কী যে হবে! আপনি বলছেন ও না।”
আরহান মৃদু হেসে বললেন,“যা হবে, ঠিকটাই হবে।”
“বললে কী এমন হবে! যদি না বলারই ছিলো, তবে কেনো আমাকে বললেন, খারাপ খবর পাবো!”
“খারাপ বললাম কখন?”
“বলেননি?”
“নাহ্!”
“তবে কী বলেছেন?”
“বলেছি, কষ্টের খবর।”
বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। হালকা আওয়াজে “ধুর!” বলেই জানালার বাইরে তাকালাম আমি। এই লোকটা ভীষণ অসভ্য! ওপাশে আরহান আমাকে দেখে মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছেন।
হুট করেই আরহানের জরুরি কিছু মনে পড়ে গেলো, এমন ভাবে ব্রেক কষলেন। কিছু একটা খুঁজলেন। না পেয়ে রুদ্রকে কল লাগালেন। রুদ্র রিসিভ করতেই, আরহান ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন,“ফাইলগুলো আমার কাবার্ড এ রেখে এসেছি। নিয়ে এসো।”
ব্যাস! ওপাশে রুদ্রের কিছু বলার আগে যেমন নিজের কথা শুরু করেছিলেন। তেমনই নিজের কথা শেষ হতেই কল কেটে দিলেন।
ঘন্টাখানেক পর গাড়ি একটা বাড়ির সামনে থামালেন আরহান। প্রথমে নিজে নেমে এরপর এপাশে দরজা খুলে হাত এগিয়ে দিলেন। মুখে উনার বরাবরের মতো মিষ্টি হাসি। তা দেখে আমিও হাসলাম। হাত এগিয়ে উনার হাতে রেখে নেমে এলাম।
আমাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে অগ্রসর হলেন।
_______________________
গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে নিশা রুম থেকে বেরোচ্ছে। এই বয়সী মেয়েদের মন বোঝা বড্ড কঠিন। এই কান্নায় ভেংগে পড়ে তো এই আহ্লাদে নাচতে শুরু করে দেয়।
রুম থেকে বেরোতেই শক্ত কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগায় নিশা মনে মনে নিজেকে কতোগুলো গালি দিয়ে নেয়। ভেবেছে হয়তো সামনে দেয়াল। বেখেয়ালি ভাবে হাঁটতে গিয়ে এই অবস্থা। কিন্তু না! সামনে তাকাতেই নিশার হৃদপিন্ড থমকে যায়।
রুদ্র কপাল কুঁচকে নিশার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,‘আমার ভাগ্যে তো নেই তুমি, তবে কেনো সামনে আসো? কেনো প্রতিবার মনের মাঝে ভালোবাসা নামক তুমি হয়ে আগমন ঘটাও?’
কিন্তু এটা বলা সম্ভব নয় রুদ্রের পক্ষে। এক পলক নিজের মায়াবিনীকে দেখে নিলো। ভাগ্যে না’ই থাকলো, চোখের ক্যানভাসে না হয় থাকুক।
নিশা রুদ্রের সামনে এলেই কেমন যেনো অসুস্থ অনুভব করে। এই অসুস্থতা, ও রুদ্রের অনুপস্থিতিতেও টের পায়। তখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না নিশা। প্রতিবারের মতো স্তম্ভিত হয়ে যায়। তবুও বর্তমান সময়ে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকাটা বড্ড বেমানান লাগার দরুন, কিছু বলা নিশার জন্য আবশ্যক হয়ে গেলো।
মিনমিনে কন্ঠে নিশা প্রশ্ন করলো,“কেমন আছেন?”
রুদ্র স্থির চাহনি নিশার পানে আবদ্ধ করে গম্ভীর মুখশ্রীতে ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো,“ভালো।”
ভদ্রতার খাতিরে যে পুনরায় তাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে,‘তুমি কেমন আছো?’ এর মিনিমাম সেন্স রুদ্রের ছিলো না। নিঃশব্দে প্রস্থান ঘটালো।
নিশা স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে রুদ্রের যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ভীষন শকে আছে। নিশা বিস্মিত কন্ঠে আওড়ালো, “যাহ বাবা! রুদ্র ভাইয়া, সম্পূর্ণ আমার ভাইয়ার কোয়ালিটি সম্পন্ন হয়ে গেলো দেখছি। একেই বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”
স্তব্ধ নিশাকে এক দৃষ্টিতে স্থির একদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিশার মা নিজ রুম থেকে বেরোতে বেরোতে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে? কী দেখছিস?”
নিশা নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। মেকি হাসি দিয়ে বললো, “কোথায়? কিছু না তো!”
“কলেজে যাবি না? যা রেডি হয়ে নে।”
“আচ্ছা আম্মু।”
_______________________
সকাল থেকে মিসেস শেফালী তার বাবাই এর নম্বরে একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছেন। ধরছে না ওপাশ থেকে। তেমন কোনো প্রয়োজনে কল দিচ্ছেন না, ছেলেটা কেমন আছে এই খোঁজটার জন্যই এত উতলা হওয়া।
অষ্টম বার কল দিতেই ওপাশ থেকে তৃষ্ণা কল রিসিভ করলো। মাথা ভার তার। সারারাত কষ্ট লাঘব করতে নেশার সাগরে ডুবে ছিলো। ঘুমিয়েছে ভোরে। এটুকুতে ঘুম হয়নি। বারবার কানের কাছে ফোনের কর্কশ শব্দ হয়ে যাচ্ছে বলে রিসিভ করে কানে তুললো।
ওপাশ থেকে মিসেস শেফালীর কাতর কণ্ঠস্বরে শুনতে পেলো,“বাবাই! কী হয়েছে তোর? কল ধরছিস না! সকাল থেকেই কল দিয়ে যাচ্ছি তো।”
“ঘুমোচ্ছিলাম মামনি।”
“খেয়েছিস সকালে?”
“না। পরে খাবো।”
“শোন, তোকে কিছু বলার ছিলো।”
মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে আছেন। তৃষ্ণাকে বলেনি এখনও সে তার মেয়ের খোঁজ পেয়েছে। ভেবেছিলেন, সবটা সমাধান হবার পর বলবেন। যেহেতু আজ সমাধানের শীর্ষে সবটা। তাই জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন।
“আমি, আমার মেয়ের খোঁজ পেয়েছি।”
তৃষ্ণা শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,“ফাইনালি পেলে! আমি তো সেই আগেই বলেছিলাম, আমাকে বলো। আমি খুঁজে দেবো। তুমি রাজিই ছিলে না।”
মিসেস শেফালী হালকা হাসলেন। বললেন,“আমি ভুল করে ফেলেছিলাম। আজ সবটা শুধরে নেবো।”
“আমি কী আজ ঐ বাড়িতে আসবো?”
“কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে, তোর ঘুম হয়নি। ঘুমিয়ে নে। রাতে চলে আসিস।”
তৃষ্ণা “আচ্ছা” বলতেই মিসেস শেফালী কল কেটে দিলেন। উচ্চকন্ঠে দীপ্তিকে ডাকলেন,“বাবুন! কই তুই? জলদি নিচে আয় না।”
দীপ্তি তার মায়ের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে এলো। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে মা? এভাবে ডাকছো কেনো?”
“এভাবেই। কী করছিস?”
“কিছুনা মা।”
মিসেস শেফালী হেসে বললেন,“তোর আপুকে দেখবি?”
“দেখার কী আছে?”
পরক্ষণেই আবার বলে উঠলো,“ওয়েট!”
প্রথমে দীপ্তি খেয়াল করেনি। পরে যখন বুঝতে পারলো, ওর মা কী বলেছে! চকিতে চাইলো তার মায়ের পানে। দীপ্তি এখনও বুঝে উঠতে পারছে না, সে কী শুনেছে?
তাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কী বললে তুমি? আমি হয়তো ভুল শুনেছি। আবার বলো।”
“ঠিকই শুনেছিস। তোর আপুকে দেখবি?”
দীপ্তি অত্যধিক বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে বললো,“আপু!”
“হুঁ।”
“পেয়েছো আপুকে?”
“হ্যাঁ রে বাবুন।”
“কোথায় আছে আপু? কবে দেখা করাবে?”
“এই শহরেই আছে। আর আজ দেখা করাবো। একটু বাদেই চলে আসবে ওরা।”
দীপ্তি এখনও নিজের বিস্ময় রোধ করতে পারেনি। ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
তখন কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে পড়েন। দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজার বাইরে দিকটা অবলোকন করতেই তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আঠারো বছর! হ্যাঁ! আঠারো বছর পর, আজ সে দেখতে পেলো তার কলিজার টুকরোকে। নিজের আবেগ দমাতে হিমশিম খাচ্ছে। কিছু বলতে পরছে না। বাক্য মিলছে না। কণ্ঠস্বর কোনো শব্দ তৈরি করতে পারছে না।
কম্পনরত অধর যুগল অনেকখানি সময় নিয়ে উচ্চারণ করলো, “ববীনু!”
চলবে…